লাবনী জঙ্গি
এই গল্পটা একটা নদীর গল্প অথবা একটি সমুদ্দুরের অথবা একটি পাহাড়ের গল্প। না, এটা সেই গল্প, যেখানে একটি দেবতার নদী প্রবাহিত হয়, যার গা ঘেঁষে সমুদ্দুর আর পাহাড়। ঈশ্বরের আঁকা ছবির মতো রূহানী এই জায়গাটার গল্প শুনতে কেমন লাগবে? এই দীর্ঘ ঘরবন্দী মৃত্যুসময়ের বুকে, চলুন আমরা সেইখানে ঘুরে আসি; সেখানকার কয়েক টুকরো ছড়িয়ে থাকা বিস্মৃত গল্প শুনে আসি। শরীরের দরকার নেই আপাতত। ২১ গ্রাম রূহ-র সাথে চলুন ভ্রমণ করি এই দুঃসময়ে। বাংলাদেশের পূর্ব পাহাড়ি অঞ্চলের একটি নদীর নাম নাফ নদী; যদিও এটি নদী নাকি বঙ্গোপসাগরের শরীরের অংশমাত্র, তাই নিয়ে দ্বিমত আছে। যেমন দ্বিমত আছে ইভ আদমের পাঁজর থেকে হয়েছে কিনা, তাই নিয়ে। এসব দ্বিমতে না গিয়ে বলি, নাফ একটি পাহাড়ের গা ছুঁয়ে চলা শান্ত নীল, যে নীলের শূন্যতাতে সফেদ গাঙচিলেরা উড়ে বেড়ায়, রঙিন নাও ভেসে বেড়ায়, আর আসমানের রঙের সাথে সন্ধি করে সেই অনন্ত থেকে প্রতিটা মুহূর্তে রূপকথা বুনে চলে। সেসব রূপকথা আর ঈশ্বরের আঁকা নিসর্গ দেখতে প্রতি বছর কতো ভিড়! তবে রূপকথা যেহেতু ওরা(ক্ষমতাবানেরা) লেখে, তাই সেখানে এই গল্পগুলো থাকে না যে গল্পটা আজ আমি বলব। এইসব রূপকথার বুনট চাদরটা সরালে যে মৃত মানুষেরা এখনও আর্তনাদ করে ওঠে, এই গল্পটা তাঁদের লেখা। এই গল্পটা তাই রূপকথার নয়, ২১ গ্রামের ‘রূহ-কথা’। দেবতার নদীর তীরে হেঁটে হেঁটে ক্লান্তি নিয়ে কতো সময় এই রূহ-কথা সমুদ্দুরের লোনা পানিতে নিখোঁজ হয়ে যায়। কিছু কিছু রূহ-কথা আমাদের জন্য কোন তীরে, কোন ক্ষেতে খামারে অপেক্ষা করে থাকে।
এই গল্পটা শুনেছিলাম বছর তিনেক আগে। আমাদের ২১ গ্রাম রূহটুকু নিয়ে চলুন ওই দিনটাতে যাই। সেই দিনটিতে, ২০১৭ সালের মধ্য এপ্রিলে, নাফ নদীর পাড়ের মানুষের উৎসবমুখর দিনে। সেদিন ওখানে স্থানীয় মানুষদের সাংগ্রাই; অর্থাৎ “স্রাইমা সাক্রঃয়” (বর্ষপঞ্জিকা) মতে পুরনো বছর শেষে নতুন বছরের শুরুর দিন। এই দিনটি নাফের পাড়ের মানুষেদের— যদিও হাতে গোনা কয়েকটা পরিবারই এখন রয়েছে, বাকি উপজাতিদের ঘর পুড়েছে, দেশ মাটি ছেড়ে পালাতে হয়েছে। এখন এ জায়গাটা বিশ্বের কাছে একটি নাম করা পর্যটন স্থান। এখানে পার্বত্য জনজাতির মহল্লা আর ঘর পোড়ানোর স্মৃতি দিয়ে তেমন কিছু এসে যায় না পর্যটকদের। এইখানে যে কয়েকটি উপজাতি পরিবার রয়ে গেছে, তারা সমেত শহুরে বিদেশী পর্যটকের ভিড়ে এই সময়ে টেকনাফের সাংগ্রাই, বর্ষবরণ উৎসব, পালিত হচ্ছে। এই উৎসবের মূল আকর্ষণ তরুণতরুণীদের খেলা “ড়ি লং পোয়ে” বা পানি খেলা। এই খেলা শুরু হলে বিকট ও দমবন্ধ লাগতে থাকে মাথিনের। কিছু বছর থেকে মাথিন আর এইদিন নিজের মাতৃভূমিতে সাংগ্রাই উদ্যাপন করতে পারছে না। সে যখন দেখে সিক্ত বসনের কোন জনজাতির কিশোরী বা তরুণীর দিকে শহুরে বা বিদেশী বাবুদের লোলুপ দৃষ্টি, সেসব দৃষ্টি তাকে উথালপাথাল করে দেয়। অসহ্য লাগে তার। মৃত মাথিন আরও কতো কতোবার মরে যায় এই মুহূর্তগুলিতে। তখন সে পালাতে চায় ওই নির্মিত নরক থেকে।
এইসব পর্যটকেরাই এখানে টেকনাফে এসে ‘মাথিন কুয়া’ দর্শন করতে আসে। যাকে এক ‘অমর প্রেম কথা’-র স্মৃতিভূমি বানিয়ে বাণিজ্য করা হয় এখানে। মাথিন-কুয়ার সেই অমর প্রেমকথা আসলে কতোখানি কুৎসিত প্রতারণার কাহিনী, সেকথা একমাত্র মাথিন জানে। মাথিনের প্রেমিক কোলকাতার ওই বামুন সন্তান, যার এক সাহেবের বউয়ের সাথে পরকীয়া চলছিল বলে সাহেব খেপে গিয়ে টেকনাফে বদলি করে তাকে একপ্রকার নির্বাসনের শাস্তি দিয়েছিল বলে জানা যায়। তো কলকাতার সেই বামুন সন্তান, সেই ব্রিটিশ সরকারের পোষা পুলিশটি যখন টেকনাফে বদলি হয়ে আসেন, হাতে তেমন কাজ না থাকাতে, সেই ভদ্রলোক থানার বারান্দায় বসে বসে জনজাতির কিশোরী ও তরুণীদের কুয়ো থেকে জল তোলার দৃশ্য উপভোগ করতেন। এমন সময়ে ভদ্রলোক জনজাতির মধ্যে এক কিশোরী উপজাতি মেয়েকে দেখেন… বাবুর বইয়ে বিবরণের ভাষা এমন ছিল—
“আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় এরকম রূপযৌবনে লাবণ্যময়ী মেয়ে আর দেখেছি বলে মনে পড়ে না। নাক চোখ মুখ সুন্দরী বাঙালী মেয়েদের মতই নিখুঁত, তার উপর ঐ নয়ন মনোহর খোঁপা। মনে হল, সমুদ্র থেকে কোনো জলপরী উঠে এসেছে টেকনাফের পাতকুয়ো থেকে জল নিতে।”
বাবু বন্য রোমাঞ্চের প্রেমে পড়লেন। মেয়েটিকে বিবাহের প্রতিশ্রুতিও দিলেন। সমস্ত প্রতিকূলতা সরিয়ে জনজাতির কিশোরী মেয়েটি যখন পরিবার ও সমাজের সঙ্গে লড়াই করে প্রেমিকের সঙ্গে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে ফেলল, তখন হঠাৎ প্রেমিক যুবকটি মেয়েটিকে জানাল, এক মাসের ছুটি নিয়ে সে বাড়ি যাচ্ছে, ফিরে এসে একসাথে ঘর বাঁধবে দুজনে, তারপর আর কখনো ফিরল না। কিশোরী মাথিন অপেক্ষা করতে করতে ২১ গ্রাম রূহ হয়ে যায়। মাথিনের রূহ একশো বছরেরও বেশী সময় জুড়ে নাফ নদীর পাড়ে অপেক্ষা নিয়ে রয়ে যায়।
কিন্তু সেই অপেক্ষাও শেষ হয়। মাথিন তার জন্মমাটি টেকনাফ থেকে পালিয়ে নাফ নদীর বুকে আশ্রয় চাইছে ভীষণভাবে, এই কিছু বছর ধরে। নাফ নদী কি মাথিনকে আশ্রয় দিতে পারবে? মাথিন জানে না। তবে মাথিন গত পাঁচ বছরে এই নদীর বুকেই আশ্রয় খুঁজে চলেছে। নাফ নদীর পানিতে ভেসে ভেসে কোনো একদিন যদি মাথিনের ২১ গ্রাম রূহ অনন্ত সমুদ্দুরের স্পর্শে বিলীন হয়ে যেতে পারে, সেই আশাতে। ২০১২-র পর থেকে তার টেকনাফ ক্রমশ অসহ্য দমবন্ধ লাগতে শুরু করেছে। সে তার প্রিয় কুয়াতে মিঠা পানি আর স্মৃতি ছুঁয়ে দেখতে যায় না, খুব তৃষিত হলেও আর ওই পথে যায় না সে। যেদিন থেকে সে দেখে তার মূর্তির পাশে ওই বিষাক্ত লোকটার একটি মূর্তি বসানো হয়েছে। তার শরীরবিহীন রূহ প্রথমে যন্ত্রণাতে কুঁকড়ে যায়। তারপর ঘৃণাতে কেমন মূর্ত হয়ে ওঠে, কিন্তু বুঝতে পারে না এই ঘৃণা কার প্রতি। ওই প্রতারক ভদ্রলোকটির প্রতি? নাকি এই মুহূর্তে তার সাথে হওয়া ঘটনাকে যারা বিকৃত করে মহান প্রেমগাথা লিখছে, তাদের প্রতি?
তার ২১ গ্রাম রূহ অপমানে অস্থির, দিকশূন্য হয়ে যায়। স্মৃতিস্তম্ভ কীভাবে নির্মিত হয়? ইতিহাস কীভাবে স্মৃতিস্তম্ভ লেখে? মাথিন হিস্টোরি পড়েনি; তবে মাথিনের কথা হিজ-স্টোরিতে যেভাবে লেখা হয়, হার-স্টোরি লেখা হলে নিশ্চয় এমন হত না। সেই কিশোরী রাইখান প্রেমিকা অস্থির হয়ে দেখতে থাকে, এসময়ের শহুরে বাবুরা উপজাতির রাজকন্যের প্রতারিত হওয়ার ইতিহাসকে কীভাবে গ্যাদগেদে অমর প্রেমগাথাতে বিবর্তিত করছে শুধু নয়, আরও একধাপ এগিয়ে তারা মাথিনের আবক্ষ মূর্তির ঠিক পাশে ওই প্রবঞ্চকের আবক্ষ মূর্তি বসানোর অশ্লীলতা অবধি করছে। যে লোকটা জীবিতকালে মাথিনকে কেবলই উপজাতি এক কিশোরী মাংসের মতো ভেবেছিল, তাকে জড়িয়ে অমর প্রেমগাথা লিখছে এখনকার টুরিস্ট বাবুরা, পর্যটন বাণিজ্যের মুনাফার সুবাদে। মাথিন এখন জানে, বোঝে, দেখে এখানে ঘুরতে আসা বেশীরভাগ পর্যটকগুলিও তো ওই ব্রিটিশের চামচাটার মতোই উপজাতি কিশোরীর মাংসের প্রতি আসক্ত, যাকে তারা তাদের সভ্যসমাজে ‘হুট করে হয়ে যাওয়া স্বল্পকালের বন্যপ্রেমের রোমাঞ্চকর অনুভব’ হিসেবে ভোগ করতে ভালোবাসে। তাই তাদের প্রবৃত্তিতেও, ওই ভটচাজ্জি বাবুর প্রেম-আবেগ-রোমাঞ্চকে প্রাধান্য দিয়ে, মাথিনকে বেচারি বানিয়ে, একটা মিথ্যে প্রবঞ্চনার কাহিনীকে প্রেমকাহিনী বানিয়ে রাখার অসভ্যতা মান্যতা পায়।
মাথিনকে মৃত্যু ও শত বছরের অপেক্ষা দিয়ে বুঝতে হয়েছে ওই সভ্য শহুরে বামুনবাবুর কাছে মাথিন শুধুমাত্র এক আকস্মিক বন্য রোমাঞ্চ, পরবর্তী সময়ে যাকে ‘আমি যখন পুলিশ ছিলাম’ নামের বইটির বুদ্ধিজীবী উপকরণ বা রসদ-বস্তুও বলা যেতে পারে। উপজাতির একটি কচি মাংসের দলা ছাড়া আর কিছুই ছিল না সে ওই সুপুরুষের কাছে। এর কিছু পর একজন গবেষকের সঙ্গে একটি চিঠি আসে এই টেকনাফ অঞ্চলে। কলকাতাইয়া বাবুর কাছে আসা তার বাবার চিঠির অনুলিপি। আর সেই চিঠিটি… উফফ… সেদিনের সেই শুদ্ধ সুললিত ভাষায় লেখা ভদ্রলোকদের শব্দের হিংস্রতা কেমন রুহুতে আঁচড় কেটে ক্ষতবিক্ষত করতে পারে, মাথিন স্পষ্ট বুঝেছিল। তাতে চিঠিতে লেখা ছিল—
“পিতামাতার উপর অভিমানে অপরিণত বুদ্ধি সন্তান অনেক সময় অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করিয়া এমন কিছু করিয়া বসে যাহার ফলে, শুধু তাহার একার নহে, পিতামাতার ভবিষ্যৎ জীবনও বিষময় হইয়া উঠে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আছে এমন হীন কাজ তুমি কখনই করিবে না যাহাতে আমাদের উঁচু মাথা সকলের সামনে নিচু হইতে পারে। সম্প্রতি টেকনাফ হইতে বেনামী তোমার এক শুভাকাঙ্ক্ষীর পত্রে জানিলাম— তুমি নাকি একটি মগের মেয়েকে বিবাহ করিবার জন্য বিশেষ ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছ। সরকারী কার্যে অবহেলা করিয়া দিবারাত্র মেয়েটির পিছনে পাগলের মত ঘুরিয়া বেড়াইতেছ— এমন কথাও পত্রে আছে। আমি বিশ্বাস করি নাই কিন্তু তোমার গর্ভধারিণীর একান্ত আগ্রহাতিশয্যে বাধ্য হইয়া লিখিলাম।
আর একটি বিশেষ কথা এই সঙ্গে তোমাকে জানাইয়া রাখা বিশেষ প্রয়োজন। আমার বাল্যবন্ধু ও সহপাঠী— চট্টোপাধ্যায়কে তুমি ভাল রকমই জান। বহুদিন পূর্বে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই— পুত্র-কন্যার বিবাহ দিয়া পরস্পরে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হইব। সম্প্রতি তাঁহার জ্যেষ্ঠা কন্যা বিবাহের উপযুক্ত হওয়ায় তিনি আমাকে পূর্বের প্রতিশ্রুতি স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন। কন্যাটিকে আমরা দেখিয়া আসিয়াছি— অতি সুলক্ষণা সুন্দরী ও গৃহকর্মনিপুণা। তোমার অপছন্দ হইবে না। আমি পাকা কথা পর্যন্ত দিয়া আসিয়াছি ও জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি দিন স্থির করিয়াছি। তুমি পত্র পাঠমাত্র এক মাসের ছুটি লইয়া কলিকাতায় চলিয়া আসিবে— ছুটি না পাওয়া গেলে চাকুরিতে ইস্তফা দিয়া চলিয়া আসিতেও দ্বিধা করিবে না…”
মাথিন হাসে; সেই চিঠি পড়ে মাথিনের ২১ গ্রাম রূহ এমন পাগলের মতো হাসে, যে সেদিন টেকনাফে ঝড় ওঠে, উথলপাথল ঝড়। যখন শান্ত হয়, নাফের তীরে ভাবতে বসে, তার প্রেমিকের বাবা তবে তাকে মগের কন্যা ভাবে। তার প্রেমিকও হয়তো তাই ভাবত, তাই বাপের কথা শুনে পালিয়ে গিয়েছিল। শহুরে সভ্য তো তারা, তাদের জানার কোন প্রয়োজনটা রয়েছে, যে রাইখান আর মগ এক নয়। দুটি স্বতন্ত্র উপজাতি। যেমন প্রেম আর বন্য রোমাঞ্চ স্বতন্ত্র, এক নয়।
এই একশো বছরের বেশি সময় ধরে মাথিন আরও কতো কিছু শিখেছে। সে তার প্রেমিকের মনিবদের হাত থেকে দেশকে স্বাধীন হতে দেখেছে, দেখেছে স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযোদ্ধা সেইসব উপজাতি কিশোর কিশোরীদের আবেগ ও খানসেনাদের হাতে তাদের খুন ও ধর্ষিত হওয়ার দৃশ্য। তারপর সে দেখেছে মুক্তিযুদ্ধে ভাষার জন্য লড়াই করে স্বাধীনতা পাওয়া ছোট্ট দেশটা কী করে ধর্মীয় অন্ধত্বের বশে উপজাতিদের ঘর পুড়িয়েছে, ভিটে ছাড়া করেছে। সে দেখেছে রাইখান প্রদেশ ক্রমে রাইখান জনজাতিশূন্য হয়ে কীভাবে পর্যটনকেন্দ্র ও প্রমোটারদের অধীনে চলে গেছে।
২০১৭ মার্চ-এপ্রিল থেকে মাথিনের নতুন সমস্যা হচ্ছে নাফ নদীতে। নদীতেও আর আশ্রয় সংকুলান হয় না; সেখানে ভেসে থাকে আশ্রয়হীন মৃত মানুষদের দেহ, মায়ানমারের বৌদ্ধদের হিংস্রতায় যারা ঘর হারিয়ে বাঁচার জন্য মরে যাচ্ছে। দেবতার নদী নাফে মাঝেমাঝেই এখন আরাকান থেকে পালিয়ে আসা অসংখ্য ঘরহারা রোহিঙ্গার ভয়ার্ত গুলিবিদ্ধ বা নাও ডুবে মরা দেহে ভরে থাকে। তাও, এই পচে ফুলে ওঠা বিকৃত ভাসমান মৃতদেহের সাথেও মানিয়ে নিচ্ছিল সে। সমস্যাটা হল নাফের মাছগুলো আজকাল এই মৃতদেহগুলো ভক্ষণ করাতে তাড়াতাড়ি বড় হয়। শহরের অভিজাত বাজার ও রেস্টুরেন্টগুলোতে এই মাছের চাহিদা ক্রমে বেড়ে চলেছে। এই মাছগুলো, ওই দেশহারা, ঘরহারা, জীবনের জন্য পালাতে থাকা মৃত মানুষের মাংস খাওয়ার জন্যই বোধহয়, শহুরে অভিজাতদের মধ্যে এই মাছ খাদ্য হিসেবে ভোগ করার চাহিদা এত সুতীব্র। শহুরে অভিজাতদের এই সুতীব্র চাহিদার কারণে, নাফ নদীতে মাছ ধরার ট্রলার আর তীরে ট্রাকের ভিড় বেড়ে চলেছে ক্রমশ। পর্যটক ও মাছ ব্যবসায়ীদের ভিড় যেমন বাড়ছে, তেমন নাফ নদীর বুকে আরাকান রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মৃতদেহও বাড়ছে। তার ২১ গ্রাম রূহর নাফে একটুকরো নিরালা জমিন সে খুঁজে পাচ্ছে না আর। মৃত মানুষদের মাঝে থাকতে পারলেও, বিকৃতমনা বাণিজ্যবাবুদের মাঝে থাকা অসম্ভব হয়ে ওঠে।
২০১৭তে সাংগ্রাই বা বর্ষবরণের দিন, সে, নাফ নদীর বুকে আশ্রয় খুঁজে ফেরা মাথিন, নাফের তীরা বরাবর যাচ্ছিল একটু নিরালার সন্ধানে। সেদিনও নাফে বেশ কিছু মৃত রোহিঙ্গার দেহ ভাসছে। সে নাফের তটে একটি পাঁচ বছরের শিশুর খুবলে যাওয়া শরীর দেখতে পায়। শিশুটি আসমানের দিকে তাকিয়ে আছে। গোটা শরীর মাছে খুবলে খেলেও, মোটা মোটা নিথর একজোড়া চোখের দৃষ্টি যেন অসীম শূন্যতার পানে চেয়ে কী একটা খুঁজে চলেছে। এই মৃত ছোট্ট দেহটি দেখে খুবই অদ্ভুত লাগে মাথিনের। সে লক্ষ্য করে, শিশুটি মৃত্যুর পরেও একটি খাতা দুই হাত দিয়ে বুকে চেপে রেখেছে। সেই ভেজা খাতার মলাটে, আরাকানের রোহিঙ্গা ভাষাতে, মাথিন আধো আধো করে পড়ে, লেখা আছে ‘নবী-র খাতা’। আর সেখানে আঁকাবাঁকা দাগে একটা ছোট্ট ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটি শিশু। পাঁচ বছরের ওই শিশুটি, যার নাম নবী, সে একটি খাতার মলাটে ঘর এঁকেছে প্রাণপণে, আর প্রাণপাত হওয়ার পরেও সেই খাতাটি বুকে জড়িয়ে অসীম শূন্যে ঘর খুঁজে চলেছে।
মাথিনের ২১ গ্রাম রূহ এতখানি কাঁপেনি আগে কখনো। এই শিশুটির নিথর চোখের শূন্যতায় যখন সে একটা ঘরের শেষ খোঁজ দেখতে পায়, মাথিন এলোমেলো হয়ে যায়, দিশেহারা লাগে তার। মনে পড়ে, তার নিথর দুচোখেও তো, মৃত্যুর পরও, প্রেমিকের সাথে একটি ঘর বাঁধার অদম্য স্বপ্ন অসীম নীলে পাড়ি জমিয়েছিল। মাথিন নাফের বুকে নবীর ২১ গ্রাম রূহকে বেপরোয়ার মতো খুঁজতে থাকে। অবশেষে রাইখান রাজকুমারী মাথিন খুঁজে পায় আরাকানের ছোট্ট নবীর রূহকে। প্রেমিকা মাথিন আর ছোট্ট শিশু নবী, দুজনের ২১ গ্রাম রূহ সেই থেকে নাফ নদীর অনন্ত নীলে ঘর খুঁজে বেড়াচ্ছে। তাদের নিজেদের আপন ঘর।
এই গল্পটি শেষ হল, নটে গাছ মুড়োল না। কারণ আমি এই রোগ-জরা-মৃত্যুসময়ের শেষে নাফে পর্যটক হয়ে যাব যখন, তখন আমি রাজকুমারী মাথিনের ‘হিজ-স্টোরি’তে প্রতারকের সাথে তার আবক্ষ মূর্তিকে, তার প্রতি প্রবঞ্চনার কথাকে, মহান অমর প্রেমের ইতিহাস হিসেবে দেখব। আর নবীর কথা এই পৃথিবীতে কেউ না জানে, কেউ না শোনে।এই অতিমারীর শেষে আরও অনেক নবী সমেত নাফ তখন লক্ষ লক্ষ ২১ গ্রামের রুহু-কথাতে ভরে যাবে, যা ওই দেবতার নদীকে আরও রূহানী করে তুলবে। আমি সেই রূহানী নীল নদীর বুকে পাহাড় আর সমুদ্দুর মিশে যাওয়াকে দেখে মন জুড়োব। তখন যদি মাথিন আর নবীদের কথা নাই বা মনে থাকল, তারার পানে চেয়ে চেয়ে, পৃথিবী কতো সুন্দর সেই ছবি আঁকব আমার ও আপনাদের জন্য।
…
লাবনী জঙ্গি লেখক ও চিত্রশিল্পী এবং সেন্টার ফর সোশ্যাল সাইন্স কলিকাতা-র শিক্ষার্থী ও গবেষক।
সঙ্গের ছবি – লেখক
অসাধারণ লেখনী। চমৎকৃত হলাম উপস্থাপনার আঙ্গিকে। আরো লিখুন।