সৌভিক ঘোষাল
সাহিত্যের ছাত্র। মার্ক্সবাদী মতাদর্শে আস্থাশীল। মার্ক্সবাদকে সমকাল ও ভারতীয় প্রেক্ষিতে জানাবোঝা ও প্রয়োগের কাজে যুক্ত।
একসময় মনে করা হয়েছিল আমাদের এই সময়টা সামন্ততন্ত্র, সাম্প্রদায়িক মৌলবাদ, কুসংস্কার, অপবিজ্ঞান সহ সমস্ত অধিবিদ্যার দর্শন ও তার যেন বা ক্রম হ্রাসমান সামাজিক প্রভাবকে ধীরে ধীরে পরাভূত করে সমাজতন্ত্র, বিজ্ঞান মনস্কতা, হেতুবাদী দর্শনের পথে এগিয়ে যাবে। জীবনানন্দের ভাষায় বলতে গেলে “এ পথে আলো জ্বেলে এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে”। হতে পারে “সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ,” কিন্তু হবে, একদিন হবে। এই স্বপ্নকে ভেঙে দিয়ে বাস্তবে অবশ্য বিপরীত ঘটনাগুলোকেই চোখের সামনে দেখতে দেখতে আমরা বেড়ে উঠলাম। গত শতাব্দীর শেষ দশক থেকে যেন ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গর মধ্যে দিয়ে প্রগতির বিপরীত পথে যাত্রা শুরু হল। বিশ্বজুড়ে এবং আমাদের দেশেও। সোভিয়েত সমাজবাদের পতন হল, বার্লিনের প্রাচীর ধ্বসে পড়ল, ওয়াশিংটন কনসেন্সাস ও বিশ্বব্যাঙ্ক – আই এম এফ চালাতে লাগলো কর্পোরেট ঘরানার মুনাফা সর্বস্ব দুনিয়ার অর্থনীতি, ধারা পাল্টালো মাও সে তুং-এর চিনও, ইরান সহ নানাদেশে ইসলামিক বিপ্লব হল, মুক্তিযুদ্ধে জন্ম নেওয়া ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষিত হল ইসলাম আর ভারতে বাবরি মসজিদকে ধুলোয় লুটিয়ে দেওয়া হল, কেন্দ্রীয় ক্ষমতা দখল করল হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে নয় দশক অতিক্রম করা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের রাজনৈতিক মুখ ভারতীয় জনতা পার্টি।
তবু যাঁরা মনে করেন “এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা সত্য/ কিন্তু শেষ সত্য নয়”, যাঁরা অপেক্ষা করে আছেন নতুন এক আরম্ভের জন্য, তাঁদের অবশ্যই অনেক রক্তাক্ত পথ অতিক্রম করতে হবে। দেখতে হবে বোবা করে দেওয়া রক্তঝরা অনেক কঠিন মুহূর্ত। দেশে এবং বিশ্বজুড়ে। কোথাও পেশোয়ারের স্কুলে বাচ্চা ছেলেদের খুন করা হবে ইসলামের নামে তো কোথাও ড্রোন হামলায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এই কাজ করবে নিজেদের বাড়িয়ে তোলা মৌলবাদকে ধ্বংস করার নামে। কোথাও জামাতী ইসলামী কাফের এর কল্লা নামাবে বা ইসলামিক স্টেট, বোকো হারাম, আল কায়দা, তালিবানরা গুঁড়িয়ে দেবে সভ্যতার চেনা যাবতীয় ছককে তো কোথাও ঘটানো হবে গুজরাট ২০০২ বা মুসলিম সংখ্যালঘু সংঘারের স্টেট স্পনসর্ড টেররিজম। উপমহাদেশের এখানে ওখানে খুন হয়ে যাবেন দাভোলকর পানেসর বা অভিজিৎরা। শুধু মুক্তচিন্তার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকার জন্য, ধর্মীয় মৌলবাদ বা কুসংস্কার এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে কায়েমী স্বার্থে আঘাত হানার জন্য। রক্ত ঝরবে আর রক্তের মধ্যে থেকেই উঠে আসবে প্রতিবাদ। শার্লে হেবদোর হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে যেমন পথে নামবে মানুষ, তেমনি বাংলাদেশ দেখবে জামাতি তাণ্ডবের বিরুদ্ধে শাহবাগের স্পর্ধাকে, খাপ-এর বিরুদ্ধে, পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে ‘নির্ভয় স্বাধীনতা’র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়বে দিল্লি থেকে সর্বত্র।
সঙ্কটগুলিকে পেরোতে হলে তার পরতগুলিকে নিবিড়ভাবে বোঝা দরকার। আমাদের বর্তমান প্রবন্ধ আমাদের দেশের তথা উপমহাদেশের অন্যতম সমস্যা ধর্মীয় মৌলবাদের বিষয়টিকে বোঝার কিছু চেষ্টা করেছে। চেষ্টা করেছে ইতিহাসগত প্রেক্ষাপট থেকে তাকে বোঝার। মূলত হিন্দু মৌলবাদ আর মুসলিম মৌলবাদের ইতিহাসকে আলাদা আলাদাভাবে ফিরে পড়তে চেয়েছি আমরা। সাম্প্রদায়িক সঙ্কটের মোকাবিলা কোন কোন পথে করা যেতে পারে, সেই জরুরী আলোচনাতে আমরা এখানে প্রবেশ করিনি। ইতিহাসটাকে জানা বোঝা সমাধানের হদিশ সন্ধানের কাজে সাহায্য করে থাকে এটুকুমাত্র এখানে বলার।
হিন্দু মৌলবাদ : ইতিহাসের দিকে ফিরে
৩ অক্টোবর ২০১৪, বিজয়া দশমীর দিনটাতে একটা বিশেষ ঘটনা ঘটল। সেদিন বেতারে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আর দূরদর্শনের মতো সরকারী প্রচারমাধ্যমে ‘জাতির উদ্দেশ্যে’ বক্তব্য রাখার জন্য সসম্মানে জায়গা করে দেওয়া হল বর্তমান সঙ্ঘচালক মোহন ভাগবতকে। চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী প্রজাতন্ত্র দিবস বা স্বাধীনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। সেই চিরাচরিত প্রথার সঙ্গে বিজয়া দশমীর দিনটাকে কেন জুড়ে নেওয়া হল নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর ?
প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তর তো জানা। বিজয়া দশমীর দিনটি আর এস এস এর প্রতিষ্ঠা দিবস, যে আর এস এসকে কেন্দ্রের বর্তমান শাসক দল বিজেপি তার ‘মতাদর্শগত দিশারী’হিসেবে খোলাখুলি স্বীকৃতি দেয়। আজকের ভারত তথা গোটা উপমহাদেশেই সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, পরিচিতি সংঘাত ও হিংসা বা তোষণের মত নানা অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ নিয়ে যে সমস্ত তর্জা অবিরত চলে, যে তর্জা থেকে উপমহাদেশ জুড়ে জন্ম হয় নিরন্তর দ্বেষ বা রক্তক্ষরণের মর্মান্তিক নানা বাস্তব, তাকে বোঝার জন্য সমকাল থেকে একটু পেছন দিকে ফিরে তাকাতে পারি আমরা, একটু বিশেষ নজরে দেখতে পারি হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা ও মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার বিকাশ প্রতিষ্ঠার ইতিবৃত্তকে।
ভারতে হিন্দুত্ববাদের রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক মতাদর্শ ও সাংগঠনিক বিস্তারের বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে আমাদের নির্দিষ্টভাবে শুরু করতে হবে বিশ শতকের প্রথম ও তৃতীয় দশকে জন্ম নেওয়া দুটি সংগঠনের কথা দিয়ে। প্রথমটি হিন্দু মহাসভা ও দ্বিতীয়টি আর এস এস। প্রদীপ জ্বলার আগে সলতে পাকানোর সচেতনে অচেতনে মেশা এক পর্ব অবশ্য শুরু হয়েছিল হিন্দু মহাসভা প্রতিষ্ঠারও কয়েক দশক আগে। হিন্দুত্বের রাজনীতির কারবারিরা বিভিন্ন সময়ে নিজেরাই সেই নবজাগরণ পর্বের কয়েকজন চিন্তাবিদের থেকে নানা ধরণের প্রেরণা নেবার কথা বলেছেন যাদের মধ্যে রয়েছেন বঙ্কিমচন্দ্র, বিবেকানন্দ বা দয়ানন্দ সরস্বতী প্রমুখ। (এই নিয়ে ‘আলিবাবার গুপ্তভাণ্ডার’ বইয়ের ‘পুনর বিষয়ে পুনরবিবেচনা’ নামক আকর্ষণীয় প্রবন্ধে শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় কৃত মনোজ্ঞ আলোচনা আগ্রহীরা দেখে নিতে পারেন।)
মর্লে মিন্টো সংস্কার এল ১৯০৯ খ্রীষ্টাব্দে। এল পৃথক ধর্মভিত্তিক নির্বাচন এর প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিয়ে। আর এই প্রেক্ষিতে তৈরি হওয়া উত্তেজনাময় পরিস্থিতিতে হিন্দু মহাসভার জন্ম হল ওই একই বছরে, ১৯০৯ সালে। এর আগেই ১৯০৬ এ মুসলিম লীগের জন্ম হয় বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনকে সদ্য জন্ম নেওয়া মুসলিম লীগ সমর্থন করতে পারে নি এবং মুসলিম অধ্যুষিত এক পৃথক প্রদেশের ধারণার সূত্রে বঙ্গভঙ্গকেই তারা স্বাগত জানিয়েছিল। এর বিরুদ্ধে হিন্দু সমাজের ভেতর থেকে নানা উগ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গিয়েছিল এবং মর্লে মিন্টো সংস্কারে ধর্মভিত্তিক নির্বাচনের প্রস্তাব এলে তা আরো বৃদ্ধি পেয়েছিল। হিন্দুদের পালটা একটি রাজনৈতিক সংগঠন দরকার এবং কংগ্রেস তা হতে পারে না, এই ভাবনা থেকেই হিন্দু মহাসভা জন্ম নিয়েছিল। কিন্তু হিন্দু মহাসভা সে সময়ে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তারে সমর্থ হয় নি। ধর্মীয় উন্মাদনার মুখে দাঁড়িয়েও হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতি সংক্রান্ত সঙ্কটের বাস্তব দিকগুলিকে বোঝবার ও তার ভিত্তিতে আন্তরিকভাবে কাছাকাছি আসার একটা আগ্রহ লক্ষ্য করা গিয়েছিল বুদ্ধিজীবীদের মধ্য, আর এই এই গোটা প্রক্রিয়ার পুরোভাগে অন্যতম ব্যক্তি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ‘গোরা’, ‘ঘরে বাইরে’র মত উপন্যাসে বা অসংখ্য কবিতায়, প্রবন্ধে হিন্দু সমাজের মধ্যেকার জরুরী আত্মসমালোচনার কাজটা শুরু করেছিলেন তিনি।
মহাত্মা গান্ধীর জাতীয় রাজনীতিতে আবির্ভাবের পর, বিশেষত গণ আন্দোলনের পর্ব শুরু হলে ধর্মীয় উগ্রতার পরিবেশ অনেকটা কমে আসে। লক্ষ্নৌ চুক্তি (১৯১৬)-র সূত্রে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সামনের সারির নেতারা প্রথমবারের জন্য কাছাকাছি আসেন এবং সম্প্রীতি ও সমঝোতার পরিবেশ তৈরি হয়। সম্প্রীতির পরিবেশ আরো জোরালো হয় ১৯১৯ এ অসহযোগ আন্দোলন ও খিলাফৎ আন্দোলন একযোগে হাত মিলিয়ে চলতে শুরু করলে। সম্প্রীতির পরিবেশ হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির জমিকে অনেকটাই কেড়ে নেয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না এবং ১৯২২ সালে চৌরিচৌরার একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেওয়ার আকস্মিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন গান্ধীজী। অচিরেই ব্রিটিশ বিরোধী গণ আন্দোলনে শুরু হয় ভাঁটার পর্ব, হিন্দু মুসলিম ঐক্য ভেঙে পড়ে এবং এই পর্বেই ১৯২৫এ জন্ম নেয় আর এস এস, নতুন করে বিকশিত হয় হিন্দু মহাসভা। এই সময়েই সাভারকর হিন্দু মহাসভার নেতা হিসেবে সামনে আসেন। ততদিনে তাঁর বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী অতীতকে ঝেড়ে ফেলে তিনি রূপান্তরিত হয়েছেন এক হিন্দুত্ববাদী চরমপন্থী রাজনীতিবিদে। ১৯২৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রভাব সঞ্চারী বই – ‘হিন্দু কে?’ পরবর্তী দীর্ঘদিন ধরে হিন্দুত্ববাদের রাজনীতিতে এই বই মতাদর্শগত দিকনির্দেশিকা হয়ে থেকেছে।
অবশ্য হিন্দুত্ববাদের রাজনীতি শুধু মতাদর্শগত বিচার বিশ্লেষণের ওপরেই দাঁড়িয়ে থাকে নি, তাকে সাংগঠনিক দৃঢ়তা দেওয়ার প্রয়োজনও অনুভূত হয়েছিল। সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের মধ্যে দিয়ে তাকে আসমুদ্র হিমাচল ব্যাপ্ত করার সংকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। এই কাজে বিশেষ ভুমিকা গ্রহণের জন্যই তৈরি হয়েছিল রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ (আর এস এস)।
হেডগাওয়ার তার অনুগামীদের নিয়ে ১৯২৫ এ আর এস এস তৈরি করেন আর ১৯২৭ সালেই এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্রে তার প্রভাব বাড়তে শুরু করে। সাভারকর যে জন্মভূমি ও পিতৃভূমির যুক্তিকাঠামো তৈরি করে দিয়েছিলেন, তার সঙ্গে হেডগাওয়ারের মতাদর্শগত সামীপ্য ছিল প্রকট। তারা মনে করেছিলেন খ্রীষ্টান বা মুসলিমরা এদেশে বাস করলেও প্যালেস্টাইন বা আরবকে তাদের পিতৃভূমি (পবিত্রভূমি) ভাবে। জন্মভূমির জন্য এদেশের মুসলিম বা খ্রীষ্টানরা তাই কখনো নিবেদিতপ্রাণ হতে পারে না। সেটা পারে একমাত্র হিন্দুরাই, যাদের জন্মভূমি আর পিতৃভূমি এক, এই আসমুদ্র হিমাচল। হেডগাওয়ার এর মতে গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের ফলে দেশময় তৈরি হয় এক দূষিত আবহাওয়া, নগ্নভাবে প্রকট হয়ে পড়ে ব্রাক্ষ্মণ–অব্রাক্ষ্মণ বিরোধ, দাঙ্গা উসকে তোলে ‘অসহযোগের দুধে প্রতিপালিত যবন সাপেরা’। যবন সাপেদের প্রতি বিবমিষার মতোই লক্ষ্য করার বিষয় তাঁর ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী অবস্থানটি। বস্তুতপক্ষে আর এস এস কে শুধু হিন্দুত্ববাদী বললে সেটি খণ্ডিত অভিধা হতে পারে, হিন্দু ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী হিসেবে আখ্যাত করলেই পাঁচ ব্রাক্ষ্মণকে নিয়ে প্রথম তৈরি এই সংগঠনটির স্বরূপ আমরা ভালোভাবে বুঝতে পারব।
অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহারের পর সাম্প্রদায়িক ঐক্য সঙ্কটগ্রস্থ হয়েছিল। আর এস এস নাগপুরে স্থানীয়ভাবে প্রথম তার কাজ শুরু করে। দীর্ঘদিন কাজ করতে পারবে আর আনুগত্য থাকবে প্রশ্নাতীত – এই বিচারে আর এস এস এই সময়ে অল্প বয়েসী ছেলেদের হিন্দুত্বের আদর্শে দীক্ষা দিতে শুরু করে। এখন যেখানে বিশাল হেডগাওয়ার ভবন, তখন সেখানে খোলা মাঠ আর এই মাঠেই প্রথম সঙ্ঘচালক হেডগাওয়ার বালকদের কর্মশালা শুরু করেন। তাদের শোনানো হতে থাকে হিন্দু বীর যোদ্ধাদের সংগ্রাম কাহিনী, শিবাজী বা রাণা প্রতাপের মতোই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাদের আমরণ রত থাকার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়। মতাদর্শগত শিক্ষার পাশাপাশি চলতে থাকে ব্যায়াম, কবাডি বা খো খো খেলা, লাঠিখেলা, তলোয়ার খেলা, ছুরি চালানো, বর্শা ছোঁড়ার মতো রাস্তার লড়াইয়ে সাফল্যের লক্ষ্যে নানা কৃৎকৌশলগত শিক্ষা। পরের বছর ১৯২৬এ রামনবমীর দিন সংগঠনটি তার নামের সঙ্গে নির্দিষ্ট করে নেয় নিজের পতাকাও, যে গৈরিক পতাকা শিবাজী এবং স্বয়ং রামচন্দ্রও নাকি ব্যবহার করতেন! আদ্যন্ত হিন্দুত্ববাদী একটি সংগঠনের নাম হিসেবে রাষ্ট্রীয় অভিধাটি ব্যবহার লক্ষ্যণীয়, যা বুঝিয়ে দেয় হিন্দুত্ব ভারতীয়ত্বের কোন সমীকরণ তৈরি করা তাদের লক্ষ্য। সেপ্টেম্বর ১৯২৭এ নাগপুরে একটি দাঙ্গার ঘটনা ঘটে এবং সেখানে রাস্তার লড়াইয়ের কৃৎকৌশলে দক্ষ হয়ে ওঠা আর এস এস কর্মীরা ভালো পরিমাণ সাফল্য লাভ করে। এই সাফল্য লোকের মুখে মুখে ফিরতে থাকে এবং অচিরেই আর এস এস এর ‘জনপ্রিয়তা’ বহুগুণ বেড়ে যায়। দক্ষ সংগঠক হিসেবে হেডগাওয়ার এই সাফল্যকে সংগঠন বৃদ্ধির কাজে ব্যবহার করেন। কয়েকগুণ প্রসারিত এবং উদ্দীপ্ত সংগঠনকে দৃঢ়তর করার প্রয়োজনে ৩১ মার্চ ১৯২৮এ একটি শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এখানে হেডগাওয়ার তাঁর ভাষণে তুলসীদাসের বিখ্যাত পঙতি “প্রাণ যায়ে পর বচন না যায়ে” মন্ত্রে কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করেন। স্পীকার বিটলভাই প্যাটেল সহ বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আর এস এস কর্মশালা পরিদর্শনে আমন্ত্রণ জানান হেডগাওয়ার। মহারাষ্ট্রের বাইরে সংগঠনকে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ শুরু হয়। কয়েকজন স্বয়ংসেবককে ছাত্র হিসেবে পাঠানো হয় উত্তরপ্রদেশের বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে তারা অধ্যক্ষ মদনমোহন মালব্যের অনুগ্রহ লাভ করে এবং বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেই খোলা হয় আর এস এসের কার্যালয়। সংগঠনকে কেন্দ্রিকতার দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করার দিকে এগিয়ে নেওয়ার ভাবনা তৈরি হয়। এই লক্ষ্যে ১৯২৯ এর ৯ ও ১০ নভেম্বর নাগপুরে একটি বিশেষ অধিবেশন বসে। অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের পরিবর্তে এক সঙ্ঘচালকের সর্বময় নিয়ন্ত্রণ ও হিন্দু যৌথ পরিবারের আদর্শে সঙ্ঘ পরিবার চালানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
আর এস এস ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সেভাবে কোনওদিনই অংশগ্রহণ করে নি এবং ব্রিটিশ নয়, মুসলিমদেরই মূল শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারী কংগ্রেস প্রথমবার প্রতীকী স্বাধীনতা দিবস পালন করার কথা বলে এবং অতঃপর প্রতি বছর দিনটি এভাবে পালিত হতে থাকে পুলিশি জুলুমের মোকাবিলা করেই। আর এস এস কেবল প্রথম বছর প্রতীকী স্বাধীনতা দিবস পালন করেছিল, পরে আর কখনোই নয় আর এই প্রথম বছরেও সে তেরঙ্গা ঝান্ডাকে বর্জন করে গৈরিক পতাকাকে উর্ধ্বে তুলে ধরে। আইন অমান্য আন্দোলনেও আর এস এস সেভাবে অংশগ্রহণ করে নি এবং কংগ্রেসের পক্ষ থেকে ১৯৩৩ সালে জামনালাল বাজাজ হেডগাওয়ারের কাছে সরাসরি জাতীয় আন্দোলন বিষয়ে আর এস এসের দৃষ্টিভঙ্গী কী তা জানতে চান। বাজাজের সঙ্গে হেডগাওয়ারের ব্যক্তিগত বৈঠক ফলপ্রসূ হয় নি। ১৯৩৪ সালে কংগ্রেস এক নির্দেশিকায় মুসলিম লীগের পাশাপাশি তার সদস্যদের হিন্দু মহাসভা এবং আর এস এসের সদস্য হওয়া বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারী করে। আর এস এস অবশ্য এই পর্বে জাতীয় আন্দোলন থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্নতা চায় নি এবং হেডগাওয়ার ১৯৩৪এই গান্ধীকে তাদের ওয়ার্ধায় এক কর্মশালা পরিদর্শনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। গান্ধী সেই আমন্ত্রণ গ্রহণও করেন।
আর এস এসের সঙ্গে হিন্দু মহাসভার সম্পর্ক ১৯৩০ এর দশক জুড়ে মাঝেমাঝে ওঠাপড়া করলেও এই দুই প্রধান হিন্দুত্ববাদি সংগঠনের মিলিত প্রভাব অনেকটাই পরিব্যাপ্ত হয়েছিল। সমধর্মী দুই সংগঠনের কিছু স্বাভাবিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং রাজনৈতিক–সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ সংক্রান্ত ঘোষিত অবস্থানের কিছু পার্থক্য ব্যতিরেকে তাদের মধ্যে মৈত্রী ক্রমশ বাড়তে থাকে। ১৯৩১ এই বাবুরাও সাভারকরের হিন্দু মহাসভার যুব শাখাটি আর এস এসে মিশে যায়। হিন্দু মহাসভার কর্মীসংস্থানগত কিছু অসুবিধা ছিলই এবং তারা সাগ্রহে আর এস এসের মতো সাংগঠনিকভাবে মজবুত দলকে নিজেদের রাজনীতির সম্প্রসারিত গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করতে আগ্রহান্বিত হয়। ১৯৩২ সালে দিল্লিতে আহূত হিন্দু মহাসভার সম্মেলন দেশজুড়ে আর এস এসের প্রসারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলে। ওই বছরেই করাচীতে হিন্দু যুবক পরিষদের সম্মেলনে হিন্দু মহাসভার পক্ষ থেকে বিশেষ আমন্ত্রণ জানানো হয় সঙ্ঘচালক হেডগাওয়ারকে। সিন্ধ এবং পাঞ্জাবে হিন্দু মহাসভার সাহায্যে আর এস এস তাদের সংগঠন বিস্তার করে। পশ্চিম মহারাষ্ট্রে সাভারকর পরিবারের খ্যাতিকে আর এস এস তাদের সাংগঠনিক বিস্তারের কাজে ব্যবহার করে। নাগপুরের পর পুণে হয়ে ওঠে আর এস এসের দ্বিতীয় প্রধান কার্যালয়। ১৯৩৭ সালে জেল থেকে বেরোনোর পর হিন্দু মহাসভার বিশিষ্ট নেতা সাভারকর আর এস এসের শাখা বৈঠকগুলিতে একের পর এক বক্তৃতা করেন। ১৯৪০ এ লাহোর এর আর এস এসের এক শাখায় গিয়ে হিন্দু মহাসভার আর এক বিশিষ্ট নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় দেশের মেঘাচ্ছন্ন পরিস্থিতিতে আর এস এসকেই একমাত্র আলোর রুপোলি রেখা বলে বর্ণনা করেন। হিন্দু মহাসভার সূত্র ধরেই হিন্দি বলয়ে আর এস এস তাদের কাজের সূত্রপাত ঘটাতে সক্ষম হয়। ১৯৩৭ থেকে ৪০ সালের মধ্যবর্তী সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার তীব্র পর্বটিকে আর এস এস দেশজোড়া সংগঠন বৃদ্ধির কাজে সফলভাবে ব্যবহার করে। পশ্চিম ভারতে তারা আগেই ভালোরকম শক্তিশালী ছিল। উত্তর ভারত, হিন্দি বলয়ের পাশাপাশি এই সময়ে হেডগাওয়ার মাদ্রাজ শহর এবং তামিলনাড়ু কর্ণাটকের বিভিন্ন অঞ্চলে সঙ্ঘসেবকদের পাঠান।
উত্তর ভারতে আর এস এসের বিস্তারে অবশ্য দয়ানন্দ সরস্বতী প্রতিষ্ঠিত আর্য সমাজের প্রভাব সবচেয়ে বেশি কার্যকরী হয়েছিল। উত্তরভারত জুড়ে আর্যসমাজের অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল। এই দয়ানন্দ অ্যাংলো বৈদিক বিদ্যালয় এবং গুরুকুল কাংড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমূহর মতাদর্শগত প্রভাবকে আর এস এস ভালোভাবেই ব্যবহার করে নিতে পেরেছিল। ১৯৪০এ নাগপুরে দেওয়া তার শেষ ভাষণে প্রথম সঙ্ঘচালক হেডগাওয়ার গোটা দেশ এর প্রায় সমস্ত অঞ্চল থেকে আগত বিরাট সংখ্যক স্বয়ংসেবকদের কে সম্বোধিত করে আবেগদৃপ্ত গলায় জানিয়েছিলেন এতদিনে তিনি তার চোখের সামনে স্বপ্নের হিন্দুরাষ্ট্রের এক ছোট সংস্করণকে দেখতে পাচ্ছেন।
হেডগাওয়ারের পর সঙ্ঘচালকের দায়িত্বভার বর্তায় গোলওয়ালকরের ওপর এবং ৪০ ও ৫০এর দশক জুড়ে জাতীয় জীবনের অত্যন্ত গুরূত্বপূর্ণ বছরগুলিতে তিনি আর এস এস ও হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাকে দেশজুড়ে বিস্তৃত ও সংহত করেন। সঙ্ঘচালক হিসেবে দায়িত্ব নেবার দু বছর আগেই তিনি লিখেছিলেন ‘উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইনড’ নামের আলোড়ন সৃষ্টিকারী রচনা । এখানে এবং তার দেওয়া বিভিন্ন প্রবন্ধ ও বক্তৃতার সংগ্রহ ‘চিন্তাসমূহর সংকলন’(বাঞ্চ অব থটস) এ পাওয়া যাবে গোলওয়ালকরের হিন্দুত্বভাবনার স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। আমরা দেখব গোলওয়ালকর সাভারকরের সেই ‘পিতৃভূমি/ পুণ্যভূমি ও মাতৃভূমি’সংক্রান্ত তত্ত্বায়নটিই গ্রহণ করেন এবং আরো উগ্রভাবে তাকে এগিয়ে নিয়ে যান। ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদ এবং সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের মধ্যে গোলওয়ালকর শুধু পার্থক্যই করলেন না, হিটলারের উদাহরণ সামনে রেখে দেশকে বিশুদ্ধ রক্তের মানুষেরই আবাসভূমি রাখার জন্য ‘সেমেটিক বিতাড়ন’এর প্রয়োজনীয়তার কথা তুললেন। হিটলারের উদাহরণকে হিন্দুস্থানের জন্য শিক্ষণীয় বলেও মনে করলেন। বলাই বাহুল্য হিটলারের সেমেটিক তথা ইহুদী বিদ্বেষকে এখানে সেমেটিক অর্থাৎ মুসলিম বিদ্বেষে পরিবর্তিত করে নেওয়া হল। ভারতের অ-হিন্দুদের জন্য গোলওয়ালকর রাখলেন তার স্পষ্ট নিদান। ‘সমস্ত অহিন্দুদের অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে হিন্দু সংস্কৃতি ও ভাষা, হিন্দু ধর্মকে শ্রদ্ধা করতে শিখতে হবে, হিন্দু জাতিরাষ্ট্রের জন্যই কেবল গৌরব করতে হবে, অন্য কোনও কিছুর (অর্থাৎ অন্য কোনও পুণ্যভূমির) জন্য নয়। এই দেশ এবং তার দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য সংস্কারগুলিকে অশ্রদ্ধা করা চলবে না বরং একে ভালোবাসতে হবে, শ্রদ্ধা করতে হবে। এককথায় হয় তাদের দেশ ছাড়তে হবে অথবা কোনও দাবি না রেখে হিন্দুজাতির অনুগত হয়ে থাকতে হবে। কোনও বিশেষ সুযোগ সুবিধা পাওয়া দূরে থাক, তাদের এমনকী নাগরিক অধিকারও থাকবে না’। (উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইনড – পৃঃ ২৭)
খ্রীষ্টান এবং মুসলিম বিদ্বেষকে চরম সীমায় নিয়ে গেলেন গোলওয়ালকর। প্রশ্ন তুললেন ‘খ্রীষ্টান এবং মুসলিমরা এদেশে জন্মেছে ঠিকই, কিন্তু তারা কি দেশের নুন এর প্রতি সত্যকারের বিশ্বস্ত ? তাদের বিশ্বাসের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই জাতির প্রতি তাদের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা নষ্ট হয়ে গেছে’। বিশেষ করে মুসলিমদের তিনি এককথায় ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে আখ্যা দিলেন। বললেন ‘মুসলিমরা এখনো ভাবে তারা এদেশ দখল করতে এসেছে, এখানে তাদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে এসেছে। তাই এটা কেবল বিশ্বাসের পরিবর্তনের বিষয় নয়, এটা হল জাতীয় পরিচয় পরিবর্তনের প্রশ্ন’।
সমকালীন ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও দেশাত্ববোধের প্রচলিত ধারণাটিকেই গোলওয়ালকর প্রশ্নায়িত করেন। তার মতে ‘ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদের সাধারণ শত্রুসম্বন্ধীয় তত্ত্বসমূহই হল মূল সমস্যা, আর এগুলিই হিন্দু জাতিয়তাবাদের ইতিবাচক প্রণোদনা থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে রেখেছে এবং আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে কেবল ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে পর্যবসিত করেছে। ব্রিটিশ বিরোধিতাকে দেশাত্ববোধ ও জাতীয়তাবাদের সঙ্গে একীভূত করে ফেলা হয়েছে। এই প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শ আমাদের সমগ্র স্বাধীনতাযুদ্ধ, আমাদের নেতা এবং জনগণের ওপর ভয়ংকর খারাপ প্রভাব বিস্তার করেছে’।
এই যুক্তিজাল থেকেই গোটা চল্লিশের দশক জুড়ে গোলওয়ালকরের আর এস এস সরে থেকেছে স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে। ৪২এর ভারত ছাড়ো আন্দোলন, আজাদ হিন্দ ফৌজ এর লড়াই, আজাদ হিন্দ ফৌজ এর সেনানিদের বিচারকে কেন্দ্র করে ১৯৪৫-৪৬ এর উত্তাল প্রতিরোধ বা নৌ বিদ্রোহ – কোনও কিছুতেই আর এস এস অংশগ্রহণ করেনি। বিপরীতে দাঙ্গার ঘটনাগুলিতে অতিসক্রিয় থেকেছে। এইসময় হিন্দু মৌলবাদ ও মুসলিম মৌলবাদ পরস্পর পরস্পরকে পাল্লা দিয়ে বাড়তে চেয়েছে এবং স্বাভাবিক নিয়মেই একে অপরকে পুষ্ট করেছে। মুসলিম লীগের মতো আর এস এসও এই পর্বে ব্রিটিশ এর যুদ্ধকালীন নিপীড়ণের মুখোমুখি হয় নি এবং গোটা পর্বটিকে সংগঠন বৃদ্ধির কাজে ব্যবহার করেছে। ১৯৪৫ এ আর এস এস দশহাজার স্বয়ংসেবকের এক শিক্ষাশিবিরের আয়োজন পর্যন্ত করেছে। এই সময় মুসলিম মৌলবাদেরও ভালোমাত্রায় বিকাশ হয়েছিল এবং মুসলিম লীগের পাকিস্থান দাবি ক্রমেই জোরালো হচ্ছিল। অনেকে মনে করতে শুরু করেছিলেন এই পরিস্থিতিতে কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আর এস এস ই তাদের ত্রাতা হতে পারে। বেশি সংখ্যক মুসলিম অধ্যুষিত প্রদেশগুলির হিন্দুদের একাংশের মধ্যে এই ভাবনা দানা বেঁধে উঠছিল, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ। কংগ্রেস নেতৃত্বের একাংশও আর এস এস এর প্রতি তাদের দুর্বলতা পোষণ করছিলেন। নেহরু আর এস এস প্রতি আগাগোড়া বিদ্বিষ্ট থাকলেও বল্লভভাই প্যাটেল তাদের প্রতি অনেকটাই সহানুভূতি সম্পন্ন ছিলেন। বেনিয়া গোষ্ঠী আর এস এস কে বিরাটভাবে মদত দিয়েছিল। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য শক্তিশালী বামপ্রভাব থাকায় বাংলাতে আর এস এস এর উত্থানকে প্রতিহত করা সম্ভবপর হয়েছিল।
১৯৪৬ এ জিন্না তথা মুসলিম লীগের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের ঘোষণা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাকে তীব্র করে তোলে। কোলকাতায় শুরু হয় নারকীয় দাঙ্গা ও বিহারের নোয়াখালি, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব সহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে তা ছড়িয়ে পড়ে। আর এস এস এই পর্বে হিন্দু মহাসভা ও অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির সঙ্গে মিশে দাঙ্গায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। দাঙ্গা বিধ্বস্ত মানুষের মধ্যে তাদের চালানো ত্রাণকার্য ও ব্যাপক সাম্প্রদায়িক প্রচার তাদের বিকাশকে ত্বরাণ্বিত করে।
আর এস এস এর কার্যক্রম ও বৃদ্ধিবিকাশে একটি বড় যতিচিহ্ন পড়ে গান্ধীহত্যার পর। গোটা দেশজুড়ে গান্ধীহত্যায় আর এস এস এর যুক্ত থাকার বিষয়টি নিয়ে আলোড়ন তৈরি হয়, আর এস এস-এর অফিস ও বাড়িগুলি গণক্রোধে ভাঙা হতে থাকে এবং ১৯৪৮ এর ৪ ফেব্রুয়ারী আর এস এস নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। আর এস এস নিষিদ্ধ হবার পর গোলওয়ালকর প্রাথমিকভাবে প্রতিবাদ আন্দোলন বা সত্যাগ্রহের পথ নিলেও দ্রুত তা পরিত্যাগ করেন এবং জাতীয় নেতৃত্বের কাছে নিষেধাজ্ঞা তোলার বিষয়ে অনুরোধ করা শুরু করেন। নেহরু ও প্যাটেল উভয়কেই তিনি আর্জি জানিয়ে চিঠি লেখেন। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এই সমস্ত চিঠিতে পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের উদাহরণ তুলে তিনি কমিউনিস্ট ভীতি জাগিয়ে তুলতে চান এবং জানান আর এস এস এর মতো সংগঠনই কমিউনিস্টদের প্রতিষেধক হতে পারে। কংগ্রেস রাজনৈতিকভাবে এবং আর এস এস সাংস্কৃতিকভাবে কমিউনিস্টদের মোকাবিলা করলে তবেই এদেশে ক্রমবর্ধমান কমিউনিজম এর প্রভাব থেকে ভালোভাবে রক্ষা পাওয়া সম্ভব হবে – এমনই ছিল তার অভিমত। কয়েকটি শর্ত পালনের প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে আর এস এস এর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয় ১২ জুলাই, ১৯৪৯। আর এস এস ও সরকারের মধ্যে এই পর্বের মধ্যস্ততাকারীদের অন্যতম ছিলেন জি ডি বিড়লার মতো শিল্পপতি। ১৯৬২ র চীন যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আর এস এস জাতীয় রঙ্গমঞ্চে তার গুরূত্ব ফিরে পায় এবং ১৯৬৩ র প্রজাতান্ত্রিক দিবসের শোভাযাত্রায় সে অংশগ্রহণও করে। ১৯৬৫ র ভারত পাকিস্থান যুদ্ধ আর এস এস এর বৃদ্ধি বিকাশের সহায়ক আবহাওয়া তৈরি করে।
এই সময়ে গোলওয়ালকর এর উদ্যোগে ১৯৬৪তে তৈরি হয় বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভি এইচ পি)। এর মধ্য দিয়ে একদিকে গোটা দেশের সাধু সন্তদের সঙ্গে আর এস এস সংযোগ তীব্র হয়, অন্যদিকে গোটা বিশ্বের হিন্দুসমাজকে ‘রক্ষা’ করতে ও ‘মর্যাদা’ দিতে তাকে এক বিশ্বজনীন অবয়ব দেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়। উত্তেজনা তৈরির রসদ সম্পন্ন বিভিন্ন সংবেদনশীল বিষয়কে ভি এইচ পি তার প্রচার আন্দোলনের বিষয় করে তুলতে থাকে এবং তীব্র সামাজিক মেরুকরণে সক্ষম হয়। ১৯৬৭ তে সে শুরু করে গোহত্যা বন্ধের দাবিতে এক জঙ্গী আন্দোলন। আশির দশক থেকে রামমন্দির আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ভারতীয় রাজনীতিতে আগ্রাসী হিন্দুত্বের রাজনীতির এক নতুন বিস্তার ঘটে। ভি এইচ পি অযোধ্যা, মথুরা ও কাশীতে মন্দির নির্মাণের জন্য ডাক দেয় এবং এই প্রশ্নটিকে ঘিরে দেশজোড়া ব্যাপক উন্মাদনা সৃষ্টিতে সক্ষমও হয়। ১৯৯২তে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর দেশজোড়া সমালোচনার মুখে দাঁড়িয়েও নিবৃত্ত হবার কোনও ইচ্ছে না দেখিয়ে সে স্লোগান তোলে ‘ইয়ে তো পহেলি ঝাঁকি হ্যায়/ আব তো কাশী মথুরা বাকী হ্যায়”।
আর এস এস সর্বব্যাপী প্রভাব বিস্তারের জন্য ভি এইচ পি সহ বিভিন্ন শাখা সংগঠনের ওপর আরো বেশি বেশি করে নির্ভর করতে থাকে। বিভিন্ন মাত্রার সচলতা সম্পন্ন অনেকগুলি সংগঠন সমৃদ্ধ একটি বৃহৎ সঙ্ঘপরিবারের সে জন্ম দেয়। সঙ্ঘ পরিবারের অংশ বা প্রত্যক্ষ প্রভাবাধীন এমন সংগঠন এর তালিকাটি বিরাট এবং আগ্রহোদ্দীপক। শিক্ষার ক্ষেত্রে আর এস এস এর নিয়ন্ত্রণাধীন বিদ্যাভারতী বেসরকারি শিক্ষাক্ষেত্রে অন্যতম বৃহৎ শিক্ষা বিষয়ক সংগঠন। ১৩,০০০ শাখা, ৭৫,০০০ জন শিক্ষক ও ১৭ লক্ষ বিদ্যার্থীর এই বিশাল কর্মকাণ্ডর মাধ্যমে আর এস এস তার প্রভাবকে ভালোভাবেই ছড়াতে সক্ষম হয়। উপজাতিদের নিয়ে রয়েছে আর এস এস-এর বনবাসী কল্যাণ আশ্রম, সাহিত্য সম্পর্কিত ভারতীয় সাহিত্য পরিষদ, বুদ্ধিজীবীদের সংগঠিত করার জন্য প্রজ্ঞা ভারতী আর দীনদয়াল গবেষণা কেন্দ্র, ইতিহাস সম্পর্কিত ভারতীয় ইতিহাস সংকলন যোজনা, শিক্ষকদের নিয়ে ভারতীয় শিক্ষক মণ্ডল আর অখিল ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শৈক্ষিক মহাসঙ্ঘ, ভাষা বিষয়ে সংস্কৃতি ভারতী, সংস্কৃতি বিষয়ে সংস্কার ভারতী, বস্তি সম্পর্কিত ক্ষেত্রে সেবা ভারতী, হিন্দু সেবা প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসা ক্ষেত্রে স্বামী বিবেকানন্দ মেডিক্যাল মিশন, ন্যাশানাল মেডিকোস, সমবায় সম্পর্কিত সমবায় ভারতী, গ্রাহকদের সংগঠন অখিল ভারতীয় গ্রাহক পঞ্চায়েত, মিডিয়া সংক্রান্ত ভারত প্রকাশন, সুরুচি প্রকাশন, জ্ঞানগঙ্গা প্রকাশন, লোকহিত প্রকাশন ইত্যাদি সহ আরো বেশ কিছু, বিজ্ঞান বিষয়ক বিজ্ঞান ভারতী, ধর্ম ও ধর্মান্তরীতকরণের জন্য বিবেকানন্দ কেন্দ্র, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, হিন্দু জাগরণ মঞ্চ, শিল্পপতিদের জন্য ভারত বিকাশ পরিষদ, যুবদের জন্য বজরং দল, ছাত্রদের জন্য অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ, অনাবাসী ভারতীয়দের জন্য ভারতীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ, ফ্রেন্ডস অব সোসাইটি ইন্টারন্যাশানাল, ট্রেড ইউনিয়ন ক্ষেত্রে ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ (বি এম এস), মহিলাদের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সেবিকা সমিতি, অর্থনীতি ক্ষেত্রে স্বদেশি জাগরণ মঞ্চ। আর এস এস-এর এই সুবিস্তৃত জাল এর রাজনৈতিক মুখ হিসেবে আছে ভারতীয় জনতা পার্টি, যা তৈরি হয়েছে প্রথমে হিন্দু মহাসভা ও পরে ভারতীয় জনসঙ্ঘের উত্তরাধিকার বহন করে।
আর এস এস বা ভি এইচ পির আন্দোলন অবশ্যই শুধুমাত্র কোনও ধর্মীয় আন্দোলন ছিল না, তা ছিল তার রাজনৈতিক মুখকে ক্ষমতার কাছাকাছি নিয়ে আসার জন্য এক সুচিন্তিত পরিকল্পনা। বস্তুতপক্ষে স্বাধীনতার পর থেকেই আর এস এস রাজনৈতিক কার্যক্রম সম্পর্কে নতুন করে ভেবেছে, সময় অনুযায়ী রণকৌশল বদলের নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছে। হিন্দু মহাসভার কমে আসা প্রভাবের প্রেক্ষিতে নতুন এক রাজনৈতিক দল গঠন বিষয়ে সে চিন্তাভাবনা করেছে। এরই ফসল হিসেবে মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং সঙ্ঘচালক গোলওয়ালকরের উদ্যোগে ১৯৫১ সালে জন্ম নেয় ভারতীয় জনসঙ্ঘ। ষাটের দশকে ভারত চিন যুদ্ধ ও ভারত পাক যুদ্ধের পর কংগ্রেস বিরোধী মানসিকতাকে উশকে দিতে সে নমনীয় রণকৌশল নেয় এবং বিভিন্ন অকংগ্রেসী দলের সঙ্গে বৃহত্তর ঐক্য স্থাপনের নীতি নেয়। জনসঙ্ঘের তৎকালীন নেতা দীনদয়াল উপাধ্যায় সরাসরি এই নীতি ঘোষণাও করেন। এমনকী কমিউনিস্টদের উপস্থিতি স্বত্ত্বেও বিহার এবং উত্তরপ্রদেশে সে অকংগ্রেসী সরকারের শরিক হয়েছিল । বলরাজ মাধোকের মতো যারা এর তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন তাদের জনসংঘের বাইরেই শেষপর্যন্ত চলে যেতে হয়। সংসদীয় রাজনীতির দিকে আর এস এস এর নজর কতটা তীব্র হয়েছিল তা বোঝা যায় যখন সে ৭০ দশকের প্রথম দিকে তার শাখাগুলির বিন্যাস সংসদীয় আসনের ভৌগোলিক চৌহদ্দি অনুসারে পুনর্গঠিত করে। শুধুমাত্র লোকসভা বা বিধানসভা নির্বাচনেই নয় বিভিন্ন শ্রমিক ইউনিয়ন, ছাত্র ইউনিয়ন বা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের নির্বাচনের দিকেও তার আগ্রহ প্রসারিত হয়।
আর এস এস এবং তার রাজনৈতিক মুখ ভারতীয় জনসঙ্ঘের কার্যকলাপ ১৯৭৪-৭৫ এ ইন্দিরা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে জয়প্রকাশ নারায়ণের দেশব্যাপী আন্দোলনের সময় এক অন্য মাত্রায় পৌঁছয়। আশ্চর্যজনক ভাবেই তারা এবং জয়প্রকাশ কিছুসময়ের জন্য পরস্পরের ঘনিষ্ট মিত্রে পরিণত হন। আর এস এস-এর নেতৃত্বে সঙ্ঘচালক হিসেবে তখন গোলওয়ালকরের মৃত্যুর পর অভিষিক্ত হয়েছেন দেওরাস। ১৯৭৪এর ডিসেম্বরে তিনি জয়প্রকাশকে ‘একজন সন্ত’ বলে উল্লেখ করেন। এমার্জেন্সী পর্ব শুরু হলে সঙ্ঘচালক দেওরাস গ্রেপ্তার হন, আর এস এস আবারো নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। এই সময় জনতা দল নির্মাণের প্রস্তুতি চলতে থাকে এবং আর এস এস তাতে সক্রিয়ভাবে মদত দেয়। ১৯৭৭এর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনতা দলের সরকার ক্ষমতায় আসে এবং প্রথমবারের জন্য কয়েকজন প্রথমসারির আর এস এস কর্মী কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হন, যাদের মধ্যে ছিলেন বাজপেয়ী এবং আদবাণী। জনসঙ্ঘ তার সমস্ত সদস্যদের জনতা দলে মিশিয়ে দেয় কিন্তু অচিরেই আর এস এস এর মধ্যে পূর্বতন জনসঙ্ঘীদের সদস্যপদ তথা যৌথ সদস্যপদের প্রশ্নটি নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়। শেষপর্যন্ত এই বিতর্কের ফলেই ১৯৭৯তে জনতা দল ভেঙে যায়। এই সময়ে জনতা দলে জনসঙ্ঘের ৯৩ জন এম পি ছিলেন। ১৯৮১তে ভারতীয় জনসঙ্ঘকে পুনর্জীবিত না করে জনতা পার্টির সাফল্যকে মাথায় রেখে নতুন নামে দল খোলা হয় ও নাম দেওয়া হয় ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)।
১৯৮৪র নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যু এবং সহানুভূতি হাওয়ার বিজেপি মাত্র দুটি আসনে নেমে যায়। দেশজুড়ে এই সময় আর এস এস ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদ নিয়ে আসে রামমন্দির নির্মাণের ইস্যুটিকে এবং যথেষ্ট সফলও হয়। ১৯৮৯তে প্রায় ৮৮টি সংসদ আসনে জেতে বিজেপি এবং ক্রমশ কেন্দ্রীয় ক্ষমতার দিকে এগোতে থাকে।
রাম রাজনীতির ঢেউয়ে ভর করে বিজেপি অচিরেই সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল হয়ে ওঠে এবং নির্বাচনের আগে পরে জোট রাজনীতির নতুন সমীকরণ বিন্যাসকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়। ১৯৯৯ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত বিজেপি তার নেতৃত্বাধীন এন ডি এ সরকার চালায় এবং এই সময় সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আর এস এস-এর বিভিন্ন অ্যাজেন্ডা জাতীয় কার্যক্রম হিসেবে সামনে আসে। ইতিহাসকে ইচ্ছামতো বিকৃত করা হয়, বিজ্ঞানের জগতে অধিবিদ্যা নানাভাবে প্রশ্রয় পায়, জ্যোতির্বিদ্যা ও জ্যোতিষশাস্ত্রকে পর্যন্ত মিলিয়ে মিশিয়ে নেওয়া হয়। তৎকালীন কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী মুরলী মনোহর যোশী শিক্ষার ব্যাপক গৈরিকীকরণের কাজ শুরু করেন। দশ বছর পর ২০১৪র লোকসভা নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের সূত্রে একক শক্তিতে কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করল বিজেপি আর আমরা দ্রুতই দেখলাম আর এস এস আরো জোরেশোরে গৈরিকীকরণের কাজ শুরু করেছে। এবারের কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী স্মৃতি ইরানী ঘন ঘন বৈঠক করছেন আর এস এস নেতৃবৃন্দের সঙ্গে। দীননাথ বাত্রা ইতিহাস সংসদের কর্ণধার হিসেবে ইতিহাস বিকৃতির খেলা শুরু করেছেন মারাত্মকভাবে। তাঁর লেখা বইতে কখনো বৈদিক যুগে মোটর গাড়ি আবিষ্কারের কথা বলা হচ্ছে তো কখনো গান্ধারীর সন্তান জন্মের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে স্টেম সেল রিসার্চ এর কথা, সঞ্জয় প্রসঙ্গে আসছে টেলিভিশন আবিষ্কারের লোমহর্ষক সিদ্ধান্ত। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মোদী গণেশের কাটা মুণ্ড জোড়ার পৌরাণিক কাহিনীতে প্লাস্টিক সার্জারির নিদর্শন খুঁজে পাচ্ছেন বৈদিক যুগে, আর বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ জানিয়ে দিচ্ছেন ‘গীতা’কে জাতীয় গ্রন্থ করার ভাবনা চিন্তা করছে সরকার। বলপূর্বক ধর্মান্তরের আয়োজন করছে হিন্দুত্ববাদীরা, নাম দেওয়া হচ্ছে ‘ঘরবাপসি’ বা ঘরে প্রত্যাবর্তন। সমস্ত ভারতীয়ই আবশ্যিকভাবে রামজাদা, রামের সন্তান – এমন নিদান দিচ্ছেন মন্ত্রী আর যারা তা মানতে রাজী নয় তাদের দেগে দিচ্ছেন হারামজাদা বলে। ছেলেমেয়েদের খোলামেলা মেলামেশাকে লাভ জেহাদ নাম দিয়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করা হচ্ছে, নির্বাচনী বৈতরনি পার হতে লাগানো হচ্ছে পরিকল্পনামূলক দাঙ্গা, যাকে আর এস এস বরাবরই সংগঠন বৃদ্ধির অন্যতম কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে এসেছে।
আজকের বিজেপির হিন্দুত্ববাদী বিভিন্ন অ্যাজেণ্ডাকে তার মতাদর্শগত নির্দেশক আর এস এস-এর ইতিহাস-দর্শন থেকে বুঝে নেবার সঙ্গে সঙ্গে এটাও মাথায় রাখার আজকের শাসকশ্রেণী তথা কর্পোরেট ক্যাপিটালের কাছে এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি জনগণের বিশেষত শ্রমজীবী মানুষের ঐক্য ও আন্দোলনকে ভেঙে দেবার অন্যতম কার্যকর হাতিয়ার হিসেবেই এত মদত পেয়ে থাকে।
আজকের বিজেপি নিঃসন্দেহে তার পূর্বসরী জনসঙ্ঘের অবিকল অনুকৃতি নয়, এমনকী ৯০ এর দশকের শুরুতে জাতীয় রাজনীতিতে অন্যতম প্রধান শক্তি হয়ে ওঠার পর্বে তার যে চরিত্র ছিল তার থেকেও খানিকটা আলাদা। কংগ্রেসকে পেছনের আসনে ঠেলে দিয়ে সেই এখন কর্পোরেট পুঁজির প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠেছে এবং দেশি বিদেশি একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থে সবচেয়ে আগ্রাসী শক্তি হিসেবে কাজ করছে। মিডিয়ার একাংশ বিজেপি ও মোদির কেবল ‘উন্নয়ন সর্বস্ব মুখ’কেই আমাদের সামনে তুলে ধরতে চাইলেও ঘটনাধারা দেখিয়ে দিয়েছে বিজেপি বা তার সামনের সারির নেতারা তাদের হিন্দুত্বের রাজনীতিকে কখনোই পেছনের সারিতে ঠেলে দেয় নি, বরং সর্বদাই তাকে অবলম্বন করে এগোতে চেয়েছে। সাম্প্রতিক সময়েও লোকসভা নির্বাচনের আগে পরে ধর্মীয় মেরুকরণ, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানো বিভিন্ন মন্তব্য ও কার্যকলাপ, পরিকল্পিত দাঙ্গা ও সংখ্যাগুরুর মৌলবাদকে চাপিয়ে দেওয়ার মতো ভয়ংকর সমস্ত ঘটনা বারেবারেই সামনে এসেছে।
‘কর্পোরেট কমিউনাল’ শক্তি, বিজেপির পুঁজির পক্ষে দাঁড়িয়ে চালানো আগ্রাসন আর তার মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মধ্যকার পরস্পর সম্পর্ককে বুঝে নেওয়া কঠিন কিছু নয়। মেহনতি মানুষের ঐক্যকে বিভক্ত করার এবং তাদের লড়াই আন্দোলন দাবি দাওয়ার বিষয়গুলিকে উত্তেজনার ইন্ধন সমৃদ্ধ বিভিন্ন ইস্যু দ্বারা প্রতিস্থাপিত করার সবচেয়ে সহায়ক কৌশল হিসেবেই বিজেপি সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে ব্যবহার করে থাকে। সাম্প্রতিক বিজেপি সরকারের কার্যকলাপের একটি দিক যদি ‘রামজাদা –হারামজাদা’ তত্ত্বায়নের মধ্য দিয়ে হিন্দুত্ব-ভারতীয়ত্বের সমীকরণ কষা হয়, তবে অপর দিকটি অবশ্যই আদানি আম্বানির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর প্রকাশ্য ঘনিষ্ঠতা, মেক ইন ইন্ডিয়ার নামে এফ ডি আইকে সাড়ম্বর আহ্বান আর শ্রম আইন, জমি অধিগ্রহণ নীতি, বিলগ্নীকরণ সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তড়িৎ গতির সমস্ত সংস্কারের পরস্পর সংযুক্ত এক বহুবর্ণ ছবির কোলাজ। নয়া উদারনৈতিক রাজনীতি অর্থনীতির বিরুদ্ধে শ্রমজীবী মানুষের লড়াই আর উগ্র হিন্দুত্বের আধিপত্যবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে বহুস্বর সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে রক্ষার গণতান্ত্রিক লড়াই এখন একসঙ্গে মিলেছে।
উপমহাদেশ ও মুসলিম সাম্প্রদায়িক রাজনীতি : প্রাক স্বাধীনতা পর্ব
বিজেপি বা হিন্দুত্ববাদীদের দিক থেকে সচেতনভাবেই বারবার সামনে আনা হয় মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নটি। আজকের দিনে বিশ্বজুড়ে পলিটিকাল ইসলাম এর উত্থান ও মৌলবাদীদের ইসলামের নামে চালানো নানা তাণ্ডব কতটা মুসলিম ধর্ম-দর্শনের ‘অনিবার্য আগ্রাসন’ আর কতটা সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা তার স্বার্থে সৃষ্ট, তার আলোচনা, সে সম্পর্কে ইতিহাসানুগ বিশ্লেষণ বিশেষভাবেই জরুরী। সেই বিস্তৃত পরিসরে বর্তমান প্রবন্ধে আমরা খুব একটা প্রবেশ করতে চাইছি না। আগ্রহী পাঠক এই অংশটির জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতি সমৃদ্ধ বিশ্লেষক সমীর আমীন এর ‘মান্থলি রিভিউ’-এ প্রকাশিত পলিটিকাল ইসলাম শীর্ষক আলোকসম্পাতি প্রবন্ধটি দেখতে পারেন।
আমরা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটটির সূত্র মাথায় রেখে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম সমাজের একটি অংশের সম্প্রদায়গত চিন্তা কীভাবে কোন প্রেক্ষাপটে আত্মপ্রকাশ করেছে ও তা সমাজ রাজনীতিকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে, তার মধ্যেই আপাতত সীমাবদ্ধ থাকতে চাইছি।
নিঃসন্দেহে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার বিশেষ একটি ধরণ ভারতের ক্ষেত্রে সামনে আসে স্যর সৈয়দ আহমেদ ও তার আলিগড় আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। হিন্দু এলিট ও তার সঙ্গে শাসকের বোঝাপড়ার বিপরীতে তা শাসক ইংরেজের সঙ্গে এক বোঝাপড়ায় নিয়ে আসতে চায় তখনো পর্যন্ত এই নিরিখে অনেকটাই পরান্মুখ মুসলিম সমাজকে। সৈয়দ আহমেদ ও আমীর আলির নেতৃত্বাধীন মুসলিম সমাজ সংস্কার আন্দোলনের কথায় আসার আগে অবশ্য আমাদের ফিরে তাকাতে হবে উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশক নাগাদ (রামমোহনের সংস্কার আন্দোলনের পর্বেই) বিশ্বজোড়া মুসলিম মানসের মধ্যে ওঠা এক ঢেউ এর দিকে, কেননা ভারতের মধ্যেও তা ভালোমাত্রাতেই আলোড়ন তুলেছিল এবং যথেষ্ট সামাজিক ভিত্তি খুঁজে নিয়েছিল। পাঠক বুঝতে পারছেন আমরা ওয়াহাবী আন্দোলনের কথাই বলছি।
ওয়াহাবী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল ওয়াহাব ছিলেন মিশরের বাসিন্দা। তার প্রচারিত একটি মতবাদ মুসলিম সমাজে বিশেষ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, যার মূল কথা ছিল – নানা বহিরঙ্গের আচার অনুষ্ঠান ও পুরোহিততন্ত্রের প্রভাব ইসলামের প্রাণশক্তিকে খর্ব করছে, অতএব ইসলামের বিশুদ্ধি প্রয়োজন এবং এই বিশুদ্ধিকরণ অভিযান সার্থক করতে হলে সর্বত্র ইসলামিক বাদশাহী প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। প্যান ইসলামিক এই আন্দোলনের সঙ্গে ভারত ভূখণ্ডের মুসলিম সমাজের সম্পর্ক তৈরি করে দেন উত্তরপ্রদেশের রায়বেরিলির অধিবাসী সৈয়দ আহম্মদ ব্রেলভি। ১৮২২-২৩ খ্রীষ্টাব্দে তিনি মক্কায় যান ও সেখানে ওয়াহাবী মতবাদে প্রাণিত হন। দেশে ফিরে ব্রেলভি নিজেকে ইমাম বলে ঘোষণা করে ওয়াহাবী মতাদর্শ প্রচার করতে থাকেন। বলেন – যারা মুসলমান নয় – অর্থাৎ হিন্দু শিখ খ্রীষ্টান প্রভৃতি – তারা সকলেই দার – উল-হাবাব বা ঈশ্বরের শত্রু। তাদের বিরুদ্ধে জেহাদ প্রত্যেক মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য। পেশোয়ারের সন্নিহিত উপজাতি এলাকা থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে সৈয়দ আহম্মদ ব্রেলভি ১৮২৬ খ্রীষ্টাব্দে শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ইংরেজরা এই সংবাদ পেয়েও এতে কোনও হস্তক্ষেপ করে নি। বহু নরসংহারের মাধ্যমে ওয়াহাবীরা পেশোয়ার অধিকার করে এবং কোয়ায়েৎ উপত্যকার সিত্তানাতে একটি ক্ষুদ্র ওয়াহাবী রাজ্য স্থাপনে সমর্থ হয়। এক বছরের মধ্যেই অবশ্য ব্রেলভি যুদ্ধে নিহত হন ও সিত্তানা রাজের পতন হয়। ওয়াহাবীদের বিদ্রোহমূলক অভিযান অবশ্য চলতে থাকে এবং ১৮৬৩ সালে ওয়াহাবীরা সিত্তানা পুনর্দখলে সমর্থ হয়। বাংলার তিতুমীরের বিদ্রোহ বা ফরাজী আন্দোলন এর মধ্যে কৃষক আন্দোলনের মর্মবস্তুর সঙ্গেই ওয়াহাবী আন্দোলনের প্রেরণা বহুলাংশে মিশে ছিল। বস্তুতপক্ষে ফরজ বা মুসলমানদের পালনীয় কর্তব্যের সূত্রেই ফরাজী আন্দোলনের এরকম নাম হয়। এই আন্দোলনের মূল প্রবক্তা শরিয়ৎউল্লা মক্কায় হজ করতে গিয়ে ওয়াহাবী মতাদর্শে দীক্ষিত হন। তার পুত্র দুদুমিঞা এই আন্দোলনকে অনেক বিস্তৃত করেন। তিতুমীরও মক্কায় হজ করতে গিয়েই ওয়াহাবী মতবাদে দীক্ষিত হয়েছিলেন এবং দেশে ফিরে ওয়াহাবী মতবাদ প্রচারের জন্য একটি দল গঠন করেন।
ইংরেজদের সঙ্গে মুসলিম সমাজের বোঝাপড়ার বেশ অভাব ছিল এবং ১৮৫৭ র মহাবিদ্রোহের পর পারস্পরিক অবিশ্বাস ও তিক্ততা বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু শাসন প্রণালীর নিরিখ থেকে বিরাট জনসংখ্যার মুসলিম সমাজের সঙ্গে ইংরেজদের বোঝাপড়ার প্রয়োজনীয়তাও অনুভূত হয়েছিল। সাম্রাজ্যের শোষণ ও শাসনকে নিরঙ্কুশ রাখার জন্য ভারতবর্ষ শাসনের ক্ষেত্রে বহুখ্যাত ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসি গ্রহণের একটা তাগিদও রাজনৈতিক প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গ অনুভব করেছিলেন। বস্তুতপক্ষে মহাবিদ্রোহের আগে কোম্পানির শাসন চলাকালীনই এটা অনুভূত হয়েছিল। পরবর্তীকালে এলফিনস্টোন এরকম কথাই রাজকর্মচারিদের পরামর্শ দিতে গিয়ে সরাসরি বলেছিলেন। তখন অবশ্য মহাবিদ্রোহ হয়ে গিয়েছে এবং কোম্পানীর শাসনের জায়গায় সরাসরি রাণীর শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মহাবিদ্রোহের ব্যর্থতায় মুসলিম সমাজ তখন হতাশাগ্রস্থ এবং অভিমানে তারা ইংরেজদের নিয়ে আসা আধুনিকতা থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখেন। অনেক শিক্ষিত আধুনিক মনস্ক মুসলিম মনে করতে থাকেন এটা মুসলিম সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর হচ্ছে। জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর তাকে হিন্দুদের প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করেও মুসলিম এলিট সমাজের অনেকে শাসক ইংরেজদের সঙ্গে মুসলিমদের সংযোগের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। এই সংযোগের প্রাথমিক দুই কারিগর ছিলেন স্যর সৈয়দ আহম্মদ ও সৈয়দ আমির আলি।
আমির আলি মুসলিমদের উন্নতির জন্য ১৮৭৭ সালে তৈরি করেন ন্যাশানাল মহমেডান সোসাইটি। পরে একে সর্বভারতীয় চরিত্র প্রদানের সময় এর নাম দেওয়া হয় সেন্ট্রাল মহমেডান সোসাইটি। আমির আলির মতবাদের মধ্যে ইতিহাস বিকৃতির মধ্য দিয়ে মুসলিম জয়গানের প্রবণতা প্রকট। তিনি বলেছিলেন ভারতবর্ষের ইতিহাসের সূচনা হয় ভারতে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকে, তার আগে ভারতের কোনও ইতিহাস ছিল না। আমির আলি এলিট মুসলিমদের একাংশের সঙ্গে ইংরেজদের সম্পর্ক স্থাপনের গোড়াপত্তনের কাজটি করেছিলেন ইংরেজদের প্রতি সম্পূর্ণ অনুগত্য রেখেই। ভারতবর্ষের ইংরেজ শাসকদের তিনি পিতৃস্থানীয় মনে করতেন। মুসলিম সমাজের প্রতিস্পর্ধী হিসেবে তিনি ইংরেজ নয়, হিন্দুদেরই দাঁড় করিয়েছিলন।
স্যর সৈয়দ আহমেদ ১৮৫৭ র মহাবিদ্রোহের সময় বিদ্রোহ দমনে ইংরেজদের নানাভাবে সহায়তা দিয়েছিলেন। এর পুরস্কার হিসেবে ইংরেজ সরকার তাকে মাসিক দুশো টাকা বিশেষ পেনসন মঞ্জুর করেন। মহাবিদ্রোহের পরবর্তী বছরগুলিতে মুসলিমদের মধ্যে ইংরাজী শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে তিনি সচেষ্ট হন। এই উপলক্ষ্যেই ১৮৭৫ সালে আলিগড়ে তৈরি হয় মোহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ। অনতিবিলম্বে আলিগড় মুসলিম রাজনীতির কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। ১৮৮৭ খ্রীষ্টাব্দে লক্ষনৌতে এক প্রকাশ্য বক্তৃতায় তিনি মুসলিমদের জাতীয় কংগ্রেসের বিরোধিতা করার জন্য আহ্বান জানান। অতঃপর এই কাজ তিনি নানাভাবে চালিয়ে যান এবং আলিগড় কলেজের শিক্ষকদেরও এই কাজে নিযুক্ত করেন। আধুনিক ভারতের সম্প্রদায়ভিত্তিক রাজনীতির প্রথম দিককার কাণ্ডারীদের মধ্যে সৈয়দ আহম্মেদ অন্যতম। অথচ অবাক করার মত বিষয় একসময় তিনি বলেছিলেন, “ আমি আন্তরিকভাবে আমার দেশ এবং জাতির সেবা করতে চাই। জাতি কথাটি দিয়ে আমি হিন্দু এবং মুসলমান উভয়কেই বোঝাতে চাইছি। কেননা আমার জাতি কথাটির এইটেই একমাত্র অর্থ”। ১৮৮৪ সালে দেওয়া এই বক্তৃতা তিন বছরের মধ্যেই বদলে গেল। ১৮৮৭ সালে তিনি মতাদর্শ সম্পূর্ণ পালটে বললেন, “ যখন আমাদের হিন্দু ভাইরা অথবা বাঙালি বন্ধুরা এমন কিছু করতে চান যাতে আমাদের ক্ষতি হবে এবং আমাদের জাতির অপমান হবে তখন আমরা তাদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন থাকতে পারি না এবং তখন আমাদের অবশ্যই কর্তব্য হবে হিন্দু এবং বাঙালিদের আক্রমণ থেকে আমাদের জাতিকে রক্ষা করা – এই আক্রমণ যে আমাদের জাতির ক্ষতি করবে সে বিষয়ে আমরা নিশ্চিত”। কংগ্রেসের প্রতি তীব্র বিদ্বেষই তার মতাদর্শ পরিবর্তনের কারণ কিনা সে অনুমান অনেকেই করতে চাইবেন। বস্তুতপক্ষে ১৮৮৯এ তিনি সরাসরি বললেন, “ কংগ্রেসের প্রস্তাবগুলি যে দেশে দুটি স্বতন্ত্র জাতি বাস করে সেই দেশের পক্ষে নিতান্তই অযৌক্তিক। ধরে নেওয়া গেল সব ইংরাজ ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে গেল। তখন কারা ভারতবর্ষ শাসন করবে ? এটি কি সম্ভব যে এইরকম অবস্থায় হিন্দু এবং মুসলমান দুটি জাতি একই সিঙ্ঘাসনে অধিরুঢ় হবে এবং ক্ষমতার ক্ষেত্রে উভয়েই হবে সমান ? তা কখোনোই হতে পারে না। যা হবে তা হল একটি অপরকে পরাভূত করবে এবং নিপীড়িত করবে। দুটিতে সমান হয়ে থাকবে এমন আশা করা হল অসম্ভব এবং অভাবনীয়কে প্রত্যাশা করা”।
এই ভাবনাকে ইংরেজরা অবশ্যই উশকে দিতে চেয়েছিল এবং মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থার দিকে এগিয়েছিল। বস্তুতপক্ষে কোনও মুসলিম ব্যক্তি বা সংগঠনের তরফে এরকম ভাবনা আসার আগে লর্ড ডাফরিনই ১৮৮৮ সালে এরকম একটি প্রস্তাব আনেন। এর অনেক পরে ১৯০৯ সালে ভাইসরয় লর্ড মিন্টোর কাছে মুসলিমদের পক্ষ থেকে এই দাবি তোলা হয়। লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনা প্রত্যক্ষভাবে একটি মুসলিম সংখ্যাগুরু প্রদেশ ও একটি অবাঙালি সংখ্যাগুরু প্রদেশ তৈরির মাধ্যমে বাঙালি হিন্দুর বিকাশমান জাতীয়তাকে প্রতিহত করতে চেয়েছিল। ঢাকার নবাবের প্রাসাদে মুসলমান নেতাদের কার্জন সরাসরি বলেছিলেন, “আমি আপনাদের একটি মুসলিম প্রদেশ দিচ্ছি”। তীব্র গণ আন্দোলনের মুখে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব শেষপর্যন্ত বাতিল করে দিতে হয় এবং এতে অনেক মুসলমান নেতা প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন।
বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা থেকে পিছু হঠতে বাধ্য হয়ে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার কথা ভাবেন। সরকার লক্ষ্য করেছিল আমির আলি বা সৈয়দ আহমেদের মত মানুষদের প্রভাব উচ্চবিত্ত এবং প্রতিষ্ঠিত মুসলিমদের একাংশের মধ্যেই বিদ্যমান। সাধারণ মুসলিম সমাজ রাজনীতি সচেতন হয়ে ওঠে নি। মুসলিম নেতারাও সংঘবদ্ধ ছিলেন না। ধর্মীয় বিভেদের রাজনীতিকে ব্যাপক জনগণের মধ্যে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে সাংগঠনিক উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা ইংরেজরা চতুর মস্তিষ্কে অনুভব করে। ১৯০৬ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজদেরই সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলিম লীগের জন্ম হয়। আগা খাঁর নেতৃত্বে এক প্রতিনিধি দল ভাইসরয়ের সঙ্গে দেখা করে মুসলিম সমাজের জন্য পৃথক নির্বাচনের দাবি জানিয়েছিলেন। ভাইসরয় সেই দাবি সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনার আশ্বাস দেন। ওই বছরেই ৯ অক্টোবর নবাব সালিমুল্লা একটি বিবৃতি প্রকাশ করে অল ইন্ডিয়া মুসলিম কনফারেন্স নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলার কথা বলেন। এর কিছু দিন পরে ডিসেম্বর মাসে ঢাকা শহরে মুসলিম শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেই অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের জন্ম হয়। মুসলিম লীগ বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়। সে সময় অনেক মুসলিম নেতা বঙ্গভঙ্গকে সমর্থন করেন নি, যেমন আগা খাঁ। এজন্য তাকে যথেষ্ট সমালোচিত হতে হয় এবং তিনি মুসলিম লীগের সভাপতির পদ থেকে সরে আসতে বাধ্য হন। মুসলিম লীগের দ্বিতীয় সাধারণ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ১৯০৮ সালে, আলিগড়ে। এখানে বঙ্গব্যবচ্ছেদকে অভিনন্দন জানিয়ে ও স্বদেশী আন্দোলনের নিন্দা জানিয়ে প্রস্তাব পাশ হয়েছিল। একদিকে হিন্দু মহাসভা ও পরবর্তীকালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ অন্যদিকে মুসলিম লীগ হিন্দু ও মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার মূল নির্যাসকে বহন করে এগিয়ে চলে।
বঙ্গভঙ্গ ছাড়া প্রথম পর্বের মুসলিম লীগের অন্যতম আগ্রহের বিষয় ছিল মর্লে মিন্টো সংস্কার। এই শাসন সংস্কারে মুসলিমদের জন্য পৃথক নির্বাচন প্রথার কথা বলা হয়। এই পৃথক নির্বাচন প্রথা পরবর্তীকালের ভারত বিভাজনের ভ্রূণ, এমনটাই অনেকে মনে করেছেন। জাতীয় আন্দোলনের মধ্যে থেকে এই শাসন সংস্কারের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ উত্থাপিত হয়েছিল। ১৯১০ খ্রীষ্টাব্দে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের তৃতীয় সাধারণ অধিবেশন কিন্তু মর্লে মিন্টো সংস্কারকে অভিনন্দন জানায় এবং এই সংস্কারের বিরুদ্ধে চলা আন্দোলন বিষয়ে দেশবাসীকে সতর্ক করে।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের প্রবল চাপে ব্রিটিশ সরকার শেষপর্যন্ত বঙ্গভঙ্গর সিদ্ধান্ত বাতিল করেন। এই সিদ্ধান্ত মুসলিম লীগকে আশাহত করে এবং জন্মের পর থেকে তাদের শাসক আনুগত্যে প্রথম বারের জন্য চিড় ধরায়। সমকালে ইউরোপীয় ভূখণ্ডের বেশ কিছু ঘটনা ভারতীয় মুসলিম নেতৃত্বের সঙ্গে শাসকদের দূরত্ব বাড়িয়ে তোলে। ১৯১২ সালে বলকান যুদ্ধ হয় এবং তার জেরে তুরস্ক সাম্রাজ্য ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তুর্কীর সুলতান মুসলিম জগতের সর্বোচ্চ ধর্মগুরু বা খলিফা হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন। বলকান যুদ্ধের ফলে তুরস্ক সাম্রাজ্যের বিস্তীর্ণ এলাকা বিভিন্ন ইউরোপীয় শক্তির দখলে চলে যায়। ব্রিটেন তুর্কি সাম্রাজ্যের অঙ্গচ্ছেদে পরোক্ষে ব্যাপক সহায়তা করেছিল। ভারতের মুসলিম নেতৃত্বের একাংশের অবিচল ব্রিটিশ ভক্তি এর ফলে নড়ে গিয়েছিল। মুসলিম লীগের অবস্থান এই সময় থেকে কিছুটা পাল্টাতে শুরু করে এবং কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে তার কিছু নতুন সমীকরণ তৈরি হয়।
মহম্মদ আলি জিন্নার মত অনেকেই এসময় একইসঙ্গে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সদস্য ছিলেন। জিন্না স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছিলেন ভারতের জাতীয় স্বার্থে তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে আছেন এবং মুসলিমদের সাম্প্রদায়িক স্বার্থে তিনি মুসলিম লীগের সঙ্গে আছেন। ১৯১৬ র লক্ষনৌ চুক্তির মধ্যে দিয়ে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের নেতারা প্রথমবারের জন্য কাছাকাছি আসেন এবং এতে জিন্নার বিশেষ ভূমিকা ছিল। এই সময় থেকে ১৯১৯ এ খিলাফৎ আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনের যৌথ সূচনা পর্যন্ত সময়কালটি উপমহাদেশে হিন্দু মুসলিম ঐক্যের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্ব ছিল। অসহযোগ আন্দোলন আকষ্মিকভাবে প্রত্যাহার করার পর ঐক্যের সম্পর্কে অনেকটাই ফাটল ধরে এবং দাঙ্গার বিভিন্ন ঘটনা ঘটতে থাকে। ১৯২৩ এ সাভারকরকে ঘিরে হিন্দু মহাসভার পুনরুজ্জীবন পর্ব শুরু হলে মুসলিম লীগের সক্রিয়তাও নতুন গতি পায়। প্রতিষ্ঠার কিছুদিন পর থেকেই উপযুক্ত কর্মসূচী ও যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে লীগের কাজকর্মে কিছু ভাঁটা পড়েছিল। হিন্দু মহাসভার সক্রিয়তা, পৃথক নির্বাচনের দাবি এবং দেশে সাধারণ নির্বাচন মুসলিম লীগের কাছে একটি বড় কর্মসূচী উপস্থিত করে। বস্তুতপক্ষে পৃথক নির্বাচন, আসনের সংরক্ষণ কেন্দ্রিক বাঁটোয়ারা, শাসন সংস্কার দেশভাগের প্রত্যক্ষ দাবি ওঠার আগে পর্যন্ত সম্প্রদায়ভিত্তিক রাজনীতির অন্যতম বিষয় ছিল আর সম্প্রদায় ভিত্তিক নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দাঙ্গার পরিকল্পিত আয়োজনও আমরা ভালোভাবেই লক্ষ্য করি।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পর্বে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তারে পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর ধারণার প্রবর্তন একটি প্রভাবসঞ্চারী বিষয়। সংখ্যালঘু সহ বিভিন্ন অংশের জন্য উপযুক্ত আসন সংরক্ষণ এক জিনিস আর পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর ধারণা আর এক। আসন সংরক্ষণ করলেও যদি পৃথক নির্বাচক মণ্ডলীর পরিবর্তে সাধারণ অর্থাৎ মূলত হিন্দু মুসলিম যৌথ নির্বাচকমণ্ডলী থাকে, তবে মুসলিম সম্প্রদায়ভূক্ত প্রার্থীকেও জয়ের জন্য হিন্দু ভোটের ওপর নির্ভর করতে হবে বা হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রার্থীকে মুসলিম বা ক্ষেত্রবিশেষে অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ভোটের ওপর। এক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতাবাদী দুর্বুদ্ধির প্রশ্রয় সম্ভাবনা তুলনায় কম। বিপরীতে হিন্দু নির্বাচকমণ্ডলী দ্বারা হিন্দু প্রতিনিধি ও মুসলিম নির্বাচকমণ্ডলী দ্বারা মুসলিম প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে অবাধে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির প্রচারের সম্ভাবনা থাকে। এই সম্ভাবনার আশঙ্কা বিভিন্ন নির্বাচনের আগে পরে বাস্তব চেহারায় আত্মপ্রকাশ করেছিল এবং নির্বাচনের আগে পরে বহু সংখ্যক দাঙ্গার ঘটনা ঘটত। যেমন ১৯২৬ সালে সাধারণ নির্বাচনের আগে ওই বছরেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পঁয়ত্রিশটি ছোট বড় হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। নির্বাচনে ভোট আদায় করার জন্য সাম্প্রদায়িক প্রচারকে বাড়িয়ে দেওয়া হয়। লালা লাজপত রায়, পণ্ডিত মদন মোহন মালব্য হিন্দু ভোটারদের নিজেদের দিকে আনতে যেভাবে সক্রিয় হয়েছিলেন তার স্বরূপ বিশ্লেষণ করলেও এটা ধরা পড়ে।
পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী দ্বারা তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের বিষয়টি লক্ষ্নৌ চুক্তির (১৯১৬) সময় কংগ্রেস নেতৃত্বও মেনে নিয়েছিলেন। উদারনৈতিক দৃষ্টিকোণে সাম্প্রদায়িক দূরত্বকে কমিয়ে আনার এই প্রচেষ্টা বাস্তবে বিপরীত ফলই দিয়েছিল। উল্লেখযোগ্য বিষয় প্রথম পর্বে জিন্না নিজেও এ কারণে পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর ধারণাকে সমালোচনা করেছিলেন, ১৯১০ সালে এর বিরোধিতা করে তিনি একটি প্রস্তাবও উত্থাপন করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে অবস্থান সম্পূর্ণ বদলে ফেলে তিনি পৃথক নির্বাচন সমর্থন করে সাম্প্রদায়িকতার বোধকে প্রশাসনের মধ্যে যুক্ত করতে সাহায্য করেন। মুসলিম সমাজের অবিসংবাদী নেতা হিসেবে উঠে আসায় জিন্নার সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ ছিল। কংগ্রেসের ভেতরের মুসলিম নেতৃত্ব যেমন একদিকে ছিলেন, তেমনি অন্যদিকে ছিলেন কংগ্রেসের বাইরের বিভিন্ন মুসলিম নেতা, যেমন বাংলায় কৃষক প্রজা পার্টির ফজলুল হক, পাঞ্জাবের ইউনিয়নিস্ট পার্টির সিকান্দর হায়াত খাঁ, সিন্ধুপ্রদেশে আল্লা বক্স, উত্তরপ্রদেশে খালিকুজ্জমান। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে খালিকুজ্জমান জিন্নার শিবিরে যোগ দেন। পরবর্তীকালে কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা কংগ্রেসের অনাগ্রহে ব্যর্থ হবার পর ফজলুল হক জিন্নার দিকে সরে যান। এক্ষেত্রে কংগ্রেসের অবিমিশ্রকারিতা জিন্নার অপ্রতিহত উত্থান ও দেশভাগের রাজনীতির বিস্তারে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছিল। বস্তুতপক্ষে আধুনিক ভারতের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিস্তারের ক্ষেত্রে হিন্দু মহাসভা-আর এস এস এবং মুসলিম লীগ দ্বিত্বের বাইরে কংগ্রেসের অবস্থান কী ছিল, সেটাও বিবেচ্য।
১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর থেকে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ক্রমাগত বাড়তে থাকে এবং দেশভাগের মধ্যে দিয়ে তা চূড়ান্ত পরিণতি পায়। ৮৩৬টি অমুসলমান আসনের মধ্যে কংগ্রেস ৭১৫টিতে জয়লাভ করে। কিন্তু মুসলিমদের জন্য সংরক্ষিত ৪৮৫টি আসনের মধ্যে ৮৫টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে কংগ্রেস মাত্র ২৬টি আসনে জয়ী হতে সমর্থ হয়। মুসলিম আসনের ক্ষেত্রে অবশ্য মুসলিম লীগও সর্বত্র বিশেষ সাফল্য পায় নি। পাঞ্জাবে মুসলিম লীগ ৮৬টি মুসলিম আসনের মধ্যে মাত্র দুটি পায়। বাংলায় ১১৯টির মধ্যে পায় ৪০টি। সিন্ধুপ্রদেশ এবং উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে একটি মুসলিম আসনেও তারা জিততে পারে নি। বিহারে ২৯টির মধ্যে ২০টিতে, মাদ্রাজে ২৮টির মধ্যে ১১টিতে এবং উত্তরপ্রদেশে ৬৪টি মুসলিম আসনের মধ্যে ২৭টিতে তারা জয়লাভ করে। কংগ্রেস কোথাও মুসলিম লীগের সঙ্গে যৌথভাবে মন্ত্রীসভা গঠনে রাজী হয় নি এবং এই সিদ্ধান্ত বিশেষত উত্তরপ্রদেশকে কেন্দ্র করে জিন্নাকে রুষ্ট করেছিল। যৌথভাবে মন্ত্রীসভা গঠনের ক্ষেত্রে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ নেতৃত্বের মধ্যে অবশ্যই আলোচনা হয়েছিল কিন্তু কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধান সূত্র মেলে নি। কংগ্রেসের দুই সামনের সারির নেতা মৌলানা আবুল কালাম আজাদ এবং জহরলাল নেহরু উত্তরপ্রদেশে যৌথ মন্ত্রীসভা গঠনের বিষয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থানে ছিলেন। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়া গোবিন্দবল্লভ পন্থ মুসলিম লীগ নেতা খালিকুজ্জমান এর সঙ্গে বৈঠক করে কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা বিষয়ে অনেকদূর এগিয়েছিলেন। মৌলানা আজাদও খালিকুজ্জমান এর সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকের পর খালিকুজ্জমান এবং নবাব ইসমাইল খাঁ মন্ত্রীসভায় যোগ দিতে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু নেহরু আজাদের সঙ্গে পরামর্শ না করেই কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠনের সম্ভাবনা বাতিল করে দেন। কংগ্রেসের প্রগতিপন্থী অবস্থান এই নেতারা মানতে পারবেন না – এটাই নেহরুর বক্তব্য ছিল। আজাদ গান্ধীজীকে প্রথমে তার স্বপক্ষে আনলেও নেহরুর সঙ্গে কথা বলে গান্ধীজী নেহরুর অবস্থানেই সম্মতি দেন। কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠনের সম্ভাবনা ভেস্তে যাওয়ায় মুসলিম লীগ সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে অচিরেই তীব্রতর করে তোলে। জিন্না এবং মুসলিম লীগের সামনে অন্যান্য মুসলিম নেতৃত্বের যে চ্যালেঞ্জ ছিল, যেমন বাংলায় কৃষক প্রজা পার্টির ফজলুল হকের, তাও আস্তে আস্তে প্রশমিত হয়ে যায়। কংগ্রেসের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠন না হওয়ায় ফজলুল হক বাধ্য হয়ে মুসলিম লীগের দিকে ঝোঁকেন এবং এই নতুন বিন্যাস মুসলিম লীগের জমিকে বাংলায় দৃঢ়তর করে। ভারত বিভাজনের সঙ্গে বঙ্গ বিভাজনের ক্ষেত্রে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তরফে ফজলুল হকের সমঝোতা প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া এবং তাকে মুসলিম লীগের মুখাপেক্ষী হতে বাধ্য করা অনেকাংশে দায়ী।
মুসলিম লীগের ১৯৩৭ এর নির্বাচন পরবর্তী সময়ে কড়া সাম্প্রদায়িক অবস্থান ও কার্যকলাপ হিন্দু মহাসভাকে নতুন শক্তিতে আত্মপ্রকাশের জমি তৈরি করে দিয়েছিল এবং মুসলিম ও হিন্দু মৌলবাদ পাল্লা দিয়ে বেড়েছিল। কংগ্রেস এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে গিয়ে এই দুটি সংগঠন এর সঙ্গেই নিজেদের সমস্ত সম্পর্ক শেষ করে দেয় এবং ১৯৩৮ এর ডিসেম্বরে এক নির্দেশিকা জারী করে জানিয়ে দেয় তার কোনও সদস্য এই দুটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবেন না। এই বিচ্ছেদ কেবল প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিচ্ছেদ হিসেবে সীমাবদ্ধ ছিল না, তা দেশের দুটি প্রধান জনগোষ্ঠীর মধ্যেও সঞ্চারিত হয়ে গিয়েছিল। হিন্দুদের প্রধান অংশটি অবশ্য হিন্দু মহাসভাকে উপেক্ষা করে কংগ্রেসের স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল। কিন্তু মুসলিম লীগ মুসলিম মানসে কংগ্রেসের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র সম্পর্কে সন্দেহ তৈরিতে সফল হয়ে তাদের কংগ্রেস ও জাতীয় আন্দোলন থেকে দূরে রাখতে সমর্থ হয়েছিল। শুধু তাই নয় সে তার অনুগামীদের একটি বড় অংশের মধ্যে কংগ্রেস সম্পর্কে তীব্র জিঘাংসার মনোভাব তৈরি করে দিয়েছিল। এই মানসিকতারই শেষ পরিণতি দেশভাগ।
মুসলিম লীগের তোলা দেশভাগের প্রস্তাবের আগেই অবশ্য বিভিন্ন সময়ে মুসলিমদের জন্য স্বতন্ত্র একটি রাষ্ট্রগঠনের কথা বিভিন্ন সময়ে নানা অবস্থান থেকে উচ্চারিত হয়েছিল। দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকের সময়েই আগা খাঁ নেহরু পরিকল্পিত ইউনিটারি গভর্মেন্ট এর তীব্র বিরোধিতা করেন এবং অনেকগুলো রাষ্ট্র নিয়ে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র গঠনের কথা বলেন। জিন্না এই সময়ে ফেডারেল রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে ছিলেন না। পরবর্তীকালে উত্তরপ্রদেশের প্রভাবশালী নেতা খালিকুজ্জমান ফেডারেল রাষ্ট্র গঠনের বিষয়ে জিন্নাকে বোঝান এবং জিন্না তাকে বলেন তিনি এই প্রস্তাবের বিরোধী নন এবং বিষয়টি গভীরভাবে চিন্তা করার যোগ্য। ১৯৩৯-এর মার্চে এই প্রস্তাব নিয়ে খালিকুজ্জমান ভারত সচিব জেটল্যাণ্ডের সঙ্গেও কথা বলেছিলেন। এই কথার পেছনে ছিল কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রহমৎ আলির তোলা একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী প্রস্তাব। ১৯৩০-এর গোলটেবিল বৈঠকের সময় রহমৎ আলি হিন্দু ভারতবর্ষ থেকে পৃথক করে ভারতবর্ষের মধ্যেই একটি জাতীয় মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলন শুরু করেন এবং এই সূত্রে পাঞ্জাব, আফগানিস্থান, কাশ্মীর, সিন্ধুপ্রদেশ এবং বেলুচিস্তান নিয়ে পাকিস্থান এর কথা বলেন। এই দাবিকে জনপ্রিয় করার জন্য রহমৎ আলি ‘নাউ অর নেভার’ নামে একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করেন।
রহমৎ আলি যখন মুসলমান অধ্যুষিত প্রদেশগুলি নিয়ে স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের পরামর্শ দিচ্ছিলেন সেই সময়েই মুসলিম লীগের মঞ্চ থেকে বিশিষ্ট কবি ইকবালও এই ধরণের প্রস্তাব পেশ করছিলেন। এলহাবাদে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের বার্ষিক অধিবেশনে ইকবাল সভাপতিত্ব করেছিলেন। সভাপতির ভাষণে তিনি বলেন, “ আমি দেখতে চাই পাঞ্জাব, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বালুচিস্তান একটি রাষ্ট্রে সমন্বিত হবে। এটি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভেতরে বা বাইরে স্বশাসিত রাষ্ট্র হবে। সংযুক্তি সাধনের মাধ্যমে গঠিত উত্তর ভারতের মুসলিম রাষ্ট্রই হল সকল মুসলমানের, অন্তত উত্তর পশ্চিম ভারতের মুসলমানদের চরম ভাগ্য”। ইকবাল এই বক্তৃতাতেই আরো বলেন, “আমরা হলাম সাত কোটি মানুষ। ভারতবর্ষের অন্য সমস্ত মানুষদের চেয়ে আমরা বেশি সমগোত্রীয়। বস্তুত ভারতবর্ষের মুসলমানরাই একমাত্র জনগোষ্ঠী যাদের সম্পর্কে আধুনিক অর্থে জাতি শব্দটি প্রয়োগ করা যায়। হিন্দুরা যদিও প্রায় সব বিষয়েই আমাদের থেকে এগিয়ে আছে তবু একটি জাতির পক্ষে প্রয়োজনীয় সমগোত্রীয়তা তারা অর্জন করতে পারে নি। ইসলামের দান হিসেবে আমরা তা পেরেছি। সুতরাং ভারতবর্ষের মধ্যে মুসলমানদের দাবি সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত”। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মন্ত্রীসভাগুলির সঙ্গে পরামর্শ না করে ভারতকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সামিল করা হলে দেশের অধিকাংশ প্রদেশে প্রতিষ্ঠিত কংগ্রেসী মন্ত্রীসভা পদত্যাগ করে। মুসলিম লীগ এর সুযোগ গ্রহণ করে। জিন্না ১৯৩৯এর ২২ মার্চ তারিখটিকে ‘মুক্তি দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেন। এই দিনটি পালনের মধ্যে দিয়ে মুসলমানদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্যে মুসলিম সংহতি গড়ার চেষ্টা শুরু হয়। বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় ভারত শাসন আইন ১৯৩৫এ উল্লিখিত ফেডারেশন গঠনের প্রস্তাব মুলতুবি রাখা হয়েছিল। জিন্নার নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ মুলতুবে রাখা এই ফেডারেশন কে একেবারে বাতিল করার দিকেই জোর দেন। জিন্না লিনলিথগোকে এই দাবির কথা জানিয়েছিলেন এবং লিনলিথগো ব্রিটিশের তরফে এই দাবি মেনে নেন। তখন থেকেই স্পষ্ট হতে থাকে দেশভাগের পরিকল্পনার ব্রিটিশ সরকারের আপত্তি নেই। এই পর্বেও অবশ্য মুসলিমদের জন্য একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে দেশভাগ যখন সুনিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল তখন মুসলিম লীগের দিল্লি অধিবেশনে মুসলমানদের জন্য একটিমাত্র রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়। জিন্না লাহোর কংগ্রেসের স্টেটস কথাটি ছাপার ভুল বলে বর্ণনা করে বলেন এটি আদতে হবে স্টেট। বাংলার লীগ সম্পাদক জিন্নার এই সাফাইতে সন্তুষ্ট হতে পারেন নি এবং অনেকের মনেই সন্দেহ জেগেছিল জিন্না চাতুরী করে স্টেটস কথাটি লিখে পূর্বাঞ্চলের মুসলমানদের সমর্থন আদায় করেছিলেন এবং সময় বুঝে তা থেকে পিছিয়ে আসেন। তাদের মতে এটি কোনও ভুল ছিল না, ছিল শঠতা। পাকিস্থানের গৃহযুদ্ধ তথা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বিষয়টি ভালোভাবেই সামনে আসে।
মুসলিম লীগের অধিবেশনে দেশভাগের প্রস্তাব গৃহীত হবার কয়েক দিন পরেই দিল্লিতে কিছু মুসলিম সংগঠনের প্রতিনিধিদের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাতে আহরার, জমায়েত উল উলেমায়ে ই হিন্দ, শিয়া রাজনৈতিক সম্মেলনের নেতৃবৃন্দ যোগদান করেছিলেন। কংগ্রেসের কয়েকজন মুসলমান নেতাও এতে যোগ দেন কিন্তু মুসলিম লীগের কেউ অংশগ্রহণ করেন নি। সম্মেলনের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘আজাদ মুসলিম সম্মেলন’ এবং এর সভাপতিত্ব করেছিলেন সিন্ধুপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আল্লা বক্স। সম্মেলনে পাকিস্থান ধারণার তীব্র সমালোচনা করা হয়। কিন্তু ব্রিটিশের দিক থেকে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক বিভাজনের নীতিকেই সমর্থন দেওয়া অব্যাহত থাকে। জিন্না অবশ্য ভারত ছাড়ো আন্দোলনের তীব্রতা এবং যুদ্ধে ব্রিটিশের সঙ্গীন অবস্থার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। ১৯৪৩এ অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে তিনি স্বাধীনতার দাবিটিকে সংযোজন করে নেন দেশভাগের দাবীর সঙ্গে এবং স্লোগান তোলেন “ডিভাইড অ্যান্ড কুইট’। অনেকে অবশ্য মনে করেন ইংরেজদের ভারত ত্যাগের আসন্ন সম্ভাবনায় দেশভাগের পক্ষে তাদের অবস্থানকে সুনিশ্চিত করার দিকটি জিন্নার এই আহ্বানের মধ্যে ধ্বনিত। কারণ গান্ধীজী ততদিনে ইংরেজদের বলেছেন দরকারে অরাজকতার মধ্যে ভারতকে রেখেও ইংরেজরা যেন দেশ ত্যাগ করে। অতঃপর ভারতবাসী নিজেই তার ভাগ্য বুঝে নেবে। ভারত সচিব আমেরিও ১৯৪৩এর ফেব্রুয়ারীতে বলেছিলেন, “ আমরা যদি তাদের পথ থেকে সরে আসি তবে ভারতবাসীরা ঐক্যমত্যে আসতে পারবে গান্ধীজীর এই যুক্তির মধ্যে কিছু সত্য আছে”। জিন্না এই দৃষ্টিকোণকেই ভয় পেয়ে ব্রিটিশ যাবার আগেই দেশভাগকে নিশ্চিত করার তাগিদ অনুভব করে থাকতে পারেন। ব্রিটিশরা অবশ্য পরবর্তী সময়ে তাদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ অটুট রাখার জন্য বিশ্বস্ত স্বাধীন পাকিস্থানকে চেয়েছিল কারণ কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ভারতের প্রতি তাদের নিরঙ্কুশ আস্থা ছিল না। কংগ্রেসের বিরোধিতা বা গান্ধীজীর ঘোষণা (আমার মৃতদেহের ওপর দিয়েই দেশভাগ হবে) ব্রিটিশ এবং মুসলিম লীগ উভয়কেই নিজ নিজ আকাঙ্খার ব্যাপারে ভীত ও মরিয়া করে তুলেছিল এবং বিশ্বযুদ্ধ অবসানে জিন্নার অবস্থান ও প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের ঘোষণায় এই উদগ্রতাই আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৪৬এ ক্যাবিনেট মিশনের ভারত রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাবকে মুসলিম লীগ মানতে পারে নি এবং তারা ভারত ও পাকিস্থান – দুটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব দেয়। কংগ্রেস এই বিকল্প প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে। ক্ষমতা প্রদর্শনের নিরিখে ১৬ অগস্ট ১৯৪৬ তারা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের ডাক দেয়। এই সূত্রেই শুরু হয় দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং এবং ভয়াবহ এই দাঙ্গা বিহার, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মত বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ভয়াবহ দাঙ্গার মুখে দাঁড়িয়ে শেষপর্যন্ত ভারতভাগ ছাড়া সাম্প্রদায়িক রক্তক্ষরণের কোনও সমাধান চোখে পড়ে নি।
দেশভাগ পরবর্তী উপমহাদেশ ব্যাপী মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস তিনটি আলাদা দেশে তিনটি আলাদা প্রেক্ষাপটে এগিয়েছে। সেটা আমাদের বর্তমান পর্যালোচনার বাইরেই থাকছে, অন্য কোনও পরিসরে এই নিয়ে আলোচনা করা যাবে। সাম্প্রদায়িকতার রক্তাক্ত বাস্তবের মোকাবিলা কোন কোন পথে কীভাবে হতে পারে সে নিয়েও কোনও আলোচনা এখানে করলাম না আমরা। অকিঞ্চিৎকর এই লেখাটির পাঠক পাঠিকারা চলমান সেই আলোচনা ও প্রক্রিয়ায় সামিল থাকবেন, তাকে শক্তিশালী করবেন, এটুকুই আশা।
নিজের অজান্তে কখন কোথায় “ক্লিক” করেছিলাম জানি না, বা মনে নেই। আজ হঠাৎ লেখা প্রবন্ধের বন্যা দেখছি আমার দেয়ালে। আশ্চর্য্যের বিষয় হলো এই অতর্কিত আক্রমণ (?) একটুও খারাপ লাগছে না। উলটে খুবই ভাল লাগছে। লেখকরা বেশ শিক্ষিত, মার্জিত এবং মননে গভীর ও সুস্থমনা। বিষয় বস্তুও বেশ তাৎপর্য্যপূর্ণ। আমি এদের সর্বাত্মক প্রসার ও সমৃদ্ধি কামনা করি। আমাকে সঙ্গে নেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
তোরা কাকে বুলডোজার দিয়ে ভাঙতে গেলি;
কেন্দ্রীয় সরকারে কাছে যে করলো দরবার-
মাসে ১৮০০০ টাকা মজুরি দেবার;
সে তো ছিলো লেনিনেরই প্রতিধ্বনি,
তাকেই তোরা উপড়ে ফেলার চেষ্টা করলি;
যারা ধর্মের ছদ্মবেশ ধরে
করছে শাসন-শোষণ
তাকেই তোরা ভাবলি পূজারি!!
রাম-এর নাম করে
জ্যান্ত মানুষ পুড়িয়ে দিলি;
শিশু কাঁদিয়ে – তাকে অনাথ করলি!!
এ কেমন রামের ভক্ত
সীতা তো চাইনি এমন রক্ত!!