হাত ঘড়িটা

হাত ঘড়িটা বড্ড চেনা, আঙুলগুলোর সাথে
চিলেকোঠার আদর পেরোয় দেওয়াল লেখা রাতে।

মেয়েবেলার জন্ম ছিল, খেলনাবাটির গ্রামে
অচেনা ভীড় ভাঙছিল গ্রাম, মিছিল হাঁটা ঘামে।

চেনা মিছিল দশক দশক, রথের ঠাকুর আমি
মিছিল এবার ওড়না ছাড়ায়, পুতুলও সংগ্রামী।

জীবনজুড়ে নোঙর খুঁজি, বন্ধনীতে জ্বর
শীতলপাটি গুটিয়ে ফেরত, শিকড় ছেঁড়া স্বর।

চাঁদের পিঠে চাঁদ থাকে না, তাসের বাড়ির খোঁজ
নীলকণ্ঠ পাখির দেখা, বৃষ্টিভেজা রোজ।

বালির উপর হাঁটতে চাওয়া, ঢেউ ভেঙ্গেছে পাড়
জটলা শুধুই শাসন শেখায়, কবিতা কাঁটাতার।

শিকড় খুঁজি শীতের রাতে, ছোঁয়াছুঁয়ির নামে
স্লোগান-শরীর স্পর্শকাতর, মধ্যবিত্ত দামে।

হাত ঘড়িতে দম গিয়েছে, তবু আঙুল টানে  মুঠো
দেওয়াল ব্যারিকেডে, পথে নতুন রুটের অটো।

তাসের বাড়ির ছাদ জোটেনা, মুঠোয় বাঁধি ঘর
মিছিল কানে ডানা ঝাপটায়, শিকড় খোঁজার স্বর।

*

টানাহ্যাঁচড়ার দেখা ছেড়ে

তোমার সাথে দেখা হয়েছিল বহুদিন আগে
যেদিন অবনীবাবু বাড়ি ছেড়ে সাড়া দিয়েছেন
সময় বের করে,
যেদিন ফুলমাসি ওর রান্না করার গপ্প লিখে ফেলেছিল
কোন এক নতুন ভোরে।
স্কুলব্যাগে শুধু কবিতার বই খোঁজা ছেড়ে
সেই থেকে আমি খুঁজছি তোমায়।

তোমার সাথে দেখা হয়েছিল বহুদিন আগে,
যেদিন মৃত সভ্যতার ঘুম ভাঙ্গায় ‘সন্ত্রাসবাদী’ রাইফেল
আর ‘অবৈধ’ প্রণয় আটকে খোঁজে মধ্যবিত্তের জেল।
মোবাইলে রিংটোনের আশেপাশে তোমার উপস্থিতির শব্দগুলো
সেই থেকে শুনতে শিখেছি আমি।

তোমার সাথে আবার দেখা বেশ কয়েকটা যুদ্ধ আগে,
যেদিন ওড়নায় ঝুলতে থাকা শাহিনার পাড়ায়
আর কাশ্মীরে লাগু থাকা সরকারী ধারায়,
একটা হাজিরা খাতা লেগেছিল।
আয়নায় গোঁফ-দাড়ি-শাড়ি চেনা ছেড়ে
সেই থেকে তোমায় চিনছি আমি।

তোমার সাথে দেখা হয়েছিল আবার এই সেদিন,
যেদিন, ক্যাকটাসের কাঁটায় বসে থাকা চড়াই পাখিগুলো
টাওয়ারের বেড়া টপকে আবার ফিরে এল,
যেদিন বন্ধ জুটমিলের মোড়ে, একরাশ জোরালো স্লোগান
আর চাপ চাপ রক্ত নিয়ে,
আর একটা নতুন ভোর রাস্তায় পড়ে ছিল।
এই মাঝেমাঝে দেখা, স্কুলের শেষ পিরিয়ডের মতনই
বড্ড টানাহ্যাঁচড়া করে।

তাই তোমার সাথে শেষ দেখাটা আমি সেদিনই করব;
যেদিন সমস্ত গণতান্ত্রিক সিগন্যাল পেরিয়ে
রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা সমস্ত প্রিজন ভ্যান ভরিয়ে,
ফুটপাত ছেড়ে দিয়ে,
রাজপথ দখল নেবো আমরা।

*
ট্রেনের কবিতা একটা

আমার ট্রেনের দরজায়
কাশফুল আর ঘামের গন্ধ মিশে একাকার,
আমার ট্রেনের দরজায়
আলোর রোশনাই আর ন্যাংটো বস্তির হাহাকার।

আমার লোকাল ট্রেনের দরজায়
ভাঙাচোড়া হকার জীবনের বাস,
আমার ঝুলন্ত ট্রেনের দরজায়
তোমাদের কবিতা আটকে করে হাঁসফাঁস।

আমার চক্ররেলের দরজায়
জমতে থাকে, অচল চায়ের ভাঁড়ের মায়া;
নিশুতি রাতে চাঁদের সাথে
উচ্ছেদের গল্প শোনায়, বহুতলের ছায়া।

আমার সাউথ লাইনের দরজায়
নন্দ’র মা সবজি নিয়ে আসে,
ঘোমটা গেছে, তবু পেটের টানে
শরীর, কালশিটেতেই হাসে।

আমার লালগোলার দরজায়
অবনী চাকরি খুঁজে ফেরে,
হোর্ডিং-এতে ছায়া পড়ে না
বেকার লাশের ভিড়ে।

আমার অফিস ফেরত দরজায়
হাওয়া শান্তি ডেকে আনে,
হিসেবপত্রে শূন্য পকেট
মাসের মাঝখানে।

আমার লেডিস ট্রেনের দরজায়
পুরোনো চিঠি বাঁধার ফিতে,
জানলার ধার একাই কখন
ঘুমিয়ে গেছে শীতে।

আমার মেট্রোরেলের দরজায়
দেখি পাতাল খোঁজার ছুতোয়,
যানজট এখন রাস্তা পেরোয়
মন জোড়ে না সুতোয়।

আমার বোবা ট্রেনের দরজায়
ছুঁড়ি কবিতা একমুঠো,
কবিতা শুধুই সিঁড়িই খোঁজে
অথবা ঘুলঘুলির ওই ফুটো।

1 thought on “শিঞ্জিনী রায়ের কবিতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.