সারা বসু, জয়লিপি দত্ত, জয়ন্তী বসু, নন্দিনী ধর, কুন্তল মিত্র, মধুশ্রী বসু

bhoy
আয়নানগর থেকে যৌথভাবে লেখালেখির প্রথম প্রয়াস—‘ভয়ের কবিতা’। কথাটা শুনতে খানিকটা মাসিক কিশোর পত্রিকার ভূত সংখ্যার মতন বটে, কিন্তু এর মধ্যে আরও একটু ব্যাপার আছে।

একটি নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক লেখা হলেও এক্ষেত্রে বিষয়ের চাইতে একসাথে লেখাটাই ছিলো জোরের জায়গা। একভাবে দেখলে, এটা ছিলো আমাদের একটা খেলা। কয়েকজন মানুষের একত্রিত হবার, পরস্পরকে এবং নিজেদেরকে জানবার খেলা। আবার আরেকভাবে দেখলে এটা ছিলো নিজেকে এবং পরস্পরকে নানান স্বভাবের, অভ্যাসের, অনিচ্ছার এবং হতাশার স্নিগ্ধ খোলস থেকে বার করে আনবার, চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবার একটা মৃদু চেষ্টা। ‘বিগ ব্রাদার’-এর মতো একে অন্যের ঘাড়ে চড়ে নয়—যদিও সেটাও একটা পদ্ধতি হতে পারতো। কিন্তু এই একটা অদ্ভুত সময়ে দাঁড়িয়ে—যখন বাইরের পৃথিবী হামেশাই নানা চেহারায় আমাদের একা পেলেই ভয় পাওয়াবার চেষ্টা করে চলেছে—আমরা তখন সচেতনভাবে এবং সপ্রেমে ছুঁতে চাইছিলাম যৌথতাকে। আবার এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে যখন আমাদের মতো গড়পড়তা মানুষ জেনে বা না জেনেই “সকলে প্রত্যেকে একা”, প্রায়ই যখন তারা “কথা বলে কথা না শুনে, কথা শোনে কথা না শুনে”, তখন একা-একাই দারুণ সব কবিতা লিখে ফেলার চাইতে পরস্পরকে শোনাটার ভিতর আমরা অনেক বেশি মজা পাচ্ছিলাম।

তা বলে বিষয় এক্ষেত্রে পুরোপুরি গৌণ নয়। সাম্প্রতিককালের একটি বড় অংশের বাংলা কাব্যে প্রেম-পরকীয়ার যন্ত্রণা-উদ্বেগের আধিক্যে ক্লান্ত কবিতাপাঠক হিসেবে আমরা খুঁজছিলাম একটি অন্যরকমের ‘রস’। সারা—আমাদের কবি সারা বসু—এই খেলার ছয় খেলুড়ির একজন বললো—‘ভয়’ নিয়ে লেখা যাক। তা সেটাই টিঁকে গেলো। লিখতে লিখতে ক্রমশ আমরা শুধু কবিতা এবং যৌথতার ধারণাগুলিকে নয়, ‘ভয়’—এই বিশেষ অনুভূতিটিকেও নানাভাবে দেখতে শুরু করি। সেই দেখা আর পরস্পরের দেখা নিয়ে ভাবনাচিন্তাও তখন খেলার অংশ হয়ে ওঠে।

আড্ডা দিতে দিতে এই যৌথ খেলার কথা মাথায় এসেছিলো। আবার আড্ডা দিতে দিতেই একদিন খেলা শেষও হয়ে গেলো। কিন্তু খেলা থেকে যা প্রাপ্তি—সেগুলো খেলার সাথে সাথে ফুরিয়ে গেলো না। বিশেষত যেহেতু দল কখন যূথবদ্ধ গোষ্ঠী হয়ে ওঠে, যৌথতা কোন পথে হয়ে ওঠে সাম্য ও বন্ধুত্ব—এসবের সারল্য-জটিলতা নিয়েই আয়নানগর। কবিতা-গল্প-প্রবন্ধ-শিল্প-প্রচার—এসবের জন্যে তো রয়েছে অন্য আরও নানান ক্ষেত্র।

আপাতত, কবিতাগুলির শেষে সেইসব ইমেল-আড্ডারও কিছু কিছু অংশ এখানে তুলে দিলাম।

(‘ভয়ের কবিতা’ সিরিজের একটি কবিতা ‘আড্ডা ফোরাম’-এ পূর্বপ্রকাশিত)

সারা বসুর কবিতা

দুঃস্বপ্নে বিবস্ত্র হাঁটি
কবিতাতেও

রক্তকরবী
বেশ বড় হয়ে নাগকেশরের ফুল চিনেছি।
আরও বড় হয়ে রক্তকরবী।
চিনে মনে হলো, এরাই তারা?
এদের তো দেখেছি কতবার!
এদের রূপ তো পূর্বচেনা!
না জানতে নামের মহুয়ায়
কি আচ্ছন্ন ছিলাম, আহা!
ঠিক এভাবেই, ছোটবড়’র দোলনায়
একদিন চিনলাম ভয়কে।
ইচ্ছেপূরণ-ভয়ের চেহারাটা নাগকেশরের ফুল হয়ে ফুটল,
আর বাজারি হিসেবে সুদক্ষ আমি
রক্ত ও করবীকে আলাদা করলাম,
অপ্রেমের রোদে শুকিয়ে মরলো
আমার
মহানতর বিস্ময়।

নিম্নগতি স্নেহ
আর নিম্নগতি ভয়
দুয়ের পরাগমিলন
জীবন-চাঁদোয়ায়।
স্নেহের মহল গড়ে
ভয়তাড়ানি গান
ঘুমোলো যেই বোকা
উল্টোলো পুরাণ।
নাকি, ওটাই ছিল ঠিক?
স্নেহের নামই ভয়?
ভুল রসায়নপাঠে
পিচ্ছিল সংশয়।

শৈশব
নির্জনতার আলো
জ্বেলে
নির্জনতার ভিড়
শাঁখের মত ঘুম
হতক্লান্ত বীর।
ঘরের মধ্যে আলো
জ্বেলে
বাইরে পর্দা দিন
নরম বুকে থাকা
স্বেচ্ছা পরাধীন
সৃষ্টি বাইরে রেখে
নির্জনতার চাবি
খুলে, নঞর্থকে একা
উপভুক্ত খাবি
কেউ না, আর বিশেষ
বেছে,
দুয়ের মাঝে ছ্যাঁচা
এখন তালা খোলা
এখন শিশুর বাঁচা।
এখন ভয়ের মেদ
শরীরে বইছি
আত্ম কিংবা জা
আগলিয়ে রয়েছি।

কবিতার থাপ্পড় খেয়েছি
কবিতার আদরও
একবার কবিতা একটা বাতিল জামায় বোতামও বসিয়েছিল
কবিতায় একদিন খুব ভয় হল
সে ভয় অভিমন্যুর মহান শেষ মুহূর্তকে আমার কুয়োয় নামিয়ে আনল
খোঁজহীন দড়ি বেয়ে ঝপাত করে পড়ল সে
আমার কি আর কখনো অন্য গোলার্ধে ফেরা হবেনা?
সেখানে যে সব সাহসের ঋণে আমার ফিরতে পারার মানত ছিল! ছিল! ছিল!
আমি বীর হতে পারি, আমার নিয়তি তো তা না।

আবার ওই আধখানা মুখের বুনো দ্যুতিতে
আমার গর্বিত ভয় ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল।
আবার ভয় ডিঙিয়ে আমার এত কষ্টার্জিত
নির্বিকার চিত্ত ছুঁতে চেয়েছিল রক্তের স্বাদ মাখা ছুরিটাকে।
আমার দ্বি-ধার বেপরোয়া সারল্য ভয়ের পায়ের
তলায় সর্ষে দিয়েছিল।
যখন ফালাফালা হয়ে কাটছে আমার সংস্কার
ভয় বেরোলো পাড়া বেড়াতে।
সততার পর নিরুদ্দেশ সম্পর্কের ঘোষণায়।
তারপর চিৎকার শেষ।
কেননা তখন মৃত একটা খসখসে হাত,
অপ্রেমে নীল একটা হাত
আমার ঠোঁট থেকে তোমার দেওয়া বিশ্বাস
মুছে নিয়েছে।
আর ভয় দেখিয়ে বলেছে— “তুমি নেই কোথাও।”
এর থেকে বেশি ভয়ের গল্প আমার অন্তত
জানা নেই।

সততই মিছে এক ভরসা বপন,
সতত বিনির্মাণে বহু আয়োজন।
অপরূপ ক্লান্তির ছিদ্রহীনে,
সতত হে নদ, তুমি পড়ো মোর মনে।
নদী হতে চেয়েছি কি প্রগলভতায়!
তুমি পাশে এলে নাকি জল বয়ে যায়।
তবুও হে নদ, তুমি অসীম প্রতাপ,
ভীতি মোহনার তাই জানো শেষ ধাপ।
জানোনি শুধু, তুমি বইছো অপার
বদ্ধ পঙ্কিলে মজা বুক যার।

***

জয়লিপি দত্তের কবিতা

পই পই করে বলা হচ্ছে ভয়ের গল্প বলতে, সাত, সা-আ-ত খানা ভয়ের গল্প। তা সে আমি বেজায় ভীতু মানুষ—সাতটা কেন, আমার সাতশো রকম ভয়। মুশকিল হয়েছে কি, ভয়েদের তো দায় নেই—সাজানো, গোছানো, গভীর, গম্ভীর, মৌলিক, শালীন কি যুক্তিসংগত হওয়ার। সে মোটেই ভাবতে বসছে না—‘আহা! অমুক যে ভয়—কি তার রস, কি তার আমেজ, কি তার চলন— ভয়ই যদি হবো, তবে অমনটাই হবো’। সে তার মত দিব্যি আছে সুখে—যেমন, ঠিক তেমনটি হয়ে। এদিকে লিখছে যে, তার তো তেমন নয়—তার লোক না-হাসাবার দায়, প্রাসঙ্গিকতার দায়, উৎকর্ষ বজায় রাখার দায়—অন্য যারা লিখছে তাদের ছাপিয়ে না যাওয়া যাক, নিদেন কাছাকাছি পৌঁছতে পারার দায়।

এই যে রাশিকৃত দায় আমাদের—মার্জিত হয়ে ওঠার, গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠার, অন্যরকম হয়ে ওঠার—কি দমবন্ধ করা, কি ভয়ঙ্কর, না!

ভূত আমার পুত/ পেত্নী আমার ঝি/ রাম-লক্ষ্মণ সাথে আছে/ ভয়টা আমার কি!

ভয় বললেই ভূত, আর ভূত বললেই ছড়া। আমাদের বাড়িতে অবশ্য ভূতে ভয় পাওয়া মানা। ভূত বলে নাকি হয়ই না কিছু মোটে। অন্ধকারে হাওয়ায় নারকেল গাছের পাতা সরসর ক’রে উঠলে মামদো কি ব্রহ্মদত্যি গাছে বেয়ে নেমে ঘাড়ে ঠাণ্ডা নিঃশ্বাস ফেলল ভেবেছ কি ব্যাস্‌। অমনি তুমি বোকা। আমি ভীতু যদি বা হই, বোকা নই বিলকুল।

এই ছড়ার চল আমাদের বাড়িতে ছিল না একেবারেই। কোথা থেকে শিখেছিলাম, এখন আর মনেও পড়ে না, তবু ভয় বলতেই এই ছড়াটাই মনে এলো। শিউরে উঠলাম।

এই ছড়া আমরা যে বয়সে শিখি, সেই বয়সে সব শেখাই ছন্দে, তালে, লয়ে শেখা। ছড়ার কথা, ছড়ার মানে—তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে না তখন বিশেষ। এখনও যদি উচ্চারণ করা হয়, দেখা যাবে, আমরা সব্বাই পাঠশালার পড়ুয়াদের মতো দুলে দুলে, একই সুরে, একই জায়গায় থেমে, একই শব্দান্তে নিঃশ্বাস নিয়ে বা না নিয়ে ছড়াটি বলে চলেছি। একবার-দু’বার-তিনবার—আবহমান কাল ধরে এর কোনো পরিবর্তন নেই কোথাও, এতোটুকু।

ভয় করছে না! শিরদাঁড়া বেয়ে হিমেল স্রোত বইছে না! সেই কোন বয়স থেকে মনে গেঁথে দেওয়া হয়েছে রাম-লক্ষ্মণ সাথে থাকলেই সব ভয়ের অ্যায়সি কি ত্যায়সি! জোড় হাতে রাম-নাম জপো আর উদ্ধার পাও। একবার-দু’বার-তিনবার-বারবার—আমরা সব্বাই মিলে কেমন বোকা হয়েই চলেছি। মারছি-কাটছি, ধর্ম-অধর্ম-জাত-বেজাত গুলিয়ে পেঁচিয়ে একশা হয়ে মাথা কুটে মরছি—আবহমান কাল ধরে। কি অন্ধকার চারিদিক! আমরা প্রেতেরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছি। একে অপরের রক্ত শুষে বাঁচছি—রাম-লক্ষ্মণ কোথায় কি জানি! উদ্ধার করতে কেউ ছুটে আসছে না তো কই!

প্রিয় শ,
এই চিঠি একমাত্র তোকেই লেখা যেত।
একমাত্র তোর কাছেই আগল খুলে ঝাঁপিয়ে
পড়তে ভয় করে না আমার। জানি
আমার পাপ, আমার স্খলন সব পেরিয়ে
আঁকড়ে, আগলে রাখবি আমায় ঠিক।
তলিয়ে যেতে যেতে আর যদি না ডাকি,
হাত বাড়িয়ে না-ই যদি দিই আর—
তুই টান মেরে তুলে আনবিই ঠিক, জানি।
তোর বুকে মাথা পেতে শোব, তুই দেশবিদেশের গল্প বলবি—রাজা, রাণী, যুদ্ধ, রাজনীতি,
আরও কত কি!
নিজেকে খুঁজে আনব বেশ।
তোর কাছে আসা হলেই নিজেকে খুঁজে পাওয়া হয়।
তারপরে আবার হারাব— হারিয়ে যেতে খুউব ইচ্ছে করে আমার।
ভয়ও আছে।
যদি ক্লান্তি আসে তোর?
আর যদি তুই না-ই খুঁজিস আমায়
আমার অমন নিশ্চিন্তের হারিয়ে যাওয়া—
অগৌরবের,
মিথ্যে হয় যদি?

ভয়,
সত্যি হয়।
দেশান্তরে বৃষ্টি নামে, হাওয়ায় হাওয়ায় খবর ওড়ে;
হঠাৎ জানান পশলা ছবি
আর ভিজিয়ে যায় না…
না অর্থের ভয়
পেরিয়ে যেতেই হয়
বৃষ্টিবাদল লেগেই থাকে, হাওয়ায় হাওয়ায় খবর ওড়ে;
ভেজার ধরণ যখন যেমন
বর্ষা পুড়তে হয় না।

***

জয়ন্তী বসুর কবিতা

এই ভূতের গল্পটা সবারই জানা— সেই যে একজন ব্যাঙ্কে গেল, দেখল ম্যানেজারের মুখটা ডিমের মত লেপাপোঁছা, তার চোখ ঠোঁট নাক নেই, দৌড়ে বেরুতে গিয়ে দেখল দারোয়ানেরও তাই, রিক্সা করে বাড়ি আসতে গিয়ে দেখে রিক্সাওয়ালারও—

আজকাল সন্ধেবেলা আমি ঘর থেকে বেরোই না যদি
দেখি সেই লোকটা আমার অপেক্ষায়—যার শরীর নদীর
মত তরল অর্থাৎ যার মুখ সর্বদা পালটায়
অথবা একেবারেই পালটায় না কারণ তার ঠোঁট নাক চোখ
কিচ্ছু নেই—সে হতে পারে ব্যাঙ্কের ম্যানেজার, মুদি কিম্বা যে কোন লোক
পাঁচ দশক সে আমার অপেক্ষায় থেকেছে—কি আসে যায় আর কয়েক ঘন্টায়
তারপর আমি যার কাছেই হাত পাতব সে-ই—

পরশুদিন কেষ্টপুরে একটা খুন হয়েছে, তার বদলা নিতে আজ আরেকটা। ছবিদি কেষ্টপুর থেকে রোজ সল্টলেকে ঠিকে কাজ করতে আসে, আজ খুব ভয় পেয়েছে

সুবলকে রোজ দেখতে পেতাম বৌদি, যদিও ও ছিল মস্তান
পরশু দুপুরে খুন হয়ে গেছে—না তো, শুনিনি মায়ের কান্না

মিহিরেরা খুব শাসিয়ে গিয়েছে যেন না শুনি টুঁ শব্দ
সেই থেকে মা-ও নির্বাক, বুঝি আছে আরো দুটো সন্তান

আজ শুনলাম মিহিরের লাশও পড়েছে—ভেঙ্গেছে ঘরদোর
সে-ও মস্তান—একই দলে ছিল, সবাই তো সব জানত

তার বৌ বটে আছাড়িপিছাড়ি—পেটে আছে কিনা একটা
সুবলের মা আজকে কে জানে কার শোকে কাঁদে রাতভোর।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে—

আমাকে বেশি ভয় দেখিও না, লক্ষ্মী ভাইটি আমার। তোমার নুইসেন্স ভ্যালুকে আমি বিষম ভয় পাই। তাছাড়া কোন ইমোশন বেশি হলেই আমার হিসি পায় আর সেই সঙ্গে হ্যাঁচ্চোও পায়। দুটো একসঙ্গে পেলে কিরকম ভয়ের কথা তুমিও তো জানো। খুব মরিয়া হয়ে উঠলে আবার আমার হিস্টিরিয়াও পায়—

ক্লাস ইলেভেনের সাইকোলজি টেক্সট বই থেকে আবেগ প্রসঙ্গে জেমসল্যাঙ্গ থিওরির উদাহরণ—আমরা শীতেও কাঁপি, ভয়েও কাঁপিশীতে কাঁপলে ভয়—এই আবেগ অনুপস্থিত থাকে।

ওসব সায়েবসুবোদের হতে পারে, যারা বরফের উপর গোল্লা ছোঁড়াছুঁড়ি খেলে
ছোঁড়া ও ছুঁড়িরা একসাথে খেলে বলে শীত করে না, ভয়ও অনুপস্থিত।
আমি আবাল্য টনসিলের রোগে ভুগি—প্ররোচনাতে আইসক্রিম চাটি না
ঠান্ডা গরম বেসামাল হলেই পেটও গড়বড়—তাই সতত ভয় ভয়
নার্ভাস হলে আমার শীত করে, নাক দিয়ে জল গড়ায়।
আমি সারাবছর ভয় পাই।
উত্তুরে হাওয়াকে ভয় পাই, জৈষ্ঠ্যমাসে ভয় পাই ঘামকে,
বর্ষাশেষে ভয় পাই লাউডস্পিকারকে, বর্ষশেষে প্রেমকে।
হে ঠাকুর জেমস ও প্রভু ল্যাঙ্গ শ্রীহরি
প্রশ্নপত্রে তোমাদের দেখে আমি শীতে ও ভয়ে থরহরি।

শ্মশান বৈরাগ্য থাকাকালীন কিছু চিন্তা

ঘরের কোণায় নাকিপুকি
ঘরের বাইরে হাঁ
ভয় পেয়েছিস সোনার খুকি
এবার ঘুমু যা।
অন্ধকারের গর্ত গভীর
অন্ধ হোক না চোখ
ভয় দেখাচ্ছে চেনা শরীর
মুখোশ মুখের লোক।
হাত কেটেছি হাড় কেটেছি
চোখে বিঁধেছি শলা
কদম কদম পা ফেলেছি
এই নাকি পথ চলা।
ঘুমের মধ্যে বোবা লোকটা
ঘুমের বাইরে হাঁ
স্বপ্নে নাচে ছুপা শোকটা
কোজ্জাবো গো মা?
টাপুর টুপুর বিষ্টি পড়ে
নদে এল বান
এক কন্যে কেমন করে
বাপের বাড়ি যান?
ভিজে গামছা, ভাঙ্গা হাঁড়ি
পিছু ফিরে না চাওয়া
নাকিপুকি গুড়িসুড়ি
টুকি বলেই হাওয়া।

শ্মশান বৈরাগ্য থাকাকালীন কিছু চিন্তা

এটা সিরিয়াস কবিতা
মোষের মুণ্ডুর হাতল লাগানো বেবাক কালো পাথরের সিংহাসনে
যমরাজ যদি সত্যি বসে ঠ্যাং নাচান
আমায় দেখে বর-টর দেবার তো কোন জাস্টিফিকেশন নেই
বরং তিন থাপ্পড়ে থোবড়া ঘুরিয়ে দেব—বললে বুঝব
নরকটা হ্যালুসিনেশন নয়
পাপ বই পুণ্য করি নাই জীবনে
ফোঁপরদালালির পেশায় নিমগ্ন আয়ুষ্কাল
মিথ্যা বই সত্য বলিব না—প্রতিজ্ঞা ছিল জন্মলগ্নেই
সত্য বলার পাপে কৌশিকের শাস্তি হয়েছিল শুনে খুব আরাম পেয়েছিলাম
মহাভারতে সব আছে তো
ছোটবেলাতেও মার-টার বেশি খাই নি—মাথা ধরলে কাতর
মাছের কাঁটা ফুটলেই সাইলেশিয়া—এ হেন আতুশি
ভাল মেয়ে সেজে পার পেয়ে যাব আশা করি
ওপারেও যেমন এপারে
কেমিস্ট্রির কমলাদি যেমন বকে ঝকে তারপর আমার দুঃখে নিজেই কেঁদে ফেললেন
আমিও তো কমলাদির সামনে হাসি নি, সময়োচিত
যমরাজকে বলব, ইয়েসসস্যার, আজ তো দশটা চল্লিশে ঢুকেছি
দেরি করিনি একটুও
প্রেয়ারেও প্রেজেন্ট প্লিজ
আপনার ডাক শুনেই ছুট ছুট
জানেন তো ওরা হিংসে করে আমার নামে আপনার কাছে লাগায়

ভয় ভালবেসে ভয়
জপে তপে ধ্যানে স্তবে
কোলাহলে কলরবে
ভয় আগুপিছু ভয়
ভয় বাথরুমে ভয়
ভয় বেডরুমে ভয়
আতুরি বুড়ির হাতের কচুপাতায় প্রাণটুক ধুকপুক
ও পাড়ার খোকা মরেছে ভয়
এ পাড়ায় গাঁজার ঠেকে ভয়
ভয়
পুলিশের
উকিলের
ডাক্তারের
ডাকাতের
গেজেটের
বাজেটের
যেখানেই আমাকে স্মরণ করিবে, ভয়
রেপের ভয়
খেপের ভয়
রঙের ভয়
মনের ভয়
ভূতের ভয়
বাঁচার ভয়
ভুলের ভয়
শূলের ভয়
ভয় প্রেম পূজা ইষ্টদর্শন
ভয় বিদ্রোহ ক্রান্তিকাল
নিঃশর্ত সমর্পণ।

***

নন্দিনী ধরের কবিতা

সুচরিতা 

হারমোনিয়ামের হাওয়ার হুহু ভারে দেওয়ালের ফাটলে তখন খাবি খাচ্ছে  ঠিক লক্ষীপ্যাঁচা  নয়, তবে প্যাঁচাজাতীয় কোনো এক প্রাণী—বলা ভালো প্যাঁচার আকৃতি। যেমন খেলনাভালুক আসলে ভালুক নয়, ভালুকের আকৃতিমতন। নাচের মাষ্টারমশাইয়ের হাতে কাঠি। কাঠি না বেত না কাঠ। কণ্ঠনালী হাতে নিয়ে নাচের দিদি চিল্লায়: তেইয়ম তাত থা, তেইয়ম: তালপরাধীন যুদ্ধক্ষেত্র। ঝনঝন করে ভেঙ্গে পড়া কাঁচ, উন্মুক্ত জানলা। মাত্রা না তাল না ফাঁক। একেক মাত্রায় একেক অলিখিত স্বরলিপি। গুরুজির কাঠির মুখে শুকনো লঙ্কা গুঁড়ো। ওমা, কি লাল! লিপিস্টিক-আলতা-নেলপালিশের নাচের ফাংশান। নাচতে নাচতে হারমোনিয়ামই হয়ে গেল পাশের বাড়ির টুম্পা। সে হারমোনিয়াম বাজিয়ে বৃন্দসঙ্গীত গাওয়া হবে অখন অষ্টমী পড়লে। নদী মজে খাল, খাল মজে ভিআইপি। কলকাতা-ঘেঁষা মফস্বলে স্কুলপড়ুয়া দিদিরা পাড়া বেড়াতে বেরোয়। হাতে হাত খামচে ধরে সেকি হিহি হাসি। অ ছুঁড়ি, মজা গাং বেয়ে আসবে নাকি তোর বর? কুমিরদাঁতের মত বাড়া আর রবিঠাকুরের মত দাড়ি? তুই নাকি বড় নকখি? সাত চড়ে রা নেই, রাঙা মাথায় ঝুঁটি নেই। দিদির নাম নেড়ি। দূর হ হতচ্ছাড়ি বিড়ালনি। হু হু করে হারমোনিয়ামের হাওয়া দেয়: রবীন্দ্রসঙ্গীত ঝড়। সাদাকালো রীড দুমড়ে-মুচড়ে গায়িকাবাহিনী: অক্ষর অক্ষৌহিণী। বৃদ্ধাঙ্গুলবর্তিনী। পাটপাট ইস্তিরি বাসন্তীবাটিক, পায়ে পা জড়িয়ে রেশমহোঁচট। লক্ষীপ্যাঁচার ডানার ঝাপটে হারমোনিয়াম টুকরো টুকরো: শতছিন্ন। তিন পলিব্যাগভর্তি টুম্পা, দিদিগো। বাঁচা গেছে। হাড় জুড়োলো। চিলচিৎকারে আর গলা সাধবে না কখনো।

স্বরলিপি শাসন 

বসো মা লক্ষ্মী টানপীঠ করে
গান গাও এ জীভ কামড়ে ধরে

অরিগামি বক চেপে ওই উড়ে আসে তবলামাস্টার: পাশের বাড়ির ছাদে তখন সশব্দে ফাটছে গতবছরের অঙ্কখাতা। বিকেলের গানের ক্লাসে রোজকার মণিমালা: এক নম্বর পিটি শুরু কর। এ কবিতায় কোনো আমি নেই। নেই পংক্তিবিভাজন—আছে শুধু সারি সারি ছ’বছরি বালিকাবাহিনী। তবলামাস্টার তালে তাল ঠোকে, জানলার কাছে কালশিটের মত সন্ধ্যে: কাঁচে ধাক্কা খেতে খেতে নীড় ভুলে দাঁড়কাক ছানা সিধে হারমোনিয়ামের মধ্যিখানে। সুরস্বাধীন সরগম: পাশের বাড়ির কলেজপড়ুয়া মাসিমণির গলায় সে কি গান—আমারে তুমি অশেষ করেছ ও ও ও। এক কলি করে গায় আর  হারমোনিয়ামের ভেতর খলবল করে ওঠে শেওলাপড়া জল। সে জলে ডিঙ্গিনৌকো ভাসাতে চেয়ে এক ছ’বছরির হাত কেটে ফালাফালা। তবলামাস্টারের দুহাতের পাতার ফাঁকে দাঁড়কাক ছানা: গলার মাংস দুমড়ে-মুচড়ে ছিঁড়লে তবেই তো সার্থকনামা। ঘরের উত্তরদিকের কোণে, পুরনো দলিল-দস্তাবেজের ফাঁকে ঘর বাঁধে যে দর্জিপাখি, তার মুখে তৃতীয় শ্রেণীর বাংলা দিদিমণির আদল। তবলার বোলে বেজে ওঠে যে ছন্দ, তার কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে বালিকাবাহিনী তখন গজগজ করে গিলে খাচ্ছে গোটা গোটা গীতবিতান। বাদ থাকছে না বাঁধাইয়ের সেলাই পর্যন্ত।

দাসব্যবসা 

এক।

অলিগলি পেরিয়ে কোনো এক ইতিহাসহীন বটগাছের কোটরে যে চিলেকোঠা, তাকে চিলেকোঠা বলে এখনও কেউ চিনতে পারে নি। জর্জেট বোরখার মত মিশকালো দেওয়াল, দেওয়ালের কোণ ঘেঁষে ঘেঁষে কোনো এক আদ্যিকালের জমিদারবাড়ির বাতিল যত গ্র্যান্ডফাদার ক্লক। বাতিল তবু মার নেই—ঘন্টায় ঘন্টায় তাল মাপছে। এ ঘরেই বন্ধ করে রাখা হত বেয়াদব যত কাচ্চাবাচ্চার দল। কস্মিনকালে মা-মাসি-পিসি মিলে হাজার থাবড়ালেও দুচোখের পাতা এক হয় না যাদের। বর্ষাশেষের রাস্তাডোবা কাদাজলে সাইকেল চালিয়ে ওই তো আসে ফিঙে। সাইকেলের স্পোকে দুটো দুটো করে বেঁধে মাঝদরিয়া অবধি হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে নিয়ে যাবে ওই কচিদের। তারপর, জাহাজের মাস্তুল, জরাজীর্ণ লাইটহাউজ, ফসফরাসের ঝলকানিতে শীত্কার—ফিঙের দায়িত্ব শেষ। আর বেশি কি, পাড়া জুড়োলো। ঘুম, শুধু ঘুম।

দুই।

হেথায় আমরা অনেক জনে,
বাক ঢাকে তাই ঘামের তোড়ে।

সাজঋতু 

যে গুদোমঘরে এককালে বন্দী করে রাখা হত অবাধ্য কচিকাঁচাদের,
সেখানে আজ এখন বিউটিপার্লার। ঠিক সকাল নটায়,
চাবির গোছা দোলাতে দোলাতে অরুমাসি পার্লারের তালা
খোলে। চাবির রিংয়ে দোলে একটুকরো চাঁদ। তালা
খোলে আর হিহি করে শীতে কাঁপতে থাকে দেওয়ালজোড়া
আয়না। কাঁচ আর কাঠের ফ্রেমের মধ্যে যেইটুকুনি ফাঁক,
সেইখানে বসে সিলভিয়া প্লাথ হতে চেয়ে একের পর এক
কবিতা লিখে চলেছে অরুমাসির ছোটবোন তরুমাসি। লিখতে
হয়, নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়। অরুমাসী বোতলে বোতলে
ভরে রাখে চাঁদের গুঁড়ো। ওই এক হাতযশ অরুমাসির।
কালোকুচ্ছিত খ্যাংরাকাঠি মেয়েকেও বানিয়ে দেবে
হিমোগ্লোবিনবিহীন সাদা। ফ্যাটফেটে সাদা—ধ্রুবতারাসম।
বেশি বাড় বেড়েছ তো সপ্তর্ষিমণ্ডল ছেনে বানিয়ে দেবে
পন্ডস পাউডার। তোমার হাড়মাস তখন গুঁড়ো গুঁড়ো গুঁড়ো—
কোনো এক নেকিচুদি মাগীর চামড়া আচাচ্ছে। তবে
ওই এক বদভ্যেস অরুমাসির। ভুলেও তাকাবে না
আয়নার কাঁচে। মাগো, কে অত শখ করে দেখতে
চায় আম্রপল্লবের মুখে গর্ভস্রাবের উচ্ছিষ্ট?

গীতবিতান 

গলায় হারমোনিয়াম বেধে এক ধাক্কায় যেই না আলো-না-ফোটা শহরের রাস্তায় বের করে পেছনে দড়াম করে বন্ধ হলো গেরস্তবাড়ির দরোজা, অমনি ঝাঁকে ঝাঁকে দাঁড়কাক এসে দখল নিল নাচের ইস্কুলের লম্বা হলঘর। চোখে চোখ ঝলসে ওঠে নলখাগড়ার বন, তবে সেসবই তো মুখে মুখে শোনা স্মৃতি। নাচের দিদিমণি আধ ইঞ্চি শাড়ি তুলে দেখাতে চায় সেলোফেনের খসখস ছন্দ। কঙ্কালের নখে নখে কে যেন ঢেলে দিয়েছে শিশি শিশি নেলপালিশ। তার বোধহয় কোনদিন করবীফুল দেখা হয়ে ওঠেনি। করবীর পাপড়ির ভাঁজে মরচে। সে মরচে খুঁটে খায় একজোড়া শালিক। গুলতি দিয়ে মারলে একটাকে জোড়া শালিক হবে এক। এক শালিক মানে স্কুলে বেত। বেতের দাগের ওপর দিয়ে ছুটবে কু ঝিক ঝিক রেলগাড়ি। দিদিমণির শাড়ি ওঠে আধ ইঞ্চি আর চোখ গোল গোল করে ক্লাসশুদ্ধ নর্তকীরা দেখে আকাশী নীল ধনেখালির কুচি বেয়ে গোলাপবাগিচা। ঘরের কোণের হাতপাবিহীন ছেনিপুতুল মাথা নাড়তে শুরু করে। উলের বলের মত এ হলঘর এ কাঁটায় জমলে, গড়ে উঠবে দাঁড়কাক আর পুতুলদের মিলিত সঙ্গীতানুষ্ঠান। চলন্তিকা অভিধানের জরাজীর্ণ পাতা ফর্দাফাঁই করে ছিঁড়লে, নিংড়োলে জোটে যে আধ ছটাক আলতা, তাতে দানা ভিজিয়ে ভিজিয়ে সেসবের ফর্দ লিখবে বুড়োধাড়ি চিল। অদৃশ্য, চোরাই চালের দানার ব্যাসার্ধের চুল খিমচে ধরে, পা পিছলে কলম।

লোকগল্প 

গিরগিটির জিভের মত ধানক্ষেতের
মধ্যে দিয়ে চলে গেছে আলপথ। বকের
ঝাঁকের ফাঁকফোকর দিয়ে উড়ে আসে
যে পঙ্গপালের দল, তাদের ডানায় চ’ড়ে
হাততালি দেয় রাখালবালক। ওপাড়ায়
গাইগাভীদের মড়ক। তাই, বেকার। তবু
এ লোককথা-কস্টুম ছেড়ে বেরিয়ে আসে
যদি প্লাস্টার অফ প্যারিস কাগের ঠ্যাং
ব্যাঙের ঠ্যাং স্কার্ভি সম্মানিত উদর, তবে
সাঁওতাল নেত্য হবে কোন বাবুদের বাউল-উৎসবে?

ডাকিনীকাব্য 

এক।

মিষ্টি দই সবাই ভালবাসে জেনে অরুমাসির ছোটবোন তরুমাসি ক্যাঁচক্যাঁচ করে কেটে ফেলে নিজের পিঠের চামড়া। তারপর, অস্থি মাংস শিরা-উপশিরা। আরও কত কি। নিজের গোটা পিঠ নিজে ঠিক হাতানো যায় না বলে প্রথমে চলে কসরত, পরে ভাড়া করে আনে এক লরি লিলিপুট বাহিনী। লিলিপুট-বাহিনী নীরা সিরিজ আওড়াতে আওড়াতে তরুমাসির মেরুদন্ডের জায়গায় থাবড়ে থাবড়ে দই ভরে। উঠোনের চারদিকে গন্ডি কেটে দিয়া হাতে ঘুরপাক খায় সখিকুল। কপালে ইয়া বড় লাল টিপ, কানে টেরাকোটার দুল। তরুমাসির পালা শেষ হলে এক এক ক’রে তারাও ভাড়া নেবে লিলিপুট বাহিনী। বাজারে মিষ্টি দই শেষ হলে আছে গোপালমুদির এক দোকান ভর্তি জ্যাম-জেলি-আচার-চাটনি। এ ভঙ্গ রঙ্গভরা বাংলাদেশে মিষ্টান্নের অভাব হয়েছে বলে কেউ কখনো শোনেনি।

দুই।

তরুমাসি যখনই কবিতার খাতা খুলে বসে, খাতার পাতায় ছায়া ফেলে আট বছরের ভাইপোর চিল-চিত্কার। চারের ঘরের নামতা এখনো মুখস্থ রাখতে পারে না বলে, তাকে বন্ধ করে রাখা হয়েছে মীটসেফে। কাগজের নৌকার মত ভাঁজে ভাঁজ ফেলে গুটোনো ভাইপো মাছের ঝোলের ভাপ, বস্তাভর্তি নতুন আলুর গুমো গুমো গন্ধ আর কাজের ঝি লক্ষ্মীমাসির শিলনোড়ার শব্দ শুনতে শুনতে ঘামে ভিজতে থাকে। ভিজতে থাকে আর গলতে থাকে— ঘড়ির কাঁটার শব্দ হারিয়ে ফেলে সময় মাপতে থাকে পিসিমণির কবিতা লেখার শব্দে। পিসিমণি তখন অক্ষর-শব্দে বিভোর— প্লাস্টিক রজনীগন্ধার মত নির্নিমেষ, নিষ্কলঙ্ক কবিতার লাইনে । এইটুকুনি, সুসংহত, প্রতিসাম্য ছাড়া অন্য কোনো চাহিদা নেই। সান্ধ্য-আসরে পিসিমণি কবিতা পড়বে, হাততালির শব্দে তিরতির করে থুথু ছেটাতে থাকবে নন্দন চত্বরের যত দেবদারু পাতা। কোনো এক অতিবাম কেরানির হাতের তেলোয় হাঁটু অবধি শাড়ি তুলে ধেই ধেই নাচবে পিসি। কবিতার খাতা তখন ঘুমের ওষুধ। টেরাকোটা দুল দুলিয়ে ছাদনাতলায় পিসিমণি বসলে ভাইপো দেখে রান্নাঘরের কোণায় কোথাও কিছু নেই। খালি এক গোসাপ কলোনি। ওই তো পিসিমণি নতুন পিসেমশাইয়ের হাতে হাত ধরে চিড়িয়াখানার সাপঘরে পা রাখছে। সানাই কোথায় হে? সইসাবুদের কলম? চুক্তিপত্রে টিপছাপ মেরে পিসিমণি কবিতা লিখতে বসে। অন্ত্যমিলের বিভীষিকা ছাড়া আর কিছু লেখা হয়ে ওঠে না। পারে না। ঘুমপাড়ানিয়া ছড়াগান মকশো করতে করতে ওই তো পিসি কৃত্তিবাস কুড়োল।

***

কুন্তল মিত্রের কবিতা

আমি শিউরে উঠি
কেননা, জমাট রক্ত তাড়া করে আমায়
আমি চমকে উঠি
কেননা, ঠিকরে আসা চোখ আমার দিকে তাকায়
আমি ঘেমে উঠি
কেননা, কাটা হাত গলা টিপতে আসে আমার
আমি কেঁপে উঠি
কেননা, আমার দিকে এগিয়ে আসে কঙ্কাল, আর…
কাল সারা রাত ধরে প্রহার করেছ
কাল সারা দিন ধরে জড়িয়ে ধরেছ
কাল সারা সন্ধে ধরে ধর্ষণ করেছ
কাল ঘণ্টায় ঘণ্টায় চুম্বনে রেখেছ
তোমার ওই চওড়া কাঁধ একদিন আমায় বহন করেছিল
তোমার ওই সুদৃঢ় হাত একদিন আমার জন্য ফুল পেড়েছিল
তোমার ওই দীঘল চোখ একদিন আমায় কটাক্ষ হেনেছিল
তোমার ওই সুঠাম দেহ একদিন আমায় পাগল বানিয়েছিল
এই যে পাশবালিশ
এই যে রাতপোষাক
এই যে আলো ও আয়না
এই যে ক্লিপ ও রবার ব্যান্ড
তুমি তো জানতে, তুমি তো জানতেই
আমায় বোবায় ধরে, আমায় নিশিতে ধরে।
টর্চের আলো যা দেখেছে তা শুধু গহ্বর
মশালের আলো যা দেখেছে তা শুধু ঘন জঙ্গল
হ্যারিকেন আলো যা দেখেছে তা শুধু আঁচড়ানো মাটি
মোমবাতি আলো যা দেখেছে তা শুধু ধূ ধূ বালিয়াড়ি…
তুমি তো দেখোনি
দেখি না আমিও আর…
আতঙ্ক নিয়ে সহবাস করি
দড়ি নিয়ে সহবাস করি
আগুন নিয়ে সহবাস করি
ভয়কে নিয়ে সহবাস করি না, করি না আমি।

রাশিচক্র ভাঙতেই নেমে আসে ভয়
ভয়, নাকি ভয়কল্প, আদিম তরাস,
নাভি থেকে উঠে আসে শিরশিরানি
স্নায়ু থেকে উঠে আসে ধুকপুকানি
ঘিলু থেকে উঠে আসে ম্যাজম্যাজানি
ত্বক থেকে উঠে আসে ঘিনঘিনানি,
নাকি এসব কল্পনা, আমার মধ্যে
খুঁজে ফিরি আমারই আমিকে?

এ একধরণের খেলা ভয়ের সঙ্গে, জয়
আদতে এই কী শ্রীহীন মধু
তবু ভয়…
সারা বেলা অপেক্ষার পরও নন্দিনী
আসেনি রক্তকরবীর খোঁজে
তবু ভয়…
গেঁথে তোলা লিপিকায় জয়পতাকা তুলে ধরা
আকাশ তো খোলা নীল ক্যানভাস
রঙে রঙে ছয়লাপ
তবু ভয়…
এও একধরণের খেলা ভয়ের সঙ্গে, পরাজয়ও।

নাভিপদ্ম ছুঁয়ে দিতে নেমে আসছে ভয়
জন্ম নিচ্ছে গুটিপোকা, হাজার হাজার
গুটিপোকা, ছেয়ে যাচ্ছে বাজারে-ঘাটে
বাসে-নৌকোয়-মেট্রোয়-ট্রামে-বাংলায়
ভারতবর্ষে— ভুবন জুড়ে গুটিপোকা,
পোকায় ঢেকে ফেলছে দিকবিদিক,
চরাচর জুড়ে কালো, তমসাচ্ছন্নতা
বিষণ্ণ হলুদ আলো পোকা কাটছে
পোকা কাটছে হলুদ বিষণ্ণ আলো,
পোকা থেকে কবে জন্ম নেবে— আমার প্রজাপতি

মণিবন্ধ থেকে নেমে আসছে আঁধার
নেমে আসছে ভয়ের গুটিপোকা।
ছেয়ে যাচ্ছে, ঢুকে যাচ্ছে ব্রহ্মরন্ধ্রে
বালিকার নাভিত্বকে ফুটে উঠছে আলো
আলো শবাধার, আলো রোমকূপে, আলো যোনি-সম্ভূতে,
আলোয় ভেসে যাচ্ছে বিপজ্জনক ব্রহ্মবিদ্যালয়
আর আমাদের শাল্মলী গাছ থেকে
বেরিয়ে পড়ছে অস্ত্র, কিংবা অন্ধকার ঢেকে ফেলছে
নদী-ঘাট-আলপথ। এই আলপথ দিয়ে
একদিন হেঁটে চলে গেছে দুদ্দুশাহ, কুবির গোঁসাই
এই পথে পড়ে আছে এক কামবিমুখ পাখি
গুটিপোকা খেতে পারেনি তাকে।

নীবিবন্ধে লেখা রয়েছে পরাজয়
স্যাঁতস্যাঁতে আঠাল দিনগুলিকে ভুলতে চাওয়া
লালায় ভরে যাচ্ছে বুক-পিঠ
শিরদাঁড়া বেয়ে নামছে লজ্জা
ইড়া-পিঙ্গলা-সুষুম্না খুলে দিলে
বাতাস চলাচল করবে নিজের মতো
তখন রক্তের আশ্রয়ে রক্ত চলকে ওঠা
ইশারা গভীর হলে নামবে বান
তীব্র থেকে তীব্র হয়ে উঠছে— ইচ্ছা
ইচ্ছার আরেক নাম কী আমি জানি!

তাকে আমি রেখে এসেছি—শৈশবের জামগাছের কোটরে,
হারিয়ে এসেছি—কেটে যাওয়া ঘুড়ির লেজে,
ফেলে এসেছি—সন্ধ্যার গোরুর গাড়ির হ্যারিকেনের রাতে,
ছেড়ে এসেছি—জলঙ্গীর পার ঘেঁষা ছোট্ট ডিঙিতে।
সে ছিল আমার আদর;
এখন শহরের প্রতিটি কিস্তিতে ভয় জমা হয়,
সোডিয়াম ভেপারের ফ্যাকাশে সন্ধে ভয় জমা হয়,
বহুতলের তারায় আলোকবর্তিকার ভয় জমা হয়,
জলাধারের নীল আবেশে ভয় জমা হয়।

***

মধুশ্রী বসুর কবিতা

ভয়তাড়ানি মন্ত্র

ভয় আছড়ে ভয় পাছড়ে ভয় নিত্য ভয় সনাতন ভয়
ভয় ঝগড়ায় ভয় রগড়ায় ভয় চিত্তে ধুম দনাদন ভয়
ভয় ধর্ম ভয় স্বর্গ ভয় খণ্ড ভয় ব্রহ্ম ভয়
ভয় মর্মে ভয় মর্গে ভয়ে পণ্ড যাত্রারম্ভ ভয়
ভয়ং তন্ত্র ভয়ং যন্ত্র ভয়ে অন্ত্র ভভংভয়ে ধাঁ
ভয়স্বরে মন্ত্র পড়ে ভভংভয়ের পুতনি ভয়ের ছা
ভয়ংকণ্ঠে ভভং ভড়ং ভয়ংগচ্ছ অহং বয়ং ভোঁ
ভয়ম্‌প্রাতে ভয়ম্‌রাতে ভয়ের পুঁটলি গামছা বেঁধে থো

সাইকেল

তাহলে কি থেকে যাবো বেপাড়ার সেলফিযুগলের বগলের নীচে অপসৃয়মান সাইকেলের চাকা হয়ে? মৃত্যু না যে দানধ্যান, কবিতা না যে বিতর্ক, কাঁচি না যে ক্যাঁচ ক্যাঁচ কট কট, ক্রিকেট না পিকেট না কিতকিত না কিছু না মিছু না।

সত্তরের দশকে চাদ্দিকে যখন আর দশটা জিনিস ঘটছিলো টটছিলো, এক দুপুরে অনন্যায় ‘শোর’ বই দেখতে গিয়ে যদ্দূর বুঝি কেঁদে ভাসিয়েছিলো আমার বাবা। বাবা, যার কাঁচাপাকা গোঁফে খাবারের টুকরো লেগে থাকে (লজ্জা লজ্জা), আর দুঃখ পেলে যার নীচের ঠোঁট ঝুলতে ঝুলতে বুকে গিয়ে ঠেকে। চেয়েচিন্তে ঘণ্টার কড়ারে ধার করা সাইকেল শুইয়ে রেখে, পুরনো স্কুলবাড়ির পাঁচিলের গায়ে দেড় ফুট বাই দেড় ফুট গর্ত দিয়ে হাঁ করে পৃথিবী নামক বায়োস্কোপ দেখা। গর্ত ডিঙিয়ে ওপাড়া থেকে এপাড়ায় আসতে বাবার এক জীবন পেরিয়ে কাবার। অথচ বাবু মনোজকুমারকে দেখো! জীবন চলনেকা নাম চলতে রহো চলতে রহো সুব্‌হ শাম করতে করতে করতে করতে দিব্যি চোখ উল্টে পড়ে মরে গেলো। চেইন পড়ল না, নিদেনপক্ষে একটা পেরেক কি কাঁচের টুকরো কিম্বা কাঁটার ডাল-টাল কেউ দয়া করে ফেলে দিলেও প্রাণটা বাঁচতে পারত। কিন্তু যার যা কপাল।

তা’বলে কি থেকে যাবো বেপাড়ার সেলফিযুগলের বগলের নীচে অপসৃয়মান সাইকেলের চাকা হয়ে?

অথচ ধরা যাক আমার ঠাকুরদা। এই চুরি করে বউএর গয়না বেচে দিচ্ছে, হুই ইজিচেয়ারে দু’ঠ্যাঙ তুলে আরাম করে ঘুম দিচ্ছে, এদিকে মুখের উপর খবরের কাগজে অক্ষরেরা নিজে নিজে এ ওকে পড়তে পড়তে হাকুচ ক্লান্ত, ওই আবার কলেজের নালাক্যাবলা ছাত্রদের প্রতিফলন প্রতিসরণ ছ্যারাফ্যাটা ভুলচুল পড়াতে পড়াতে এক মিনিট আসছি বলে চট করে একটা দোতলা বাড়ি বানিয়ে ফেললো, হুশ করে পড়তি কাবাডি প্লেয়ারের নোংরা রুমাল পিকপকেট করে তাই দিয়ে মুখ মুছছে,  ওই আবার দেখা গেলো অনন্ত দুপুর ধরে পুরনো সাইকেলের পার্টস খুলছে, জুড়ছে, খুলছে, জুড়ছে…

বিনয় মজুমদার যখন বলছেন ফিরে এসো, চাকা, সেটা কি পাশের পাড়ার দুই-বেনুনি অমিতা ঘোষকে উদ্দেশ্য করে নয়? অমিতা ঘোষ, যাঁর গায়ের রং ক্ষীরকমলার মতো, নাকের উপর ছোট্ট আঁচিল আর যিনি ছোট্ট ছোট্ট পায়ে লেডিবার্ড পেডাল করেন আর খামোখাই কবির জানালার নীচ দিয়ে স্কুল থেকে বাড়ি বাড়ি থেকে স্কুল যাতায়াত করেন রোজ।
অবশেষে আসছি আমার প্রপিতামহের প্রসঙ্গে, যার জীবনের অধিকাংশ সময়টাই কেটে গেলো দু’চাকার পিঠে ঘোড়ার স্বপ্ন দেখতে দেখতে। এ ঘোড়া সে ঘোড়া নয়। এ ঘোড়ার মুণ্ড টেবিলে স্থাপিত না, এ ঘোড়া জ্যোৎস্নায় ঘাস খায়না মোটে, পিঠে ডানা অব্দি নেই, শুধু দশ দশ মাইল লম্বা ডাণ্ডার আগায় জোড়া ভারী পেন্ডুলামের মতো এ ঘোড়া মহাপ্রস্থানের পথে পবিত্র গু-এর এপিঠ আর ওপিঠ করতে করতে একদিন কৈবল্য লাভ করলো।

এইভাবে সময়ও ঘোরে।

তালিকা

আলস্য
কুডাক
যস্মিন দেশে
যদাচার
অগত্যা
কদাচার

ক্লান্তি
প্রবজ্যা
গ্রহ
ছিছিৎকার
শীঘ্রপতন
শান
অপেক্ষা
শান
অপেক্ষা
শান

মিথ্যা
আচারবিচার
ক্ষোভ
ক্রন্দন
বিশ্রাম
এক পা গিয়ে
তিন পা
পশ্চাদপসরণ

বাতেলা
খেলা
ঝিল্লিরব
শৃঙ্খল
কাংস্যকণ্ঠ
তাচ্ছিল্য
শৈথিল্য
কুৎসা
অপ্রয়োজন
এতদর্থে ভয়।

ক্রমহ্রাসমতী বালিকা(গণ)

খুশি খুশি খুশি।
তিন গু-খাকী।
খুশির চুল ঝাপর,
খুশির চোখে কাজল,
খুশির নাকে নোলক।

খুশি খুশি।
দুই গু-খাকী।
খুশির বুকে আঁচড়,
খুশির নাকে দড়ি।

খুশি।
গু-খাকী।
খুশির দাঁতে মিশি।
খুশি একা-একাই খুশি।

মা’র মন্ত্র

জগজ্জননী জয় মা। ওঠো মা। খাও মা। বসো মা। ঘষো মা। রক্ষে করো, রক্ষে করো, রক্ষে করো।
এতং বেতং বদ মা,
সাত-সহস্রং বদ মা,
ভাটং বদ, চাটং বদ, মা লিখো, মা লিখো, মা লিখো, লিখো মা: ওম নমো নমো নমো নমো।
মা লিখো ধুলোর উঠোন,
মা লিখো তুলট কাগজ,
মা লিখো ভূর্জপত্র, শ্লোক, কাব্য, ঠাপব, পরিবার, ধরি মাছ, না-ছুঁই-না-ছুঁই-না-ছুঁই লো পানি।
এদিকে মায়ের যত পাগলা ব্যাটা, মারছে ঝ্যাঁটা। রক্ষে করো, রক্ষে করো, রক্ষে করো, করো মা।
সিংহের পাছা সরু মা,
গাধার পিঠে মাথায় ঘোল,
চাট্টিমাত্র হাত বই কি, পিঠপ্রমাণ ঘাম-ঘামাচি,
পদ্মপাপড়ি ছেঁড়ো, খাও, ছেঁড়ো, খাও, ছেঁড়ো, খাও, ছেঁড়ো মা। ওম নমো নমো নমো নমো।

জীর্ণপরিচয়

জীর্ণপরিচয়, মেয়েলি প্রথম পাঠ— ছেঁড়াফাটা যা-ই হোক না কেন, যা বললেই তারপর এসো এসো বলতে হয়।
তাই এসো মা লক্ষ্মী বোসো ঘরে আয় আয় তবে সহচরী ঝড় নেমে আয় আয় হাতে হাতে ধরি গিরি গৌরী আমার এলো কই? তার জায়গায় এলো কিনা— আ ছি ছি ছি! গায়ে পিঠে শতেক আঁচিল, নাক কান নিয়ে গেলো চিল, আঁই মাঁই কাঁই গো, আমি তো আর নাই গো, যাঃ যাঃ যাঃ!
এসো, এসো
যাক রাগের মাথায় কাগজকাটা হালুমবুড়ো
যাক ডালের হাতায় মগজ চাটা মর্চেগুঁড়ো
(আহা) যাক বললেই যায় ঘোচানো হাত ঘুরোনো তিলের নাড়ুর স্বপ্নরাজি
(ও বাবা) নাক ধরলেই মান বোঁচানির, রাগ ভাঙানি মিলের শাড়ি, আতসবাজি
কী রূপ বহিরং-গে!
তাই কাল তোমার সং-গে
দেখতে গেলুম যাত্রা—
কী যাত্রা করালে বঁধু!
বেপথে…
পড়ন্ত রোদ্দুর…
যাক যাক যাক
তাই এসো এসো ও বান্ধব গো। বসতে দেবো দুটো পিঁড়ি, খেতে দেবো একটা বড়ি, মারিবে পড়িবে উড়িবে সুখে, আর কুত্তায় কান্দিবে উঠোন শুঁকে শুঁকে শুঁকে। হাতে নেইকো ঝুমঝুমি, ললাটে নেই চুমোচুমি। ভ্যাঁ করলেই দিন চলে যায়? ট্যাঁ করলেই রাত? আর হ্যাঁ করতেই সুদিন এলো? প্যাঁ করতে পোঁদে কষালো লাথ? যাঃ যাঃ যাঃ…
আবার বলে যা! রাজপুত্তুর কি শস্তা?
আর রাজকন্যা…? রাজকন্যা কি কম পড়িয়াছে?
জীর্ণপরিচয়, মেয়েলি দ্বিতীয় পাঠ— পথের শেষ, ঘোলের শেষ, আড়ির শেষ আর দ্রৌপদীর শাড়ির শেষ কোথায়? আর যাই বললি যে, যাবার ঠাঁই-ই বা কোথায়? পাতের শেষে পান্তা। ন্যাতা খাবি? ন্যাতা যাবি? ন্যাতা গেলে ল্যাংটা।
এসো, এসো

কূপ

পুরাতন তলহীন কূপের গভীরে
অতিকায় জলজীব এক মৃদুমন্দে যাতায়াত করে,
শিকার সন্ধানে থাকে
নিঃশব্দে, ওঁত পাতে।
আকাশে বকের ছায়া কখনো বা জলতলে পড়ে।
অমনি প্রকাণ্ড লাফে কূপবারি আলোড়িত ক’রে
ছায়া ধ’রে টান দেয়।
কাঁচের বলের মত চোখে কোনো মায়া নেই, ঘৃণা নেই,
খিদে আছে, খাদ্যের প্রয়োজন আছে।
আকাশ পাতাল ঢেকে
সারি সারি ক্রূর দাঁতে ভরা মুখ খুলে ধরে।
এখনই, এখনই মৃত্যু হানা দেবে
শরীরে, নরম মাংস ছিঁড়েখুঁড়ে
তুখোড় আঘাতে।

ক্ষোভ, বিস্ময়, অবিশ্বাস, চমক ছাপিয়ে ত্রাস—মহাত্রাস—
পুরাতন তলহীন কূপের গভীরে
খেলা করে, শিকার সন্ধান করে
অতি ধীর, মৃদুমন্দবেগে,
দ্রুতি নেই, দ্রুততার প্রয়োজনও নেই।
দেহ আছে, ভর আছে, জাড্য আছে
নিয়তির মত এক অতিকায় পুচ্ছ আছে
দেহের পশ্চাতে।
ইতিপূর্বে এই জীব সমুদ্রে বসতি করে ছিলো।
বসতি বলেনা হয়তো তাকে—
সপ্তসিন্ধু জুড়ে ছিলো সাবলীল বিচরণ।
যেখানে ভয়ের গন্ধ, সেখানেই ভেসে উঠতো
নিরীহ ত্রিকোণ পাখা, অতর্কিতে
কেউ কিছু বুঝে উঠবার আগে
হিঁচড়ে অতলে নিতো
অপঘাতে।

বহু বছরের চেষ্টা, বহু কষ্টে কুয়োতে এনেছি ফেলে তাকে।
অবশেষে কাকচক্ষু সমুদ্রস্নান সম্ভব হয়েছে আজ।
অথচ হৃদয়ে জানি, যেই দিন কৌতূহলে
পরিত্যক্ত কৃষ্ণকায় কূপের উপরে ঝুঁকে
নিজের মুখের দাগে কী রহস্য লেখা আছে খতিয়ান নিতে যাবো,
আরও, আরও কৃষ্ণতর অতিকায় মূর্তিমান ত্রাস
জলতল আলোড়িত করে, মহালাফে
ছায়া ধরে টান দেবে,
আকাশ পাতাল ঢেকে
সারি সারি ক্রূর দাঁতে ভরা মুখ খুলে ধ’রে
সারল্যে তাকাবে।
কাঁচের বলের মত নির্বোধ দু’চোখে
খাদ্যরূপ একাকার হতে থাকবো
আমিই আমাতে।
***

‘ভয়ের কবিতা’ নিয়ে আড্ডা এবং কৈফিয়তের কিছু অংশ

আমাদের ইমেল আড্ডার কিছু অংশ এখানে তুলে দিলাম। এই ‘ভয়ের কবিতা’ লেখার পিছনের যে পদ্ধতি বা ‘প্রসেস’ তাকে এইভাবে কাগজে কলমে ধরা মুশকিল। যেমন আমাদের জয়লিপি দত্তকে দিয়ে কিছুতেই কবিতার কৈফিয়ত লিখিয়ে ওঠা গেলো না। তবু তার এই ‘না’ বলাটাও এই যৌথ পদ্ধতিতে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে। জীবনে কৈফিয়ত আসবে নিজের ভিতর থেকে, প্রেসক্রিপশন মেনে কি কৈফিয়ত লেখা যায়! অথচ জয়লিপির সাথে এই কবিতা সিরিজ নিয়ে, এবং আরও হাজার একটা ছোটবড় বিষয়, যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই সিরিজের সাথে সম্পর্কিত, সেসব নিয়ে ফোনে কিম্বা মুখোমুখি যত আড্ডা হয়েছে তাকে কপি পেস্ট করবো কোন যন্ত্রে?

তবে কুন্তলদা তাঁর ছোট্ট ইমেলে যে কথাটি বলেছেন সেটি আমাদের সকলের জন্যেই সমান ভাবে খাটে—এইভাবে একসাথে সবাই লিখতে এলাম, তাই এই ক’টি কবিতা লেখা হলো। নয়তো এই ঊনচল্লিশটা কবিতা কোনোদিন লেখাই হতো না। তাতে বিশ্বজগতের কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হতো কি হতো না—এই বিতর্কটার উপরে দাঁড়িয়েই হয়তো আমাদের বাঁচা-মরা সৃষ্টি-অনাসৃষ্টি…

ভয়ের কবিতা ৩ – সারা

‘নিম্নগতি স্নেহ’ খুব আবেগের কবিতা। সমস্যা থেকে ভয়ের উৎপত্তি হয় অনেক সময়। এই ভয়টা আমার সমস্যাজনিত ভয়। মধুশ্রীদির কথায় প্রেম-দুঃখকে মূল রস করে কবিতা না লিখতে গিয়ে ‘ভয়’ অনুভূতিটাকে বেছেছিলাম। আমার তীব্র কিছু অনুভূতির মধ্যে ভয় অন্যতম। কাউকে হারানোর ভয়, নিজে হারার ভয়, নতুন কিছুকে ভয়, পুরনোকে ছাড়ার ভয় – এগুলো আমার মজ্জাগত। ভালবাসলে সবার আগে হিংসে আর ভয়ে আমি কাতর থাকি। এই কবিতাটা আমার ইতিহাস।

ভয়ের কবিতা ৫ – সারা

‘কবিতার থাপ্পড়’: মিথ আমার খুব প্রিয় বিষয়। কবিতায় মিথ আমায় খুব টানে। মিথের ব্যবহারে, অনুষঙ্গে কবিতার খুব কাছে পৌঁছতে পারেন পাঠকেরা। কারণ মিথের সেতুটা খুব পোক্ত – উভয় দিকেই বেশ ভালোমতো চারিয়ে আছে। মাঝে একবার আমার কবিতার সাথে বনিবনাহীন সম্পর্ক চলছিলো। কবিতা বা অনুভূতির উচ্চারণ এড়িয়ে চলাই শ্রেয় মনে করছিলাম। তখন দিনরাত আরেকটা বিষয় আমায় তাড়া করে বেড়াতো। আমি কি আর কোনোদিন দু-লাইন লিখে ‘আহা কবিতা লিখলাম!’ – এই তৃপ্তিটা পাবো না? যে সহজ সম্পর্কে শ্বাস নিতাম এতদিন, যে গোপনতম অনুভূতি লালন করে চলতাম, একার ছিলো যা, তা কি আর ফেরত পাবো না? কবিতা আর স্বপ্নের অনুষঙ্গে আমার একটা সম্পর্কে সবুজ পাতা ফুটেছিলো। সেই নটেগাছটি মুড়নোর ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকার কবিতা এটা।

ভয়ের কবিতা – কুন্তল

আমার কবিতা আমার কৈফিয়ত। এ তো তোমরা বলেই দিয়েছো। তবে তোমাদের সব্বাইকে ধন্যবাদ। তোমাদের জন্য লেখাগুলো হলো। আসলে আমি যে শেষ পর্যন্ত তোমাদের সঙ্গে থেকে খেলা বা লেখা চালিয়ে যেতে পারব এ ব্যাপারে আমার নিজেরই ভয় ছিল। তবু তোমাদের আগ্রহে, বিশেষত সারার তাগাদা কিংবা অনুপ্রেরণায় কবিতাগুলো লিখে ফেলা গেলো। এবার এগুলোর ভালোমন্দ বিচারের ভার পাঠকদের। তবে আমার তোমাদের সবার কবিতাই ভালো লেগেছে। আর জয়ন্তীদির কবিতা আমায় চমকে দিয়েছে।

ভয়ের কবিতা ১ – জয়ন্তী

আমার কয়েকটা পোষা ভয়ের গল্প আছে। কোন বাচ্চা ত্যাঁদড়ামো করলেই আমি যেগুলো শুনিয়ে থাকি। তার একটা হল এই নাকচোখহীন মুখের গল্প, সর্বত্রগামী যে মুখ—যেটা প্রথমে শুনেছিলাম বা পড়েছিলাম কোন জাপানি গল্প হিসেবে। আমার কল্পনায় এই মুখের অধিকারী মানুষটা (পুরুষ মানুষ) বেশ ফর্সা, জাপানি বলে একটু বেঁটে, পিছন থেকে দেখলে ধীরস্থির হাবভাব।  না নন্দিনী, কোনো মেয়েকে আমি এখন চেষ্টা করেও এই জায়গায় দেখতে পাচ্ছি না। মানে ইনি ভূত-ই, ভূতিনী নন।

ঠিক ঠিক করে ভাবলে এখনো এই গল্পে আমি ভয় পাই।  মুখের রেখার মধ্যে একটা সম্ভাবনা থাকে; বদলে যাবার সম্ভাবনা, তাই যত বড় দুর্বিপাকই হোক তার থেকে মুক্তি পাবার একটা আশাও থাকে। মুখের রেখায় আমরা মনের কথা পড়ি—সে পড়া ভুলভাল হলেও। গল্পের এই মানুষটি অপরিবর্তনীয় কিন্তু বহুরূপী, নির্বিকার কিন্তু নিশ্চেতন বা উদ্দেশ্যহীন নন; নিয়তির মত, ইনি কি করবেন আমরা জানি না; কিন্তু যেদিকেই যাই এঁর থেকে নিস্তার নেই। এই মুহূর্তে আমার বেশি ইন্টারেস্টিং লাগছে এই ভেবে যে ইনি কেন আমার কাছে পুরুষমানুষ—অবশ্যই ইনি ধর্ষক নন—বোধ হয় ভালবাসাহীন জাজমেন্টের রূপও আমার কাছে পুরুষ।
বিচ্ছুদের জন্য আরো কয়েকটা ভয়ের গল্প আছে, মায়ের লম্বা হাত বাড়িয়ে গাছ থেকে লেবু পেড়ে দেওয়া, বাঁদরের হাত, ইত্যাদি। কিন্তু সেগুলো নিয়ে কবিতা এল না, লেপাপোঁছা মুখের অ্যাবস্ট্র্যাকশন তাদের মধ্যে নেই বলেই বোধহয়।

ভয়ের কবিতা ৫ – জয়ন্তী

দু-একটা টীকা—

নাকিপুকি— নাকি ও পুকি হল দুই পেত্নী বোন, যারা দরজার পিছনে ঘরের কোণায় থাকে। তারা দুজনে গল্প করে আর রাত্রে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। দিনের বেলা আমরা তাদের ধুলোঝুল ভাবি। ঘরে কাগজের কুচি, আঁচড়ানো চুল এসব পেলে তারা আরো খুশি হয়ে মোটাসোটা হয়ে ওঠে। মরাল—ঘর পরিষ্কার রাখবে। সূত্র—আমার পিসিমণি। ফুসফুসের রোগে খুব যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু হয়েছিল।
ভয় দেখাচ্ছে চেনা শরীর/ মুখোশ মুখের লোক—মুখে গামছা ঢেকে আস্তে আস্তে পায়ে পায়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে আমার দাদা—আমি জানি এটা দাদাই, ওর ঈষৎ দোদুল্যমান ভুঁড়িটা আমি চিনি, চিনি পায়ের চপ্পলটাও, তবু ভয়ে আপ্রাণ চীৎকার করছি। এই দাদা কিছু বছর আগে ক্যানসারে মারা গেছে।

ঘুমের বাইরে হাঁ—বরাবরই মৃত মানুষের হাঁ করা মুখ আমাকে—ঠিক ভয় নয়, কিরকম অসহায়তায় আচ্ছন্ন করে। কেউ কেউ একটুকরো কাপড় দিয়ে চোয়াল বেঁধে দেয়; তাতে আরো বেশি অসহায়তা।

সবকটা অনুষঙ্গ মৃত্যুতে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

ভয়ের কবিতা ৬ – জয়ন্তী

এটা একেবারে সত্যি কবিতা। নিকটজনের ভস্মান্ত শরীর নিজের মৃত্যুকে নিয়ে সেমি-সিরিয়াস চিন্তা আনবেই। যতই যাই বলি, চারপাশের মানুষজনের সঙ্গে আমার এত বছরের ট্র্যানসাকশনে তঞ্চকতাই তো বেশি। আর আমি ভাল মেয়ে—সবাই জানে। অথচ নিজের সম্পূর্ণ চেহারাকে মেলে ধরলে তো নিজেরই বিবমিষা। তাই কখনো কখনো—যদি পৃথিবীটা র‍্যানডম না হয়? যদি কোনো বিরাট পুরুষকে কৈফিয়ত দিতে হয়? হ্যাঁ, আবার পুরুষ—কবিতা ১-এর মত নির্মম বিচারক পুরুষ। র‍্যানডমনেসে বিশ্বাস তাই হয়তো আমার একটা ডিফেন্স—এই ভয়ের বিরুদ্ধে একটা আলগোছ আগল।

কিন্তু, হ্যাঁ রে এত কথা কেন?

ভয়ের কবিতা ৩ – মধুশ্রী 

২’য় আর ৩’য় কবিতার মধ্যে বেশ অনেকটা – এক সপ্তাহের বেশি – ছেদ পড়ে গেলো। এর মধ্যে কিছু মাথায় আসছিলনা সেটাও যেমন ঠিক, আবার চট করে কিছু লিখতে চাইছিলামনা এটাও ঠিক, কারণ এর মধ্যেই আমরা পরস্পরের সাথে ২টি করে কবিতা শেয়ার করেছি এবং কিছু ফিডব্যাক পেয়েছি। এটা ভাল হচ্ছে না মন্দ সেই নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। কারণ এখনো এই ফিডব্যাকগুলি ‘ভালই’, ‘ভাল’ বা ‘খুব ভাল’ – এই জায়গায় আছে। যদি খেলার শেষেও এই ফিডব্যাক এই তিনটি ‘ফ্রেজে’ই সীমাবদ্ধ থাকে তাহলে হয়তো বলতে হবে এই প্রোজেক্টটা ফেল করলো – কারণ এর মানে দাঁড়াবে হয় আমরা যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করলাম না, নয়তো আমাদের কবিতায় চিন্তাভাবনা করার মতো কিছু নেই।

যাই হোক, চট করে আর কিছু লিখে ফেলবো না—এটা ভাবতে গিয়ে আবারও সেই ‘ভয় কি?’ এই প্রশ্নে এসে পড়লাম। তাতে মনে হল আমার প্রায় পুরো জীবনটাই ভয় দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এই যে কোনো এক পরিচিতজনকে একটা খুব ছোট্ট সাধারণ সত্যি কথা বলতে গিয়েও বলতে পারছিনা—এটা সঙ্কোচ বা অস্বস্তি বা ‘বলা না বলা সমান’ জাতীয় ভুয়ো দর্শন হতে পারে, কিন্তু এটা আসলে ভয়। আমার উপর দায়িত্ব আছে—এমন একটা কাজ—করে ফেললেই হয়, কিন্তু করছিনা, এদিক ওদিক করে দেরি করছি—ভয়ে কি? কাজে ভুল থেকে যায় যদি? সে তো থাকবেই। কাজটা শেষ হয়ে যায় যদি? সে তো হতেই হবে। এই সমস্ত ভয় অমূলক নয়, এবং অন্য অন্য রূপে আসে বলে, ‘ভয়’ বলে চট করে ধরা যায় না। আগের কবিতার কাহিনীমূলক ফর্মটা ছেড়ে বেরোবার ইচ্ছে ছিল—কিন্তু তা সত্বেও এই কবিতার ফর্মটা সচেতনভাবে তৈরি করা নয়। এটা একটা তালিকা। তালিকা তো এইরকমই দেখতে হয়।

ভয়ের কবিতা ১, ২ – নন্দিনী

ভয় নিয়ে কবিতার কথা বলতে প্রথমে প্রচুর হাসলাম। মানে, আমি কাউকে কখনো কবিতা লেখার বিষয় লিখতে দিলে, “ভয়” দিতাম না।  কারণ  নিজেকে ভীতু ভাবতে আমার ভালো লাগে না।  আর,  কোনোকিছুকে ভয় পাচ্ছি মনে হলে, প্রথম যেটা মনে হয়, এই ভয়টা আমাকে কাটাতেই হবে। কিন্তু, এও তো সত্যি, রাজনৈতিক ভাবে সত্যিই বড় ভয়াবহ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি আমরা।  সেটা যেমন ঠিক, তেমনি আবার এই বাক্যটার মধ্যেও কি নেই আমূল মধ্যবিত্ত সুবিধাবাদ?  মানে, যে মানুষটি ফুটপাতে সারাজীবন কাটিয়েছে, যাকে যখন তখন তাড়া করে পুলিশ, ধরে কারণে-অকারণে মারে কয়েকটা থাপ্পড়, সত্যিই কি পৃথিবীতে কখনও এমন কোনো সময় ছিল যখন সে সময়টাকে ভয়াবহ ভাবেনি ?

একটু তলিয়ে ভেবে দেখতে গেলে, যে ভয়টা বোধহয় আমাকে অবচেতনে তাড়িয়ে বেরিয়েছে, তা হলো যৌন-হিংসার ভয়।  মানে, যে কোনো সময়ে আমি ধর্ষিত হতে পারি, সেই ভয়।  আমার ব্যক্তিগত জীবনে আমি যতই পেছন-পাকামো করে এ ভয় কাটানোর চেষ্টা করি না কেন, এ ভয় গেঁথে আছে আমার খুব ভেতরে, খুব জটিলভাবে।  একেই হয়ত একভাবে বলে লিঙ্গায়ন। মেয়ে-জন্মের ইতিবৃত্ত।  আর বহু রকমের ভয় ছিল ছোটবেলায়। ভূতের ভয় আমার কোনোদিন ছিল না।  কিন্তু ছিল পড়া না পারার ভয়, মার খাবার ভয়, শাস্তি পাবার ভয়। স্কুলে ঠিক সময়ে পৌঁছতে না পারার ভয়। এইরকম কতশত ভয় নিয়েই তো আমরা বড় হই। ছোটবেলার সেই ছেলেটি বা মেয়েটি যে মার খাবার ভয়ে রোজ পড়া মুখস্ত করে স্কুলে যায়—তা সে সেই স্কুলের পড়া বুঝুক বা না-ই বুঝুক—সেই তো ভবিষ্যতের বাধ্য নাগরিক। স্কুলের টিচার বদলে হয় কলেজ প্রিন্সিপাল, পিএইচডির গাইড, অফিসের বস। মেনে নেওয়া, মানিয়ে নেওয়া।

এই সার্বজনীনতার মধ্যেও আবার আছে শ্রেণী বা লিঙ্গায়নের গল্প। বড় কঠিন ভাবে বাঙালি মধ্যবিত্ত মেয়েরা মেয়ে হতে শেখে। সেই শেখার মধ্যে থাকে কথক নাচের ক্লাস, রবীন্দ্রসঙ্গীত,  পাড়ার পূজোর ফাংশন। একভাবে বাঙালি মধ্যবিত্ত সুচেতনা, সংবেদনশীলা, সুরুচিসম্পন্না মেয়ে হতে শেখা মানে বোধহয় একধরনের প্রলম্বিত ন্যাকামোর পার্ফরমেন্স। সেখানে, সেই মেয়েলি ন্যাকামোর সামাজিক দর্শনে ভয় একটা বড় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কোনটা সত্যিকারের ভয়, কোনটা যে ভয়ের পার্ফরমেন্স, তা আলাদা করা বড় কঠিন। সাম্প্রতিককালের বাংলা মেয়েদের কবিতায় এই ন্যাকামোর উদাহরণ ঝুরিঝুরি।

তো, এই কবিতা দুটোতে আমি ফিরে যেতে চেয়েছি আবার শৈশবের সেই ভয়ের ভূগোলে। এই কবিতাদুটিতে শৈশবকে কোনো মধুমাখা স্মৃতিবিজড়িত দৃষ্টিতে দেখতে যাই নি। স্মৃতি আছে এখানে—আছে তার সমস্ত ভয়াবহতা নিয়ে। যে সমস্ত ক্ষেত্রগুলিকে বাংলা সাহিত্যে দেখা হয়েছে নস্টালজিয়া মাখানো দৃষ্টি দিয়ে, মনে করা হয়েছে সেসব সমালোচনার উর্দ্ধে, যেমন রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্লাস, নাচের ক্লাস, সেগুলোকেই আমি আমার মতো করে ধরার চেষ্টা করেছি। তাদের দেখানোর চেষ্টা করেছি তাদের সমস্ত অবদমনসহ। তার সাথে আছে ছোটদের চোখ দিয়ে আরেকটু বড়দের জীবনটাকে দেখার চেষ্টা। বিশেষ করে আরেকটু বড় যে মেয়েরা। এসেছে ছোটদের ছড়া, ছোট মেয়েদের কথার ভাষা। বিশেষ করে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার মুখের ভাষা। ফরাসী পরাবাস্তববাদী ছবি ও লেখালেখি নিয়ে একধরনের উত্সাহ আছে আমার। বিশেষ করে পরাবাস্তববাদী নারী শিল্পীদের আঁকা ছবি নিয়ে—তাই, কোথাও বোধহয় লীয়নারা কারিংটন, রেমেদীয়স ভারস প্রমুখের জগতের কাছেও হাত পেতেছি আমার প্রজন্মের বাঙালি ছোট মেয়েদের জীবনকে ধরতে গিয়ে। ‘হাইপারবোল’ ব্যাপারটাও বেশ আকর্ষণ করে আমায়। আর,একভাবে মনে হয়, বাংলা মেয়েদের কবিতায় এই হাইপারবোলের অভাব বড় বেশি। যদিও ‘ভিকটিমাইজেশন’ বা যন্ত্রণাবিলাস ছাড়া সেখানে অন্য কিছু তেমন একটা দেখতে পাওয়া যায় না, তবুও সেখানে সমাজের অবদমনের চিত্রও আসে বড় সুললিত ভাবে। নেকি নেকি চিত্রকল্পে। সেই ন্যাকামিকেও নিজের মত করে প্রশ্ন করার চেষ্টা করেছি এসব কবিতায়। চিত্রকল্পের মধ্যে হাইপারবোল আমদানি করে।
আর, ভয়ের কথা বলতে গেলে এটা অবশেষে লিখতেই হয় যে আমার জীবনের একটা বড় সময় কেটেছে বাংলা সাম্প্রতিক কবিতার ভাষাকে ভয় পেয়ে।  মনে মনে ভেবেছি, বাংলা সাম্প্রতিক কবিতা আমার কথা বলে না। মস্তিষ্ক ও হৃদয়—এ দুই দিয়েই বুঝেছি বাংলা ভাষায় মেয়েদের কবিতায় যে ন্যাকামো চলে, তা কখনো আমার হতে পারে না। কিন্তু, তাকে প্রশ্ন করতে ভয় পেয়েছি। কারণ, মনে হয়েছে আমার বোধহয় সে যোগ্যতা নেই। এই কবিতাগুলোতে সে ভয়কেও একটু একটু করে ভাঙ্গার চেষ্টা করছি।

কবিতা ৩, ৭ – নন্দিনী

এই কবিতাগুলো একটাভাবে দেখতে গেলে আগের দুটোর ধারাবাহিকতায় লেখা। খুব বেশি সময় না নিয়ে, খুব ভোরবেলায় অথবা খুব বেশীরাতে ঠিক শুতে যাওয়ার আগে লেখা। একটা দুটো শব্দের বাইরে পরিমার্জনা, সম্পাদনা ইত্যাদিও করা হয়নি। আমার প্রচেষ্টা ছিল খুব বেশি অন্তর্মুখীনতায় না গিয়ে, বা একেবারেই না গিয়ে, কতগুলো ছবির মধ্য দিয়ে ‘ভয়” বিষয়টাকে ধরা। কোথাও একটা আশির দশকের শেষ দিক, নয়ের দশকের গোড়ার দিকের যে কলকাতার কাছাকাছি যে মফস্বল শহরগুলো, যেগুলোকে একদিক থেকে কলকাতাই বলা চলে, কিন্তু আবার অন্যদিক থেকে কোথাও একটা রয়ে গেছে একটু মফস্বলী ছাপ, সেই পাড়াগুলোকে ধরার চেষ্টা করেছি। তাই এসেছে বিউটি পার্লারের অনুসঙ্গ। যে নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্য মধ্যবিত্ত মহিলারা অনেকসময়েই খুলে বসতেন এই পার্লারগুলো, বা চাকরি করতে যেতেন সেসব জায়গায়, তাদের কথা ধরার চেষ্টা করেছি। আমি পরাবাস্তবতাকে বুঝি পুঁজিবাদের যে বাস্তবতার নিরিখ, তার বিপরীতে গড়ে ওঠা একধরনের নান্দনিকতা হিসেবে। ফরাসী পরাবাস্তববাদীদের মতাদর্শ, কাজকর্মকে একটু খুঁতিয়ে দেখলে সে কথা বেশ স্পষ্ট হয় বলেই আমার মনে হয়। পরাবাস্তবতার যে নান্দনিক অস্ত্রশস্ত্র সমূহ, সেসব যেন সেই পুঁজিবাস্তবকে আঘাত করার জন্য উঁচিয়েই আছে। তবে সেই উঁচিয়ে থাকা বড়ই জটিল। আমি আমার মত করে, আমার প্রজন্মের বাঙালি মধ্যবিত্ত ছেলেমেয়েদের কাছে ধরা দিয়ে পরবর্তী বা তার একটু আগের যে পরিবর্তিত হতে থাকা পুঁজিসময়, তাকে ধরার চেষ্টা করেছি। সে পুঁজিসময়ের গল্প বড়ই বহুমাত্রিক। সেখানে যেমন আছে জমিহারানো রাখালবালকদের কলকাতায় বাবুদের লোক-উৎসবে নাচতে আসা, তেমনি আছে একটু আঁতেল একটু সংবেদনশীল বলে নিজেকে ভাবতে ভালবাসে—হয়ত বা প্রেসিডেন্সি বা যাদবপুরে বাংলা বা তুলনামূলক সাহিত্য পড়ে—তার সিলভিয়া প্লাথের সাথে পরিচিত হওয়া। প্লাথীয় ধারায় মেয়েজীবনের গল্প লিখতে শুরু করা। যে ধারার প্রতিই অনেকটা বিরক্ত হয়েই যদিও আমার নিজের বাংলা কবিতার লেখালেখির শুরু। এছাড়া কিছুটা আনার চেষ্টা করেছি শিশুসাহিত্যের চরিত্রদের, শিশুদের রূপকল্প বা প্রবাদপ্রবচনকে। বড়দের ন্যাকামো বাদ দিয়ে কিভাবে তৈরী করা যায় শৈশবের জটিল আখ্যান—এক, বড় হয়ে যাওয়া মানুষের হাতে—দুই, আদৌ যায় কিনা, এ আমার অনেকদিনের খোঁজ, প্রশ্ন। বাকিটা বাকি খেলোয়াড়দের হাতে। তাদের কি মনে হলো এ লেখাগুলো পড়ে, যদি আরও কোনো বিশেষ বিষয়ে প্রশ্ন থাকে, তাহলে আমি উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব আমার সাধ্যমত।

3 thoughts on “ভয়ের কবিতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.