নয়না চৌধুরী

“আমি নয়না। দিল্লিতে কাজ করি ও থাকি। মাঝে মাঝে লিখি।”

.

five

“আপনার সাথে কেউ দেখা করতে এসেছে, স্যার!”
কম্পিউটার থেকে মুখ তুলে দেখে স্বপন ডাকছে। চোখের সামনে থেকে ফাইল সরিয়ে, চট করে একবার আউটলুকটা দেখে নিল রথীন। ভুলে গেছে নাকি কোনো আপয়েন্টমেন্ট? না! কিছু তো নেই। হাসিখুশি কিন্তু নম্র রথীন হাতের ইশারায় স্বপনকে কাছে ডাকে, “স্বপনদা, আমি তো কাউকে ডাকিনি। কে এসেছে? আপনি দেখেছেন?”
এই লম্বা উঁচু ঝকঝকে সরকারী অফিসের অফিস-বয় স্বপন। তাকে সাধারণ ক্লার্করাও নাম ধরে তুই বলে ডাকে। বড় জোর সামনে তুমি। কিন্তু এই মানুষটা ভিন্ন। গত এক বছর ধরে দেখছে স্বপন। সাততলার ঠান্ডাঘরের বড়সড় কর্তা। বয়েসে ঠিক ততটা বড় নয়। তাই সহজেই স্বপন আন্দাজ করতে পারে, কৃতিত্বে বেশ অনেকটা বড় স্যার। অসীম ধৈর্যও স্যারের। আর প্রত্যেকটি মানুষকে মানুষের মত ভাবতে জানেন। ছোটবড় নেই। নিচের দোকানের চাওয়ালা থেকে সবচাইতে বড় কর্তা সকলেই রথীনবাবুকে ভালবাসেন। স্বপন বলল, “জানি না স্যার! আগে কখনো দেখিনি। মেয়েছেলে একজন। একটা বড় ব্যাগও এনেছে সঙ্গে। মনে হলো দূর থেকে এসেছে।”
“আহ্‌ স্বপন! আপনাকে আমি কতবার বুঝিয়েছি মেয়েছেলে শব্দটা কানে লাগে। ভদ্রমহিলা বলবেন। নাম জিজ্ঞাসা করেন নি? যাকগে! নিচে যাই চলুন। দেখেও আসি। এক কাপ চাও খেয়ে আসা যাবে। খোকনের মেয়েটা অসুস্থ ছিল। সে কেমন আছে জেনে আসব একবার।”
স্বপন বলে, “কালকেও তো জিজ্ঞাসা করতে গেছিলেন… এখনো বাইরে অনেক গরম স্যার…”
উত্তর দেয় না রথীন, নিচে নেমে আসে স্বপনকে নিয়ে। স্বপন পছন্দ করে না রথীনের সাথে সিঁড়ির কাছে যেতে। উনি সর্বক্ষণ সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করেন। বলেন নাকি, লিফটে অনেক বিদ্যুতের অপচয় হয়।  আরে মানুষ যদি লিফট ব্যবহারই না করলো তবে লিফট আছে কেন? শুধু তাই নয়। অর্ধেক সময় নিজের ঘরের এসি বন্ধ করে রাখে। ফ্যানও না চালাতে দেখেছে কখনো কখনো স্বপন। চালিয়ে দেয় তখন আস্তে করে। মরে যাবে তো গরমে! বেশিরভাগ দিন কফি মেশিনের কফি না খেয়ে, হেঁটে গিয়ে রাস্তার দোকানের চা খায়। বলে নাকি ওতেও বিদ্যুতের অপচয়। বেশি পড়লে মাথা খারাপ হয় মানুষের, মনে মনে ভাবে স্বপন। কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারে না তার এই স্যারকে। মানুষটা বড় ভালো।
নিচে এসে চমকে ওঠে রথীন। রিসেপশনের পাশে মুখ নিচু করে যে মেয়েটি ফোন নাড়াচাড়া করছে নার্ভাস ভাবে, তাকে বড় চেনা লাগে রথীনের। কিন্তু জুহী এখানে কি ভাবে আসবে! সব চিন্তার অবসান করে জুহী উঠে দাঁড়ায়। ঝকঝকে দাঁত খুলে এক মুখ হাসে। যে হাসি রথীন বহুবার দেখেছে পর্দার ওপারে। আজ মুখোমুখি।

“কি? চমকে দিয়েছি তো? দেখুন, বলেছিলাম না, একদিন চলে আসব আপনার কাছে। আপনি ভাবতেন ঠাট্টা বুঝি! কেমন? হলো তো! আমার সঙ্গে চ্যালেঞ্জ!” অনর্গল বলে যায় জুহী।
রথীন হাসে, “তাই তো দেখছি! ভীষণ চমকে গেছি! অন্যায় হয়েছে মশাই এমনভাবে কথা বলা, যাতে আপনার চ্যালেঞ্জ মনে হয়েছে। কারণ আপনাকে চ্যালেঞ্জ করার কথা তো আমি ভাবতেই পারি না। আপনি পারেন না এমন কোনো কাজ নেই।”
জুহী চারদিকটা দেখে নেয় একবার। যেন রথীনকে তার পরিবেশের পরিপ্রেক্ষিতে দেখে নিতে চাইছে।
চোখে চোখ রাখে রথীনের, বলে, “এবার বাড়ি যাই…”
স্বপন কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে আছে দেখে, জুহীকে মাঝপথেই থামায় রথীন, “চলুন আগে চা খাই বাইরে গিয়ে। ওই ঢাউস ব্যাগটা রিসেপশনেই রেখে দিন।”
রিসেপশনের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলে, “এই যে স্মিতা এই ব্যাগ টা একটু রেখে নেবেন? যদি বোমা থাকে তাহলে আমাকে দায়ী করবেন, কিন্তু দোহাই আপনার রেখে নিন! ইনি আমার অতিথি। চা খাইয়ে আনি।”
স্মিতা বেরিযে আসে কিউবিকল ছেড়ে। শিফনের শাড়িতে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে। জুহী মনে মনে তারিফ করে মেয়েটার পছন্দের। হাসিমুখে নিজেই তুলে নেয় ব্যাগ। রথীনের বাহুতে হাত রেখে জোরে  হাসে, খোলা চুল উড়ে পড়ে রথীনের গালে, “আপনি! বোমা?” চোখ নাচায় স্মিতা। “যান যান! অত বলতে হবে না! দেখভাল করব আপনার ব্যাগের আমি!”
জুহী তাকায়, রথীন এর কানের গোড়া লাল হয়ে ওঠে একটু যেন। মাথা নামিয়ে এগোতে এগোতে ধীর গলায় বলে, “স্মিতা ওইরকমই। না ছুঁয়ে কথা বলতে পারে না।” একটু নিশ্বাস নিয়ে যোগ করলো, “খুব ভালো মেয়ে কিন্তু।”
রথীনের কথা কানে যায় না যেন, জুহী বলে, “আমি বুঝি অতিথি!” তারপর রথীনের উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলে, “মেয়েটি অবাঙালি? নাকি প্রবাসী? বাংলাতে টান আছে মনে হলো।” হাঁটতে হাঁটতে বলে জুহী। এতো ভ্যাপসা গরম কলকাতায় এখনো! অথচ অক্টোবর তো এসে গেলো প্রায়। টিস্যু দিয়ে কপাল মোছে ও।
“অবাঙালি। আপনার মত নয়। ওর মা বাবা দুজনেই অবাঙালি। বাংলা শিখেছে শিলিগুড়িতে পড়ার সময়।”
“আমার মা অবাঙালি ছিলেন বলে বললেন? কবে আর মা কে দেখলাম বলুন? আমার নামেই মা’র ইচ্ছেটুকু বেঁচে আছে, আর আমার অবাঙালিপনাও ওইটুকুই।” জুহী স্মিত হাসে।
চায়ের দোকানে এসে দাঁড়ায় ওরা। পার্কের রেলিং ঘেঁষে দোকান। কেটলিতে ফুটছে চা ইঁটের উনুনের ওপর।
“খোকনদা দুটো চা দেবেন আমাদের।” গলা উঁচু করে বলে রথীন।
“আপনার মত বিদেশে থেকে বাঙালি থাকা মানুষ আমি আর দেখিনি জুহী! কলকাতার বাঙালিরাও পাল্লা দিতে পারবে না।” রথীন বলে। একটু অন্যমনস্ক। তার মাথায় এখনো সদ্য বন্ধ করে আসা বালি ব্রিজের কাজের ফাইলটা ঘুরছে। ওটা চটপট শেষ করে মিত্র স্যারকে দিয়ে দিতে হবে, আর দেরী করা যাবে না।
“অনেক বিদেশিনী দেখেছেন বুঝি?” জুহী কিন্তু পুরোপুরি ছুটির মুডে!
“কই আর! আমি ছাপোষা বাঙালি। আমার সাথে কোন বিদেশিনী কথা বলে না। স্বদেশিনীরাই পাত্তা দেয় না, তো বিদেশিনী!” কপট হতাশা দেখায় রথীন। “উফ দেখেছেন আমি কেমন খারাপ লোক! আপনাকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরছি যেন আপনি পাশের পাড়ায় থাকেন। কিচ্ছু জানা হয়নি এখনো! তা সাত সমুদ্র পেরিয়ে এত দূর এলেন যে? কাজ পড়েছে এ দেশে কিছু?”
“হ্যাঁ তো। আমার রাজপুত্রকে রাক্ষস বন্ধ করে রেখেছে সেই সাততলা দুর্গের সব থেকে ওপরের ঘরে। তাকে উদ্ধার করতে এলো তো পোস্ট মডার্ন রাজকন্যে। আপনি বলেছিলেন যে, এমনটা করতে হবে!”
“বলেছিলাম বুঝি!” জোরে হেসে ওঠে রথীন! “কবে? কি নিয়ে কথা হচ্ছিল সেদিন? এত কথা বলেছি আপনার সাথে!”
“জানি। আপনি বলেছিলেন, এত কথা আপনি আর কারোর সাথে বলেন না। শুধু শোনেন।” হাসে জুহী। আত্মতৃপ্তির হাসি।
পার্কের রেলিঙের কাছে অনেকগুলো লম্বা গাছ। মাথার ওপরের ওই গাছগুলো অদ্ভুত আলোছায়া সৃষ্টি করেছে। রথীন এর মুখে কখনো আলো, কখনো অন্ধকার।
মাথা নিচু করে জুহীর কথা শোনে রথীন। ভাবে, জুহী বেশ লম্বা। এতোটা লম্বা ছবিতে মনে হয়নি। কথা ঘোরায়। “চা টাতে চুমুক দিন! ঠান্ডা হয়ে এলো। উঠেছেন কোথায়, জুহী?”
“আপনার কাছে উঠব তো! ব্যাগ দেখলেন না?” জুহী সপ্রতিভ।
“ইয়ার্কি হচ্ছে গরীবের সাথে ম্যাডাম! আমার বাড়িতে আপনি! আমি মাঝে মাঝে জানলা দিয়ে চাঁদ ধরার স্বপ্ন দেখি বটে, কিন্তু এরকম দুঃসাহসী কল্পনা আমি কখনো করি না!” গলায় বিদ্রূপ উঁকি মারে যেন রথীনের।
“এ মা! কেন! আমি সত্যি আপনার কাছেই থাকব বলে এসেছি!” জুহী বেশ জোর দিয়ে বলে।
মুহুর্তে সামলে নেয় রথীন, “সে তো আমার সৌভাগ্য! আপনি যে ভেবেছেন আপনি আমার বাড়িতে থাকতে পারেন আমি তাতে ধন্য হয়ে গেছি। কিন্তু আমারও তো একটা দায়িত্ব আছে। আমি তো আপনাকে বা আপনার নামকে বিপদে ফেলতে পারি না।”
“আমাকে বিপদে ফেলবেন আপনি? কিভাবে?” জুহী অবাক হয়ে যায়।
ইতস্তত করে রথীন, “পুরুষ মানুষ মানেই তো মেয়েদের জন্যে বিপদ, তাই না আফটার অল আয়্যাম এ সিসজেন্ডার মেল। যাকে বলে পুরুষদেহধারী পুরুষ। সন্দেহের জায়গা মাত্র নেই যে আপনাকে আমি বিপদে ফেলতে পারি। নারীদেহের প্রতি আসক্তি অস্বীকার করতে পারি না তো। আর পুরুষকে বিশ্বাস কি? জানেন তো বহু ফেমিনিস্টরাই বলেছেন এভরি ম্যান ইজ অ্যা পোটেনশিয়াল রেপিস্ট।
“নারীদেহের প্রতি না আমার প্রতি? এতো থিওরি না দিয়ে সোজা বলতে দোষ কি বাবা?” ভুরু তোলে জুহী।
“দুষ্টুমি হচ্ছে?” চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে রথীনও হাসে।
“নাহলে কি করব? এখানেও বায়োলজির প্রফেসারী!” বিরক্তি দেখায় জুহী। “সারা রাত প্লেনে বসে এখন একটু রেস্ট করতে চাই! কোথায় সে ব্যবস্থা করবেন, তা না শব্দের খেলা জুড়েছেন!”
“তাই তো! তাই তো!” ব্যস্ত হয়ে বলে রথীন। “কষ্ট হচ্ছে নিশ্চই খুব। চলুন চলুন! খোকনদা, চায়ের পয়সাটা নিন। মেয়ে কেমন আছে আপনার?”
চায়ের সসপ্যানটা আগুন থেকে নামিয়ে খোকন এগিয়ে আসে। রোজ কথা বলে সে রথীনের সাথে, কিন্তু আজ এই জিন্স-রোদচশমা পরিহিতা দিদিমনির সাথে দেখে সে আর এগোয়নি।
“ভালো আছে দাদা। কালকের থেকে আজকে ভালো। কিন্তু সেদিন আপনি টাকা না দিলে খুবই বিপদে পড়তাম। ভাগ্যিস! আমি টাকাটা শিগগিরই শোধ করে দেব দাদা।”
“ছাড়ুন তো ওসব খোকনদা। পরে দেখা যাবে।” পয়সা মিটিয়ে এগোয় ওরা। জুহী মুগ্ধ চোখে রথীনকে দেখে। মানুষটা ওর চোখে ক্রমশই বড়, আরো বড় হয়ে উঠছে।
রথীন একটু ভেবে বলে, “একটা হোটেল আছে বাড়ির কাছেই। আমার মত, আবার আমার মত নয়। মানে আমার মতই সস্তা, কিন্তু আমার থেকে গুণমানে ঢের ভালো!” হেসে ওঠে জোরে।
কপট ধমক দিল জুহী, “কেন যে বার বার এরকম কথা বলেন! আপনি জানেন আপনাকে আমি কতটা শ্রদ্ধা করি। শুধু আমি না, আমি তো এমন মানুষই দেখিনি যারা আপনাকে ভালবাসে না।”
“আপনি তো আমার জীবনের কোনো মানুষকেই দেখেননি জুহী! আমার সিগ্নিফিক্যান্ট আদারকেও না!”
“আপনার প্রাক্তন স্ত্রীর কথা বলছেন? যিনি মাত্র তিনশ চৌষট্টি দিন ছিলেন আপনার সাথে? এক বছর পূর্ণ করেননি?”
“সেই দিনগুলো আমার জীবনের একমাত্র সময় যখন আমি যৌথ জীবন যাপন করেছি। ভুলে যাবেন না।” রথীন খুব চেষ্টা করে গলাটা ওপরে উঠতে দেয় না।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো জুহী,”যে দিনগুলোতে আপনার প্রতিদিন নিজেকে ব্রাত্য মনে হয়েছে? ইউ ফেল্ট রিজেকটেড এভরি সিঙ্গল ডে?”
“আপনাকে আমি খুব সম্মান করি জুহী। আমার স্ত্রীর বিরুদ্ধে কথা বলাটা সেই সম্মানের পরীক্ষা নেওয়া হয়ে যাবে।”
“আমি কখনো আপনার স্ত্রীর বিরুদ্ধে কথা বলেছি?” জুহী প্রশ্ন করে।
হাসে রথীন। “না। আপনি কখনো আমার স্ত্রীর নিন্দে করেননি। সেইজন্যে আমি আপনাকে সম্মান করি। তাছাড়া আপনার প্রগাঢ় মেধা, আপনার অসীম জ্ঞান, আর আপনার সহমর্মিতা আমাকে সব সময় নুইয়ে রাখে। আপনার কাছে আমি চিরঋণী…”
“আবার বাজে কথা! কি যে ভালো লাগে আপনার এসব বলতে! চলুন অফিস এসে গেছে আপনার। আজ তো আর অফিস হলো না। আমার সাথে ঘুরে বেড়াতে হবে!”
রথীন হাসে, “ধমক দিলে কি আর সত্যিটা বদলে যায় ম্যাডাম? তবে অফিস ফাঁকি দেবার এমন ভালো কারণ পাওয়া গেলে ছাড়ে কে? চলুন চলুন…” মুখে বলে রথীন। মনে মনে জানে আজ রাত্রে বহুক্ষণ সেই ফাইল নিয়ে বসতে হবে তাকে।
অফিসে ঢুকে স্মিতার কাছে রাখা ব্যাগ সংগ্রহ করে ওরা। তারপর ট্যাক্সি নেয়। জানলা দিয়ে দেখে জুহী তার এই আধচেনা শহরটাকে। তার স্মৃতিতে যে শহর আছে, আর এই যে শহরকে সে দেখছে, তার মধ্যে অনেক পার্থক্য। অনেক জল বয়ে গেছে গঙ্গায় তার কুড়ি বছর বয়েসে দেশ ছাড়ার পর।

“কি এখন একটু রেস্ট করবেন তো নাকি?”, হোটেলে ঘর নিয়ে রথীন জিজ্ঞাসা করলো রিসেপশনের সামনেই, “আমি তবে ঘুরে আসি একটু?”   জুহী চোখে চোখ রেখে দেখছিল রথীনকে। প্রথমবার। সামনাসামনি। মেলাতে চাইছিলো শব্দে পড়া, ছবিতে আর স্কাইপে দেখা মানুষটির সাথে এই রক্তমাংসের মানুষটিকে। চোখ কি আদর করতে জানে? ভাবছিলো সে। চমকে উঠলো প্রশ্নটা শুনে। বললো, “আপনি আসবেন না ওপরে?” “না! আমার আসা উচিত হবে না।” “কেন…” এসে গেছিল প্রশ্নটা জিভের ডগায়, কিন্তু সামলে নিলো জুহী। রিসেপশনিস্ট কাজের অছিলা করে মন দিয়ে কথা শুনছে ওদের। বললো, “দাঁড়ান তবে। এখুনি আসছি আমি।”
ছোট হোটেল সত্যিই, কিন্তু খুব পরিষ্কার। বাইরে কাঁচ ঝকঝকে। আগেকার কলকাতায় এরকম হোটেল ভাবাই যেতো না।
রুমে গিয়ে ছোট করে একটু স্নান করে নিল জুহী। সারা রাতের ক্লান্তি। একটা শিফনের শাড়ি পরে নিলো। একমাত্র শাড়ি যেটা ও এনেছে। অল্পই জামা কাপড় এনেছে সঙ্গে। ভেবেছিলো বাড়িতে থাকবে, ধুয়ে আবার পরে নেবে। নিজের কাজ নিজেই করে আজন্ম, আর কথায় কথায় ওয়াশিং মেশিন চালানো ওর জীবনবিজ্ঞান পড়া চেতনায় আঘাত করে। এই ব্যাপারে রথীনের সাথে ওর খুব মিল। কিন্তু এ মানুষটা তো ঘরে নিয়ে যাবার নামও করলো না। কি এমন খারাপ ঘর? বড় ধরনের চাকরি করে, সেরকম দায়িত্বও কিছু নেই এক পিসি ছাড়া, যিনি গ্রামের বাড়িতে থাকেন। সাধারণ ঘর হতে পারে, কিন্তু তাই বলে তাকে রাখা যাবে না? রথীন বুঝি ভেবেছে সে খুব সৌখীনতায় অভ্যস্ত? এতটাও কি বোঝেনি রথীন এতদিনে, যে জুহী ওর সাথে যেখানে খুশি থাকতে পারে?
তার আর রথীনের বন্ধুত্বের গভীরতাটা অসাধারণ। সবাই বুঝবে না। হাসে জুহী নিজের মনেই। বন্ধুত্ব বলবে নিজের মনের কাছেও? নিজেকেও চোখ ঠারা? রথীন যেভাবে জুহীর ছোট ছোট কথা মনে রাখে, তেমনটা জুহী আগে কারুর সাথে দেখেনি। আবার যত কথা রথীনকে নিয়ে জানে জুহী, তার বাড়ি নিয়ে, মা বাবাকে নিয়ে, ছোটবেলার যৌথ পরিবার নিয়ে, অবিবাহিত মানসিক অবসাদগ্রস্থ পিসিকে নিয়ে, আর হ্যাঁ তার সেই বিয়ে নিয়েও, যেটাকে বিয়ে বলা যায় বলেই মনে হয়নি তার। আর কেই বা জানে অতটা! আর আশ্চর্য তাদের মিল! দিনের বিভিন্ন সময়ে তাদের গানের পছন্দ! ইমন যখন মনে ধরে, দুজনকেই যেন একসাথে ধরে। বেহাগ হলে আবার বেহাগ। আর সেদিন? যখন রথীন ফোন করলো, তার ল্যাপটপেও বাজছে “ইয়াদ পিয়া কি আয়ে”, আর রথীনের ফোন বেয়েও ভেসে আসছে সেই একই গান! একজনের ঘরে কৌশিকী, অন্যজনের ঘরে রশিদ খান। বিভিন্ন বিষয়ে তাদের মতামত ও পড়াশোনারও অদ্ভুত মিল। কে বলবে তারা এতদিন পৃথিবীর দুই প্রান্তে থেকেছে! কে বলবে তাদের ইন্টারনেটে আলাপ!
এক কমন বন্ধুর দেয়ালে কমেন্ট লিখতে লিখতে আলাপ। পরে রথীন ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে বলেছিল, “আমি সাধারণত কখনো মেয়েদের বন্ধুত্বের প্রস্তাব পাঠাই না। আপনি ব্যতিক্রম!” জুহী সহজেই গ্রহণ করেছিল। তারপর রাতদিন সর্বক্ষণ কথা বলেছে তারা এই কয়েক মাস। সে তার ইউনিভার্সিটির ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে, আর রথীন তার অফিস ঘরের হাজার হাজার টেকনিকাল ফাইল স্তুপের পিছন থেকে। কখন বছর ঘুরে গিয়েছে বুঝতেও পারেনি। একটা না দেখা মানুষকে ভালবাসা যায় শুধু শব্দ দিয়ে, এ কথা রথীন না এলে জুহী বুঝতেও পারত না। যেদিন রথীন প্রথম ফোন করে তাকে, বুকের ভেতর আফ্রিকান মাদল বেজেছিল। যেন কোন চিরকাল এর চেনা মানুষের প্রত্যাবর্তন বার্তা! দেখেনি তখনও জুহী ওকে, কিন্তু ভালোবেসে ফেলেছিল। এরও অনেক পরে তারা ক্যামেরায় একে অপরকে দেখে কথা বলতে শুরু করে। রথীন বলেছিলো, “অনেক অনেক দিন আগে আপনার সাথে দেখা হলো না কেন? এতগুলো বছর কেটে গেল না পাওয়ায়, না জানায়!” জুহী বলেছিলো, “হয়ত এই বছরগুলোতে আমরা তৈরি হচ্ছিলাম একে অপরের সাথে দেখা হবে বলে। প্রতিটা বছর আমাদেরকে প্রস্তুত করেছে এই মুহূর্তগুলোর জন্যে!” মনে মনে তারও যে আফসোস হয়নি তা নয়, কিন্তু আফসোস করে জীবন কাটাতে চায়না সে।
সত্যিই যেতে চায় সে রথীনের বাড়ি। চট করে গুছিয়ে দিতে চায় তার ঘর। না, সে মেয়ে বলে নয়। সে চায় বলে। সেই ঘরটা, যে ঘরে ও নিজেকে দেখে। রথীনের বুকে মাথা, গলায় নাক ঘষে আদর করতে দেখে। আর সেই ভালোবাসার মানুষটাকে খুশি দেখতে চায় ও। যতটা খুশি তাকে রথীন দিয়েছে, ততটা না পারলেও অন্তত খানিকটা! সে তো আর রথীনের মতো তাকে নিয়ে সুন্দর কবিতা লিখে মুগ্ধ করতে পারবে না। তাই যা পারে সে, সেটুকু দিয়েই রথীনকে একটু খুশি দেখতে চায়। ও জানে, হাসিখুশি মানুষটা আসলে বড় দুঃখী। মা বাবার অবসাদ, পরে মৃত্যু, পিসির বারবার আত্মহত্যার চেষ্টা, স্ত্রীর বিশ্বাসঘাতকতা…ঝাঁঝরা হয়ে আছে মানুষটা। তাকে আদরে আদরে ভরিয়ে রাখতে চায় ও।
রথীনের নিজের পিসিকে নিয়ে চিন্তাটা প্রায় অবসেশনের পর্যায়ে বলে মনে হয় কখনো কখনো জুহীর। প্রতিদিন কথা, প্রতি সপ্তাহে যাওয়া। কখনো কখনো সপ্তাহে দু বার! পিসি নাকি কলকাতাতে থাকতে চান না। কিন্তু সে এটাও বোঝে যে এই পিসি ছাড়া রথীনের আপন বলতে কেউ নেই। রথীন যখন পিসির কথা বলেছে, বহুবার জুহীর মনে হয়েছে ভদ্রমহিলা প্রায় অত্যাচার করেন ভাইপোর ওপর। খুব স্বাভাবিক লাগেনি ওদের মধ্যে সম্পর্কটা। রথীন এমনিতে এতো যুক্তিবাদী, কিন্তু পিসির তার প্রতি অদ্ভুত ব্যবহার নিয়ে কথা বলতে গেলেই, “পিসি আমাকে খুব ভালোবাসেন” বলে থামিয়ে দিয়েছে। কিছু যেন একটা রহস্য আছে সেখানে। জুহী বেশি খোঁচায়নি। অনধিকার চর্চা তার অভ্যাস নয়।
রথীন না আসা অবধি, জনাথন এর সাথে বিয়ের দশ বছর পর ওর জীবনটা শুধুমাত্র কাজ ঘিরে ছিলো। নিজের ছাত্র ছাত্রীদের ঘিরে। খুব ভালো করে শিখেছিলো, ভালবাসা বলে কিছু হয় না। নৈকট্য অপ্রয়োজনীয়। নিজের নিজের জীবন কাটাও, নিজের নিজের ঘরে শোও, বাঁচার মত বাঁচার চেষ্টা বাচালতা। বেঁচে আছো তো কাজ করে যাও। মৃত্যু বেশি দূরে নয়। কোনোরকমে দিন পার করে যাও। দশ বছরে এটুকু শিখতে পারবে না এত খারাপ স্টুডেন্ট জুহী কখনো ছিলো না।  রথীন, সেই মানুষ যে ওকে শিখিয়েছে, আবার ভালবাসা যায়। মরে না ভালবাসা। বেঁচে থাকে মনের গভীরে।
নেমে এসে দেখে কোঁকড়া চুল ভরা মাথাটা নিচু করে বসে আছে রথীন, রিসেপশনে। সৌম্য, প্রশান্ত লাগে ওকে দেখতে। মনটা শান্তিতে ভরে যায়। না চাইতেও মনে পড়ে যায় জনাথন কিভাবে রেগে কথা বলত ওর সাথে, দাঁতে দাঁত পিষে, মুখের খুব কাছে মুখ এনে। থুতুর ছিটে লাগতো মুখে। সেটা শাস্তি ছিল জুহীর। জোর করে জনাথনকে দিয়ে কথা বলাতে চাওয়ার শাস্তি। নাহলে শান্তি ছিল বাড়িতে। শ্মশানের শান্তি। ভাবনাটা এক রকম জোর করেই সরিয়ে দেয় জুহী মন থেকে। হেসে বলে “দেখলেন, বসিয়ে রাখলাম তো আপনাকে?”
“তাতে কি হয়েছে? চলুন পার্ক ষ্ট্রীট-এর দিকটা ঘুরিয়ে আনি আপনাকে। নাকি গঙ্গার ধারে যাবেন?” চশমার পেছনে উজ্জ্বল চোখ দুটোও হেসে ওঠে।
“সেই যেখানে আপনি মন খারাপ করে বসে থাকতেন আর আমি চিন্তায় অস্থির হয়ে ফোন করতাম? না না। বরং পার্ক ষ্ট্রীট যাই চলুন! কি নাকি একটা সাশা দোকান আছে সেখানে। নিয়ে যাবেন?”
বেরিয়ে পড়ে দুজনে। ট্যাক্সি নেয়। পাশাপাশি বসে। জুহী গন্ধ পায় রথীনের। রথীনও ওর গন্ধ পাচ্ছে ভেবে লজ্জা করে যেন একটু। জুহীর খুব ইচ্ছে করে রথীনের পাশে রাখা হাতটা ছুঁতে। পারে না! এত দ্বিধা কেন? এই মানুষটা তো আদ্যন্ত তার। আর কেউ না জানুক, তারা দুজন তো জানে! সামনে ঝুঁকে রাস্তা দেখে জুহী। তার মাথার কাছে মাথা আনে রথীন। সেও সামনে দেখছে। ওর নিশ্বাস লাগে জুহীর কানে, মনে হয় চুমু খাবে রথীন ওর কপালের পাশে। যেন রথীন জানে এই চুম্বন জুহীর বড় প্রিয়। অপেক্ষা করে জুহী। হঠাৎ হোঁচট খায় ট্যাক্সিটা। ঘোর ভেঙ্গে সরে আসে জুহী। পার্ক ষ্ট্রীট এসে গেছে।
নেমে হাঁটতে শুরু করে দুজনে। হাঁটতে হাঁটতে রথীনের রোদে পোড়া ডান হাতটা দেখে ও। মোটা চামড়ার বেল্টের নিচ থেকে গায়ের আসল রংটা উঁকি দিচ্ছে। ফিল্ডে ঘুরে কাজ করার ছাপ স্পষ্ট। ওকে রথীন বুঝিয়েছে কয়েকবার নিজের কাজ। শুধু অফিসে বসে থাকতেই পারে সে। কিন্তু নিজে দেখে কাজ যাচাই করে ফাইল সই করতে পছন্দ করে রথীন।
আলো জ্বলে উঠেছে দোকানগুলোর। রথীন বলে, “শাড়িতে দারুন লাগছে আপনাকে এই পরিবেশে! কে বলবে ঘোর বিদেশিনী আপনি! নামকরা প্রফেসর!” জুহী লজ্জা পায়। মাথা নামিয়ে রাস্তা দেখে। প্রশংসা পাওয়া তার কাছে নতুন কিছু নয়। সে জানে তার রূপের আকর্ষণ আছে। কিন্তু রথীনের মুখে শুনতে কি রকম যেন লাগে।
দুজনে অনর্গল কথা বলতে বলতে ফ্রি স্কুল ষ্ট্রীট-এর মোড়ের কফি শপে ঢোকে। জানলা দিয়ে অজস্র গাড়ির চলাচল দেখতে পায় জুহী। মনে হয়, গাড়িগুলোর মতো ওর সময়টাও চলে যাচ্ছে।
আর না পেরে জুহী বলে, “সত্যি কিন্তু আমি আপনার বাড়ি থাকব বলে এসেছি। ফেরত যাবার টিকিটও করে আসিনি। বোলপুরে ঠাকুমা জানেও না আমি এই দেশে।”
“এরকম পাগলামির কোনো মানে হয়?”
“ভালবাসায় পাগলামি একটু থাকেই। মানছি আমার বয়েসটা ষোলো নয়!”
“ভালবাসা! হ্যাঁ বলেছেন আপনি আমাকে আগে একবার। আপনার মনে হয়েছে, আপনি আমাকে ভালবাসেন”, শান্ত গলায় বলে রথীন।
“মনে হয়েছে…!”
“হ্যাঁ মনে হওয়াই ওটা। সত্যি তো আর হতে পারেনা! আসলে তো জানেন না আমি মানুষটা কি ভয়ানক খারাপ। জানলে ভালবাসা দূরের কথা, কথা পর্যন্ত বলবেন না।”
“আমার আপনাকে আরও জানা বাকি বলতে চান? এবার তাহলে সাত পুরুষের গোত্র মুখস্থ করতে হয়। ঠাকুমাকে নিয়ে আসব তাহলে! তিনি তো আবার আপনার গুণমুগ্ধ ভক্ত!” হাসে জুহী।
রথীন আরও গম্ভীর হয়ে যায়। “জুহী, আপনি মানুষটা এতই ভালো যে ভাবতে পারছেন না একজন কতদূর খারাপ হতে পারে। ভেবে দেখুন আমার স্ত্রীর কথা। চলে যেতে হয়েছিল তো ওকে? পারেনি থাকতে আমার সাথে।”
“আপনার প্রাক্তন স্ত্রী সম্ভবত আপনাকে ভালবাসেননি, রথীন। সব মানুষেরই ভালবাসা খুঁজে নেবার অধিকার আছে।”
“আপনার এই স্বভাবটা আমার খুব ভালো লাগে। আপনি কখনো আমার স্ত্রীর নিন্দে করেন নি। মেয়েদের নিন্দে করা খুব খারাপ! দোষ শুধু ছেলেদের! এই কথাটা আমি মনে-প্রানে বিশ্বাস করি। আর ভেবে দেখুন, যে লোককে তার স্ত্রী ভালবাসতে পারে না সে কি আর কারোর ভালবাসার যোগ্য?”
“এ কথা আপনি আগেও বলেছেন। আর আমিও বলেছি এটা দুজন মানুষের ব্যাপার। দুজন মানুষ একে অপরকে ভালবাসতে পারে অকারণে, আবার অকারণেই তারা ভালবাসতে পারে না।”
“মানে আমি তার মনে ভালবাসা জাগাতে পারিনি।” রথীন আপনমনে বলে যায়, “বেড়াতে গেল আমার সাথে, জড়িয়ে পড়ল অন্য ছেলের সাথে। বাধা দিই নি। বরং পথ সুগম করে দিয়েছিলাম। আহা! মেয়েটা কাউকে তো ভালোবাসলো! ফিরে এলো কাঁদতে কাঁদতে, আমার বিছানায়। বললো, আমি যদি আদর না করি, ধরে নেবে আমি ওকে ত্যাগ করেছি! আমি কি তাই পারি? কিন্তু সেই রাতটুকুই শুধু। পরের দিন গায়ে হাত রাখতেই আবার…”
“জানি!” থামিয়ে দেয় ওকে জুহী। “শুনেছি আমি এই সব। কি হবে আবার কষ্ট পেয়ে? তুমি ভুলে গিয়ে নতুন করে শুরু করতে পারো না?”
“না। পারি না। আমার মধ্যে আসলে ভালবাসাই নেই। না আমি কখনো আমার স্ত্রীকে ভালোবেসেছি, না অন্য কাউকে কখনো ভালবাসতে পারব। আমি ভালবাসতে জানি না।”
“কি বলছো তুমি রথীন? তুমি ভালোবাসো না? তুমি ভালবাসতে জানো না? তুমি না জানলে কেউ জানে না। আমার জন্যে দিনের পর দিন রাত জেগেছো, যখনই ডেকেছি সাড়া পেয়েছি! এমনকি একবার বলা মাত্র রাত্রে ট্যাক্সি নিয়ে দু’শ কিলোমিটার দূরে পাড়ি দিয়েছ আমার ঠাকুমার জন্যে! আমার বান্ধবীর মা মারা গেলেন মধ্যমগ্রামে। তুমি সব করলে হাতে হাতে। আমার ট্রান্সক্রিপ্ট হারিয়ে গেল, নতুন কোর্সে অ্যাপ্লাই করব, তুমি দৌড়োলে য়ুনিভার্সিটি! আমি কি গান শুনব, কোন ফুল ভালোবাসি, কোন বই পড়ব, সর্বক্ষণ তোমার, সরি, আপনার চিন্তা জগতে আমি! এ যদি ভালবাসা না হয়, আমি বোধহয় ভালবাসা কি, কোনোদিন বুঝতেই শিখিনি।”
রথীন থামায় ওকে “একটু আস্তে কথা বলবেন? সবাই তাকাচ্ছে! আমি ছাপোষা মানুষ আমার কোনো সম্মান নেই কিন্তু আপনাকে দেখলেই বোঝা যায় সম্মানীয় ব্যক্তি! তাই বলছিলাম!”
লজ্জা পায় জুহী। সত্যিই গলার আওয়াজ জোরে হয়ে গেছিলো। মাথা নামায় ও।
রথীন বলে, “আপনি যতটা ভালো মানুষ, এবং যেরকম আশ্চর্য সব কাজ করছেন বিজ্ঞানের জগতে, আপনি যেভাবে আপনার ছাত্রছাত্রীদের জন্যে দিনরাত ভাবেন, শুধু তাদের পড়া নিয়ে নয়, শরীর নিয়ে, মানসিক বিকাশ নিয়ে, আমি কেন যে কোনো কেউ আপনার কাজ করে দিয়ে ধন্য হবে। আপনার হৃদয় এত বড় যে একে ভালবাসা নাম দিয়েছেন। অন্যের স্ত্রীকে আমি ভালবাসতেই পারি না! নিজের জীবনটা যেভাবে ছারখার হয়ে গেছে, আরেকজন পুরুষকে সেই কষ্ট দিই কি করে আমি?”
“অন্যের স্ত্রী? এখনো? আমার ডিভোর্স তো হয়ে গেছে, রথীন!”
“আমি খুবই পুরনো চিন্তাধারার মানুষ। আমি জানি বিবাহ জন্ম জন্মান্তরের বন্ধন। একখানা কাগজের জোরে তাকে ভেঙে ফেলা যায় না।”
চুপ করে থাকে জুহী। এ কথার কি উত্তর দেবে? উত্তরটা এখন স্বপক্ষের ওকালতি মনে হবে।
রথীনই আবার কথা বলে। “আর হলোই বা কেন ডিভোর্স? আশা করি আমি দায়ী নই…”
“কেন? এতদিন পর কেন? আপনি তো জানতেন রথীন, জনাথন আর আমি বছরের পর বছর এক বাড়িতে থেকেছি শুধু। আমরা সে অর্থে বিবাহিত বহুদিন ছিলাম না!” উত্তেজিত শোনায় জুহী কে আবার।
“বাঁচালেন! আমি কারোর সম্পর্ক ভাঙ্গার জন্যে কখনো দায়ী হতে চাইনা।”
খারাপ লাগে জুহির। রথীন শুধু নিজের বাঁচা দেখেত পেলো এর মধ্যে? তার তিল তিল করে মরা দেখতে পেলো না? বলে, “একভাবে তো আপনি দায়ী নিশ্চই রথীন! আপনি এলেন আমার জীবনে, তাই তো জানতে পারলাম যে আমি আবার ভালবাসতে পারি। মরুভূমিতেও বৃষ্টি হয়। তাই তো আবার বাঁচতে ইচ্ছে করলো।”
“এইভাবে কথা বলে কষ্ট দেবেন না আমায়, জুহী। আমার বাড়ি অন্য লোকে ভেঙ্গেছে, অন্য কারুর বাড়ি আমি…”
“রথীন, আপনি কবে বুঝবেন বাড়ি অন্য কেউ তখনই ভাঙ্গতে পারে যখন বন্ধনই আলগা! গোড়াতেই গলদ! অন্য মানুষকে দোষ দিয়ে কি হবে?”
“না! সে কথা ঠিক! আমাকেই ভালবাসা সম্ভব নয়। নাহলে ও কেন আমাকে ভালবাসতে পারবে না এতকিছুর পরেও…”
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে জুহী! ” সেই এক কথা নিয়েই পড়ে আছে। আমার ভালবাসা নিতে পারে তো, রথীন? নিজের ভালবাসা স্বীকার করতে পারে তো… “কোনো মানে হয় এইভাবে বিলাপ করে জীবন কাটাবার?”
“আমি আপনাকে ভালোবাসি না জুহী। আর আপনিও আমাকে ভালবাসেন না। আমাকে ভালবাসা সম্ভব নয়। আপনি এখানে থাকলে কিছুদিন পরেই বুঝতে পারবেন আমি আপনার যোগ্য নই। তখন আমি পড়ে থাকব। আপনি পাড়ি দেবেন আপনার সেই দেশে।“
“এতো নেগেটিভ কেন আপনি? এরকম নাও তো হতে পারে। একটু খোলা মনে, পরিণাম না ভেবে কিছুদূর হাঁটলে ক্ষতি কি? ”
“এতে নেগেটিভ এর কি আছে? আমার বাস্তব বুদ্ধি বেড়েছে এতদিনে বলতে পারেন। আমি এসবের পরিণতিগুলো এখন আন্দাজ করতে পারি। আর আমি ঠিক করেছি আর কখনো বিয়ে করব না।” রথীন বেশ জোরের সাথে বলে।
“বিয়ে? বিয়ের কথা কে বলল আপনাকে?”
“তাহলে?” সন্দিগ্ধ শোনায় রথীনকে। “কি করতে চান আপনি আমাকে নিয়ে?’
“একটু আগেই যে বললাম আমি ষোলো বছরের নই আর। আমি জানি ভালবাসা মানেই বিয়ে নয়। বিয়েতে সামাজিকতা থাকে। আমি আপনার কাছে সামাজিকতা নয়, সামাজিক স্বীকৃতি নয়, শুধু ভালবাসার আশা রাখি। বাকি সব আমার আশাতীত। সে নিয়ে আমি ভাবিও না।” জুহীর কণ্ঠস্বরে কোনো জড়তা নেই।
রথীন উত্তর দেয় না।
“স্যার, আমাদের রেস্টুরেন্ট আজ একটু তাড়াতাড়ি বন্ধ হবে।” বেয়ারা বিল নিয়ে এসে দাঁড়ায় ওদের সামনে, ইতস্তত করে “বাইরে লেখা আছে স্যার! মালিক এর ছেলের মুখেভাত!”
উঠে দাঁড়ায় ওরা।  বিল মিটিয়ে বেরিয়ে আসে। জুহীর মনটা ভারী হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। রথীন চমকে যাবে আশা করেছিল ও। কিন্তু চমকানির এই দিকটা ভেবে দেখেনি। ভেবেছিল, সামনে দেখলে দ্বিধা কাটিয়ে মুক্ত কন্ঠে স্বীকার করতে পারবে রথীন ভালবাসা। যে ভালবাসা ও প্রতি পদক্ষেপে টের পেয়েছে গত এক বছর, ঘিরে রেখেছে যে ভালবাসা ওকে। সব শব্দ কি মুখে বলা যায়, নাকি সব মুখে বলা শব্দ সেই অর্থ বয়ে আনে?
হোটেলের সামনে এসে বলে জুহী, “সত্যিই ওপরে আসবেন না?”
“না! আপনার কোনো ক্ষতি আমি হতে দিতে পারব না। আমি যদি সেই ক্ষতির কারণ হই। নিজেকেও আটকাবো।”
“ক্ষতি? যদি একে ক্ষতিই বলেন, সে তো আমার হয়েই গেছে রথীন। এর থেকে বেশি ক্ষতি আপনি আমার রুমে এসে করতে পারবেন না” বিড় বিড় করে বলে, দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় জুহী।

ছুটি নিয়ে নিল পরের দিনটা রথীন। এতদূর থেকে চলে এসেছে জুহী, একটা দায়িত্ব আছে তো। যদিও সে ডাকে নি, আর জানতোও না জুহী আসছে। কাজের অসুবিধাও হবে একটু, কিন্তু তাহলেও অভদ্রতা করা যায় না।
জুহী সকালে উঠেই একটা ফোন করলো রথীনকে। সারারাত ঘুম হয়নি, কিন্তু রথীনকে অনলাইন দেখেনি। খুব খারাপ লাগছিল। কেন বলল রথীন ওর ক্ষতি করেছে। রথীন ওর জীবন বদলে দিয়েছে ঠিকই কিন্তু এটা খুশির বদল। জুহীর জীবনে এমন কিছু ছিল না যা বদলালে ওর ক্ষতি হতে পারতো! আসলে ওই “আপনার ক্ষতি হবে!” কথাটা মাথা গরম করে দিয়েছিল জুহীর। ফোনটা বেজে গেল খানিকক্ষণ। রাগ করলো নাকি রথীন? তোলা মাত্র সংশয় ভেঙ্গে দিল অবশ্য।
“কেমন ঘুম হলো ম্যাডাম? রেগে নাকি এখনো?”
“না না কি যে বলেন! রেগে থাকব কেন? ঘুম অবশ্য হয়নি। জেট ল্যাগ কি না! আমার সাথে ব্রেকফাস্ট করবেন নাকি?”
“নিশ্চয়! ছুটি নিলাম কেন তবে? আজ একটা দারুন জায়গা দেখাবো আপনাকে।”
হাঁফ ছাড়ল জুহী। পরে রাস্তায় বেরিয়ে আর মনেও থাকলো না কালকের মনোমালিন্য। দিনটা মেঘলা আর হাওয়া দিচ্ছে ফুরফুরে। ওরা বেরিয়ে পড়ল শহর পেছনে ফেলে। জুহী ভাবছিল কতবার ওরা কত জায়গায় একসাথে ঘোরার প্ল্যান করেছে! শেষ পর্যন্তএকসাথে বেরোলো।  গাড়ি নিয়ে এসেছে রথীন আজ। ভাড়া করেছে। সঙ্গে ড্রাইভার। সাঁই সাঁই  করে পেরিয়ে যাচ্ছে বাইপাস, কামাল গাজী, সোনারপুর, বারুইপুর। জুহী বুঝলো প্ল্যান লম্বা আর খুব খুশীতে উচ্ছল হয়ে উঠলো। জমে উঠলো গল্প। সেই সেবার  শেয়ার করে দেখা সাহেদ পারভেজ এর সেতার।  এখনো ওরা তর্ক করে চলে উনি ঝিনঝটি ভালো বাজিয়েছিলেন নাকি ছায়ানট। তারপর তুমুল উৎসাহে শক্তির পদ্য আর শঙ্খ ঘোষ। শেষবার যে বইটা উপহার পাঠিয়েছিলো রথীন সেটার বেশ কয়েকটা কবিতা জুহীর কণ্ঠস্থ এখন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় তার প্রিয় কবি শুনে, বান্ধবীর হাতে বই পাঠিয়েছিল রথীন, সেই তুমুল ব্যস্ততার মধ্যেও। “কলকাতা বইমেলাতে আপনাকে ছাড়াই ঘুরতে হলো। একবার একসাথে ঘুরবো!” লিখে দিয়েছিল পেছনের প্রচ্ছদে। মুগ্ধ হয়ে একবার ওর দিকে তাকায় জুহী, মনে মনে বলে, “তবু বলবে ভালবাসে না!”
রায়চকে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর হয়ে যায়। রায়চকের হোটেলটা আশ্চর্য সুন্দর। অবাক হয়ে দেখে জুহী! নদীর মোহনায় এতো সুন্দর জায়গা যে ছিল, প্রকৃতি না নষ্ট করে ফেলেও যে এতো সুন্দর ট্যুরিজম হয়, তা জুহী তার ওখানকার দেশে দেখেছে। এ দেশে নয়। তবে শুনেছে আজকাল ইকো-ট্যুরিজম নাকি ভারতেও খুব ভালো চলছে। এটা অবশ্য একেবারেই বাণিজ্যিক হোটেল। তা হোক। তবু সৌন্দর্যে একটুও কম নয়। ওরা পৌঁছেই লাঞ্চ সারে। ঘুম পাচ্ছিল জুহীর, এখন তার দেশে গভীর রাত। কিন্তু আবার রুম নেবার কথা কি করে বলে! ওরা দুটো কোল্ড ড্রিংক হাতে নিয়ে নদীর বালির ওপর হাঁটতে যায়। নদীর ধারের হাওয়ায় মনটা স্নিগ্ধ হয়ে যায় জুহীর। কলকাতার ভ্যাপসা গরম এখানে নেই।
“তারপর? এখান থেকে কোথায় যাচ্ছেন?”, রথীন প্রশ্ন করে।
“কোথাও যাবো বলে তো আসিনি। হ্যাঁ কিছু মাস পরে গিয়ে ওখানকার পাট চুকিয়ে আসতে হবে ঠিকই, কিন্তু সেইটুকুই। আর আমার কোথাও যাবার নেই।”
“এখানে কোথায় থাকবেন? কেন করবেন এরকম? আপনার অত কাজ, অত ছাত্র ছাত্রী…” রথীন আকাশ থেকে পড়ে!
“কাজ, ছাত্র-ছাত্রী এখানেও করে নেওয়া যায়। বসিয়ে খাওয়াতে পারবেন না কিছুদিন? সত্যি বলছি দাবী দেওয়া বেশি নয় আমার।” হেসে বলে জুহী।
“পারলে নিশ্চয় আপনার খরচ দিতাম। আরেকটা সেট আপ চালাবার মত ক্ষমতা আমার নেই জুহী। আপনি তো জানেন আমার পিসিকে…” দুঃখের আঁচ রথীনের গলায়।
“হ্যাঁ জানি তো। কিন্তু একটা সেট আপ-এ চালিয়ে নেওয়া যায় না? আর আমারও কিছু টাকা আছে বৈকি। ভাগাভাগি করে চালিয়ে নেবো আমরা। কতদিন আলাদা থাকবো?”
“মানে? আপনি আমার সাথে থাকতে চান? ঠাট্টা করছেন আমার সাথে? এটা কি করে সম্ভব?” অধৈর্য শোনায় রথীনকে এবার।
“যেমন করে আমরা দিনের পর দিন বেড়াতে যাবার প্লান করেছি সেরকম ভাবেই সম্ভব!” জুহী জোর করে হাসে।
“বেড়াতে যাওয়া আর এক বাড়িতে থাকা এক ব্যাপার হলো, জুহী। নাঃ আপনার মাথাটা গেছে! আর থাকবেনই বা কেন আপনি আমার সাথে?”
জুহী শান্ত হয়ে যায়, থমকে যায় এক মুহূর্ত, যেন সাহস জোটায়।
“আমরা একসাথে থাকব কারণ যারা ভালবাসে তারা একসাথেই থাকতে চায়।”
“যারা ভালবাসে!” আকাশ থেকে পড়লো রথীন।
“হ্যাঁ। আমার কোনোদিন কোনো সংশয় হয়নি আমাদের এই ভালবাসা নিয়ে। আপনার এখনো সংশয় থাকলে আমি কিছুদিন অন্য কোথাও পেয়িং গেস্ট থাকতে পারি!”
“আমাদের ভালোবাসা? সংশয়? না জুহী আমার মনে কোনো সংশয় বা কোনো সন্দেহ নেই যে আপনার ভীষণ ভুল হচ্ছে! আমাদের মধ্যে কোনো ভালবাসা নেই।”
“আপনি এখনো বলবেন নেই ভালবাসা? এতো মাস ধরে এতো কিছু তবে কি?”
“এতো কিছু? কি এতো কিছু? বই পড়া? গান শোনা? গল্প করা? উপহার দেওয়া? সেগুলো কি বন্ধুর সাথে করা যায় না?”
“শুধু সেগুলো নয় কিন্তু। যখন বলেছিলেন, আমার সঙ্গে রাত কাটাতে চান কোনো পাহাড়ে? ভোর হবে চৌরাসিয়ার বাঁশিতে। আর যখন বলেছিলেন শুধু আমাকে জড়িয়ে ধরতে পারলে খুশি হতেন?”
“জড়িয়ে ধরতে পারলে! আমি ‘হাগ’ বলেছিলাম, জুহী। কি মুশকিল! বিদেশিনী কি সত্যি এতোটাই গোঁড়া হয়, নাকি আপনি আমাকে অস্বস্তিতে ফেলতে চাইছেন?” রথীনের ভুরু কুঁচকে ওঠে, “আমি আমার মা বাবার পর পর মৃত্যুতে খুবই ভেঙ্গে পড়েছিলাম তখন। তাই হয়ত এই ধরণের কথা আমার মুখ দিয়ে বেরিয়েছিলো! অন্যায় হয়েছে বুঝছি। যদি বলেন, ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি!”
“আপনার তাই মনে হচ্ছে? আমি আপনাকে অস্বস্তিতে ফেলতে চাইছি? আমিই বরং ভীষণ অস্বস্তি বোধ করছি। একদম গুলিয়ে যাচ্ছে সবকিছু আমার…”
“ভালো করে ভেবে দেখুন তো জুহী, আমি কি কখনো আপনাকে বলেছি আমি আপনাকে ভালোবাসি? কোনদিন বলেছি?” রথীন কনভিন্স করতে মরিয়া হয়ে ওঠে যেন।
“না, বলেননি আপনি। সত্যিই ওই শব্দ তিনটে বলেননি। কিন্তু সব কিছু কি সেই পার্টি‌কুলার শব্দ ব্যবহার করেই বলতে হয়? ভালোবাসা কি বোঝা যায় না?”
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে রথীন, “হয়তো যায়। হয়তো যায় না। আমি ভালোবাসার কি জানি!”
“আবার বলছেন ভালোবাসার কি জানেন? ভালোবাসা আমার জন্যে সহমর্মিতা। দুঃ খের দিনে একে অপরের পাশে দাঁড়ানো। দুঃখের দিনে যাকে আমি পাশে চাই, আমি জানি, আমি তাকে ভালোবাসি। সারাদিন অপেক্ষা করা কতক্ষণে ভাগ করে নেব সারাদিনকার গল্প। একে অপরের কাজ ভাগ করে নেওয়া। একসাথে হাসা। অন্যজন না খেলে নিজেও না খেতে চাওয়া। অন্যের কষ্টে চোখে জল আসা। করেননি এই সমস্ত কিছু আপনি আমার জন্যে? আমি খেতে পাইনি বলে আপনি খেতে চান নি মনে আছে?” জুহী বলে চলে, “প্লেটো বলেছিলেন, যে বাচ্চা অন্ধকারকে ভয় পায় তাকে সহজেই ক্ষমা করে দেওয়া যায় কিন্তু পূর্ণবয়স্ক মানুষের আলোকে ভয় পাওয়ার থেকে বড় ট্র্যাজেডি বোধহয় আর কিছুই নেই। আপনি যেন আলো দেখে চোখ বন্ধ করে আছেন! ভালোবাসা হলো সবকিছু উপেক্ষা করে একটি মানুষকে পাশে চাওয়া। সেই চাওয়াই ছুটিয়ে নিয়ে এলো আমাকে, ভেবেছিলাম আপনি খুব খুশি হবেন…” গলা বুজে আসে জুহীর।
“কি ছেলেমানুষি করছেন বলুন তো! আমার মত একটা ওঁচা লোকের জন্যে এত দামী অশ্রু বইয়ে দেবেন? বাঁচিয়ে রাখুন জুহী দেবী! বাঁচিয়ে রাখুন! আমি আপনার যোগ্য নই। মিস্টার জনাথন রাইটও হতে পারেন নি। কিন্তু আমি জানি কেউ না কেউ আছেনই এর যোগ্য! যে শিবের মত আপনার পায়ের তলায় পড়ে থাকবে কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র মান খোয়াবে না তার। আপনার মত মহিলাদের আমার মা দুর্গার রূপ মনে হয়। পুরুষ পড়ে থাকবে পায়ের কাছে। সঙ্গী হবার যোগ্যতাওয়ালা পুরুষ বিরল। রামকৃষ্ণদেবই ঠিক করেছিলেন…”
মুখ ঘুরিয়ে নেয় জুহী। লাল সূর্যাস্তের আলো লুটিয়ে পড়েছে নদীর চরে। তার নিজের হৃদয় যদি এখন খুলে দেখাতে পারতো, তার থেকেও অনেক গাঢ় লাল সেটা এখন। কেউ যদি তার জীবনের সবথেকে মূল্যবান মুহূর্তগুলোকে ভুল বলে ফেরত নিয়ে নিতে চায়, তাহলে সে কি করে? এই প্রথম মনে হচ্ছে ঠিকই বলেছে রথীন। হয়ত ওকে ভালোবাসেনি সে। ভালোবাসলে, ভালোবাসার নারীর রক্তক্ষরণ এমন অদেখা থাকত না। সেই মুহুর্তে দার্শনিক ভাষণ দিত না রথীন। নিজেকে খুব খারাপ লাগে। যেন জোর করে ভালোবাসা আদায় করতে এসেছে। অথচ ও খুব নিশ্চিত ছিল এর উপস্থিতি নিয়ে। মনে হয়, রক্তপাতে রক্তপাতে যদি শূন্য করে দেওয়া যেত হৃৎপিণ্ডটাকে, যদি লুটিয়ে পড়ে মরে যেতে পারত জুহী এই মুহূর্তে! আরাম হত!
তার বদলে মুখ ঘুরিয়ে গাড়ির দিকে হাঁটে। পেছনে রথীন। পুরো রাস্তা চুপ করে থাকে জুহী জানলায় মাথা দিয়ে। হাওয়ায় চুল ওড়ে। পাশ দিয়ে সারি সারি নারকোল গাছ পেরিয়ে যায়। তাদের লম্বা কান্ডগুলো পূর্ণবিরামের মতো দেখায়। ভাগ্যিস ড্রাইভার গান চালিয়েছিল তাই নৈঃশব্দ পাথর হয়ে বসে না! রথীনও কথা বলে না। জানলা দিয়ে আকাশ দেখে। বড় চাঁদ উঠেছে আকাশে। রথীন ভাবে, পরের পূর্ণিমাই কোজাগরী লক্ষী পূর্ণিমা। নিজের মনেই ফোনটা নিয়ে নাড়াচাড়া করে যায়। বেশ কয়েকটা মেল জমা হয়েছে গত দুদিনে। এই সব মেলের উত্তর দিতে হবে তাকে। এমনিতেও মনটা অস্থির হয়ে আছে। তার ওপর কাজ জমে গেলে অস্বস্তি লাগে তার।
হোটেলের কাছাকাছি এসে অন্যমনস্কভাবে জুহী বলে, “কাল সকালের ট্রেনে বোলপুর চলে যাই তবে? যদিও চিনতে পারবো কি না…”
উচ্ছলতা ফিরে পায় রথীন, “সেই ভালো! ঠাকুমা ভীষণ খুশি হবেন! ওনাকে আমার প্রনাম দেবেন। আমি বলে দেব ডাইরেকশন আপনাকে।”
আর পারে না জুহী, হাহাকার করে ওঠে! “আমাকে যেতে দেবেন না রথীন। আমাকে চলে যেতে দেবেন না। রেখে নিন আপনার কাছে। আমি এত ভালো আর কাউকে কখনো বাসতে পারব না!”
চুপ করে থাকে রথীন। মাথা নিচু করে শোনে কথাগুলো। খুব নম্র স্বরে বলে, “রাখতে পারলে, আমার থেকে বেশি খুশি আপনিও হতে পারতেন না। আমি নাহয় ভালোবাসিনা কিন্তু আপনার ভালোবাসার মর্যাদা দিয়েও যদি রাখতে পারতাম, আমি নিশ্চয় সে চেষ্টা করতাম। কিন্তু, আমি তো জানি এ আপনার ভুল ভাবনা। আমি জানি, আপনি আমাকে আসলে ভালোবাসতে পারেন না। আপনি এরকম মনে করছেন ঠিকই, কিন্তু এটা সত্যি নয়। কিছুদিনের মধ্যেই এই ভাবনাটা আর মনের কোথাও বেঁচে থাকবে না! আর তখন ভালোবাসেনা এমন একটা লোকের সাথে দিন কাটাতে অপমানবোধ হবে আপনার!”
তারপর একটু থেমে বলে, “আমি যাই এখন। কাল সকালে এসে ট্রেনে তুলে দেব আপনাকে।”
জুহীর মনে হলো, না বলার ক্ষমতাটুকুও আর অবশিষ্ট নেই তার ।

“কাল সারারাত আমি ভাবলাম আপনার কথা।” শুনে চমকে উঠল জুহী। তবে কি রথীন ভুল বুঝতে পারলো! রথীন নিজের মনেই বলে চলে “আপনি আমাকে ভুল বুঝেছেন। আমি কখনই বলিনি আমি আপনাকে ভালোবাসি। আমি আপনার গুণমুগ্ধ ভক্ত হতে পারি, তার বেশি কিছু হবার যোগ্যতা আমার কখনো ছিল না। হবেও না।  আর ওই যে বললাম, আমি কোনদিন কাওকেই ভালোবাসিনি। ভালবাসাটা আমি শিখিনি কখনই। ওটা আসে না আমার। সেই জন্যেই তো আমার স্ত্রী ভালবাসার খোঁজে বার বার অন্য পুরুষে উপনীত হয়েছেন। ইট ইজ রিয়েলি দ্যাট নাউ এ ডেজ, রাইট? উইমেন অন টপ! তবে, আমি জানি এই যে আপনার মনে হয়েছে, এই যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে সেটার জন্যে আমিই নিশ্চয় দায়ী। আমার বারবার মনে হয়েছে আমার মত ভালবাসাহীন মানুষের বেঁচে থাকাই উচিত নয়। অনেক দিন আগেই মরে যাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু আমার পিসি বড় একা। তাঁর আমি ছাড়া কেউ নেই…” আরও কি সব বলে যায় রথীন।
আর শুনতে পায় না জুহী। হাসি শুকিয়ে গেছে কালই, এখন কানও বন্ধ হয়ে আসে। হাঁটতে থাকে ও প্লাটফর্ম এর দিকে। ফিরে তাকায় না। এত বড় ভুল করলো বুঝতে ও! এতদিন ধরে ভুল বুঝলো? জুহী এগোয় আর ভাবে, কেন সে জিজ্ঞাসা করলো না, থামায় নি কেন রথীন তাকে? যখন সে রথীনের ফোন পেয়ে বলেছে, “মরে যাব একদিন আপনার গলা শুনে আমি। আপনার গলায় জাদু আছে !” কেন বলেনি রথীন, সে ভুল পথে এগোচ্ছে? কিন্তু রথীনের কি দায়! বিশেষত সেই রথীনের, যাকে সে এই দুদিন দেখে এলো! এর মধ্যেও ভাবে কি ভাগ্যে হাত ধরতে যায়নি রথীনের সেদিন। হাত সরিয়ে নিলে কি লজ্জাই না লাগতো! এখনই বা কি কম লজ্জা পেতে হলো! নাকি সে ভুল বুঝছে? রথীন তাকে পরীক্ষা করছে হয়তো। দেখতে চাইছে সে থাকবে কি না সব অনাদর উপেক্ষা করে! বন্ধ চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে চাইলে, সানগ্লাস দিয়ে চোখ ঢাকে সে। মনে মনে আদর করে ওই মুখটাকে। কপালে চুমু খায়। গলার পাশে হাত রাখে। বুকে মাথা। যেমনটা সে গত একবছর করে এসেছে মনে মনে। কিছুতেই ঘৃণা করে উঠতে পারে না! অনেক কষ্ট পাওয়া রথীন আরো কষ্ট পাক ও এমনটা চাইতে পারে না! সিটে বসে কাঁচের জানলার দিকে মাথা ঘুরিয়ে রাখে। ট্রেন গড়াতে শুরু করে।

ওদিকে রথীন দাঁড়িয়ে থাকে। জুহী চোখের বাইরে চলে গেলে স্বস্তি হয় তার। ফোনটা অফ করে দেয়। আজও কম্পিউটার খুলবে না সে। উফ! খুব জোর বেঁচেছে। এতটা ফেঁসে যেতে পারে কোনোবার মনে হয়নি তার। সোজা ক্যালিফোর্নিয়া থেকে কেউ কলকাতা চলে আসবে, এতটা কে পারবে ভাবতে? আজব হয় মহিলারা! নিজের বর ছেড়ে অন্য পুরুষের অঙ্কশায়িনী হবার তাড়াটা আশ্চর্যজনক! আবার বলে ভালোবাসা! এরা ভালোবাসার বোঝেটা কি! আর ভাবে পুরুষমাত্রেই সেক্স ছাড়া কিছু বোঝে না। তাই তাদের বিছানায় টানা তো কোনো ব্যাপারই না। আসলে দেখছে তো রথীন গত দু বছরে, মেয়েদেরই ছোঁক-ছোঁকপনা অনেক বেশি। কোনোক্রমে লুকিয়ে রাখে। একটু আঁচড় দিতে হয় ব্যাস! লালঝোল ফেলে দৌড়ে আসে। এখন সে নিজে আর এদের চায় না! মনে মনে হাত সরায় রথীন। গুনে গুনে। একটা একটা করে। অনেকগুলো দিন পেরিয়ে গেছে, কিন্তু এখনো তিথির হাত ছিটকে দিয়ে, পেছন ফিরে ঘুমিয়ে পড়া মনে পড়লে, চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে রথীনের। তিনশ চৌষট্টি রাত! নিজের মনেই বলে, “সব কিছুরই মাশুল গুনতে হয়! কেউ নিজে গোনে, কারুর জন্যে অন্যরা। তুমি ভালো থেকো তিথি! আমি তোমার কোনো ক্ষতি করবো না। তোমার একমাত্র দোষ ছিল তুমি মেয়ে। এক্স ক্রোমোজোমের শিক্ষা তোমার মজ্জাগত…যে শেখেইনি একনিষ্ঠ হতে।”
চ্যাটে ব্লক করতে হবে জুহীকে। তবে কয়েকদিন পর করবে। আশাকরি ততদিনে আবার সাত সাগর পাড়ি দেবে জুহী। অনেক সময় গেল এই ব্যাপারটার পিছনে। কিন্তু ঘটনার শেষে নিজেকে একটা থাম্বস আপ দেওয়াই যায়। সব ভালো যার শেষ ভালো। জুহী দেবীর বিসর্জন হলো মনে হচ্ছে। হাসলো মনে মনে রথীন।
পরের দিন রাত্রে কম্পিউটার খুলল। তিন দিন! এখনো কি আছে ওর উত্তরের অপেক্ষায়? যদিও প্রায় পার্ফে‌কশনের পর্যায়ে নিয়ে চলে গেছে এই আর্টটাকে ও, তবু অনিশ্চয়তা তো থাকেই। আর এই অনিশ্চয়তাই এই খেলাটার মজা শতগুণ বাড়িয়ে দেয়। নীল আলো জ্বলে উঠলো ল্যাপটপের।
নামের পাশে সবুজ আলো দেখে রথীন বলে, “কি? ভুলে গেছেন নিশ্চয় আমাকে। এই সাধারণ মানুষটাকে কেই বা মনে রাখে। তাও দীর্ঘ তিন দিন।”
“আরে, রথীন যে! কেমন আছেন? কোথায় ছিলেন? আপনার কথাই ভাবছিলাম তো। ভাবলাম শরীর খারাপ হলো নাকি! কাল ফোনেও পাইনি।” তাড়াতাড়ি উত্তর এলো।
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল রথীন। উত্তর আশানুরূপ। ব্যগ্রতাও…
“যাক! ভাবছিলাম গরীবকে দুঃখ পেতে হবে এখুনি! বলবেন, এ আবার কে! ফোনের কথা আর বলবেন না! ফোন ফেলে এসেছিলাম বন্ধুর বাড়ি। কাল আর যাবার উপায় ছিল না।” একটা দুঃখী ইমোজি দিল কথার শেষে রথীন।
“আপনার মতো মানুষকে কি কেউ দুঃ খ দিতে পারে।” হাসির ইমোজি এলো অন্য প্রান্ত থেকে।
রথীন বলে, “পারে বই কি! খুবই সহজে পারে। আপনি তো জানেন আমার স্ত্রী ও আরও অনেকেই…”
“আমি কখনো পারবো না, বরং ভয় পাচ্ছিলাম আমার সেদিনের কথা শুনে রেগে গিয়ে কথা বন্ধ করলেন নাকি!”
রথীনের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। মনে মনে বললো “একশ’ বাহান্ন… টু হান্ড্রেড টুয়েলভ মোর টু গো…”
স্ক্রিনে লিখলো, “আপনার মতো মানুষ আজকের দুনিয়ায় দুর্লভ সুচরিতা…!”
***
ছবি: বিজয়া দত্ত

2 thoughts on “ভালোবাসা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.