এই সময়ে, কবি ও কবিতার উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নেমে আসার সময়ে, দেশ ও দেশবাসীর উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নেমে আসার সময়ে দাঁড়িয়ে কিছু কবিতা, কিছু প্রতিবাদের স্বর। পঞ্চম কিস্তি – কিনফাম সিং নোঙকিনরিহর কবিতা। ভাষান্তর – শুক্লা সিংহ।

মায়ের জন্যে কিছু অপবিত্র কথা

আর কে নারায়ণ মারা গেছেন।
আজ রাতে বিষণ্ণ মনে
এই বেতের চেয়ারে বসে
তিনি ‘অসাধারণ ‘ এক ব্যক্তির কথা বলছেন।
হঠাৎ আমারও প্রচণ্ড ইচ্ছে করছে
আমিও নিজের ‘অসাধারণ আত্মাটিকে’
এফোঁড়-ওফোঁড় করে চিরে দেখি।

প্রথমেই বলে রাখি যে আমার মা, আর কে নারায়ণের মায়ের তুলনায়
অনেক বেশি মনখোলা ও স্পষ্টবক্তা।
আমার মা অবসরপ্রাপ্ত, ফোঁকলা, বহুমূত্রপীড়িত ও মাথাব্যথা এবং চোখের ছানিতে
নাকানি-চোবানি খাওয়া এক মহিলা।
এককথায় বলতে গেলে, আমার মা এক  ‘বদমেজাজি’ বৃদ্ধা।

আমার মনে আছে এককালে মা এক বদমেজাজি খিটখিটে যুবতী ছিলেন। দুপুরে যখন অবেলায় তাঁর ঘুম ভেঙ্গে যেত, মা বাঘিনীর মতো গর্জে উঠতেন। “হারামির বাচ্চার দল!“ বলে দাঁত খিঁচিয়ে উঠতেন, “আমায় এক মুহূর্তের জন্যে শান্তিতে থাকতে দিবি না , শয়তানের বাচ্চার দল! আয় সামনে জানোয়ারের বাচ্চারা! সামনে পেলে তোদের হাড়গোড় সব ভেঙ্গে দেব!… তোদের ঘেন্না করি আমি! যে তোদের জন্ম দিয়েছে, তাকেই কুরেকুরে খুবলে খাচ্ছিস তোরা! আরেকবার যদি আমার ঘুম ভাঙাতে আসিস, তোদের সব্বাইকে আমি আছাড় দিয়ে মেরে ফেলব যতক্ষণ না কুকুরের মতো আর্তনাদ করবি! গাধার দল! যতক্ষণ না ভালো ঘুম হবে, কীভাবে ভালো স্বপ্ন দেখব, কীভাবে সংখ্যাগুলোকে নিয়ে খেলব? তোদের কীভাবে খাওয়া জুটবে, ছোটলোকের বাচ্চারা?”

কথাগুলো আগুনের ফুলকির মতো আমাদের দিকে ধেয়ে আসত, তার সাথে থাকত কাঠের টুকরো, লোহার চিমটে ও কাঁসার জাঁতা,
এদিকে আমরা নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর জন্যে দৌড় দিতাম
আর মা বেত-লাঠি নিয়ে আমাদের তাড়া করত,
তাঁর চুল এলোমেলো, চোখে আগুন,
তাঁর জিভে এক ভয়ঙ্কর রাগ।
আমরা বাচ্চারা পড়াশোনা না শিখলেও মায়ের এইসব অসাধারণ অস্ত্রের
মোকাবলা কী করে করতে হয় সেটা শিখে ফেলেছিলাম।

আমার মনে আছে – মায়ের কোনো মেয়ে না থাকায়
তাঁর রক্তে ভেজা ন্যাকড়াগুলো আমাকেই ধুতে হত।
মাকে ‘না’ বলার সাহস আমার ছিল না। তাই উপায় না দেখে আমি ন্যাকড়াগুলো
লাঠি দিয়ে তুলে একটি পুরানো লোহার বালতিতে ভরে হামানদিস্তার মত পেটাতাম,
যতক্ষণ রক্ত সব ধুয়ে না যেত। কিন্তু এইসব লোকচক্ষুর আড়ালে করতাম। যদি মা দেখে ফেলত যে আমি হাত দিয়ে ন্যাকড়া পরিষ্কার করিনি, পরিণাম ভয়ংকর হতে পারত।

চেরাপুঞ্জিতে তখন টয়লেট কাকে বলে, আমাদের জানা ছিল না । আমাদের কোনো সেপ্টিক ট্যাংক বা ল্যাট্রিন ছিল না। আমরা সেইসব পবিত্র ঝোপঝাড়ে আমাদের প্রাকৃতিক কাজ সেরে নিতাম। কিন্তু মা মাঝে-মাঝে আবর্জনা রাখার পাত্রেও নিজের কাজ সেরে ফেলতেন। তারপর ওই মালটাকে নিয়ে কোনো ঝোপে রেখে আসার দায়িত্ব আমার ঘাড়েই এসে পড়ত । মায়ের কথার খেলাপ করার জো ছিল না। উপায় না দেখে আমি ওইটার ওপর একটু ছাই ছড়িয়ে দিতাম এবং জিনিসটাকে সুপুরির খোসা দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে দিতাম যাতে আমার বন্ধুরা বা প্রতিবেশীরা কেউই বুঝতে না পারে। যারা কামাল হাসানের ‘পুষ্পক’ ছবিটি দেখেছেন, তারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন আমি কীসব কৌশল অবলম্বন করেছিলাম।

আমি হয়তো আরও এক হাজার একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে পারব যে আমার মা কতটুকু বদমেজাজি বিরল এক মহিলা। তাঁর সম্বন্ধে আমি ভালো কিছুই বলব না। আমি আর কে নারায়ণ নই, এবং তাই আমি বলব না
আমার মাতাল বাবা জীবদ্দশায় আমার মাকে কত কষ্ট দিয়েছিল।
আমি এটাও বলব না কত কষ্ট করে মা তাঁর দুই ছেলে এবং নিজের মৃত বোনের দুই সন্তানকে বড় করেছেন। তাঁর সম্পর্কে ভালো কথা বলতে শুধু এটুকুই যে, যদি মা তাঁর বদমেজাজি খিটখিটে বদরাগী ভাব ছেড়ে আবার বিয়ে করে নিত, তাহলে আজ হয়তো এখানে দাঁড়িয়ে আমি এই কবিতাটি পাঠ করতাম না।

প্রধানমন্ত্রী যখন শিলং-এ বেড়াতে আসেন, বাঁশগাছগুলো নীরবে তাকিয়ে থাকে

প্রধানমন্ত্রী যখন এই শহর
ঘুরে দেখার মনস্থির করলেন
বাঁশের খুঁটিগুলো তাঁকে স্বাগত জানানোর জন্য
মাটি ফুঁড়ে উঠে এল।

কিন্তু তিনি যখন এসে হাজির হলেন, তাঁর
কণ্ঠস্বর ছিল সাইরেনের শব্দ
যেন যুদ্ধক্ষেত্রে বোমাবর্ষণের ইঙ্গিত।

বাঁশগাছগুলো তখন নীরবে তাকিয়ে দেখছিল।

তাঁর আসার উদ্দেশ্য দুটি
শান্তি-সম্প্রীতি স্থাপন এবং উন্নয়ন।
কিন্তু তিনি শুধুই বৃথা বক বক করলেন
কেবল মেঘের ন্যায় গজরাতে থাকলেন।

কেউ কেউ মন্তব্য করল
তিনি নাকি মিসাইলের মতো হুশ করে এসে
তীরের মতো উড়ে চলে গেছেন

তারা আরও বলল
তিনি নাকি উল্কার মতো খসে
নীচে পড়ে যান
এবং এটা দেখে বাকি নেতাগণ
খুব রেগে যান

তিনি খুব তর্জন-গর্জন করছিলেন,
এদিকে নিজেদের কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে
বাকি মন্ত্রীদের শরীর তখন ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল
কিন্তু অবশেষে তিনি একটি নিষ্ক্রিয় বোমার মতো বেরিয়ে যান।

লোকেরা ভাবতে লাগল
তাঁর এই ঝটিকাসফরে
তিনি এই রাজ্যের কতটুকইবা
দেখেছেন
এখানকার বাসিন্দাদের সম্পর্কে কীইবা
জেনেছেন।

ছোটো শিশুদের মতো
তারা প্রশ্নগুলোর উত্তর
খুঁজতে লাগল।

কেবল বাঁশগুলো নীরবে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল
মানুষের এসব মুর্খামির সাথে তারা সুপরিচিত।

সুন্দরী

প্রিয়তমা সুন্দরী
গতকাল আমাদের একজন
তোমাদের একজনকে খুন করেছে
আর তোমাদের একজন
আমাদের একজনকে খুন করেছে।
আজ দুই গোষ্ঠীই শপথ নিয়েছে
সামনাসামনি দেখা হলেই কেটে ফেলবে।
কিন্তু তাদের কেউ আমি নই, তুমিও নও,
আমরা কি তাহলে উমখ্রা নদীর তীরে দেখা করে
এই পাশবিক উন্মাদনা
গ্রীষ্মের জলপ্লাবনে ভাসিয়ে দেব?
আমার এই কথাগুলো
ত্রস্ত রাতের মৃদু বাতাসের গায়ে ভর করে পাঠালাম,
দয়া করে তোমার জানালা খোলা রেখো।

শিলং বাইপাস

শিলং মাল্টি-লেইন বাইপাসে
অদ্ভুত সব কারণে অনেক বছর
কোনো কাজ হয়নি ।

আমরা বললাম সরকারের দোষ
আমরা বললাম জমির মালিকের দোষ,
কিন্তু আসল সত্যিটা ঠিক কী ছিল?

ফেবি নামক এক সবজান্তা পুরো গল্পটা জানত।
সে বলতে লাগল: কৃষকদের কোনো দোষ নেই;
তারা তাদের প্রাপ্য ক্ষতিপূরণের আশায় দিন গুনছিল।
একটি বিশেষ আদালত ওই বাষট্টিজন কৃষকদের
জেরা করার হুকুম দেয়।

তো উকিলবাবু কী করলেন?

তিনি একদিন ফাইল বাড়িতে রেখে চলে আসেন;
তিনি আদালতের কাছে সময় ভিক্ষে চেয়ে নেন।
তিনি ট্রাফিকে আটকে যান;
তিনি আদালতের কাছে সময় ভিক্ষে চেয়ে নেন।
তাঁকে গৌহাটি যেতে হয়;
তিনি আদালতের কাছে সময় ভিক্ষে চেয়ে নেন।
তিনি আমাশয়ে ভুগতে থাকেন;
তিনি আদালতের কাছে সময় ভিক্ষে চেয়ে নেন।
তাঁর এক আত্মীয় অসুস্থ হয়ে পড়েন;
তিনি আদালতের কাছে সময় ভিক্ষে চেয়ে নেন।
সরকার পরিবর্তন হয়;
তিনি আদালতের কাছে সময় ভিক্ষে চেয়ে নেন।
একদিন তাঁর মনে হল
সরকারি উকিলের চাকরিটা বুঝি আর নেই;
তিনি আদালতের কাছে সময় ভিক্ষে চেয়ে নেন।
কিন্তু পরে তিনি জানতে পারেন
তিনি তখনও সরকার পক্ষের উকিলের পদে বহাল রয়েছেন;
তিনি আদালতের কাছে সময় ভিক্ষে চেয়ে নেন।
এভাবে বাষট্টিজন কৃষক বাষট্টিবার
আদালত চত্বরে ঘুরে বেড়ায়।
প্রতিবার তারা খেতের ফসলগুলোর তোয়াক্কা না করে
ধার দেনা করে গাড়ির ভাড়া মিটিয়ে আদালতমুখো হয়।
কিন্তু একদিন সেই উকিলবাবু
সম্মানীয় বিচারকের পদে আসীন হন,
আর তারপর, তাঁর বিরুদ্ধে
কেউ মুখ খোলার সাহস করেনি।

কিনফাম সিং নোঙকিনরিহ (Kynpham Sing Nongkynrih) উত্তর-পূর্ব ভারতের এক বিশিষ্ট কবি। জন্মস্থান মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি (সোহরা); পড়াশোনা শিলংয়ে।  বর্তমানে নর্থ-ইস্টার্ন হিল ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক। লেখালেখি করেন ইংরেজি এবং খাসি ভাষায়। লিখেছেন প্রচুর কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, ও লোককথা। উত্তর-পূর্ব ভারতের দুটি বিশেষ কাব্য-সংকলন অ্যান্থলজি অফ নর্থ ইস্ট পোয়েট্রি (২০০৩) ও ড্যান্সিং আর্থ (২০০৯)-এর সহ-সম্পাদক হিসেবেও কাজ করেছেন।

তাঁর কাব্যগ্রন্থ মোমেন্টস (১৯৯২), দ্যা সিভ (১৯৯২), দ্যা ইয়ারনিং অফ সীডস (২০১১) পাঠকমহলে বিশেষভাবে সমাদৃত। তিনি ‘বীর শঙ্কর শাহ – রঘুনাথ শাহ জাতীয় সম্মান’ তথা ‘নর্থ- ইস্ট পোয়েট্রি’ সম্মানে ভূষিত।

শুক্লা সিংহ সম্প্রতি ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে পিএচডি লাভ করেছেন। লেখালেখি করেন ইংরেজি এবং বাংলায়। Muse India, Yendai, The Sunflower Collective, Cafe Dissensus, ত্রিস্টুপ – এ তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে।

আরো পড়ুন: প্রতিবাদের স্বর । দেবী প্রসাদ মিশ্রর কবিতা । ভাষান্তর – অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

3 thoughts on “প্রতিবাদের স্বর । কিনফাম সিং নোঙকিনরিহ–এর কবিতা । ভাষান্তর – শুক্লা সিংহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.