সর্বজয়া ভট্টাচার্য
যাদবপুরে ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট-এ এম. ফিল.-এর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী
সমকালীন ‘মূলস্রোতের’ হিন্দি ছবি সম্পর্কে একটা কথা আজকাল খুব শোনা যায় – এই ধারায় নাকি হালে অনেক নারী-কেন্দ্রিক ছবি তৈরী হচ্ছে। চিত্রনাট্য লেখা হচ্ছে নায়ক নয়, নায়িকাকে কেন্দ্র করে। বিদ্যা বালান অভিনীত ‘কাহানি’, ‘ডার্টি পিকচার’, আলিয়া ভট অভিনীত ‘হাইওযে’ এবং কঙ্গনা রনওয়াত অভিনীত ‘কুইন’ এই গোত্রের ছবি। এমন ভাবে এই ছবিগুলোকে অভ্যর্থনা হচ্ছে যেন ভারতবর্ষে এর আগে মেয়েদের নিয়ে কেউ কোনোদিন ছবি-ই করেননি, তবে থাক সে কথা। খেয়াল করলে দেখা যাবে যে যে এই ছবিগুলো (সব নিশ্চয়ই নয়) তাদের মূখ্য নারী চরিত্রের মাধ্যমে এক ধরণের সরলীকৃত ও সহজপাচ্য ‘নারীবাদ’-এর ধারণা দর্শকদের পরিবেশন করে চলেছে। জটিল তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গী অবলম্বন না করেও তার চিহ্ন খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
এই লেখার আলোচ্য বিষয ‘কুইন’। পরিচালক – বিকাশ বেহল। নায়িকা- কঙ্গনা রনওয়াত। গোটা বিশ্বে ছবিটা একশো কোটি টাকারও বেশী ব্যবসা করেছে, যা তার তৈরী হওয়ার খরচের থেকে অনেক বেশী। প্রশংসাও কুড়িয়েছে যথেষ্ট, বিশেষত কঙ্গনা রনওয়াতের অভিনয়। বেশীর ভাগ সমালোচনাই প্রশংসায় ভরপুর এবং যে কথাটি বারবার বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে, এবং যা কিয়দংশে সত্যিও বটে তা হলো সমাজ ব্যবস্থার প্রতি এই ছবির কটাক্ষ। ছবিটির গল্পও বেশ চমকপ্রদ। দিল্লির এক মধ্যবিত্ত পরিবারের এক মেয়ের বিলেত-ফেরত হবু বর হঠাৎ বিয়ে করবে না বলে বেঁকে বসে এবং মেয়েটি (রানী) কিছুক্ষণ চোখের জল ব্যয় করার পর সিদ্ধান্ত নেয় যে সে একাই তার মধুচন্দ্রিমায় যাবে। বাকি ছবি জুড়ে আছে বিদেশে রানীর অভিজ্ঞতার কথা- তাতে দু:খ আছে, হাসি আছে, বিপদ আছে, বেপরোয়া দিন আছে। আছে নতুন বন্ধুত্ব, নতুন জগৎ- যেখানে প্রাণ খুলে নাচলে কেউ বারণ করে না, ঢেঁকুর তোলার সময় কেউ অসভ্য বলে না। এই নতুন অভিজ্ঞতা রানীকে পাল্টায় বটে, কিন্তু তার (ভাগ্যিশ) আমূল পরিবর্তন ঘটে না। শুধু যে সমস্ত নঞঅর্থক ধ্বনির মধ্যে দিয়ে রানীর জীবন গঠিত হয়েছিল, তার আওয়াজ ক্রমশ ফিকে হয়ে আসতে থাকে। ছবির শেষে তাই সে নিজেই তার ‘প্রেমিক’-কে বিয়ের আংটি ফেরৎ দিয়ে আসতে পারে।
CNN-IBNকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে কঙ্গনা বলেছিলেন যে বলিউডের নারী-কেন্দ্রিক ছবি মানেই গুরুগম্ভীর বিষয় আর জ্বালাময়ী বক্তৃতা। কেউ মেয়েদের বন্ধুত্ব নিয়ে , বেড়াতে যাওয়া নিয়ে, টুকরো আনন্দ নিয়ে- এক কথায় বলতে গেলে তাদের নিত্যনৈমিত্তিক বেঁচে থাকা নিয়ে ছবি বানায় না। ‘কুইন’ সেই শূন্যস্থান পূরণ করার চেষ্টায় নি:সন্দেহে সফল. এবং সফল এই কারণেও যে ছবিটি সত্যিই এক ধরণের চিরাচরিত জং ধরে যাওয়া মানসিকতার দিকে আঙুল তোলে, এবং এর জন্য তাকে কোনো ভাষনের আশ্রয় নিতে হয় না।
চলচ্চিত্র হিসেবে ‘কুইন’ কত নম্বর পাবে তা ঠিক করবেন/ করেছেন দর্শক এবং সমালোচকরা। তবে যেহেতু ছবিটি সচেতন ভাবেই সমাজের ফাঁক-ফোঁকরগুলোকে আমাদের দেখানোর চেষ্টা করে, তাই শুধুমাত্র চলচ্চিত্রের আঙ্গিকেই তার সমালোচনা করা সম্ভব নয়। যে সমাজের সমালোচনা আমরা ‘কুইন’-এ দেখতে পাই, ছবিটিকে সেই সমাজের ফসল হিসেবে এবং সেই সমাজের প্রেক্ষাপটে দেখা প্রয়োজনীয়।
এই আঙ্গিক থেকে দেখতে গেলে প্রথমেই যে বিষয়টি চোখে পড়ে তা হলো রানীর চরিত্র সম্বন্ধে বাবহৃত একটি শব্দ- ‘সাধারণ’। চলচ্চিত্র-সমালোচনা-আলোচনা-সাক্ষাৎকার- বিভিন্ন ক্ষেত্রে রানীর চরিত্র বিশ্লেষণে এই বিশেষণটি প্রয়োগ করা হয়েছে। শব্দটির দু’রকম ব্যাখ্যা সম্ভব। প্রথমত, ‘সাধারণ’ অর্থাৎ সাদাসিধে, বা সরল। এক্ষেত্রে এমন এক মেয়ে যে সালোয়ার-কামিজ পরে, হোম সায়েন্স পড়ে। দিল্লিতে যাদের ডাকা হয় ‘বেহেন জি’ নামে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ‘সাধারণ’ শব্দটি শুধুমাত্র রানী নয়, রানীর মাধ্যমে তার পরিবার সম্পর্কেও প্রয়োগ করা হয়েছে। এই ব্যাখ্যায় শব্দটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে পরিবারটির সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থান।
‘সাধারণ’ শব্দটি যথেষ্ট গোলমেলে। প্রথমত, ‘সাধারণ’ তকমাটি যখন একটি মেয়ের গায়ে সেঁটে দেওয়া হয়, তখন স্বাভাবিক ভাবেই আরেকটি মেয়ের দল গঠিত হয় যারা ‘অ-সাধারণ’। ”কুইন’ এই অ-সাধারণ মেয়েদের পার্শ্বচরিত্র হিসেবে স্থান দেয়, তবে অ-সাধারণত্ব বোঝাতে কেন মদ্যপান ও যৌনতা এবং সাধারণত্ব বোঝাতে ‘বেহেন জি’ শব্দের অনুসঙ্গ টেনে আনতে হবে কেন তা বলা মুশকিল। যদিও ‘কুইন’ কখনোই এই ‘সাধারণ’ মেয়েকে নৈতিকতার উচ্চাসনে বসিয়ে স্তুতি করে না, তাও সাধারণ এবং অ-সাধারণের বিভাজন কোনো কারণে এক অস্বস্তির কাঁটার সৃষ্টি করে।
দ্বিতীয় যে অর্থে ‘সাধারণ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে সেখানে অস্বস্তির কারণ অনেক বেশী স্পষ্ট। সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের মধ্যে ‘সাধারণ’ শব্দটিকে খুব আলগোছে ব্যবহার করা বিপজ্জনক। রানীকে তার প্রেমিক এই বলে প্রত্যাখ্যান করে যে তাদের ‘স্ট্যাটাস’ আর মিলছে না। এই স্ট্যাটাস সামাজিক এবং অর্থনৈতিক। রানীর প্রেমিক ভারতবর্ষের সেই নতুন যুবক যে সারাক্ষণ সামাজিক ইঁদুর দৌড়ে সামিল। সামাজিক অবস্থানের উচ্চতম চূড়ায় পৌঁছতে তার অধীর আগ্রহ। এবং সে জানে যে ইংরেজি না বলতে পারা, ‘আনস্মার্ট’, ‘সাধারণ’ পরিবারের মেয়ে রানীকে সেই চূড়ায় তার পাশে মানাবে না।
‘সাধারণ’ পরিবার বলতে বিকাশ বেহল যা বোঝেন তা হল দিল্লির মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী এক পরিবার- যাদের নিজেদের বাড়ি আছে, গাড়ি আছে. লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার সামর্থ্য আছে, যারা মেয়েকে একা বিদেশে ঘোরার অনুমতি এবং অর্থ- দুয়েরই যোগান দিতে পারে। এই যদি বিকাশ বেহলের ‘সাধারানত্বের’ ধারণা হয়, তবে কোন ভারতবর্ষে পরিচালক বাস করছেন সেই নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। সবথেকে বড় সমস্যা হল এই যে ভারতবর্ষ এবং তার সাধারণ নাগরিকদের সম্পর্কে যে ধারণা বেহল পোষণ করেন তা ব্যতিক্রম নয়। সমাজের এক শ্রেণী, বিশেষত যাদের বয়স কম, ভোটাধিকার লাভ করেছে খুব বেশীদিন হয়নি- তাদের কথোপকথনে এবং দিনযাপনে মনে হয় যে তাদের অনেকের কাছেই সাধারণ মানে এই- গাড়ি, বাড়ি, ল্যাপটপ, টি.ভি- এর মধ্যে কোনো অসাধারনত্ব নেই। সাধারণের এই সংজ্ঞা নিশ্চুপে নানা বিভাজন রেখার সৃষ্টি করে।
এই একই ধরণের বিভাজন তৈরী করে আরেকটি শব্দ এবং বৃহত্তর ক্ষেত্রে শব্দগোষ্ঠী, যার অন্তর্গত হল ‘রানী’, ‘দেবী’, ‘মা’, ‘বোন্’ জাতীয় শব্দ। এই জাতীয় উপাধি মেয়েদের ‘সম্মানের’ এক কল্পিত আসনে বসানোর নাম করে আসলে তাদের আত্মপরিচয়কে এই সমস্ত সম্বোধন ও সম্পর্কের শিকলে জড়িয়ে ফেলে। ‘মা’ এবং ‘বোন্’ জাতীয় শব্দ একটি মেয়ের পরিচয়ের ব্যাপ্তির পথকে আটকে দিয়ে তাকে এই সম্বোধন হিসেবেই চিনতে বলে- যেন এই সম্পর্ক তার অস্তিত্বের প্রথম, শেষ এবং একমাত্র চিহ্ন। মেয়েদের সম্মান ‘রক্ষার্থে যাঁরা (নারী-পুরুষ উভয়েই) ডাক দিয়ে থাকেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই এই শব্দগুলি ব্যবহার করে থাকেন। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই রক্ষকের ভূমিকায় আহ্বান জানানো হয় পুরুষকে-যা স্বস্তির থেকে আশঙ্কার সৃষ্টি করে বেশী। প্রথমত প্রশ্ন ওঠে যে মেয়েদের ‘সম্মান রক্ষার’ গুরুদায়িত্ব এঁদের হাতে সঁপে দেওয়া হলো কবে? দ্বিতীয়ত, যদি ‘সম্মান রক্ষা’ করতেই হয়, বা সম্মান শব্দটি না ব্যবহার করে যদি এটুকুই বলা হয় যে মেয়েদের জন্য আরো সুরক্ষিত সমাজ গঠন করা ,দরকার, তা শুধু ‘মা’, ‘বোন’, ‘দেবী’, এবং ‘রানীদের’ মধ্যে সীমিত কেন? অর্থাৎ যে নারী কারুর মা নয়, বোন নয়, যাকে কোনো চেনা, মার্জিত সম্পর্কের ছকে ফেলা সম্ভব নয়, তার জন্য শহর বা গ্রামের রাস্তা বা যানবাহন সুরক্ষিত করার কোনো দরকার নেই। অর্থাৎ তার শরীরে হাত দেওয়ার অনুমতি পুরুষতন্ত্র দিয়ে রেখেছে। তাই কলকাতার রাস্তায় এক মহিলাকে ধর্ষণ করল যারা, তাদের অপরাধ গৌণ হয়ে যায়ে শাসক গোষ্ঠীর সদস্যের কাছে, কারণ ধর্ষিতা একজন ‘এসকর্ট’। তাঁর এই পরিচয়ের কারণে এই যৌন অত্যাচারকে ধর্ষণ তো বলা হয়ই না, তাকে যৌন অত্যাচার বলেই মনে করা হয় না।
মনে করা হয় যে ‘রানী’, ‘রাজকন্যা’ বা ‘দেবী’ জাতীয় উপাধিতে ভূষিত করে মেয়েদের প্রতি খুব সম্মান জ্ঞাপন করা হলো। বাস্তবে, যে মেয়েটি জানলো যে সে রাজকন্যা, সে বুঝল, শিখল যে রাজকন্যে হয়ে থাকাটাই ভালো, সেটাই স্বপ্ন, সেটাই উচ্চাশার ফল। রানী এবং দেবীদের মর্যাদা দিতে গিয়ে সমাজ অনেক মেয়েকে প্রান্তে ঠেলে দিয়েছে এবং দিচ্ছেও। তাই সেই সমাজ থেকে উঠে আসে ‘কুইন’-এর মত ছবি- যা কিছু ছকে বাঁধা ধারণাকে ভাঙতে গিয়ে, অন্য কিছু গতানুগতিকতাকে প্রশ্রয় দিয়ে ফেলে। এই গল্প রানীদের গল্প- যে গল্পে ঘুঁটেকুড়ুনিদের কোনো স্থান নেই।
1 thought on “রানী কাহিনী”