দেবাশিস আইচ

 
‘‘বিস্তীর্ণ পাররে অহংখ্য জনরে
হাহাকার শুনিউ
নিঃহব্দে নীরবে
বুড়াহ লুইত তুমি
বুড়াহ লুইত বুয়া কিয়ো?’’

– ভূপেন হাজারিকা

দীপক বরকাকতি কি আরও এক উপন্যাসের ঝাঁপি মেলে ধরবেন? আরও এক উপত্যকা পেরিয়ে যাওয়ার গল্প। কালীকিশোর দত্তের কি নাম উঠেছে এনআরসি’র তালিকায়? তাঁর পরিজনদের মধ্যে কেউ বাদ পড়ে যাননি তো? না কি তিনি আজও বাংলাদেশি? সুরমা থেকে বরাক, বরাক থেকে ব্রহ্মপুত্র — উপত্যকার পর উপত্যকা পেরিয়ে এসেছেন ছিন্নমূল কালীকিশোর ও তাঁর পরিবার।

এই কালীকিশোর এবং কালীকিশোরদের জীবনপ্রবাহ উপন্যাসের স্রোতে মেলে ধরেছিলেন ঔপন্যাসিক দীপককুমার বরকাকতি। সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার প্রাপ্ত এই অসমিয়া উপন্যাস ‘উপত্যকার পরা উপত্যকায়’ প্রকাশিত হয়েছিল ২০০২ সালে। সিলেট থেকে করিমগঞ্জ, করিমগঞ্জ থেকে নগাঁও। দেশভাগ, ভাষা ও জাতি বিদ্বেষ, বঙাল খেদাও, নেলি, অসম আন্দোলন — একের পর এক বিদ্বেষের বীভৎস ঢেউয়ে ভেসেছে কালীকিশোরের জীবন-উপত্যকা। সেই উপন্যাস পাঠের স্মৃতি ফের ভেসে উঠল এনআরসি বা জাতীয় নাগরিক পঞ্জি’র ঢেউয়ে ঢেউয়ে। সেই ঢেউয়ের হাজারো চলনে অজস্র প্রশ্নের উত্তর অমীমাংসিত। ভবিষ্যতের কথা জানা নেই। তবু, স্মৃতি থেকে বর্তমানে, বর্তমান থেকে স্মৃতির উপত্যকায় — এ এক ব্যক্তিগত পাঠচারণ।

নববিবাহিত কালীকিশোর নোয়াখালি গিয়েছিলেন দাদা শ্যামকিশোরের বাড়িতে। দাঙ্গার সেই তার প্রথম স্মৃতি। যে গাঁয়ে এক সকালে মাছওয়ালা গভীর লজ্জায় বাড়ি বয়ে এসে ফিরিয়ে দিয়ে গিয়েছে বাড়তি নেওয়া একটি টাকা। সে তো গ্রামের মাস্টারমশাইয়ের ভাই। তাকে চিনতে পারেনি বলে সে এক টাকা দাম বেশি নিয়ে ফেলে ছিল। দু’দিনের মধ্যে আর এক দুপুরে দূর আকাশে ধোঁয়ার কুণ্ডলী। বেলা যত বাড়ে সেই কুণ্ডলী সাপের মতো পাক খেতে খেতে দাদার বাড়ি ছোঁয় ছোঁয় আর কি। সে রাতে দাদা বাড়ি ফেরেনি। সে রাতে অন্ধকার নামেনি। লেলিহান শিখার আলোয় আলোয় সেদিন গ্রাম জুড়ে দুপুরের দীপ্তি। ছোট্ট ভাইপো, স্ত্রী, বৌদিকে নিয়ে সেই অচেনা গ্রাম, তার ধানক্ষেতের কাদা-জলে আছাড়ি-পিছাড়ি খেতে খেতে, আতঙ্কে মৃতপ্রায় দুই রমণী ও এক কিশোরকে নিয়ে যে বাড়ির দাওয়ায় হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন কালী, সে এক মুসলমান চাষির বাড়ি। বৃদ্ধ গৃহকর্তা আর মেয়েরাই রয়েছেন বাড়িতে। গাঁয়ের জওয়ান মদ্দ পুরুষদের সঙ্গে তাঁর বাড়ির ছেলেরাও গিয়েছে হিন্দুদের গাঁ-ঘর জ্বালিয়ে দিতে। লুঙ্গি পরিয়ে, সিঁদুর মুছিয়ে, শাখা-পলা-নোয়া খুলিয়ে সে রাতেই নিরাপদ পথের সন্ধান দিয়েছিল সেই পরিবার। অবশেষে সিলেটের কুলৌরা গ্রামে দত্ত ভিটেয় পৌঁছেতে পেরেছিলেন সকলকে নিয়েই। শ্যামকিশোর খুন হয়ে গিয়েছিলেন।

বছরও ঘোরেনি। ভাগ হয়ে গেল স্বদেশ। শুরু হল দেশত্যাগ। রাতজুড়ে ‘আল্লা হো আকবর’ ধ্বনি, ইতিউতি দূর গ্রামে হঠাৎ হঠাৎ কালো ধোঁয়া, আগুনের শিখা নোয়াখালির স্মৃতি ফের উসকে দিল। গাঁয়ের দাই মাসির কুঁড়ে ঘর যেদিন জ্বলে উঠল সেদিনই স্থির হয়ে গেল আর নয় এবার যেতেই হবে। একটু দূরে বৃদ্ধ রশিদ চাচা, শামসুল, হায়দার, আব্দুল, ফিরোজ, মতিনদের ক্লান্ত, রাতজাগা, দাই মাসির কুঁড়ের আগুন নেভাতে মরিয়া কালিঝুলি মাখা লজ্জায়-দুঃখে নত শরীর, ঝুলে পড়া মুখও জানিয়ে দিয়েছিল — শুধু দেশ নয়, মানুষও ভাগ হয়ে গিয়েছে। অতঃপর একদিন ঝোপঝাড়, জঙ্গল, ধান খেত আদাড়পাদাড়ের না-পথ বেয়ে নতুন দেশের খোঁজে চললেন কালীকিশোর। সঙ্গী নানা বয়সের একপাল মানুষ, কাঁধে-পিঠে-মাথায় বয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো বোঁচকাবুচকি, গাঁটরি। বুকে জড়ানো গৃহদেবতা আর দুধের ছানাপোনা। সুরমা উপত্যকা ত্যাগ করে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে দলটি এসে পৌঁছেছিল করিমগঞ্জ। বরাক উপত্যকা। ভারত।

কাছাড়, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি বর্তমান বরাক উপত্যকার তিন জেলা। দেশভাগের বেশ আগে দত্ত বাড়ির এক ছেলে ব্রিটিশ বরাকের চা বাগানে কাজ নিয়ে চলে গিয়েছিল। সে যাওয়া নিয়ে কত না অশান্তি। সেই ভাইপোর নাম মুখে আনা বন্ধ করেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী কাকা চরিত্রচন্দ্র দত্ত। সেই কৃষ্ণকিশোর থাকেন শিলচরের কাছেই। বাগানের মস্ত ম্যানেজার সে। এমন সহজ যাতায়তের তো কত ঘটনাই রয়েছে। সেই ১৮৭৪ সালে একদিকে সিলেটকে কাছাড়ের সঙ্গে আবার গোয়ালপাড়াকে নিম্ন অসমের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল। এই জনপদ বাঙালিপ্রধান ছিলই। আবার প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের পথেই তা হয়ে উঠেছিল অসম প্রদেশের বাঙালিপ্রধান অঞ্চল। কৃষ্ণকিশোর দত্ত না হয় এসেছিলেন বাড়ির অমতে। কিন্তু তার ঢের ঢের আগে ১৯০২ সালে পূর্ববঙ্গ-অসম রেল যোগাযোগ ঘটার পর পর বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের মুসলমান ও নিম্নবর্ণের চাষিরা বেশি বেশি করে আসতে শুরু করেছিলেন অসমে। যা ব্রিটিশদের উৎসাহে শুরু হয়েছিল মোটামুটি ১৮৮৫ সালের পর থেকেই। একদিকে যেমন তারা আসত ময়মনসিংহ রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া থেকে, অন্যদিকে জলপাইগুড়ি, কোচবিহার থেকেও চাষিরা গিয়েছিলেন অসমে। বিপুল পরিমাণে পড়ে থাকা জমির টানটাই ছিল মস্ত কারণ। এছাড়াও চা বাগানের পত্তন, রেললাইন, তেলের খনির কারণে আদিবাসী শ্রমিক, বিহারি, ওড়িয়া শ্রমিক, রেলকর্মী, সরকারি অফিস-কাছারির প্রশাসনিক কর্মী-বাবুদের ভিড় যেমন বাড়তে থাকল, তেমনই প্রয়োজন হল খাদ্যের চাহিদা। তাই শুধু ইংরেজ নয়, প্রাথমিক ভাবে অসমিয়া জমিদার শ্রেণিও চেয়েছিল পূর্ববঙ্গের চাষিদের। তাদের বিপুল জমিদারিতেই শুধু নয়, চর এলাকারও বিপুল জমি পতিত হয়ে পড়ে ছিল।

১৮৯৭ সালের মার্চ মাসে আসাম অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি বাবু গুঞ্জানন বরুয়া ব্রিটিশ সরকারকে জানাচ্ছেন, অসমে ৭০.১৫ শতাংশ জমি পতিত পড়ে রয়েছে। পূর্ববঙ্গীয় চাষিদের যেন বিশেষ সুবিধায় জমি দেওয়া হয়, যাতে এই পতিত জমিতে দ্রুত সব রকমের অর্থকরী শস্য উৎপাদন করা যায়। তারও ঢের আগে একই ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন তৎকালীন অসমিয়া বুদ্ধিজীবী আনন্দরাম ঢেকিয়াল ফুকন। বিশেষ সুযোগ এই চাষিরা পেয়েছিলেন তার কারণ, ব্রহ্মপুত্রের বানভাসি চরে ধান ফলানোর বিদ্যে জানা ছিল না সেই সময়ের স্থানীয় চাষিদের। জমা জলে যে বীজের চারা চড়চড়িয়ে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, সে বীজও নিশ্চয় সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন চাষিরা। যার খোঁজ জানতেন না তিয়া, রাভাদের মতো আদিবাসী কিংবা অসমিয়া হিন্দু চাষিরা। শুধু ধান নয়। অর্থকরী ফসল হিসেবে পাট চাষ ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এই পাট চাষে কলকাতার মাড়োয়াড়ি মিল মালিকদের উৎসাহ ছিল বেশি। বিভেদ-বিদ্বেষ শুরু হতে তখনও ঢের দেরি। সে আলোচনায় যাওয়ার আগে কালীকিশোর দত্তের ছিন্নমূল উদ্বাস্তু সফরে ফিরে যাই।

কালীকিশোরেরা উদ্বাস্তুই। শরণার্থীও বলতে হবে। কিন্তু, স্বাধীনতার পূর্বে আসা ওই হাজার হাজার চাষা শরণার্থী কিংবা উদ্বাস্তু ছিলেন না। তাঁরা ছিলেন ভ্যাগান্বেষণে শিকড় উপড়ে বেরিয়ে পড়া অভিবাসী। নিজ দেশে এক জনপদ ত্যাগ করে ভিন্ন জনপদে গিয়েছিলেন, আরও একটু ভালো থাকার জন্য। কালীকিশোরেরা জমিদার ছিলেন, রাজনীতির বলি হয়েছিলেন। আর চর-চাপরির অভিবাসী চাষা কৃষি-অর্থনীতির বলি। আশ্চর্য সমাপতন এই যে, দুই দলই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শিকার। মনে রাখতে হবে, উদ্বাস্তু শরণার্থী বা অভিবাসী যে নামেই ডাকা যাক না কেন সেই স্রোত জলের ধারার মতো বয়। উজান থেকে ভাটিতে। অর্থাৎ, উচ্চমাত্রার অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে অপেক্ষাকৃত কম মাত্রার তুলনমূলক সহনীয় পরিস্থিতিতে। আর বহু সময়ই কেই-বা উদ্বাস্তু আর কেই-বা অভিবাসী তা সাদা-কালো, আলো-অন্ধকার, কুয়াশা-ধোঁয়াশায় রাজনীতি আর তাত্ত্বিকতায় বড়ো গুলিয়ে যেতে থাকে। আজকের অসম, আজকের ভারত তার বড়ো আশ্চর্য উদাহরণ। বড়ো আশ্চর্য এক রসায়নাগার। পাঠক, কালীকিশোরে ফিরি।

করিমগঞ্জের উদ্বাস্তু শিবিরে অবশ্য বেশিদিন থাকতে হয়নি কালীকিশোরকে। দু’মাসের মধ্যে সেখানেই হিসাবরক্ষকের একটি কাজ জোটে তাঁর। শিবির ছেড়ে জুটিয়ে নেন মাটির হলেও তিন ঘরের প্রয়োজনীয় ছাদ। অবশেষে একদিন খবর এল পিঙছোড়ায় উদ্বাস্তুদের জন্য জমির বন্দোবস্ত করছে সরকার। এলাকাটা পাহাড়-জঙ্গলে ভরা। কালীকিশোরের মনে ভেসে উঠল ফেলে আসা গ্রামের কথা। স্থির করে ফেললেন জঙ্গল কেটে আবাদ করবেন, গ্রাম পত্তন হবে ফের। প্রায় পাঁচ বছরের ছিন্নমূল জীবন থিতু হতে না হতেই দলে পিষে গিয়েছিল এক রাতেই। ভরা ফসলের জমিতে যেদিন হাতি নেমেছিল। কুশিয়ারা নদী ফের কালীকিশোরের মনে পুকুর, মরাই, সবুজ ধান, হলুদ সরষে খেত, শীতল পাটির স্বপ্ন দেখিয়েছিল। একরাতে তা নিঃশেষ হতেই পরিবার নিয়ে ফের যাত্রা। এবার রেলশহর লামডিং। কথা চলছিল অনেকদিনই। লামডিং রেল স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি জুটিয়েছেন বন্ধু নিরঞ্জন বিশ্বাস। উদ্বাস্তু ও বর্তমান নাগরিকত্বের শংসাপত্র দেখাতে পারলেই হল। অঢেল জমি-জমা, জমিদার পরিবারের সন্তান, বিয়াল্লিশের আন্দোলনে জেল খাটা কালীকিশোরের চাকরির মন ছিল না। শিবিরের চাকরি ছেড়েছিলেন দুর্নীতি দেখে। স্বপ্নে ছিল গ্রামপত্তন। সে স্বপ্ন ভেঙে গেলে ফের অন্য এক উপত্যকার খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন কালী। বিস্তীর্ণ পাহাড়ি পথে দীর্ঘ রেলযাত্রায় দেখা হতে থাকে, বাহান্নয় শিবির বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া মানুষজনের। সুনামগঞ্জের হরিবিলাস বদরপুর জংশন স্টেশনের গ্যাংম্যানের চাকরি জুটিয়েছেন। হরিবিলাস যার দোকান থেকে চা-মিষ্টি এনে খাওয়াল, সেই দোকানিও ওপারের। ব্রাহ্মণবেড়িয়ার শশাঙ্ক দামের বিধবা স্ত্রী এখন শিশু কোলে ট্রেনে-স্টেশনে ভিক্ষা করছেন। বদরপুরে দোকানে-হোটেলে বাসন মাজা, জল তোলার কাজের মাঝে হারিয়ে গিয়েছিলেন দেহ ব্যবসার অন্ধকার গলিতে। ভেসে উঠে আপাতত ভিক্ষাবৃত্তি। বৃত্তির খোঁজেই তো, মাটির খোঁজে, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে মাথা গোঁজার মতো একটা ছাদের খোঁজে কালীকিশোরের এই রেল যাত্রা। বৌদ্ধবিহারের ঘণ্টাধ্বনির মতো অনুরণন জাগানো লামডিং এখনও অনেকটা পথ। পেরোতে হবে মাইলংডিসা, হারাঙ্গাজাও, জাটিঙ্গা, হাফলং নামের রোমাঞ্চ জড়ানো স্টেশন। পেরোতে হবে পাহাড়ি চড়াই-উতরাই, চূড়ো থেকে চূড়ো, নীচে অকূলখাদ আর অসীম অরণ্য, আলো-সুড়ঙ্গ-আলোর ধাঁধাপথ। জীবনের মতোই। উদ্বাস্তু জীবন।

যে ভূখণ্ডে কালীকিশোর পা রেখেছিলেন, সেও যে তখন ভিতরে ভিতরে অশান্ত তার আঁচ তখনও তাঁর গায়ে লাগেনি। কিন্তু, বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বদল ঘটছিল দ্রুত। একদিন যে শিক্ষিত মধ্যশ্রেণি দরিদ্র শ্রমজীবী অভিবাসীদের স্বাগত জানিয়েছিল ক্রমে তাদের উগ্র জাতীয়তাবাদী রূপটি পরিষ্কার হয়ে উঠতে লাগল। বরাক উপত্যকা বাঙালি প্রধান ছিলই, দেখা গেল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে বরপেটা, ধুবড়ি, গোয়ালপাড়ার মতো জেলাগুলিও বাঙালি প্রধান হয়ে উঠেছিল। ১৯৩১ সালের মধ্যে অসমে বাংলাভাষীর সংখ্যা ছিল ১০,৮৭,৭৭৬ বা জনসংখ্যার ২৩ শতাংশ। অসমিয়াভাষীর সংখ্যা ১৯,৮১,৩৬৯ বা ৪২ শতাংশ। অভিবাসী বিরোধী রব উঠল। অভিবাসীরা যাতে নির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রিত এলাকার অর্থাৎ ব্রহ্মপুত্র নদের দু’পারের এক কাল্পনিক রেখার বাইরে না যেতে পারে তার জন্য ব্রিটিশ প্রশাসন তৈরি করেছিল ‘লাইন সিস্টেম’। নদীর ভাঙনে নতুন এলাকার চাষ জমির সন্ধান জরুরি ছিল। আবার প্রয়োজন ছিল স্থায়ী ঘরদোরের জন্য উঁচু ডাঙা জমি। স্থানীয়দের সঙ্গে এই নিয়েই সংঘাত তীব্র হল। সীমানা ছাড়ালেই মুসলমান চাষিদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া সহ নানা অত্যাচার বাড়তে লাগল। যে জমির লড়াই ক্রমে সাম্প্রদায়িক রূপ নিয়েছে এবং আজও অব্যাহত। সে কথায় পরে আসব।

অন্যদিকে, অবশেষে লামডিং পৌঁছলেন কালীকিশোর। বন্ধুর বাড়িতেই উঠলেন। শুরু হল শলা-পরামর্শ। নগাঁওয়ের কাঠিয়াটোলি হাইস্কুলের শিক্ষকপদ খালি ছিল। নিরঞ্জন সে কথা জানতেন। তিনি আর এখন শুধু লামডিঙের স্কুল মাস্টার নন, স্থানীয় কংগ্রেস নেতাও বটে। অবশেষে একদিন দুই বন্ধু হোজাইয়ের ট্রেন ধরল। এর পর বাসে নগাঁওয়ের কাঠিয়াটোলি। ততদিনে নগাঁও শহরে বাঙালি উদ্বাস্তু জাঁকিয়ে বসেছে। এসে পড়াটাই যা বাকি ছিল। আর প্রধান শিক্ষক কৃষ্ণহরি ডেকারোজার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। চাকরিতে বহাল হয়ে গেলেন কালীকিশোর দত্ত। পিঙছোরার পাট চুকিয়ে এসে পরিবার সহ থিতু হলেন। কাঠিয়াটোলি। নগাঁও। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা।

সময় ছুটে চলেছে দ্রুত। কাঠিয়াটোলিতে আসার পর আরও এক সন্তান হয়েছে। কন্যা সন্তান। ফেলে আসা দেশের মানুষরাও সঙ্গে আছেন এ বিভুঁইয়ে। দত্তবাড়ির মেজোবাবু হাইস্কুলের টিচার। বেড়েছে সম্মানও। মনের মধ্যে উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করল জমির স্বপ্ন। ধানখেত। জমিতে রায়তি প্রজা বসবে। ঠিক যেমনটি ছিল ওপারে। এক বিহুর সময়ে কালীকিশোর শুনলেন ওপার থেকে আসা তাদের পুরনো মুসলমান চাষি পরিবারের ছেলে কমল সহ তারই মতো বেশ কিছু মানুষকে ফের পূর্ব পাকিস্তানে চালান করে দেওয়া হয়েছে। স্বপ্ন কি ধাক্কা খেল ফের? খবরটি শুনে চুপ করে গিয়েছিলেন কালী। ইতিমধ্যে রাজ্য জুড়ে টেনশন। অসমিয়া ভাষাকে রাজ্য ভাষা করতে হবে। গুলি চলেছে কটন কলেজে। মৃত্যু হয়েছে এক অসমিয়া ছাত্রের। একদিন শোনা গেল নগাঁওয়ের খরমপট্টি এলাকার উদ্বাস্তু কলোনিতে আগুন দিয়েছে দুষ্কৃতীরা। স্বস্তির কথা হল অসমিয়া প্রতিবেশীরাই এগিয়ে এসেছেন উদ্ধার করতে। নগাঁও শহরে ভর্তি হতে গিয়েছিল ভাইপো সুবীর। এই সেই ভাইপো, নোয়াখালির দাঙ্গার গ্রাস থেকে যাকে নিয়ে পালিয়ে আসতে পেরেছিলেন কালী। তখন তার বয়স মাত্র পাঁচ। অনেকখানি দেরিতে কাঠিয়াটোলি ফিরেছিল সুবীর। খবরাখবর তার কাছ থেকেই মিলেছিল। এ কথাও স্পষ্ট করে জানা গিয়েছিল ভাইপোর অসমিয়া বন্ধুরা একমাত্র অসমিয়া ভাষাকেই রাজ্যভাষা হিসেবে চায়।

ভাষা কূল ভাঙে, কূল গড়েও। এ কথা তো সত্যি অসমে ব্রিটিশ শাসনের শুরুর দিকে বাঙালি বর্ণহিন্দুরাই ছিল রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রধান যন্ত্রী। অসমিয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণি — যারা মূলত সামন্তবাদী ভূস্বামী ও বর্ণহিন্দু — যা আদৌ পছন্দ করেননি। অসমে গেড়ে বসার এক দশকের মধ্যে ব্রিটিশ প্রভুরা আদালত, সরকারি কার্যালয় আর বিদ্যালয়গুলিতে বাংলাভাষা প্রবর্তন করছিল। অসমের শিক্ষা ব্যবস্থাকে জুড়ে দেওয়া হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে। বাঙালি বাবুদের বিরুদ্ধে সেদিন উস্কানি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। যে অভিযোগ আজও ওঠে। তবে, অসমিয়া বুদ্ধিজীবীরা বার বার নানা ভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, অসমিয়া ও বাংলা দুটো স্বতন্ত্র ভাষা। সাম্রাজ্যবাদী ভাগ করে শাসন করার নীতিতে বিশ্বাসী ব্রিটিশরাজ সে কথায় কান দেয়নি। উপরন্তু, অসমের চিফ কমিশনার হেনরি হপকিনস জোরালো ভাষায় জানান,

“I can come to no other conclusion that they (Assamese and Bengali) are one and all …with an admixture of local archaic or otherwise corrupted and debased words.”

তৎকালীন অসমের অসমিয়া বৌদ্ধিক নেতৃত্বের তিন মূর্তি আনন্দরাম ঢেকিয়াল ফুকন, হেমচন্দ্র বরুয়া ও গুণাভিরাম বরুয়ার নিরলস লড়াইয়ের ফলে ১৮৭৩ সালের মধ্যে অসমিয়া ভাষা পুনঃপ্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। ১৮৭৪ সালে অসম পৃথক প্রদেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেল। অসমে বাঙলা চাপিয়ে দেওয়ার এই নীতি অসমিয়াদের মনে বাঙালিদের উপর সন্দেহের বীজ বুনে দিয়েছিল। যা একদিন জাতীয়তাবাদীদের হাতে সার-জল পেয়ে মহীরুহ হবে। তবে এখানেই শেষ নয়। ১৮৭৪ সালে বাঙালি প্রধান সিলেট অসম প্রদেশের বাঙালি প্রধান কাছাড়ের সঙ্গে এবং বাঙালি প্রধান গোয়ালপাড়াকে নিম্ন অসমের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর সেখানকার বাঙালিরাও বাংলা মাধ্যম স্কুলের দাবি জানাতে শুরু করে। এ দাবি অযৌক্তিক ছিল না। কিন্তু গোপীনাথ বরদলৈয়ের মতো কংগ্রেস নেতারা বেসরকারি মিশ্র বিদ্যালয়ের প্রস্তাব দিলেও তা মানতে চাননি বাঙালি নেতৃত্ব। ফল বাংলা ও অসমিয়া মাধ্যমের ভিন্ন ভিন্ন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু হল।

আগেই আলোচনা হচ্ছিল ‘লাইন সিস্টেম’-এর কথা। অর্থাৎ, অসমিয়া-অভিবাসী বিভাজনের কথা। ভাষা সেই বিভাজনের আগুনে ঘি ঢালল। যখন ১৯৩৬ সালে পশ্চিম গোয়ালপাড়ার কৃষক নেতা মতিয়ুর রহমান মিয়াঁ অসম বিধানসভায় ঘোষণা করল, “আমরা বাঙালি, আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। …বর্তমান পরিস্থিতিতে যদি, অসমিয়া ভাষা আমাদের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হয়, আমাদের সন্তানদের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হয়, আমরা যদি আমাদের মাতৃভাষা থেকে বঞ্চিত হই, তবে তা আমাদের সন্তানদের শিক্ষাদীক্ষা থেকে বঞ্চিত করার সমতুল্য হবে।” মতিয়ুর রহমানের এই বক্তব্য আসলে বাঙালি অর্থাৎ শিক্ষিত উচ্চবর্গীয় হিন্দুদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিধ্বনি। এর আগেই রব উঠতে শুরু করে সিলেট ও অন্যান্য বাঙালি প্রধান অঞ্চল অসম থেকে ছেঁটে ফেলার। ১৯২৭ সালে অসম সাহিত্য সভা’র বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে তরুণ রাম ফুকন বলেছিলেন, “আমরা অসমিয়ারা ভারতীয়দের মধ্যে এক স্বতন্ত্র জাতি। যদিও আমাদের ভাষার ভিত্তি সংস্কৃত, তবু স্বতন্ত্র ভাষা। একটি উদীয়মান জাতি তার জীবনী শক্তি দেখায় অন্যান্যদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করে। দুর্ভাগ্য, আমাদের ক্ষেত্রে তা অন্যরকম। আমরা শুধু নির্ভরশীল নই, আমাদের প্রতিবেশী (বাঙালি) আমাদের অসহয়তার সুযোগ নিয়ে গিলে খেতে চাইছে। অসমিয়া ভাইয়েরা বর্তমান পরিস্থিতিকে বুঝতে গেলে আপনাদের অতীত গৌরবের প্রতিফলনে দেখতে হবে।”

শুধু জাতিগত ভাবে বাঙালির সঙ্গে সংঘর্ষে না নেমে, অসমিয়া বুদ্ধিজীবীরা ভাষার প্রশ্নে শিক্ষায়দীক্ষায় অপেক্ষাকৃত ভাবে পিছিয়ে থাকা বাঙালি মুসলমানদের সাথে অন্য পথে চর্চা শুরু করলেন। সে হল সাম্প্রদায়িক পথ। ১৯৩১ সালে অসম সাহিত্য সভার বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে নগেন্দ্রনাথ চৌধুরী অভিবাসী মুসলমানদের উদ্দেশে বললেন, “ময়মনসিং থেকে আসা অভিবাসীদের আমি বলতে চাই তাঁরা আর বাঙালি নন, অসমিয়া হয়ে গিয়েছেন। এই প্রদেশের আনন্দ, ব্যথা এবং সমৃদ্ধি ও অধঃপতনের তাঁরা সমান সমান অংশীদার। তাঁদের স্থানীয় ভাষা শেখা উচিত এবং তাঁরা শিখছেন। বর্তমানে বাংলা ভাষার সঙ্গে তাঁদের ভাষার মিল শূন্য। বড় কথা যে, মূল বাংলা ভাষা থেকে তাঁদের দূরত্ব অনেকখানি। অতএব আমরা তাঁদের স্বাগত জানাচ্ছি। তাঁরা যোগ দিন অসমিয়া সংস্কৃতি ও জাতির উন্নয়নে তাঁরা তাঁদের অবদান রাখুক।”

সাতচল্লিশে দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে সিলেট পূর্ব পাকিস্তান বেছে নিল। ১৯৫১’র জনগণনায় গোয়ালপাড়া জেলায় দেখা গেল এক চমকপ্রদ ছবি। অসমিয়াভাষীর সংখ্যা ১৮৩১সালে ছিল ১,৬১,১৭৯ বা ১৯২১ সালের তুলনায় বৃদ্ধি ছিল ১৬.১১ শতাংশ। ১৯৫১ সালের জনগণনায় তা গিয়ে দাঁড়াল ৬,৮৭,০২৭। অর্থাৎ, ১৯৩১ সালের তুলনায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছিল ৩২৬.২৫ শতাংশ। আর এই সময় বাংলাভাষীর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে উল্লেখযোগ্য ভাবে। ১৯৩১ সালে গোয়ালপাড়ায় বাংলাভাষীর সংখ্যা ছিল ৪,৭৬,৪৩৩ জন। ১৯৫১ সালে তা কমে দাঁড়ায় ১,৯৩,৩৭৯ জনে। অর্থাৎ, পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় শতাংশের পার্থক্য -৫৯.৪১। আর সমগ্র অসমে ১৯৫১ সালে সময়ে অসমিয়াভাষীর শতাংশের হার গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ৫৬.২৯ শতাংশ। ১৯৩১ সালের তুলনায় যে বৃদ্ধির হারের পার্থক্য ছিল ১৪৪.৫২ শতাংশ। বাংলাভাষীর সংখ্যাও কমেছিল অস্বাভাবিক হারেই। ১৯৩১ সালে যেখানে বাংলাভাষীর শতকরা হার ছিল ২৭.৫৬ শতাংশ, সেখানে ১৯৫১ সালে তা গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ১৯.৬৪ শতাংশে।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পেলেও ভাষার প্রশ্নে রুখে দাঁড়িয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি মুসলমান। যার ফলশ্রুতি ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। ভাষার জন্য জান কবুল করে দিয়েছিলেন ঢাকার ছাত্র-যু্ব ও সাধারণ মানুষ। সে কথা অতি গর্ব করে কালীকিশোরকে পোস্টকার্ডে লিখে জানিয়েছিলেন মনসুর চাচা। মনসুর বোধহয় জানতেন না, ১৯৫১ সালের জনগণনায় নিজেদের অসমিয়াভাষী হিসেবে পরিচয় দিতে বাধ্য হয়েছিলেন সেই সাবেক পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহ-বগুড়ার থেকে আসা বাঙালি মুসলমান। দিতে বাধ্য হয়েছিলেন জানের ভয়ে, জমি-জীবিকা হারানোর ভয়ে। চর-চাপরি মুসলমানের পাশে সেদিন কেউ ছিল না। দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে মৌলানা ভাসানি’র মতো কৃষক নেতা সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ পূর্ব পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁরা বাংলাভাষার জন্যই লড়াই শুরু করেছিলেন। কিন্ত, ফেলে রেখে যাওয়া মুসলমানদের পরামর্শ দিয়ে গিয়েছিলেন অসমিয়া ভাষা গ্রহণ করতে। বোধহয় বুঝে গিয়েছিলেন এই মানুষগুলোর আর বাঙালি হওয়া হবে না, মুসলমান পরিচয়েই বাঁচতে হবে। তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য কোনও বাঙালি (পড়ুন হিন্দু বাঙালি) নেই। আর একথাও তো ঠিক হিন্দু জমিদারদের অত্যাচার তাঁদের দেশ ছাড়ার এক অন্যতম বড় কারণ। তার সঙ্গে যদি থাকে বিনি পয়সায় জোড়া বলদ, লাঙল পাওয়ার সুযোগ এবং তিন বছর খাজনা বিহীন জমি পত্তনের অধিকার। তবে সে সুযোগ ছাড়ে ক’জনা। ট্রেনে, স্টিমারের যাওয়ার জন্য পাঁচ টাকার ‘ফ্যামিলি টিকিট’-এর বন্দোবস্ত ছিল। শুধু বাঙালি পরিচয়টি লোপ পেয়ে গেল। আজও অসমে বাঙালি বললে হিন্দু বাঙালি বোঝায়। মুসলমানরা ভাষাহীন, ভূমি পরিচয়হীন, জাতি পরিচয়হীন মুসলমান রয়ে গেলেন। অসমের জাতি তালিকাতেও তাঁরা মুসলমান।

এদিকে, ১৯৫১’র পরেও নিজ দেশে সংখ্যালঘু হওয়ার অমূলক ভয় কাটল না অসমিয়াদের। অসমিয়াকে রাজ্যের একমাত্র প্রধান ভাষা করার দাবি ক্রমে জোরালো হতে লাগল। ফলশ্রুতি ১৯ মে ১৯৬১। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিলেন ১১ জন। দাবি মানল না বোড়ো, খাসি, জয়ন্তিয়া, নাগা, মিজোরাও। ওই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের মাত্র ১০ মাস আগে ২ জুলাই ১৯৬০, শিলচরে অনুষ্ঠিত হল ‘অল আসাম নন-আসামিজ ল্যাংগুয়েজ কনফারেন্স’। বাঙালিদের সঙ্গে মিশল জনজাতি গোষ্ঠীগুলি। সম্মেলনের প্রস্তাবনায় বলা হল —

“The conference of the Non-Assamese speaking people of Assam strongly opposes the move to impose Assamese as the official language for the state of Assam and that the status quo based on the intrinsically multilingual character of the state must be maintained for the peace and security of the eastern region of India.”

ফলশ্রুতি, ভারতের সর্ববৃহৎ রাজ্যে ধরল ভাঙন। একে একে বেরিয়ে এল নাগাল্যান্ড (১৯৬৩), মেঘালয় (১৯৭১), মিজোরাম (১৯৮৬) ও অরুণাচলপ্রদেশ (১৯৮৭)। এই তো দু’দশক আগে, ১৯৯৬ সালে গুয়াহাটির সার্কিট হাউসে এক সাংবাদিক সম্মেলনে লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার পূর্ণ সাংমা তো বলেই ফেললেন, “আমরা সবাই অসমিয়া বলতাম, এখনও পারি। কিন্তু আমরা অসমিয়া নই। সুতরাং অসমিয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়া মানব না। এ জন্যই অসম ভেঙে গিয়েছে।” অসমিয়া উগ্র জাতীয়তাবাদীদের জনজাতিরা আজও অসমিয়া জাতীয়তাবাদীদের কী চোখে দেখে তা দ্য শিলং টাইমস-এর (২২ জানুয়ারি, ২০১০) এক প্রধান সম্পাদকীয় স্তম্ভে স্পষ্ট।

“For Meghalaya, January 21st is what Independence Day to the rest of India. It was a day when the hill tribes (Khasis, Jaintias and Garos) were given mandate to carve out their own destiny by way of a separate state called Meghalaya. The tribes collectively fought Assamese chauvinism which was manifested in the imposition of the Assamese language as the lingua franca. The movement, popularly known as Hill State Movement was without rancour or bloodshed.”

শুধুই কি অসমিয়াকে সরকারি ভাষা করার দাবি? প্রায় সমসময়ে শুরু হল বাঙালি খেদা অর্থাৎ অভিবাসী বাঙালিদের অসম ছাড়া করার হীন চক্রান্ত। মুসলমানরা অনুপ্রবেশকারী এই ধুয়ো শুরু হয়েছিল ১৯৫০ থেকেই। ক্রমে কেন্দ্রীয় সহায়তায় শুরু হল নানা আইনি ব্যবস্থা। যেমন, পারমিট ব্যবস্থা, অভিবাসী (অসম থেকে উৎখাত) আইন, ১৯৫০; আইএমডিটি (বেআইনি অভিবাসী নির্ধারণ আইন); সন্দেহজনক অনুপ্রবেশকারীদের উৎখাত বা আটক করার উদ্দেশ্যে ‘ডি’ ক্যাটেগরির ভোটার চিহ্নিতকরণ। এত আইনের সাঁড়াশি চাপের পর দেখা যাচ্ছে ছ’টি ডিটেনশন ক্যাম্পে অমানবিক পরিবেশে বিচারাধীন বন্দি হিসেবে আটক রয়েছেন হাজার খানেক মানুষ।

১৯৮৩ সালের নেলি গণহত্যা অভিবাসী বিরোধী সব নৃশংসতাকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। সরকারি হিসেব মতো যে চর অঞ্চলে এক সকালে ১৪টি গ্রামের প্রায় ২২০০ মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষকে মূলত দায়ের মতো ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করেছিল স্থানীয় আদিবাসীরা। যার সিংহভাগ নারী ও শিশু। এই হত্যাকাণ্ডের মদতকারী নেতৃত্ব ছিল উগ্র অসমিয়া ছাত্র সংগঠন। যারা আজ অসমে বিজেপি’র দোসর হয়ে ক্ষমতায়। গণহত্যার এই ভয়াল অভিঘাত এড়াতে পারেনি অসম আন্দোলনের দুই নেতৃস্থানীয় গোষ্ঠী আসু ও অগপ। বেশ কিছু মুসলমান নেতা আসু ও অগপ থেকে বেরিয়ে যান। তাঁদের অভিযোগ ছিল আন্দোলনকারীদের মধ্যে আরএসএস ঢুকে পড়েছে। এই নেলি হত্যাকাণ্ড ও অসম চুক্তির পর গঠিত হয় ‘ইউনাইটেড মাইনরিটিজ ফোরাম’। ফোরামের এক অন্যতম মুখপাত্র গোলাম ওসমানির ভাষায়,

“For the first time in post-Partition Assam, the Bengali Hindus and Muslims felt the need to come together to protect their interests. We found we were in the same boat. Since we were more than 40 percent of the state population, we were sure we could defend our interests against rising Assamese chauvinism.”

এ স্বপ্নের অচিরেই পঞ্চত্ব প্রাপ্তি হয়।

বিজেপি ক্রমে শক্তিশালী হয়ে উঠতে শুরু করলে বরাক ও গুয়াহাটির হিন্দু বাঙালিদের এক বড় অংশ বিজেপি’র দিকে ঝুঁকে পড়ে। গোলাম ওসমানি সহ মাইনরিটিজ ফোরামের নেতৃত্বের একাংশ ফের কংগ্রেসে ফিরে যায়। অন্যদিকে, বিজেপি-অগপ সখ্যতাও ক্রমে বাড়তে থাকে।
১৯৮৩’র গণহত্যা, নব উদ্যোগে বিদেশি খেদাও আন্দোলনের শুরু আসলে ১৯৭৯ সালে। মঙ্গলদৈ লোকসভার বিধায়ক হীরালাল পাটোয়ারীর মৃত্যু এবং পুনঃনির্বাচনকে কেন্দ্র করে। ভোটার তালিকা সংশোধন করতে গিয়ে অভিযোগ উঠল, বহু বিদেশির নাম উঠেছে। সেই নাম বাদ দিয়ে, বিদেশি তাড়িয়ে নির্বাচনের দাবি উঠল। সে বছর ৮ জুন অসম বন্ধ ডাকল আসু। অগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে প্রতিষ্ঠিত হল অসম গণ পরিষদ। আর এই টালমাটালের মধ্যে গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস নিয়ে এমএ পড়তে ভর্তি হয়েছিল বনশ্রী। কালীকিশোরের কনিষ্ঠা কন্যা।

বিশ্ববিদ্যালয় তখন ছাত্র আন্দোলনের ঘাঁটি এলাকা। সন্ধে গড়ালে নিষ্প্রদীপ, মুহুর্মুহু ‘জয় আই অসম’ রণধ্বনিতে মুখর ক্যাম্পাস। তারই মাঝে তখনও শোনা যাচ্ছে, কিছু স্থিরমতি, বিচক্ষণ কণ্ঠস্বর। উপন্যাসে সেই ব্যক্তিত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফুকন। উগ্রতায় ভেসে না-যাওয়া ছাত্রদের তখনও তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন, অসমের জনবিন্যাস, তার সাংস্কৃতিক বিন্যাসের কথা। তুলনা টেনেছিলেন নানা জাত, রঙ, গঠন, আয়তনের পাথর, কাঁচের টুকরোর মোজেইক শিল্পের সঙ্গে। বোঝাতে চাইছিলেন অসম সেই উপলচিত্রণ। ছয়ের দশকে ভাষা আন্দোলনের ভয়াবহ সময়ে কালীকিশোর তাঁর মেয়েকে তো এই শব্দ দিয়েই পরিস্থিতি বোঝাতে চেয়েছিলেন। তখন বনশ্রীর বয়স তেরো। শুধু তো বনশ্রী না, ছাত্র-ছাত্রীদের সেই ছোট্ট ভিড়ে ছিল কাঠিয়াটোলির আনন্দ শইকিয়া, বরপেটার জালালুদ্দিন, ডিব্রুগড়ের মহেন্দ্র গগৈ, জোরহাটের পিনাকী, মঙ্গলদৈয়ের ধরণী তালুকদার। অধ্যাপক বোঝাচ্ছিলেন, এই মোজাইকেও কীভাবে সামান্য আঘাতে চিড় ধরে। বার বার আঘাতে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যায়। বোঝাচ্ছিলেন, অনেক সময় চিড় অভ্যন্তরে নিহিত থাকে। কিন্তু, নানা বিন্যাসের ছদ্ম-আবরণের কারণে বোঝা যায় না। চরম আবহাওয়ার প্রকোপে সে চিড় ক্রমে প্রকাশ্যে আসে।

অধ্যাপক বুঝিয়েছিলেন, এই আন্দোলনের শিকড় রয়েছে মহা ভুল বোঝাবুঝির মধ্যে। যার বীজ পোঁতা হয়েছিল গত শতাব্দীতে। বাংলা যখন বিদ্যালয়ে বিদ্যালয়ে আরোপ করল ইংরেজ শাসক। অসমের বিদ্যালয় বাংলা মিডিয়াম হল। অসমের মানুষ তখন মনে করেছিলেন, বাঙালি কেরানিদের চাপেই তা করা হয়েছে। অধ্যাপক সাম্প্রতিক অতীতে আবিষ্কৃত ব্রিটিশ রাজপুরুষ মাইলস ব্রনসনের ডায়েরির উল্লেখ করে কী পরিস্থিতিতে এই আইন জারি হয়েছিল তা ব্যাখ্যা করেন।

যে কাজটি আরও সুচারু ভাবে সম্পন্ন করেছিল জোড়হাটের জাতীয় ভবন কৃত ‘অসম জাতীয় অভিধান’। এই মহা কর্মযজ্ঞের অন্যতম প্রধান ঋত্বিক অধ্যাপক দেবব্রত শর্মা সাম্প্রতিক এক ক্ষুদ্র নিবন্ধে লিখেছিলেন, ১৮২৬ থেকে ১৮৩৬ অসমে প্রশাসনিক কাজে অসমিয়া ভাষাই ব্যবহৃত হত। এর পর আসে বাংলাভাষা। তিনি লিখছেন, “…বহু দশক ধরে এটাই প্রচার করে আসা হয়েছে যে বাঙালি আমলা ও কেরানিরাই অসমিয়াদের উপর বাংলা ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার জন্য দায়ী। আমলা-মুহুরি তত্ত্ব নামে পরিচিত এই প্রচারকে লোকে বিশ্বাস করে এসেছে। কিন্তু বহু অসমিয়া লেখক ও গবেষদের নিরলস পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে এটা এখন সন্দেহাতীত ভাবে প্রতিষ্ঠিত যে, ইংরেজরা বাংলা ও অসমিয়ার পার্থক্যটা ভালোমতেই জানত এবং তারা এত নির্বোধ ছিল না, বাঙালি কেরানিরা তাদের বোকা বানিয়ে দেবে।”

১৮১০ সালে জোড়হাটের রুচিনাথ বড়গোঁহাই এবং কলকাতায় ড. ফ্রান্সিস বুচাননের পৃষ্ঠপোষকতায় ২৫০০ শব্দের সংস্কৃত, অসমিয়া ও কামরূপী শব্দকোষ সংকলিত হয়েছিল। ১৮১৪ সালে আহোম রাজকুমার রাজা ব্রজনাথ সিংহের উদ্যোগে পূর্ব ভারতীয় ভাষার শব্দকোষ তৈরি হয়। এরও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ড. বুচানন। এই ভাষাগুলির মধ্যে ছিল ইংরেজি, বাংলা, অসমিয়া, পানিকোচ, কাছাড়দেশিয়া, মণিপুরি, গারো, কাছাড়ি ও মেচ। এই দুটি শব্দকোষ পুনঃপ্রকাশ করেছে জোড়হাট জাতীয় ভবন। এই দুটি শব্দকোষের উল্লেখ করে অধ্যাপক শর্মা বলছেন, “সুতরাং ব্রিটিশরা অসমিয়া ও বাংলার পার্থক্য জানত না এবং কতিপয় বাঙালি ভুল বুঝিয়ে বিপথে চালিত করেছিল এ দাবিটা সত্যের অপলাপ।”

না, শেষ রক্ষা হয়নি। উগ্র জাতীয়তাবাদের স্রোত সব বৌদ্ধিক যুক্তি ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। ১৯৮৫ সালে আসু, অসম সরকার ও রাজীব গান্ধী নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার প্রথম অসম চুক্তি সম্পাদন করে। যার মূল কথাই ছিল বিদেশি নাগরিকদের চিহ্নিত ও বিতাড়িত করা। স্থির হয় ১৯৭১ সালের ২৪ আগস্ট মধ্যরাতের পরে যারা ভারতে এসেছে তাদের বিদেশি বলে গণ্য করা হবে। মনে রাখতে হবে এই সময়রেখা শুধুমাত্র অসমের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ভারতের ক্ষেত্রে যার সীমারেখা ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর। ২০০৫ সালে কেন্দ্রের মনমোহন সিংহ সরকার এবং রাজ্যের তরুণ গগৈ সরকারের সঙ্গে আসুর ফের এক ত্রিপাক্ষিক চুক্তি হয়। এই আলোচনায় স্থির হয়, ১৯৫১ সালে হওয়া জাতীয় নাগরিক পঞ্জির সংশোধন করা হবে। বিদেশি চিহ্নিতকরণের নানা প্রক্রিয়া চলতে থাকলেও, এনআরসি প্রক্রিয়া সে ভাবে চালু করেনি পূর্ববর্তী সরকারগুলি। ২০১৪ সালে অসমের কয়েকজন নাগরিক সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানিয়ে বলে অসম চুক্তির প্রধান ধারা — বিদেশি শনাক্তকরণ, আটক এবং ভোটার তালিকা থেকে তাদের নাম বাদ দেওয়া — বলবৎ করা হোক। বিচারক রোহিন্টন ফলি নরিম্যান ও বিচারপতি রঞ্জন গগৈ-এর ডিভিশন বেঞ্চ শনাক্তকরণের জন্য এনআরসি নবীকরণের নির্দেশ দেন। তাঁরা এও জানিয়ে দেন পুরো প্রক্রিয়াটি আদালতের তত্ত্বাবধানে হবে। রাজ্যে বিজেপি-আসু সরকার প্রতিষ্ঠার পরই অতি দ্রুততার সঙ্গে এই কাজ শুরু হয় এবং অবশ্যই সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এবং সর্বোচ্চ আদালতের তত্ত্বাবধানে। ৩০ জুলাই এনআরসি’র খসড়া তালিকা প্রকাশিত করে জানায়, অসমে বেআইনি অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা ৪০,০৭,০০৭। লক্ষ লক্ষ মানুষের হাহাকারের মাঝেও প্রশ্ন উঠেছে, নাগরিকত্ব নির্ধারণের ক্ষেত্রে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি কোনও প্রামাণ্য তথ্য হতে পারে কি না? সমাজতত্ত্ববিদ সজল নাগ সাম্প্রতিক এক নিবন্ধে জানিয়েছেন, “১৯৫১ সালে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি তৈরি হয়েছিল খুব গোপনে, জনশুমারির জন্য জমা দেওয়া স্লিপের ভিত্তিতে। সেই প্রক্রিয়ায় নজরদারির সুযোগ ছিল না, এই পঞ্জি প্রামাণ্য তথ্য হিসেবে গণ্য হওয়ার যোগ্য ছিল না। আক্ষেপের কথা, নাগরিকত্ব নির্ধারণের ক্ষেত্রে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি কোনও প্রামাণ্য তথ্য হতে পারে না — এই মর্মে কোনও প্রতিবাদী আবেদন সুপ্রিম কোর্টে জমা পড়েনি। আর তাই কলমের খোঁচায় ৪০ লক্ষ মানুষ রাষ্ট্রহীন হয়ে যেতে পারেন। এক শতাব্দীর আন্দোলন যা করতে পারেনি, জাতীয় নাগরিক পঞ্জির সংশোধন দু’বছরে তা করে দেখাল।”

আমাদের আক্ষেপ এখানেই শেষ নয়, লক্ষ লক্ষ দক্ষ চাষি অসমের কৃষি ব্যবস্থা বদলে দিয়েছিলেন। ১৯৫০-৫১ সালেও অসমে চালের উৎপাদন দেশের গড় উৎপাদনের চেয়ে বেশি ছিল। ১৯৫০-এর দশকের প্রথম ভাগে অসমের মাথা পিছু আয় দেশের গড় মাথা পিছু আয়ের চেয়ে বেশি ছিল। এর পিছনে বড় একটি কারণ জনবসতির ঘনত্বের তুলনায় প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ। বিশ শতকের তৃতীয় দশকে পূর্ববঙ্গে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে জনসংখ্যা ৯২৫ জন তখন অসমে ছিল ২২৫ জন। বর্তমানে তা ৩৮৪। এই সমৃদ্ধির পিছনে ছিল, চা শিল্পের সূচনা (১৮৩৪), ১৮৩৯ সাল থেকে চা রপ্তানি আর তার কাছাকাছি সময়ে কয়লা উত্তোলন, স্টিমার পরিষেবা (১৮৪৭), পাশাপাশি ট্রেন চলাচল। তেল শোধনাগার তৈরি হয়েছিল ১৮৯০ সালে। ডিগবয়ে এশিয়ার প্রথম তৈল শোধনাগার চালু হয় ১৯০১ সালে। পাশাপাশি ব্যাপক হারে করাতকলের প্রবর্তন হয়। এই মহাকর্মযজ্ঞে ঝাড়খণ্ডী আদিবাসীদের মুখে রক্ত তোলা ভূমিকার কথা মনে রাখতে হবে। তবুও, কথায় কথায় কোঁকরাঝাড়ে ঝাড়খণ্ডী বিরোধী দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন জাতের ধান, পাট, ডাল, সরষে উৎপাদন করে যাঁরা অসমের কৃষি সমৃদ্ধির সূচনা করেছিলেন, তাঁরা কিংবা তাঁদের উত্তরসূরীরা সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশিত এনআরসি’র ৪০ লক্ষ বিতাড়ন যোগ্য মানুষের তালিকায় রয়েছেন। ব্রিটিশ আমলে শিল্পায়নের হাত ধরে এসেছিলেন যে বিহারি, ওড়িয়া, গোর্খারা, এনআরসি’র কোপে পড়েছেন তাঁরাও। তাঁদের শ্রম-ইতিহাস মনে রাখেনি নির্দয় নির্দেশ। এই আদেশ আর আদেশবলে পালিত যাবতীয় অমানবিক কর্মযজ্ঞ, তা বিনা প্রতিবাদে মেনে নেবে ভারত? অসমে কী হিন্দু, কী মুসলমান বাঙালির প্রব্রজনের ইতিহাস খতিয়ে দেখা হবে না? দেখা হল না, এতগুলো গণহত্যা যারা ঘটিয়েছে তাদের শাস্তি দূরে থাক তাদের সঙ্গে, তাদের দাবি মেনে তৈরি হয়েছে একের পর এক চুক্তির বয়ান। যাদের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ-বিদ্বেষ তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনও সুযোগ দেয়নি রাষ্ট্র। তবে কি অসমে বাঙালির কোনও অংশীদারিত্ব নেই? বাঙালির মতো অসমিয়া জাতির ভাগ্যনিয়ন্তা হবে উগ্র অসমিয়া জাতীয়তাবাদী এবং বর্ণহিন্দু ফ্যাসিস্ট জোট? এ প্রশ্নের উত্তর জানা আজ খুব জরুরি। যারা দেশ জুড়ে অসমে মুসলমান অনুপ্রবেশের খতিয়ান দিতে গিয়ে ধুবড়িতে জনসংখ্যার ৭৩.৩ শতাংশ, বরপেটায় ৫৯.৩ শতাংশ, গোয়ালপাড়ায় ৫৩.৭ শতাংশ, নগাঁওয়ে ৫১ শতাংশ মুসলমান বাস করেন এবং অসমের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৫ শতাংশ মুসলমান বলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, তারা জানতে চায়নি যে, বিভিন্ন সমীক্ষা ও গবেষণায় জানা গিয়েছে — অশিক্ষা, দারিদ্র, সার্বিক পশ্চাদপদতা এবং ধর্মীয় প্রচারের কারণে এই সমস্ত জেলাগুলিতে জন্মনিয়ন্ত্রণের কোনও সরকারি উদ্যোগই চোখে পড়েনি। ফলে সেখানকার শিশুজন্মের হার অত্যন্ত বেশি। এ তথ্য জানা জরুরি, যে সরকার এই সমীক্ষাগুলিকে গুরুত্ব দেবে কি না?

গণহত্যা অবশ্য বন্ধ হয়নি। ২০১৪ সালে বোড়োল্যান্ডে ঝাড়খণ্ডী আদিবাসী হত্যাকাণ্ড, ২০১২ সালে কোকরাঝাড়ে বোড়ো-মুসলমান সংঘর্ষে ৭১ জনের মৃত্যু। যার ৯০ শতাংশ মুসলমান। ঘর ছাড়া হয়েছিলেন ৩,৯২,০০০ মানুষ। ২০০৮ সালে দরং ও উদালগুড়িতে মৃত্যু হয়েছিল ৫১ জন মুসলমান ও ১০ জন বোড়ো আদিবাসীর। গৃহহীন হয়েছিলেন দু’লক্ষ মানুষ। ১৯৯৪ সালে বোড়ো-মুসলমান সংঘর্ষে মৃত মুসলমানের সংখ্যা ৯৬, বোড়ো ৯। ১৯৯৩ সালে কোকরাঝাড় ও বঙ্গাইগাঁওয়ে এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। মৃত মুসলিম ৫০, বোড়ো ১। গ্রামছাড়ার সংখ্যা ১৮০০০। আজকের এনআরসি’র প্রেক্ষিতে মনে রাখতে হবে এই লক্ষ লক্ষ ঘর ছাড়া, গ্রাম ছাড়া মানুষের কথা। যাঁদের সব হারিয়েও প্রমাণ করতে হবে তাঁরা এদেশের নাগরিক। নিশ্চয় ইতিমধ্যে পোড়া ছাই সরাতেই ফিনিক্স পাখির মতো বেঁচে উঠেছে জন্ম-জন্মান্তরের সকল নথি। জানা নেই সে তথ্য। তবে অভিবাসীদের নথি খুঁজতে গেলে মনে রাখতে হবে ২০১২ সালের ব্রহ্মপুত্রের ভয়াবহ বন্যার কথা। ১০ লক্ষ মানুষকে সর্বস্বান্ত করেছিল সেই বন্যা।
‘উপত্যকার পরা উপত্যকায়’ শুরুটি ছিল শেষ রবিরশ্মিপাতের কাব্যময় দৃশ্যের উন্মোচনে। দীর্ঘ বাঁশবনের মাথায় সূর্য অস্ত যাচ্ছে। ঘরে পোয়াতি বউ শৈলবালা। অসুস্থও বটে। অন্ধকার নেমে এল বলে। আর উদ্বেগে ছটফট করছেন কালীকিশোর। রাত বাড়লেই ভয়। এখন যদি প্রসবের বেদনা ওঠে কে যাবে দাই কালীদাসীমাকে খবর দিতে। কাল রাতেও তো সে দেখেছে দূরে আগুনের জ্বলজ্বল রেখা। নোয়াখালির ভয়াবহ আগুনের শিখার দৃশ্য তাঁর মনে বার বার ফিরে ফিরে আসছিল।

উপন্যাসের শেষ প্রান্তে এসে কালীকিশোরের মন পড়তে পারি ফের। আসু-অগপ’র বিদেশি খেদা আন্দোলনের পটভূমিতে শেষ হয় উপন্যাস। পূর্ববঙ্গের কথা মনে পড়ে কালীকিশোরের। আর ভাবনায় ধাক্কা দেয় অমোঘ প্রশ্ন, তাঁকেও কি বিদেশি বলে চিহ্নিত করা হবে?

আরামকেদারায় আধশোয়া কালীকিশোরের চোখে পড়ে নীল আকাশে নরম তুলোর মতো ভেসে যাওয়া মেঘ আর উড়তে থাকা একটি পাখি। চোখের চশমাটা ঠিক করে পড়ে বুঝতে পারেন ওটা একটা শকুন। নিজেকে ওই ঘুরে ঘুরে উড়তে থাকা শকুনের মতো মনে হয়। মনে হয় নোয়াখালি থেকে নেলি — সেই একই দাঙ্গা আর হত্যাকাণ্ড, সেই কালো কালো ধোঁয়া আর আগুন। ক্রমে রাত নামে। উঠোনে আরামকেদারায় তখনও শুয়ে কালীকিশোর। সারা দিনের নানা মানুষের নানা কর্মব্যস্ততা তাঁকে আর ছোঁয় না। চোখ খুঁজে বেড়ায় সেই একলা পাখিটিকে। সেটি কি এখনও ঘুরে ঘুরে উড়ছে? একটু ঘাড় উঁচু করে খুঁজতে থাকেন। না তাকে দেখতে পাওয়া যায় না। ফের হেলান দিয়ে শুয়ে পড়েন কালীকিশোর। মুহূর্তের মধ্যে শিশুর মতো ঘুমিয়ে পড়েন…

কৃতজ্ঞতা

  • দীপককুমার বরকাকতি, ফ্রম ভ্যালি টু ভ্যালি, অনুবাদ: গায়ত্রী ভট্টাচার্য, সাহিত্য আকাদেমি, ২০১০।
  • সুবীর চৌধুরী, ট্রাবলড পেরিফেরি, ক্রাইসিস অভ ইন্ডিয়াজ নর্থ ইস্ট, সেজ, ২০০৯।
  • ড. দেবব্রত শর্মা, অসমীয়া জাতিগঠন আরু জাতীয়-জনগোষ্ঠীগত অনুষ্ঠানসমূহ, (১৮৭৩-১৯৬০), একলব্য প্রকাশন, ২০০৭।
  • ড. দেবব্রত শর্মা, আসাম ও জাতীয় নাগরিক পঞ্জি: ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, শ্রমজীবী ভাষা, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৮।
  • সজল নাগ, এক ঢিলে দুই পাখি, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৭ আগস্ট, ২০১৮।
  • মিলন দত্ত, মাতৃভাষা-হারানো এক বিস্মৃত বাঙালির বৃত্তান্ত, আরেক রকম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.