নন্দিনী ধর

বছর দুয়েক আগে আমি একটি ছোট্ট কবিতার বই লিখেছিলাম। বইটির কেন্দ্রে ছিল বাইবেলের একটি বিশেষ গল্পের সমালোচনামূলক কাঁটাছেঁড়া। এবং, “ঠাকুরমার ঝুলি”র একটি বিশেষ গল্প — অরুণ-বরুণ-কিরণমালা — তার পুনর্লিখন। সজোরে বলি, এই পুনর্লিখনের ভিত্তিই ছিল একধরনের মেয়েদের জীবন এবং লিঙ্গভিত্তিক বিশ্ববীক্ষা। সেই অর্থে আমি যে খুব নতুন কাজ করেছি, এমনও নয়। পৃথিবীতে বহু লেখক-লেখিকাই প্রচলিত মিথ, মহাকাব্য, উপকথা এসমস্ত ধরে কাজ করেছেন। লিঙ্গভিত্তিক ও নারীবাদী জায়গা থেকেও এই পুনর্নির্মাণের ঐতিহ্য বিশ্বসাহিত্যে কিছু নতুন নয়। বাংলাসাহিত্যেও এই পুনর্নির্মাণের একটি লম্বা ইতিহাস রয়েছে। বইটি পড়ার পরে আমার কফিহাউসের এক দাদা, যিনি নিজেও নিয়মিত কবিতাচর্চা করে থাকেন, আমাকে সস্নেহে জিজ্ঞাসা করেন, “আচ্ছা, আরেকটু ইউনিভার্সাল কিছু নিয়ে লিখলে ভালো হত না?” প্রশ্নটা শুনে আমি একটু থমকে যাই। আমার তো ধারণা ছিল আমি সর্বজনীন বা ইউনিভার্সাল বিষয় নিয়েই লিখেছি। লোককথা, মিথ, রাষ্ট্র, বিদ্রোহ, দুই প্রজন্মের মধ্যেকার সাংস্কৃতিক ও মতাদর্শগত বিভেদ, বিরোধ — এ সবই “ইউনিভার্সাল” বিষয়। তাহলে?
তাহলে তো প্রথমেই প্রশ্ন করতে হয়, “ইউনিভার্সাল” বা “সর্বজনীনতা” ঠিক কাকে বলে? তার সংজ্ঞা কী? “ইউনিভার্সাল” বা “সর্বজনীনতা”র বিপরীত ধারণাটি ঠিক কী? আবার, “স্পেসিফিক” বা “নির্দিষ্ট” খারাপ কেন? মানে, ধরেই নিলাম, আমি সর্বজনীন নই। কিন্তু, আমাকে কেন “ইউনিভার্সাল” লিখতে হবে? আমি “নির্দিষ্ট” রকম করে লিখলে সেটা খারাপ হতে যাবে কেন?

কোন বিষয়গুলি কবিতায় লিখলে তা সর্বজনীন বা ইউনিভার্সাল বলে গণ্য হবে? প্রকৃতি? প্রেম? কিন্তু, আমার লেখায় তো দুই-ই ছিল যথেষ্ট পরিমাণে। তাহলে? খোলসা করেই বলি। আমার দাদা-বন্ধু “ইউনিভার্সাল” বিষয়টি নিয়ে লেখার আগে আরেকটি কথা বলেছিলেন। “বইটি তো একটু নারীবাদী হয়ে গেলো”। “নারীবাদী” বলতে তিনি ঠিক কী বোঝেন, আমার জিজ্ঞাসা করা হয়ে ওঠেনি। তবে, নিজের মত করে বুঝে নিয়েছিলাম কিছুটা। হ্যাঁ, আমি নারীবাদী। নারীবাদ নিয়ে আমার ভাবনা জটিল। অন্যান্য বহু বিষয়ের মতোই। এবং সে জটিলতার ছায়া, আমার নারীবাদের ছায়া অবশ্যই পড়ে আমার কবিতাতে, আমার অন্যান্য লেখায়। কিন্তু, আমি নিশ্চিত, যেভাবে আমি নারীবাদকে বুঝি, আমার এই দাদাটি বোঝেন না। তাহলে? জনপ্রিয় মানসে মেয়েদের যাপনের গল্পকে কেন্দ্রে রাখাই বোধহয় নারীবাদ। আমার নিজের কাছে যদিও হিসেবটা অত সরল নয়! কিন্তু, এটা আমার ঠিক এখনো বোধগম্য হল না যে, কেন মেয়েদের গল্প লিখলেই সেটা ইউনিভার্সাল বা সর্বজনীন হবে না। মানে, মেয়েরা তো আছে। পৃথিবীর আদিলগ্ন থেকেই আছে। তবে?
আরেকটু ভেঙে ভেঙে বলি? উদাহরণ দিয়ে? যেমন ধরুন, মৃদুল দাশগুপ্তর “বিবাহ-প্রস্তাব” নামে একটি কবিতা আছে। কবিতাটি অনেকটা এইরকম:
“বাড়িটি থাকবে নদীর কিনারে, চৌকো,
থাকবে শ্যাওলা রাঙানো একটি নৌকো,
ফিরে এসে খুব আলতো ডাকবো, বউ কই…রাজি?
তবে এসো এসো জানাও তুমিও প্রস্তুত,
আত্মগোপন পর্বে তুমি এ দস্যুর
ক্ষতে দেবে মধু, দুব্বো চিবিয়ে, আস্তে
তোমাকে চেনাবো তারাগুলি, আর নৈঋত
দিক থেকে নেমে হঠাৎ আসবে দেবদূত
পুকুরে ভাসবে দুটি রাজহাঁস, চই চই…
লুঠে নেব হ্রদ, টিলাগুলি, আমি জঙ্গী
দূর বনপথে ঝরে ঝরে যাবে রঙ্গন…
ছোটাবো তুফান ঘোড়াটি, যাবে না সঙ্গে?
তোলো মুখ, এসো ধরো হাত, চলো সঙ্গে।”
বাংলার পাঠকপাঠিকাদের মধ্যে একটা সার্ভে করে দেখুন। লিঙ্গ নির্বিশেষে একটি বড় অংশ কিন্তু কবিতাটিকে ওই “ইউনিভার্সাল/সর্বজনীন” বিভাগে ফেলবেন। যদিও, আমার কিন্তু কবিতাটিকে একেবারেই সর্বজনীন বলে মনে হয় না।
বরং, মনে হয়, পৌরুষের কবিতা। বিষমকামী পৌরুষের কবিতা। মধ্যবিত্ত বাঙালি বিষমকামী পৌরুষের কবিতা। যে পৌরুষের কবিতায় নারীত্ব ও নারীর যৌন বৈষয়িকতাকে এক বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যে দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। তো, কেমন সেই নারী বৈষয়িকতা? যে কিনা দেবে পুরুষের “ক্ষতে মধু, দুব্বো চিবিয়ে”। তা-ও আবার এমনি এমনি বা সজোরে দিলে হবে না, দিতে হবে “আস্তে আস্তে” (ন্যাকা)। এখানেই শেষ নয়। কবিতার “আমি” — অর্থাৎ, যে বৈষয়িকতার মধ্যে দিয়ে আমরা গোটা কবিতাটাকেই দেখছি, শুনছি, যাকে ইংরেজিতে বলে “লিরিক্যাল সাবজেক্টিভিটি” — সে কবিতার যে “তুমি”, তাকে শেখাবে তারা চিনতে। অবশ্যম্ভাবী, “আমি” পুরুষ – দস্যু, জঙ্গী। এবং, “তুমি ” নারী — বউ। তো, এই যে তারা চেনানোর পরিমণ্ডল, সেখানে নারী/বউ/পুরুষটির ছাত্রী। নিষ্ক্রিয়। তেমনি, কবিতার যে শেষ লাইন, “তোলো মুখ, এসো ধরো হাত, চলো সঙ্গে,” সেখানে আরো গভীরভাবে জোরদার হয় এই নারী নিষ্ক্রিয়তার পরিসর, পরিমণ্ডল। বিশেষ করে কবিতাটির কোথাও বর্ণিত নেই নারীটির কণ্ঠস্বরের আভাস। আনত, নম্র, পরিচর্যাময়ী যে প্রতিমূর্তিটি কবিতায় গড়ে ওঠে, তা কিন্তু কবিতার যে “আমি”, সেই “আমি” প্রতিমূর্তির একশো আশি ডিগ্রী বিপরীতে। আমি সর্বদাই দস্যু, জঙ্গী।
অর্থাৎ, এখানে এই “আমি” ও “তুমি”কে ঘিরে তৈরি হয়েছে একটি আত্মকল্পনার পরিসর। এবং, সেই আত্মকল্পনার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে অপরের কল্পনাও। সে অপর নারী। সে অপর আনত, বিনম্র হলে তবেই না পুরুষ হতে পারে জঙ্গী, দস্যু। তো, বিষয়টা হলো, আমাদের কাছে — মানে বেশিরভাগের কাছে — এ কবিতাটি সর্বজনীন ঠেকে। কারণ, আমাদের কাছে এই কবিতার যে ভরকেন্দ্র, যে মতাদর্শগত জগত, যে প্রেমের রাজনীতি, যে লিঙ্গ-কল্পনা, তা আমাদের কাছে বড়ই পরিচিত ঠেকে। আমাদের মননজগতের যে তত্ত্ববিশ্ব, যে সংস্কৃতিবিশ্ব, তাকে কোনওভাবেই আঘাত করে না এ কবিতা, আঘাত করে না সামাজিক মহাবয়ানজাত পুরুষ-দৃষ্টির বা মেল-গেজ-এর আবহকেও। যা কিনা আমরা সবাইই কমবেশি আত্মস্থ করেছি। লিঙ্গ নির্বিশেষে।
অর্থাৎ, আমি যেটা বলতে চাইছি, তা হল, কাকে আমরা সর্বজনীন বা ইউনিভার্সাল বলব, তারও একটা রাজনীতি আছে। একটু তলিয়ে দেখুন। পৃথিবীতে যা কিছু বিশেষ, স্পেসিফিক, তা-ই আবার সর্বজনীন, ইউনিভার্সাল। কাজেই, সেইভাবে দেখতে গেলে, সর্বজনীন বলে আসলে যে কিছু হয় না। কিচ্ছুটি নয়। কিন্তু, বাংলা বাজারে কবিতা লিখতে গেলে আমাকে একটি দায় ঘাড়ে করে লিখতে হবে — তা হল সর্বজনীন হয়ে ওঠার দায়। এবং, সেই সর্বজনীনতার দায়ভার ঘাড়ে করে লেখার টেবিলে বসার অর্থ হলো, আমাকে কাঁচি করতে হবে আমার মেয়েবেলা, আমার নারী-অস্তিত্ব। আমি যে মেয়ে, সেই ছাপকে ধুয়েমুছে দিয়ে কবিতা লিখতে হবে আমায়।
কিন্তু কেন? কেন হিসেবটা একটু উলটে যাবে না? বা কেন আমি নিজে হিসেবটাকে একটু উলটে দেব না? মানে, সত্যি যদি সর্বজনীন বা ইউনিভার্সাল বলে কিছু থেকে থাকে, কেন আমার কবিতার নারী-সময়, নারী-অস্তিত্বই সেই সর্বজনীনত্বর অভিধা পাবে না? বহু বছর আগে, অনেকটা এই প্রশ্ন থেকেই শুরু হয়েছিল বাংলা কবিতা ও তার লিঙ্গচেতনা নিয়ে আমার চিন্তাভাবনা। যদিও, সেই বয়সে ঠিক এই ভাষায় বলার মত ক্ষমতা ছিল না।
সত্যি কথা বলতে কি, এই চিন্তাভাবনার পেছনে রয়েছে একটি সংকট। খুবই আপাতসরল একটি ব্যক্তিগত সংকট। সেই সংকটটি অনেকটা এইরকম, যে ৯৯.৯% বাংলা কবিতায় আমি নিজেকে দেখতে পাই না। যে নারীত্ব ধারণ করতে চাই নিজের মননে, যাপনে, তার কোনও প্রতিফলন দেখতে পাই না। যে মনুষ্যত্বকে আমি করে তুলতে চাই আমার বেঁচে থাকার অস্ত্র, তার কোনও ছবি সেখানে নেই। অর্থাৎ, বাংলা কবিতা — প্রকাশিত কবিতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে, আমার কোনও অস্তিত্বই নেই।
মানে, ব্যাপারটা অনেকটা এইরকম। আমি ওই খুব কমসংখ্যক বেয়াড়া মেয়েদের মধ্যে একজন,যে নিজেকে চিরকাল ভেবেছে ওই “দস্যু” বা “জঙ্গী” রূপে। “দস্যু” বা “জঙ্গী”-র বউ রূপে নয়।হ্যাঁ, আমি জানি, ব্যাপারটা জটিল। মানে, আমারই অনেক বান্ধবী — শিক্ষিতা, রুচিশীলা, স্বাধীনচেতা, কপালে নারীবাদোচিত ইয়া বড় টিপ পরে – যখন প্রথম সমরেশ মজুমদারের “কালবেলা” পড়েছে, নিজেদের ভেবেছে মাধবীলতারূপে। অনিমেষ নয়। বাস্তবিক জীবনে হতে চেয়েছে radical পুরুষের প্রেমিকা, অবশেষে বউ। নিজেদের radical হিসেবে গড়ে তোলার কথা ভাবেনি। তো, এটি একটি অদ্ভূত খেলা। সেখানে বাঙালি মধ্যবিত্ত পাঠিকার সাথে বাঙালি মধ্যবিত্ত পুরুষ কবি/লেখকের স্থাপিত হয় এক অলিখিত চুক্তি। বাঙালি পুরুষ কবি আঁকে নারী নিষ্ক্রিয়তার ছবি, বাঙালি পাঠিকা চেটেপুটে খায় সেই কাব্যিক প্রতিমূর্তি, প্রতিফলন। হয়ে উঠতে চায় কবিতার পাতায় পড়া “বউ”-এর মতন। সমাজ ও সাহিত্য হাত ধরাধরি করে এগিয়ে চলে। কী পরিতৃপ্তি! আসলে এই পরিতৃপ্তির হাট ধরেই আসে সর্বজনীনতা বা ইউনিভার্সাল নির্মাণ। আসলে, এই ইউনিভার্সাল বা সর্বজনীন হয়ে উঠতে পাড়ার মধ্যেও তো আছে সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষমতাতন্ত্র। সামাজিক আধিপত্যের অধিকার না থাকলে তো আসলে ইউনিভার্সাল বা সর্বজনীন হওয়া যায় না।
অবশ্য, এই নারী-নিষ্ক্রিয়তার প্রতিমূর্তি গড়ার যে খেলা, যে খেলার মধ্য দিয়ে বাংলা কবিতায় তৈরি হল এক আধিপত্যকারী ইউনিভার্সাল, তা যে ঠিক সমশিলাকেন্দ্রিক ভাবেই বাংলাসাহিত্যে দেখা দিল, তা কিন্তু নয়। তাই, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের “অসুখের ছড়া”-র বিষয়টি দেখা দিল অনেকটা এইভাবে:
“একলা ঘরে শুয়ে রইলে কারুর মুখ মনে পড়ে না
মনে পড়ে না মনে পড়ে না মনে পড়ে না মনে পড়ে না
চিঠি লিখবো কোথায়, কোন মুণ্ডহীন নারীর কাছে?”
তো, বুঝতে অসুবিধে হয় না, কবিতাটির বিষয়, যাকে বাংলা কবিকুল বলে থাকেন “অপ্রেম”। সেই অপ্রেমের হাত ধরে নারী এখানে হল “মুণ্ডহীন”। শব্দটা কেমন যেন আমার পিলে চমকে দেয়। “মুণ্ডহীন” মানে তো মৃত, মুখমণ্ডলবিহীন, ধড়সর্বস্ব। তো, ঠিক কোন অর্থে এই বিশেষণটি ব্যবহার করেছেন সুনীল? নাকি, সুনীলের নারী বৈষয়িকতায় প্রযোজ্য সব কটি অর্থই? তাহলে, দাঁড়াল হচ্ছে গিয়ে, পরিচিতিবিহীন, বুদ্ধিবিহীন, শবসম নারীর দল। সত্যি তো, এহেন নারীকুলের কাছে কী-ই বা লেখার থাকতে পারে কবির?
আমার স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, সুনীলের এই কবিতার ভাষ্যের সাথে একটি মূলগত ফারাক রয়েছে মৃদুলের কবিতার ভাষ্যের। সুনীলের কবিতার মূল সুর যদি হয় নারী বিদ্বেষ — ইংরেজিতে যাকে আমরা বলতে পারি মিসোজিনি — মৃদুলের কবিতার প্রধান আবেগ একধরনের সংবেদনশীল প্রেমমেদুরতা। কিন্তু, তৎসত্ত্বেও, যদি আরেকটু তলিয়ে দেখি, তাহলে দেখতে পাবো, “আধুনিক বাংলা কবিতা” নামক যে সাংস্কৃতিক পরিসরটি, সেখানে তৈরি হল লিঙ্গ রাজনীতির একটি মতাদর্শগত ধারাবাহিকতা। সেই ধারাবাহিকতার এক প্রান্তে রইল মৃদুলের নতচোখ, আদরমেদুর বউ, অন্যপ্রান্তে সুনীলের “মুণ্ডহীন” নারী।
কিন্তু এই যে দুধরনের রূপায়ন, তার থেকে সজোরে বাদ পড়ে গেল একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তা হল, নারী বৈষয়িকতার জটিল প্রতিফলন। তো কেমন হতে পারে এই প্রতিফলন? যেমন ধরুন, ছয় বা সাতের দশকে তো পশ্চিমবাংলার কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের ক্লাসরুমে পদচারণা কোনও বিরল ঘটনা নয়। কেমনভাবে তাদের পাঠ্যবইয়ের জগতের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছিল মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালি মেয়েরা? কলেজের ছাত্র ইউনিয়নে ছিল কি মেয়েরা? না থাকলে কেন ছিল না? যারা ছিল, তাদের রাজনৈতিক বৈষয়িকতা ঠিক কেমন ছিল? তো, সেসব প্রাত্যহিক বিষয় কিন্তু এল না বাংলা কবিতায়।
তার বদলে এল প্রেমজর্জর এক নারী-প্রতিমূর্তি। যার জীবনে প্রেম ছাড়া অন্য কোনও কিছু নেই। অর্থাৎ, যৌনতা — এবং শুধুমাত্র যৌনতা — দিয়েই দেখা হল বাংলা কবিতাজাত মেয়েদের। সে যৌনতার বোধ অবশ্যই পুরুষ যৌনতাবোধ, পুরুষ যৌনদৃষ্টিভঙ্গী। যাকে ইংরেজিতে বলে, মেল সেক্সুয়াল গেজ। মানে, মেয়েরা বাংলা কবিতায় এল পুরুষ যৌনচাহিদার বস্তু হিসেবে। এবার যেটা হল, তা হল গিয়ে অনেকটা এইরকম: কোনও পুরুষের চাই আনত, আনম্র, যত্নশীলা, সংবেদনশীলা বউ, তো কারুর চাই নীলজলে উরু ডুবে যাওয়া নীরা। এমনকি, কলেজে পড়া মেয়ের ছবি যখন এল বাংলা সাহিত্যে, তখন তারা এল পুরুষের চুলকুবাজির ক্ষেত্র হয়েই। অর্থাৎ, গোটা বিষয়টিই হয়ে দাঁড়াল পুরুষ-বৈষয়িকতার প্রতিফলন, বা আরো ভেঙে বললে, বিষমকামী পুরুষ যৌন-বৈষয়িকতার প্রতিফলন।
তো, এবার যদি আমরা ফিরে যাই যথাক্রমে মৃদুল ও সুনীলের কবিতায়, তাহলে দেখব, দুটিরই কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একধরনের আগ্রাসী পৌরুষ। যদিও, দুটি কবিতায় এই আগ্রাসী পৌরুষের অভিব্যক্তি সম্পূর্ণ ভিন্নরকমের। সুনীলের কবিতায় সেই পৌরুষ ধারণ করে বিবিক্তের মুখোশ। সমাজ থেকে বিবিক্ত। প্রেমের রোম্যান্টিক ধারণা হতে বিবিক্ত। কোনওকিছুই সেখানে কিছু নয়। নারীও তাই সেখানে পর্যবসিত হয় শূন্যে। মুণ্ডহীন ধড়ে, যার সাথে কবিতার আত্মনের কোনও বৌদ্ধিক বিনিময় সম্ভব নয়।
অন্যদিকে, মৃদুলের কবিতায় অনস্বীকার্যভাবে উত্তাল সত্তরের ছায়া। একধরনের রাজনৈতিক পৌরুষের ছবি আমরা পেলাম এই কবিতায় তাই। যে পৌরুষ ভেঙে দিতে চায় স্থিতিস্থাপকতাকে। সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখে। তাই সে জঙ্গী। তাই সে দস্যু। কিন্তু, সেই সমাজবদলের স্বপ্নের অঙ্গ হিসেবে আমরা পেলাম না কোন পরিবর্তিত নারী-প্রতিমূর্তি। বরং পেলাম সেই চিরাচরিত “বউ”। পেলাম সেই চিরাচরিত গার্হস্থ্যতা-মধ্যস্থ বিনম্র নারী প্রতিমূর্তি। যার বিপ্লবিয়ানা বিপ্লবীর ক্ষতে প্রলেপ লাগিয়ে শেষ। তার সাথে সাথে পেলাম পুরুষ ভ্যানগার্ডের এক বিচিত্র চিত্রায়ন। ঠিক যেমনভাবে মধ্যবিত্ত ভ্যানগার্ড পুরুষ শ্রমিক-কৃষককে বিপ্লব চেনাবে, মধ্যবিত্ত নারীকে সে চেনাবে তারা। তারা, আকাশ এখানে এল পৃথিবীর বিশালত্বের প্রতীকী প্রতিভূ হয়ে। নারী যেহেতু গৃহপালিত — থুড়ি — গৃহবন্দী জীব, তাই তাকে তারা চেনানোর দায়িত্ব ভ্যানগার্ড পুরুষটির। স্বীকার করতেই হবে, এই একটি ছোট্ট রূপকল্পের মধ্য দিয়ে মৃদুল তাঁর কবিতায় এনে বসালেন বাহির-অন্দর নিয়ে বহু আলোচিত লিঙ্গায়িত দ্বৈততা। বিবাহ এখানে তাই তার ভ্যানগার্ড পরিচিতি আরো দৃঢ় করার ক্ষেত্র। মেয়েটি নীরব। একতাল নরম কাদা যেন।
খুব স্পষ্ট করে বলতে গেলে, এখান থেকেই শুরু হয় বাংলা কবিতার প্রতি আমার এক ধরনের বিচ্ছিন্নতাবোধ। এলিয়েনেশন। মানে, সুনীলকে প্রত্যাখ্যান করতে বেশি খড়কুটো পোড়াতে হয়নি আমায়। সুনীল মানে আনন্দবাজারীয় ঢ্যামনামো-হেজিমনি। সুনীল মানে কবিতা-ডন। শুনেছি বটে সুনীলেরও ছিল ছোট পত্রিকা অতীত। তবে, সেসব তো কবেই চুকেবুকে গেছে। যতদিনে আমি বাংলা সাহিত্যের মনোযোগী পাঠক — গল্পের বই গেলা থেকে উত্তীর্ণ হয়ে সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পড়ছি — ততদিনে সেসবের লেশমাত্রও নেই।
কিন্ত, মৃদুল? মৃদুল তো “আমাদের” কবি। ছোট পত্রিকার কবি। বিকল্প সাহিত্য পরিসরের কবি। যার “জলপাই কাঠের এসরাজ” কবিতার বইটি আমরা অনেকেই একসময়ে গভীর মনোযোগ সহকারে পড়েছি। তবে? তবে ব্যাপারটা দাঁড়াল অনেকটা এইরকম — আনন্দবাজার থেকে ছোট পত্রিকা, এই একটা জায়গার বড়ো মিল। সেই জায়গাটির নাম হল লিঙ্গ-রাজনীতি। সেই জায়গাটির নাম হল নারী-বৈষয়িকতার রূপায়ন। সেই ধারাবাহিকতায় আমার কাছে দুটিমাত্র পথ খোলা আছে। একটি হল মুণ্ডহীন নারী। অথবা, টুলটুল-বুলটুল হাত-ধরে-নিয়ে-চলো-সখা-মার্কা প্রেমিকা। কি কেলো!

আমরা যারা নয়ের দশকে বেড়ে উঠেছি, তাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব ছিল “বেণীমাধব” উপাখ্যান থেকে মুক্তি পাওয়া। গলা কাঁপিয়ে পাড়ায় পাড়ায় আবৃত্তি, ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়ের অতিনাটকীয় বাচিক রূপায়ন, এবং অবশেষে সঙ্গীতশিল্পী লোপামুদ্রা মিত্রের সাঙ্গীতিক রূপায়নে “বেণীমাধব” হয়ে উঠল ঘরোয়া একটি নাম। চাপা পড়ে গেল এই প্রচারের তলায় একটি ছোট তথ্য। “বেণীমাধব” কবিতাটির নাম নয়। বেণীমাধব কবিতা অন্ত্যস্থ একটি চরিত্র। কবিতাটির নাম “মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়।” কবিতাটি অনেকটি এইরকম:
“বেণীমাধব, বেণীমাধব, তোমার বাড়ি যাবো
বেণীমাধব, তুমি কি আর আমার কথা ভাবো?
বেণীমাধব, মোহনবাঁশি তমাল তরুমূলে
বাজিয়েছিলে, আমি তখন মালতী ইস্কুলে
ডেস্কে বসে অঙ্ক করি, ছোট্ট ক্লাসঘর
বাইরে দিদিমণির পাশে দিদিমণির বর
আমি তখন নবম শ্রেণী, আমি তখন শাড়ি
আলাপ হলো, বেণীমাধব, সুলেখাদের বাড়ি
বেণীমাধব, বেণীমাধব, লেখাপড়ায় ভালো
শহর থেকে বেড়াতে এলে, আমার রঙ কালো
তোমায় দেখে এক দৌড়ে পালিয়ে গেছি ঘরে
বেণীমাধব, আমার বাবা দোকানে কাজ করে
কুঞ্জে অলি গুঞ্জে তবু, ফুটেছে মঞ্জরী
সন্ধেবেলা পড়তে বসে অঙ্কে ভুল করি
আমি তখন নবম শ্রেণী, আমি তখন ষোল
ব্রীজের ধারে, বেণীমাধব, লুকিয়ে দেখা হলো
বেণীমাধব, বেণীমাধব, এতদিনের পরে
সত্যি বলো, সে সব কথা এখনো মনে পড়ে?
সে সব কথা বলেছো তুমি তোমার প্রেমিকাকে?
আমি কেবল একটি দিন তোমার পাশে তাকে
দেখেছিলাম আলোর নীচে; অপূর্ব সে আলো!
স্বীকার করি, দুজনকেই মানিয়েছিল ভালো
জুড়িয়ে দিলো চোখ আমার, পুড়িয়ে দিলো চোখ
বাড়িতে এসে বলেছিলাম, ওদের ভালো হোক।
রাতে এখন ঘুমোতে যাই একতলার ঘরে
মেঝের উপর বিছানা পাতা, জ্যো‍‍‌ৎস্না এসে পড়ে
আমার পরে যে বোন ছিলো চোরাপথের বাঁকে
মিলিয়ে গেছে, জানি না আজ কার সঙ্গে থাকে
আজ জুটেছে, কাল কী হবে? – কালের ঘরে শনি
আমি এখন এই পাড়ার সেলাই দিদিমণি
তবু আগুন, বেণীমাধব, আগুন জ্বলে কই?
কেমন হবে, আমিও যদি নষ্ট মেয়ে হই?”
খেয়াল করুন, আবারও, কবিতাটির নাম “মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়”। কোথাও যেন নামটা শুধু পড়লে একটা আশা তৈরি হয়। কবিতাটিতে বোধহয় পাওয়া যাবে মেয়েদের শিক্ষাজগতের একটি ছবি। একটি অন্য নারী বৈষয়িকতার কাহিনী। যেমন ধরুন, কবিতাটিতে “ছোট্ট ক্লাসঘর”-এর অনুষঙ্গ যখনি এল, তখনি আমরা পেলাম একধরনের শ্রেণীজগত। মফঃস্বলের সরকারি মেয়েদের স্কুল, অভাব-অনটন যেখানে নিত্যদিনের সঙ্গী। আমরা — বা বলা ভালো, আমি — আশ্বান্বিত হলাম। পাব কি আমরা তবে নিম্নবিত্ত মেয়েদের শিক্ষিত হয়ে ওঠার লড়াইয়ের একটি প্রতিচ্ছবি?
কিন্তু তেমনটি হল না। তার বদলে জানলাম আমরা, যে কবিতার কথক মেয়েটি দেখে দিদিমণির পাশে দিদিমণির বর। অর্থাৎ, পড়াশুনোর প্রথাগত শিক্ষার বাইরেও স্কুল হয়ে উঠল আরো একটি প্রথাবহির্ভূত শিক্ষার জগত। সেই শিক্ষার জগতে কিশোরী মেয়েরা নিজেদের থেকে আরেকটু বড় মেয়েদের কাছ থেকে জীবন-সম্পর্কিত পাঠ আহরণ করে। বড় মেয়েদের ছাঁচে ঢেলে নিজেদের গড়তে শেখে। যাকে ইংরেজীতে অনেকেই বলে থাকেন রোল মডেল। এখানেও কবিতাটির মেয়েটির কাছে দিদিমণি হাজির রোল মডেল স্বরূপ। কিন্তু, জয়ের কবিতার দিদিমণি তাঁর ছাত্রীদের পড়া দেখিয়ে দেন না, গল্পের বই ধার দেন না। আরো পড়াশুনো করতে অনুপ্রাণিত করেন না। অদ্ভুত রকমের শূন্যতা রয়েছে এই ছাত্রী-শিক্ষক সম্পর্কটির মধ্যে। আরো একটু বিশদে ভাবলে যেটা দেখা যাবে তা হল, কবিতার দিদিমণি আর কবিতার ছাত্রীর মধ্যে কোনও বাক্য বিনিময়ই হয় না। যা হয়, তা হল এক ধরনের দৃষ্টি উৎক্ষেপণ। মেয়েটি দেখে জানলা দিয়ে দিদিমণিকে। কিন্তু, কী দেখে? দিদিমণির দৃঢ়, সুঠাম চলার ভঙ্গী? না। যাতায়াতের পথে হঠাৎ থেমে বইয়ের স্টলে দাঁড়িয়ে দিদিমণির পত্রিকা নেড়েচেড়ে দেখা? না। নিদেনপক্ষে, দিদিমণির পোশাক-আশাক? না, তাও না। দেখে দিদিমণির বিবাহিত স্বরূপ। এই বিবাহিতার ভূমিকা ছাড়া জয়ের কবিতার দিদিমণির কিছুই দেওয়ার নেই তাঁর ছাত্রীকে। এবং, এই দেওয়াও নিতান্ত পরোক্ষ। তো যাইহোক, এই পরোক্ষ, বাক্যবিহীন দেওয়ানেওয়ার মধ্য দিয়ে জয় মেয়েদের শিক্ষাক্ষেত্রকে হাজির করেন বড়ই প্রকট একটি যৌনায়িত ক্ষেত্র হিসাবে।
তো, দিদিমণির পাশে দিদিমণির বরকে দেখা যদি হয় কবিতাটির আত্মনের পরোক্ষ যৌনশিক্ষা থুড়ি, বিষমকামী বিবাহের শিক্ষা — তবে, বেণীমাধব হল সেই পরোক্ষ শিক্ষার প্রয়োগক্ষেত্র। একধরনের রিহার্সাল যাকে বলা যেতে পারে। শহুরে বেণীমাধব, লেখাপড়ায় ভালো বেণীমাধব, কবিতার কালো, অতীব নিম্নবিত্ত মেয়েটির উপরে ওঠার সিঁড়ি। কিন্তু, দুইয়ে দুইয়ে চার ঠিক হয় না। মেয়েটির সাথে বেণীমাধবের সম্পর্ক ওই হাল্কা রোম্যান্সেই শেষ। বদলে, বেণীমাধবের জোটে “আলোর নীচে অপূর্ব সে আলো” প্রেমিকা। বলা যায়, সেই প্রেমিকা এই কবিতায় শ্রেণী-স্থিতাবস্থার প্রতীক। অন্যদিকে, যে চিত্রটি কবিতাটি আমাদের সামনে হাজির করে তা হল, একটি অসমাপ্ত যৌনশিক্ষার। সেই সমাপ্তিহীনতায় আছে আমাদের পরিচিত একাধিক চেনা গল্পকে একই সুতোয় বেঁধে রাখে যে সুতোটি, যার নাম বাহারি সেন্টিমেন্টালিটি। এমনি নাম আরও প্যাঁচপেঁচে।
সেই সেন্টিমেন্টালিটির হাত ধরে, অবিবাহিত নিম্নবিত্ত মেয়েটি আমাদের সকলের সমবেদনাপ্রার্থী। তাই হোক না সে সেলাই দিদিমণি। হোক না সে নিজের গতর খাটিয়ে খাওয়া মানুষ। আমরা সেসব দিকে তাকাবো না। আমরা শুধু দেখবো ও দেখাবো, কেমন করে বিয়ে না হওয়াতে মেয়েটির একদম যায় যায় অবস্থা। আহা রে, বেচারী। যাই হোক, এই বেচারী-সমবেদনা সেন্টিমেন্টালিটির আখ্যানের উলুবন একটু ফাঁক করে যদি অন্যত্র চোখ রাখি, তাহলে দেখবো যে, জয়ের এই কবিতায় ছোট্ট করে উঁকি দেয় দুটি জিনিস। এক, কিশোরী মেয়েদের শিক্ষাগত বৈষয়িকতা। দুই, নিম্নবিত্ত মেয়েদের অর্থনৈতিক বৈষয়িকতা। এই দুটি জিনিসই হতে পারত এই কবিতাটির মেরুদণ্ড। বাংলাসাহিত্যে বিশেষত বাংলা কবিতায় তৈরি হতে পারত নতুন একটি ভাষা। কিন্তু, তেমনটি ঠিক হল না। তার বদলে আমরা দেখলাম সেই একই চর্বিতচর্বণ। শিক্ষাগত বৈষয়িকতা ও অর্থনৈতিক বৈষয়িকতাকে ছাপিয়ে উঠল একধরনের প্রথাগত, আধিপত্যকারী বিষমকামী বিবাহকেন্দ্রিক যৌনবৈষয়িকতার উপাখ্যান।
সেই উপাখ্যান থেকে বিলকুল হারিয়ে গেল মেয়েটির প্রতিরোধের কাহিনী, সম্ভাবনা। হারিয়ে গেল তার অর্থনৈতিক স্বাধীনতার লড়াই। আমরা, কবিতাটির পাঠকরা, তাকে চিনতে শিখলাম দয়ার পাত্রী হিসেবে। কবি আমাদের সেইভাবেই চিনতে শেখালেন। অর্থাৎ, সুনীলেরই আগ্রাসী পিতৃতান্ত্রিক পৌরুষের বদলে জয় গড়লেন একধরনের বদান্যতাধর্মী পিতৃতন্ত্রের নন্দনতত্ত্ব বা বেনিভোলেন্ট প্যাট্রিয়ার্কি। আমরা মধ্যবিত্ত বাঙালি পাঠক সেই বদান্যতা চেটেপুটে খেলাম। কারণ, লিঙ্গ-প্রশ্নে ওইটুকুই আমাদের দৌড়। তো, সেই বদান্যতাধর্মী পিতৃতন্ত্রে মেয়েদের দৌড় যৌনতা থেকে গার্হস্থ্যে, গার্হস্থ্য থেকে যৌনতায়। তাই, “মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়” কবিতাটির আত্মন শহুরে ছেলের সাথে প্রেম-প্রেম খেলার উত্তেজনাকে দেখেছিল বিবাহের পূর্বশর্ত হিসেবে। অর্থাৎ, যৌনতায় ভর করে সে পৌঁছাতে চেয়েছিল নিটোল গার্হস্থ্যের দরজায়। আর, সেই গার্হস্থ্যের দরজা যখন বন্ধ হল, সে আবার ফিরল যৌনতার কাছে। অতএব, বেণীমাধবের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া হুমকি — “কেমন হবে, আমিও যদি নষ্ট মেয়ে হই!”
এমনিতে দেখতে গেলে, এর থেকেও প্যাঁচপেঁচে মধ্যবিত্ত যৌনবোধে সুড়সুড়ি দেওয়া লাইন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তবে, এই হুমকিও ঠিক তার যথাযথ পরিপূর্ণতায় কবিতাটিতে পৌছল না। মানে, আমরা “নষ্ট মেয়ে”টিকে কখনও দেখলাম না কবিতাটিতে। দেখলাম না, একটি তথাকথিত ঘরোয়া মেয়ের “নষ্ট মেয়ে”তে পরিবর্তন। দেখলাম না সেই যৌন বিদ্রোহের স্বরূপ। সে বিদ্রোহের আভাস কবিতাটিতে এল একটি বিলম্বিত মুহূর্ত হিসেবে। বলা যায়, চিরতরে বিলম্বিত। বিলম্বিত এবং আনুমানিক।
যেটা দাঁড়াল কবিতাটিতে তা হল, মেয়েটির গার্হস্থ্যও নেই, যৌনতাও নেই। অনেকটা যেন সুনীলের মুণ্ডহীন নারীর মতন। কিন্তু, গার্হস্থ্য তো আছে মেয়েটির। তার একার সংসার। কিন্তু ধুর! সে আবার সংসার নাকি! স্বামী, সন্তানবিহীন গার্হস্থ্যতা আবার হয় নাকি? আমরাও পাঠক হিসেবে এই বক্তব্য মেনে নিলাম। কারণ, এটাই তো সামাজিকভাবে আধিপত্যকারী বয়ান। তাই না? আধিপত্যকারী এবং সর্বজনীন। ইউনিভার্সালও।
তবে, জয় গোস্বামী জনপ্রিয় লেখক! আনন্দবাজারীয় কবিতাচত্বরই তাঁর কাব্য পরিক্রমণের মূল স্থান। সম্প্রতি তো পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসকদলেরও অতীব কাছাকাছি বুদ্ধিজীবী বলে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তবে, ওই যে, সুনীল-শক্তির মতো জয়েরও এককালে ছিল ছোট পত্রিকা-অতীত। মানে, জয় হতে পারেন বাংলার একধরনের কবিদের পোস্টার-চাইল্ড। কেমন করে ছোট পত্রিকায় কিছুদিন হাত মকশো করে প্রতিষ্ঠানের পাদদেশে মাথা নোয়াতে হয়। ছোট পত্রিকা এখানে প্রতিরোধী বা ব্যতিক্রমী সাহিত্যের ধারকবাহক নয়। ছোট পত্রিকা এখানে ওপরে ওঠার সিঁড়ি। তো যাই হোক, তর্কের খাতিরে মেনেই নিলাম না হয়, যে এহেন জয়কে ওই আধিপত্যকারী বয়ান, মধ্যবিত্ত সেন্টিমেন্টালিটি ইত্যাদিতে সুড়সুড়ি দিয়েই লেখালিখি করতে হবে। কিন্তু প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়?
আসুন প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই কবিতাটি একটু নেড়েচেড়ে দেখি:
“ও কেন জ্বালায় ঘরে অসভ্য আলো, মৃদু, লাল
আমি কি বুঝি না ভাবো কিছুই বুঝি না ভাবো
কেন ওর অন্তর্বাসগুলি এমন রঙিন হল
কেন ও উদ্ধতভাবে সেগুলিকে মেলে দেয় বারান্দার তারে
আমাকেও শ্যামলদা চিঠি দেয়
উত্তরের অপেক্ষা ইস্কুলফেরতা পথে দাঁড়ায় প্রত্যহ
আমি তাকে কী লিখবো
আমারও তো বয়েস হয়েছে, ভূগোলদি বকেন তবু
কামচাটকা উপদ্বীপ কোথায় তা
আমি কেন জানতে যাবো? আমার কী?
আমি জানি ভূগোলদির বাচ্চা হবে, ব্যাস
পাঠ্যবইয়ের কিছু মাথায় ঢোকে না আজ
দুদিদিরই বিয়ে বাকি আমার তো ছার…
পড়তে বসলেই তবু দেখতে পাই সামনের বাড়ির বৌ
ছোট্ট ঘরে জ্বেলে দিচ্ছে অসভ্য আলো
পাখা ঘুরছে, পর্দা দুলছে কিছু
বারান্দায় উড়ছে তার অন্তরের রঙিন নিশান
শ্যামলদা তোমাকে আমি কী লিখবো উত্তর
চিতচোর দেখব না আর যাব না ধর্মতলা খাব না মোগলাই
বরং এক্ষুনি তুমি চাকরি নাও। কিচ্ছু শুনবো না
এক্ষুনি আমাকে দাও ওই ঘর ওই আলো ওই সব
বারান্দার তারে।”
স্বীকার করি, কবিতাটিতে জয়ের কবিতার তুলনায়, শারীরিক যৌনচেতনা অনেক বেশি প্রত্যক্ষভাবে হাজির। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, প্রসূন কবিতাটি লিখেছেন জয়ের ব্যবহার করা একাধিক লক্ষণার মধ্য দিয়ে। ইংরেজীতে সাহিত্য সমালোচকেরা যাকে বলে থাকেন ট্রোপ। অতএব, এখানেও এল সেই মেয়েদের স্কুল, দিদিমণি। দিদিমণির থেকে গ্রহণ করা পরোক্ষ যৌন পারিবারিক শিক্ষা। সেই শিক্ষাকে জয়ের তুলনায় প্রসূন করে তুললেন আরো যৌনায়িত। আরো শরীরনির্ভর। তাই, প্রসূনের কবিতার দিদিমণি দৃশ্যতই সন্তানসম্ভবা। মানে, কবিতাটির আত্মনের ঘাড়ে চাপল আর গূঢ় একটি দায়িত্ব। শুধু বিয়ে করে শান্তি নেই। একটা-দুটো বাচ্চা না বিয়োলে আবার বিয়ে কী? ঠিকই তো! একথাই তো আমাকে সমাজও বলে। বিবাহ-মাতৃত্ব এই দুইয়ের সমন্বয়েই না তৈরি হয় আদর্শ বিষমকামী নারীত্বের সংজ্ঞা? কাজেই, স্কুল বিষয়টির আরো, আরো যৌনায়িত চিত্র আমরা পেলাম প্রসূনের কবিতায়।
তার সাথে পেলাম আরো একটি জিনিস। কবিতার আত্মন মেয়েটির শিক্ষাগত বৈষয়িকতার এক প্রলম্বিত বিবরণ। যেখানে জয় “ডেস্কে বসে অঙ্কে ভুল করি”-র সংক্ষিপ্ত লাইন ও মুহূর্তটির মধ্য দিয়ে প্রথাগত পড়াশোনার প্রতি মেয়েটির বিবিক্ততাকে তুলে ধরেছিলেন, প্রসূন সেখানে এই মুহূর্তটিকে আরো একটু টেনে লম্বা করালেন। মেয়েটিকে দিয়ে বলালেন, “আমারও তো বয়েস হয়েছে,/ ভূগোলদি বকেন তবু/ কামচাটকা উপদ্বীপ কোথায় তা/ আমি কেন জানতে যাবো? আমার কী?/ আমি জানি ভূগোলদির বাচ্চা হবে, ব্যাস/ পাঠ্যবইয়ের কিছু মাথায় ঢোকে না আজ/ দুদিদিরই বিয়ে বাকি আমার তো ছার…” নিঃসন্দেহে, পৃথিবীর তাবড় তাবড় ছাত্র আন্দোলন ঘটেছে, ওই পাঠ্যবইতে কী আছে, তাতে আমার কী, আমি কেন জানতে যাবো জাতীয় প্রশ্নের উপর দাঁড়িয়ে। কাজেই, এই প্রশ্নবোধের মধ্যে আছে একধরনের বিদ্রোহ, একথা বলতেই পারেন এক শ্রেণীর পাঠক। কিন্তু, সেই বিদ্রোহ করে মেয়েটি রাস্তায় বেরিয়ে আসে না, বিকল্প জ্ঞানচর্চার পথ খোঁজে না। সে চায় বিবাহ, বিবাহমোড়া সামাজিক বৈধতায় পরিপূর্ণ ঘরোয়া যৌনতা। অর্থাৎ, পাঠ্যবইয়ের থেকেও ছোট্ট একটি জগত। আরো একবার, আমার কাছে প্রতিপন্ন হয় বাংলা কবিতায় আমার মত মেয়ের কোন জায়গা নেই।
কিন্তু এই মতাদর্শগত দারিদ্র্যের উপর দাঁড়িয়েও কবিতাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্যকে তুলে ধরতে সক্ষম হয়। সমাজতাত্ত্বিক সত্য। তা হল, যৌনতা বিষয়টির মধ্যে আপনাআপনি কোন প্রতিবাদের বীজ বা radicality নেই, ছিল না। থাকে না। বরং, যৌনতা ও গার্হস্থ্যতা বসত করে একই ধারাবাহিকতায়! যে ধারাবাহিকতাকে আমি বলব, পিতৃতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা। তো কবিতাটিতে আমরা দেখলাম, কবিতার আত্মন মেয়েটি নিবিড়ভাবে লক্ষ্য করে পাশের বাড়ির বউটিকে। চেয়ে চেয়ে দেখে তার ঘরের মৃদু, লাল “অসভ্য” আলো। বারান্দায় মেলে দেওয়া রঙিন অন্তর্বাস। সে জানে, এই যৌন ঔদ্ধত্যের পেছনে আছে বউটির বিবাহিতার অবস্থান। স্ট্যাটাস। একধরনের সমীকরণ তৈরি হল তাই এখানে। বিবাহের সাথে যৌনতার। যৌনতার সাথে বিবাহের। সেই সমীকরণটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে কবিতার কিশোরীর বড় হওয়ার গল্প। ইংরেজীতে যাকে অনেক সাহিত্য সমালোচকই বলে থাকেন, কামিং অফ এজ মোমেন্ট। কামিং অফ এজ স্টোরি। তো, মেয়েটি কবিতার পাতায়, কবিতার লাইনগুলির মধ্যে এই বিবাহ ও যৌনতা সমীকরণকে বুঝতে শেখে। এও একধরনের পরোক্ষ, সামাজিক শিক্ষা। যে সামাজিক শিক্ষা মেয়েটিকে শেখায়, বিবাহ ছাড়া তার আর কোন পথ নেই।
এই পরোক্ষ শিক্ষার জগত, সেখানে মেয়েটি অবশ্য মেধাবী ছাত্রী। তাই, সে কবিতায় জানান দেয়, তারও আছে এক প্রেমিক। শ্যামলদা। মাঝেমধ্যে চিঠি চালাচালি হয় তাদের মধ্যে। শ্যামলদাও যেমন আছে, তেমনি আছে কবিতার মেয়েটির দুই অবিবাহিতা দিদি। কাজেই, এই যে প্রেম – চিঠি চালাচালি, মোগলাই খেতে যাওয়ার চুদুরবুদুর — এসবেরই আছে আরেকটি অতীব বাস্তবিক-প্রায়োগিক দিক। তা হল, বিবাহ। ওই প্রেমপ্রেম খেলা, সুড়সুড়ি-খুনসুটি এসবের হাত ধরেই না মিলবে মেয়েলি জীবনের মোক্ষ? অর্থাৎ বিবাহ।
তো, পাঠ্যবইয়ের ভূগোল জানুক না জানুক, মেয়েটির কিন্তু ভালোই জানা আছে চুদুরবুদুরের সামাজিক ভূগোল। এবং সেই সামাজিক ভূগোলের জ্ঞানই তাকে জানায়, যৌনতার পোঁ ধরে একদিন সে পৌঁছে যাবে গার্হস্থ্যে। কবিতাশেষে শ্যামলদাকে তাই তার হুমকি — শীঘ্র বিয়ে নামক চীজটির উপহার না মিললে প্রত্যাহিত হবে যাবতীয় যৌন চুদুরবুদুর।
এই মেয়েদের আমরা চিনি। এবং, এও বলতে বাধা নেই যে, বিবাহ একটি অতীব জটিল জিনিস। যেমন ধরুন, আমার পরিচিত বহু মেয়ের কাছে বিবাহ ছিল একটা পরিত্রাণ খোঁজার পথ। বাবার বাড়ির বিধিনিষেধ পিতৃতান্ত্রিকতার পরিবেশ থেকে। একধরনের পলায়নবৃত্তি আর কী! তো, সেই পালানোর পথ নির্মাণ করতে গিয়ে তারা যৌবনে সজোরে প্রেম করেছে। প্রেমিককূলের সাথে বিস্তর ন্যাকামো করেছে। তাদের প্রেমিকরাও অনেকটা মহৎ কোনও উদ্ধারকার্যে বসছি, এইভাবে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছে। আঁতেল, হাফ-আঁতেল, বিপ্লবী, সেমি-বিপ্লবী, সাহিত্যপ্রেমী, কবিতাপ্রেমী কারুর ক্ষেত্রেই খুব এই নিয়মের অন্যথা হয়নি। আবার, কারুর কারুর ক্ষেত্রে, যাদের বাড়ি কিনা তুলনামূলক “লিবারাল”, তাদের কাছেও দাঁড়িয়েছে ওই বিয়েই সব। বিয়ে অর্থাৎ একটি নিশ্চিন্ত জীবন, সামাজিকভাবে প্রথাসিদ্ধ যৌনতা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুরক্ষা। তো, এই যে প্রেম প্রেম করে চিল্লানো বাঙালি, তাদের কবিতা, কবিতার নারী যৌনতা সব ওই বিয়েতে গিয়ে শেষ। কিন্তু বাদ পড়ে গেছে যে এই চিত্র থেকে একাধিক বাস্তবতা।
মানে ওই বিয়ের পিঁড়িতে বসে পিতৃতন্ত্রের বিধিনিষেধের হাত থেকে বাঁচা যায় কী? সামাজিক জ্ঞান বলে, যায় না। তবে? তবে আবার কী? পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে, নিজের বাবা, জেঠা, কাকা, দাদা, মা, কাকীমা, দিদি, পিসিমা — মায় প্রেমিকের বিরুদ্ধে পর্যন্ত — বিদ্রোহ করতে হয়। আমার নিজের অভিজ্ঞতা তো তাই বলে। আমার পরিচিতা বা বান্ধবীদের জীবনেও অন্যথা ঘটেনি। তো, সেই বিদ্রোহের জটিল চিত্রায়ন বড়ই কম এল বাংলা কবিতাতে।
অবশ্য, একধরনের মেয়েদের বিদ্রোহের কথা বাংলা সাহিত্যে, বাংলা গানে, বাঙালি আঁতেল, আধা-আঁতেলদের প্রাত্যহিক কথোপকথনে বারবার এলো। তা হল, বাড়ির অমতে প্রেম এবং বিবাহ। অস্বীকার করব না, বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত, বাংলার মত একটি সমাজে যেখানে সামন্ততন্ত্র, বিকৃত পুঁজিবাদ, ভোগবাদ একে অপরের সাথে লেপ্টে থেকে নির্মাণ করে এক বিশেষ ধরনের পিতৃতন্ত্র, সেখানে এই প্রেমজনিত বিদ্রোহের কথা লেখা গুরুত্বপূর্ণ বই কী! কারণ, এই বিদ্রোহের ভিতরে থাকে মেয়েদের স্বতন্ত্র যৌন বৈষয়িকতার ঘোষণা, যৌন ব্যক্তিবোধের ঘোষণা। তার সাথে সাথে থাকে — অনেকাংশেই পরোক্ষভাবে, বকলমে – একটি বোধ। পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটির চরিত্র মূলত নিপীড়নমূলক। মেয়েদের যৌনতার উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ রাখার মধ্য দিয়েই সে জাহির করে নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্বকে।
কিন্তু, তারপর? মানে, ওই পরিবার বা পিতৃব্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে মেয়েটি তো সেই ঢুকবে আরেকটি সংসারের জাঁতাকলেই। কাজেই, এই বাড়ির অমতে প্রেম বা বিবাহের মধ্য দিয়ে পরিবার বা বিবাহের বিরুদ্ধে কোনও মূলগত বিদ্রোহের বাতাবরণ তৈরি করা গেল কী? গেল না তো? আমি বলব, এই যে গেল না, এই জন্যই এই ধারার বিদ্রোহ নিয়ে এত কচলাকচলি হল বাংলা সাহিত্যে। কারণ, এই প্রেমজনিত বিদ্রোহ বিষয়টি এমনি যে, এখানে কোন ধরনের পিতৃতন্ত্র, পরিবার, বিবাহ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানগুলির মূলগত রাজনৈতিক কাটাছেঁড়া না করেও, দিব্যি মেয়েটির বিদ্রোহকে আত্মসাৎ করা যায়। কাজেই, বাংলা সাহিত্য ও সিনেমার তাবড় তাবড় নির্মাতারা যখন মেয়েদের গল্প শোনালেন, তখন সে বিদ্রোহ প্রেমের থেকে বেশিদূর এগোল না। তাই, বাংলা গল্পকবিতাসিনেমার বিদ্রোহী মেয়ের বিদ্রোহ নিজের পছন্দমতো বিয়ে করাতে গিয়েই হল শেষ।
কিন্তু জয় বা প্রসূন কারুর কবিতাতেই আমরা সেই বিদ্রোহটুকু — আংশিক বিদ্রোহ, খন্ডিত বিদ্রোহ, সীমিত বিদ্রোহ — তাও পেলাম না। জয়ের কবিতায় অবশ্য পেলাম, অবিবাহিত মেয়েটির অর্থনৈতিক সংগ্রামের ছবি। অর্থনৈতিক স্বাধিকারের গর্ববোধরহিত অর্থনৈতিক সংগ্রামের ছবি। পরোক্ষে পাঠককে বলা হল, দেখুন দেখি, বিয়ে না হলে এমনটিই তো হয়! প্রায় সাবধানবাণীর মতো। আর, প্রসূনের কবিতায় মেয়েটি, তার যৌনতাকে করে তুলল বিয়ের বাজারে দরকষাকষির হাতিয়ার। বিয়ে করে যা করার করো, বাপু। বিয়ে বিনে মধু আর মিলিবেক নাই। মানে, একটু বারান্দায় মেলে দেওয়া রঙিন অন্তর্বাসে ফানুস উড়িয়ে সেই পুরনো বস্তাপচা বিবাহভিত্তিক যৌন নৈতিকতার কচকচানি। তার সাথে আমার আরও কি জানলাম? প্রসূনের কবিতার মেয়েটির দুই দিদি এখনও অনূঢ়া। কাজেই, প্রেম প্রেম খেলার দুইয়ে দুইয়ে চার মিললে এই মেয়েটির কপালে বিয়ে আছে, নচেৎ নেই। মানে, এই দুটি কবিতাতেই বিবাহ বিষয়টি হয়ে উঠল মেয়েদের জীবিকা-নির্ধারণের উপায়।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এই মেয়েরা তো আছে আমাদের সমাজে। আমাদের পরিবারে, আমাদের পাড়ায়। তো, তাদের নিয়ে লিখলে সমস্যা কোথায়? না, একভাবে দেখতে গেলে সমস্যা নেই। অন্যদিকে, আমাদের সমাজে, পরিবারে, পাড়ায়, স্কুলে, কলেজে, খালি এই মেয়েরাই আছে নাকি? আছে তো সেই মেয়েরাও যারা জীবনটাকে বিবাহ ও সংসারের জাঁতাকলের বাইরে বেরিয়েও দেখতে চায়। তাহলে বাংলা কবিতায় তারা নেই কেন? প্রথমত, এই দৃশ্যমানতার অভাবকে যদি আমরা শুধুই সামাজিক বাস্তবতার নিরিখে দেখি, তাহলে ঠিক হবে না। বিষয়টি বরং দেখতে হবে একটি মতাদর্শগত নির্মাণের প্রেক্ষাপট থেকে। সেখানে দাঁড়িয়ে, বিষয়টি এমন নয় যে জয় বা প্রসূন অন্যধারার মেয়েদের বাস্তব অস্তিত্বের কথা জানেন না। আমি যখন জানি, তখন তাঁরাও জানেন। এই মেয়েদের তাঁরাও চেনেন। কিন্তু, যখন তাঁরা সযত্নে তাদের পাশ কাটিয়ে যান নিজেদের লেখায়, পাশ কাটাতেই থাকেন, কাটাতেই থাকেন, তখন সেই পাশ কাটানোটাই হয়ে দাঁড়ায় একটি বিশেষ মতাদর্শগত নিরিখ। মতাদর্শগত নির্মাণ। এই মতাদর্শগত নির্মাণই বাংলা কবিতার আধিপত্যকারী লিঙ্গ রাজনীতি। লিঙ্গায়িত শ্রেণী-রাজনীতিও বটে।
তো, এই কবিতাগুলির মধ্যে দিয়ে বাংলার কবিরা সামগ্রিকভাবে লিখলেন একধরনের বিবাহগাথা। সাহিত্য-সমালোচকেরা একে বলেন ম্যারেজ-প্লট। সাহিত্যের ইতিহাসে এই ম্যারেজ প্লটের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ, বিবাহ মানে তো শুধু বিবাহ নয়, বিবাহ মানে সামাজিক স্থিতিস্থাপকতা রক্ষণ। বিবাহ মানে শ্রেণী, বর্ণ, ধর্ম, জাতপাত ইত্যাদি নির্মিত সামাজিক স্থিতিস্থাপকতারক্ষণ। বিবাহ মানে জাতীয় রূপক। এবং, অবশ্যই বিবাহ মানে পুঁজি রাষ্ট্র ব্যক্তিগত সম্পত্তির লিঙ্গায়িত ধারাবাহিকতা। এবার খেয়াল করে দেখুন, না প্রসূনের কবিতায়, না জয়ের কবিতায় আছে কোনও বাস্তবিক বিবাহ। কিন্তু, এই বাস্তবিক বিবাহ না থাকলেও, বিবাহ-বিবাহ গন্ধ থেকে মুক্তি মেলে না পাঠকের।
কাজেই, এই কবিতাদুটির যে মূলগত মতাদর্শ, তা খুব সহজ নয়। সরলরৈখিক তো নয়ই। যেমন ধরুন, এই যে বিবাহ বিষয়টি কবিতার মধ্যে সম্পন্ন হয় না, সেখানে কি একধরনের উচাটনভাব দেখতে পাচ্ছে পাঠক? আমি তো পাচ্ছি। কোথায় যেন একটা স্বস্তিবোধের অভাব, আরাম মিলছে না। তো, আমি বলব, এই স্বস্তিবোধের অভাব আগাপাশতলা সামাজিক, রাজনৈতিক। সামাজিক ইতিহাসের দিক থেকে দেখতে গেলে, সত্তর পরবর্তী সময়ে বাংলার মধ্যবিত্ত সমাজে লিঙ্গসম্পর্কের জায়গা থেকে ঘটে গেছে একটি বড় পরিবর্তন। আরো অনেক বেশি সংখ্যায় বাঙালি মেয়েরা লেখালিখির জগতে আসতে শুরু করেছে। বাংলা কবিতাতেও। এই সামাজিক বিকাশের পেছনে বহুধা কারণ রয়েছে। কিন্তু, যেটা লক্ষণীয় তা হল, বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজে এসেছে একধরনের নতুন নারীত্বের বোধ। যে নতুন নারীত্বের বোধের মধ্যে সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব সত্ত্বেও রয়েছে একধরনের মুক্তিকামিতা, একধরনের স্বতন্ত্র মননের বহিঃপ্রকাশ। পুরনো রূপকে, পুরনো ভাষায় এই নারীত্বের সাহিত্যিক প্রকাশ আর সম্ভব নয়। যদিও কেউ কেউ এই বিতর্কও তুলতে পারেন যে, ঊনিশ শতক থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর পাঁচের দশকের ভাষায় ব্যাঞ্জনায় ছিল একধরনের নতুন নারীত্বের সংকট। তবে, সে আলোচনা আরও দীর্ঘায়িত একটি প্রতিফলন। এ লেখা তার জায়গা নয়। তো, এই যে অসম্পূর্ণ বিবাহগাথা, তার মধ্য দিয়ে এই যে নতুন নারীত্বের কাছে পুরনো ভাষার ফেল মেরে যাওয়া, তারই একপ্রকার পরোক্ষ স্বীকৃতি আমরা দেখলাম জয়, প্রসূন ও আরো অনেকের কবিতায়।
কিন্তু, এই স্বীকৃতির সাথে সাথে এও দেখলাম যে, এই সময়ের ধারা নির্বিশেষে কবিদের কবিতায় নারী বৈষয়িকতা আটকে আছে ওই সেই প্রেম-যৌনতা-বিবাহের ত্র্যহস্পর্শে। মানে, যাকে আমি বলছি বিবাহ-বিবাহ গন্ধ আর কী। আরো স্পষ্ট করে বললে, এই বিবাহ-বিবাহ গন্ধের মধ্যে দিয়ে বাংলা কবিতায় এই নতুন নারীত্বের নৈর্ব্যক্তিকরণ ঘটানো হল। তার স্বাতন্ত্র্যের দাঁতনখ কেড়ে নেওয়া হল। ইংরেজিতে যাকে বলে নিউট্রালাইজেশান।
এই নৈর্ব্যক্তিকরণের সাথে সাথে যে সমস্ত প্রক্রিয়া ও সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রসমূহের মধ্য দিয়ে এই নতুন নারীত্ব বাংলার সমাজে এল, তার জটিল চিত্রায়নেরও আর কোন জায়গা রইল না। দায়ও রইল না বাংলা কবিতার দিক থেকে। বাংলা কবিতার একটি বড় জায়গা থেকে তাই মুছে গেল বামপন্থী আন্দোলনের গল্প, বামপন্থী রাজনৈতিক পরিসরের গল্প, যে পরিসরের মধ্য দিয়ে বাংলার মধ্যবিত্ত সমাজে — বহু দ্বিধাদ্বন্দ্ব, পিছুটান, সমস্যা সত্ত্বেও – তৈরি হয়েছিল নতুন নারীত্বের বয়ান। মজার কথা হল এই যে, এই জাতীয় কবিতা লেখা ও প্রকাশনার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বামফ্রন্ট আমল। সেখানেই, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বাড়তে লাগল কবিতা উৎসব, কবিতা সভার সংখ্যা, বাংলা কবিতাও হতে শুরু করল ততোধিক অরাজনৈতিক। না, কবিতার শেষ লাইনে লাল পতাকা আঁকা সরলরৈখিক বাম রূপায়নের কথা বলছি না, বলছি জটিলতর রাজনৈতিক বৈষয়িকতার কথা। বলছি সেই রাজনৈতিক কবিতার কথা, যা সমসময়ের জটিল সমাজতত্ত্বের রূপরেখাকে নান্দনিক ফর্মের মধ্যে দিয়ে হাজির করে, মানুষের প্রাত্যহিক দ্বিধাদ্বন্দ্বে জটিল প্রতিবাদ-প্রতিরোধকে সামনে রেখে। এই যে মুছে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া, তারই রূপক হয়ে বেঁচে রইল প্রেম-যৌনতা-বিবাহের বাইরে দেখতে-ভাবতে অক্ষম বাংলা কবিতার নারী বৈষয়িকতা। যে বৈষয়িকতা প্রেম-যৌনতা-বিবাহ — এই ত্র্যহস্পর্শের বাইরে ভাবতে অপারগ।
কিন্তু, এর পরেও একটা সমস্যা আছে। খোলসা করে বলি, কোন বিশেষ কারণে আমি জয় গোস্বামী ও প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় — এই দুজনের কবিতাকে পাশাপাশি রাখলাম। সম্প্রতি সমালোচক তথা ঐতিহাসিক অনির্বাণ মুখোপাধ্যায় তাঁর বই “উত্তর ঔপনিবেশিক বাংলা কবিতা”-য় এই দুই কবির দুটি কবিতাকে পাশাপাশি রাখলেন। রেখে, জয়কে পিতৃতান্ত্রিক, “মেল গেজ” ছাড়া মেয়েদের জীবনকে দেখতে অক্ষম এসব বলে ব্যাপক তুলোধুনো করলেন। আমি অনির্বাণের জয়ের এই কবিতার পাঠের সাথে মূলগতভাবে একমত। এটা বলতেও আমার কোন দ্বিধা নেই যে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলা কবিতায় এই জাতীয় জটিল ও উৎকৃষ্ট মানের লিঙ্গ মতাদর্শের — বিশেষত পৌরুষের মতাদর্শ সংক্রান্ত আলোচনা আমার চোখে পড়েনি। যদিও, অনান্য বহু ক্ষেত্রে অনির্বাণের সাথে আমার রাজনৈতিক-নান্দনিক বিভেদ প্রভূত।
কিন্তু, সে যাই হোক, এই কবিতাদুটিকে পাশাপাশি রেখে অনির্বাণ জয়কে তুলোধুনো করলেন, এবং প্রসূনকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিলেন। অনির্বাণ লিখলেন, “এই কবিতাটির [অর্থাৎ প্রসূনের কবিতা] সঙ্গে “মালতীবালা…”র পার্থক্য এখানেই যে, এই কবিতাটির কবি ধরতে চেয়েছেন মেয়েদের ‘ব্যক্তিগত সময়মাত্রা’কে, সেই সময়মাত্রা, যেখানে পুরুষতান্ত্রিক গেজ  অনুপস্থিত।” আরও লিখলেন, “এখানে মেয়েটি একান্তভাবেই তার ‘শ্যামলদা’-কে বলে তাড়াতাড়ি চাকরি নিতে, এক ক্লস্ট্রোফোবিক অবস্থান থেকে তার নিজস্ব মুক্তিকে ত্বরান্বিত করতে। ‘মুক্তি’র ধারণাটিও এখানে স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত — “উড়ছে অন্তরের রঙিন নিশান।” প্রসূন এখানে সামাজিক দায়বোধ আওড়াননি। অন্যদিকে এর বিষয়টিকে ‘সমাজ’-এর সামনে ‘তুলে ধরেছেন’ ‘নষ্ট মেয়ে’র কল্প এনে।”
তো, “নারীর ব্যক্তিগত সময়মাত্রা” বিষয়টি কী, আমার ঠিক জানা নেই। সেখানে পুরুষতন্ত্রের চাহনি-চোখরাঙ্গানিবিহীন বেঁচে থাকা কেমন হয়, তাও জানা নেই। মানে, মেয়ে হওয়ার সুবাদে, শারীরিকভাবে আমার কিছু বাস্তবিক প্রয়োজন আছে। যেমন ধরুন, মাসে মাসে আমার গুদ চিরে রক্ত বেরোয়। এবং, সেই যে রক্ত সময়মাত্রা, তার গোটাটাই নিয়ন্ত্রিত হয় পিতৃতন্ত্রের নিয়মে। পুঁজির নিয়মে। আমি একজন নারী হিসেবে যখন বিশেষ শারীরিক গোলযোগ নিয়ে হাজির হই নারীরোগ বিশেষজ্ঞের চেম্বারে, সেখানেও পিতৃতান্ত্রিক পুঁজি বা পুঁজিবাদী পিতৃতন্ত্রের দাপট আমার পেছন ছাড়ে না। মাসিকের তীব্র ব্যথার কথা বললে পুরুষ নারীরোগ বিশেষজ্ঞ আমাকে বলেন, “বিয়ে করে নিন।” এবং একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন, “বাচ্চা হলে কমে যাবে।” মিনসের কল্পনাবুদ্ধিতে বিবাহ ও সন্তানবিহীন নারীজীবনের কথা অভাবনীয়। তো, বিবাহের ইচ্ছে না দাবি ঠিক কোন যুক্তিবোধে মেল গেজ-এর বাইরে হল, এ আমি বুঝলাম না। এ নিয়ে আমি কোনও নতুন কথা বলছি না কিন্তু। একটু ইতিহাস ঘেঁটে দেখুন। দেখবেন, কিভাবে বিজ্ঞান-পুঁজি-সামাজিক-রীতিনীতি-অর্থনীতি সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে “নারীর ব্যক্তিগত সময়মাত্রা।” কাজেই, খুব স্পষ্ট করে বলি, নারীর ব্যক্তিগত সময়মাত্রা বলে কিছু হয় না।
আর, বিয়ের পিঁড়িতে বসতে চেয়ে প্রেমিকের সাথে ইকিরমিকির খেলা? আবারও জিজ্ঞাসা করি, এ আবার কবে থেকে পিতৃতান্ত্রিক চাহনির বাইরে হল? আর, বাবার বাড়ির ক্লস্ট্রোফোবিয়া কাটাতে বিয়ে? এর মধ্যেও পিতৃতন্ত্র বিরোধিতা খুঁজতে হবে নাকি? কি গেরো! বড়জোর বলা যেতে পারে, মেয়েটি একধারার পিতৃতন্ত্র থেকে বেরিয়ে আরেকধারার পিতৃতন্ত্রের নিগড়ে বদ্ধ হল। তো, মেয়েদের লড়াই বা ‘ব্যক্তিগত সময়মাত্রা’র দৌড় এইটুকুই নাকি? যে খালি কোনধরনের পিতৃতন্ত্রের খাঁচায় নিজেকে বন্দী করবে, সেই স্বাধীনতাটুকুই তার আছে? বলতে বাধ্য হচ্ছি, এই যদি হয় অনির্বাণের পিতৃতন্ত্র বিরোধী নারী বৈষয়িকতা বোঝার দৌড়, তাহলে বাংলা সাহিত্য, সাহিত্য সমালোচনা তথা কবিতার কাছে কোনও স্বাধীনচেতা, মুক্তিকামী মেয়ের কিছু চাওয়ার নেই।
কিন্তু, তার পরেও যেটা লক্ষ্যণীয় বিষয়, তা হল, ‘বাংলা কবিতা’ নামক যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রটি, সেখানে পুরুষ কবি ও পুরুষ সমালোচকের মধ্যে কি সুন্দর স্বাক্ষরিত হল একটি অলিখিত চুক্তি! যে ঠিক কতটা সুতো ছাড়া হবে বাংলা কবিতার নারী বৈষয়িকতাকে। সেই গণ্ডী থেকে বেমালুম বাদ পড়ে গেল পিতৃতন্ত্র বিষয়ক কোন আমূল সমালোচনা, যাকে ইংরেজীতে বলা যেতে পারে radical critique।
খুব স্বাভাবিকভাবেই, তাই বাদ পড়ে গেল বিবাহ ও পরিবারের কোনও গূঢ় সমালোচনাও, যা ব্যতিরেকে কোনও পিতৃতন্ত্র সংক্রান্ত আলোচনা আদতে সম্ভব নয়।

পাঠ বিষয়টির মধ্যে সাধারণত একটি গভীর ব্যক্তিগত জায়গা থাকে। সে ব্যক্তিগততার মধ্যে জড়িয়ে আছে ইতিহাস, রাজনীতিমনস্কতা ও সমাজবোধ। ঊনিশ-কুড়ি বছর বয়সের তত্ত্বপ্রিয়, রাজনীতিমনস্ক ও সমাজ ইতিহাস নিয়ে বিপুলভাবে আগ্রহী একটি মেয়ে হিসেবে আমি যখন বাংলা কবিতার এই লিঙ্গ রাজনীতি নিয়ে ভাবতে শুরু করি, তখন আমার এই ধারার কবিতাগুলিকে নাকচ করতে খুব বেগ পেতে হয়নি। একটা অস্পষ্ট ধারণাও ছিল — পুরুষদের লেখা থেকে আর এর থেকে বেশি কী-ই বা আশা করা যেতে পারে? মানে, আমার ওই বয়সটার যে সামাজিক সমসময়, সেখানে আজকের ভারতবর্ষের মত লিঙ্গসংক্রান্ত আলোচনা সমাজের মুলস্রোতে ছিল না। আমি কলেজে সমাজতত্ত্ব নিয়ে পড়েছি। আমার তিন বছর অনার্স পড়াকালে লিঙ্গ সংক্রান্ত একটি আলোচনাও ক্লাসে হয়নি। কোনও নারী-সমাজতাত্ত্বিকের লেখা আমরা পড়িনি। আমার পরিবারে, কলেজে এবং তার বাইরে যে ছাত্র-রাজনীতির পরিমণ্ডল, সেখানেও মেয়েদের লেখালিখি নিয়ে আলোচনা বা পাঠের কোনও পরিমণ্ডল ছিল না। আমরা বাম রাজনীতি করেছি, সোভিয়েত রাজনীতি ও ইতিহাস নিয়ে তর্কে মেতেছি, কিন্তু আলেক্সান্দ্রা কলোন্তাইয়ের নাম পর্যন্ত করিনি।
ঠিক সেই নীরবতা, সেই অনুপস্থিতির জায়গা থেকেই আমার নিজের মেয়েদের লেখা নিয়ে আগ্রহ শুরু হয়। সেই বয়সে এই আগ্রহের পিছনে একটি প্রশ্ন ছিল, যে মেয়েদের লেখালিখির যে জগত, সেখান থেকে সন্ধান পাওয়া যেতে পারে কি কোনও বিকল্প লিঙ্গ রাজনীতির? তার সাথে সাথে এও ছিল যে, যেসমস্ত বই, লেখা, আলাপ আলোচনা আমার রাজনৈতিক বৌদ্ধিক পরিমণ্ডল থেকে বাদ পড়ে গেছে, তার একটি বিকল্প চর্চার অনুশীলন নিজের মত করে গড়ে তোলা। বলা যেতে পারে, এই পড়াশুনো ছিল আমার ব্যক্তিগত রাজনীতির জগত। এবং, সেখান থেকেই আমার সচেতনভাবে বাংলা মেয়েদের কবিতা পাঠ শুরু।
আমি যখন পড়তে ও লিখতে শুরু করেছি নিজের মত করে, ততদিনে বাংলা সাহিত্যে মেয়েদের উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। বিশেষত, আটের দশকে বহু সংখ্যক মেয়েরা বাংলায় কবিতা লিখেছেন। দৃশ্যতই! যদিও, আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, ঊনিশ শতক থেকেই বাংলায় মেয়েরা — বিশেষত সবর্ণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা — লিখছেন। বিপুল পরিমাণে না হলেও, যথেষ্ট পরিমাণে লিখছেন। সে লেখালিখির জটিল, পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস আজও লেখা হয়নি। কিন্তু, সাতের দশক পরবর্তী সময়ে বাংলা কবিতার জগতে যে মেয়েদের লেখালিখি শুরু হল, তার কতগুলো বৈশিষ্ট আছে।
প্রথমত, ছয় ও সাতের দশকের যে টালমাটাল রাজনৈতিক জীবন বাংলার, তার ছাপ এসে পড়ল বাংলার মেয়েদের কবিতার জগতেও। একধরনের লিঙ্গ-সচেতনতা, একধরনের বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজজাত লিঙ্গ রাজনীতির কাটাছেঁড়া, আরও বেশি বেশি করে আসতে শুরু করল বাংলা মেয়েদের কবিতায়। বিশেষত, পণপ্রথা, ধর্ষণ সংস্কৃতিকে ঘিরে উপমহাদেশ জুড়ে যে মেয়েদের আন্দোলন, তার ছোঁয়া এসে লাগল বাংলা লেখালিখিতেও। যেমন ধরুন, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ মঞ্চের কর্ণধার মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায় তখন নিয়মিত কলাম লিখছেন আনন্দবাজারে। কাজেই, আমি বলব, এই পর্বের বাংলা মেয়েদের কবিতা নতুন নারীত্বের কবিতা, যে নতুন নারীত্ব পরোক্ষভাবে হলেও, নারীবাদের কিছু কিছু ঘাতপ্রতিঘাত সম্পর্কে ওয়াকিবহাল।
কাজেই, একটু নিবিড়ভাবে পড়লে দেখা যাবে, এই সময়ের এবং এই ধারার মেয়েদের কবিতায় আসতে শুরু করল একধরনের নতুন আত্মন। যেমন ধরুন, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়ের এই কবিতাটি:
“আমি বিপ্লব দেখিনি।
নকশালবাড়ির রাতে দাদা রোজ অন্য কোথাও শুতে যেত।
রেডবুক, স্টেন্সিল পকেটে পুরত, আর, তারপর
আমাদের হাতিবাগানের পাড়া লক-আপে পৌঁছাত।
আমি রোজ মাখন মাখানো রুটি খেতে খেতে ভাবতাম,
খুব খুন হলে,
পুলিশের ভয়ে মুখ নীল হয়ে গেল,
বিপ্লব পালিয়ে যায়?
আমি কখনও বিপ্লব দেখিনি।
শুধু, এই দেশে
রাস্তায় পড়ে থাকা মোটা পাইপের মধ্যে
অন্নপূর্ণাদের
সংসার পাততে দেখেছি।”
কবিতাটি প্রকাশকাল ১৯৮৫। প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল “ভাষা” পত্রিকায়! অদ্ভূতভাবে, কবিতাটির সূচনা একটি ঘোষণার মধ্য দিয়ে — “আমি বিপ্লব দেখিনি।” কিন্তু, পরের লাইনেই যেটা বোঝা যায়, যে এই বিপ্লব না-দেখার ঘোষণা অর্ধসত্যমাত্র। কবিতার আত্মন মেয়েটি বিপ্লব দেখেছে তার দাদার ঘর ছাড়ার মধ্য দিয়ে, পারিবারিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ, গার্হস্থ্যতার ছিদ্রের মধ্য দিয়ে। যেভাবে ইতিহাসের একটা বড় সময় জুড়ে মেয়েরা — বিশেষত তথাকথিত ভদ্রঘরের মেয়েরা — পৃথিবীকে দেখেছেন। বাংলার সমাজ উত্তাল তখন, রেডবুকে, দেওয়ালে-দেওয়ালে স্টেনসিল করা মাওয়ের প্রতিকৃতিবাদ। পৃথিবীতে ঘটে যেতে পারে দুর্দান্ত ডামাডোল, বিপ্লব, সমাজ-পরিবর্তনের আন্দোলন। মধ্যবিত্ত মেয়েরা এই গোটা সময়টা জুড়ে মাখন-মাখানো রুটি খেয়ে যেতে পারে। কেউ তাদের কিচ্ছুটি বলবে না। কেউ তাদের শুধু কিচ্ছুটি বলবে না, তাই নয়, তাদের কাছে এটাই আশা করে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ। নিজে একজন মধ্যবিত্ত মেয়ে হয়ে স্বীকার করি, এর মধ্যে বেশ একধরনের আরাম আছে। কেমন সবাই না-চাইতেই সব করে দিচ্ছে! তার সাথে সাথে এও বলি, এই রক্ষণাবাদের ঘেরাটোপ না ভাঙতে পারলে মধ্যবিত্ত মেয়েদের দ্বারা কিচ্ছু হবে না। কিন্তু, ওই রক্ষণাবাদের ঘেরাটোপ ভাঙ্গার মধ্যে যে আছে ওই গার্হস্থ্য নিশ্চিন্ততা ও আরামবোধকে বিসর্জন দেওয়াও! তাই তো এত কঠিন মধ্যবিত্ত মেয়েদের পক্ষে ওই মধ্যবিত্ত পরিবার ও সমাজজাত ঘেরাটোপ ছেড়ে বেরোনো। আর, ওই রক্ষণাবাদের ঘেরাটোপে ঘুরপাক খেতে থাকা মধ্যবিত্ত মেয়েটির সমাজ হতে থাকে ছোট, আরও ছোট। নির্বোধ, আরো নির্বোধ। তো, খুব অদ্ভুতভাবে চৈতালী তুলে আনলেন মধ্যবিত্ত পিতৃতন্ত্রের এই দ্বান্দ্বিকতাকে। এই আরামবোধ আর লিঙ্গায়িত খর্বায়নের আন্তঃসম্পর্ককে।
সাথে সাথে নকশালবাড়ির রাজনীতির একটি সমালোচনাও হাজির করলেন কবিতাটিতে: “খুব খুন হলে,/পুলিশের ভয়ে মুখ নীল হয়ে গেলে/বিপ্লব পালিয়ে যায়।” চৈতালী একা নন। মূলস্রোতের যে লেখাপত্তর, সেখানে নকশালবাড়ি রাজনীতির যে দিকটি সবচাইতে সমালোচিত হয়েছে, তা হল খতমের রাজনীতি। খতমের রাজনীতির সমালোচনা তৃতীয় শিবিরের মধ্যেও আছে বইকী। কিন্তু, আর সমস্ত কিছু বাদ দিয়ে শুধুই খতমের রাজনীতিকে ঘিরে একটি কবিতার মধ্যে নকশালবাড়ি রাজনীতির একটি সমালোচনার পরিমণ্ডল গড়ে তোলার মধ্যে আছে একধরনের বিপুল সরলরৈখিকতা। যে সরলরৈখিকতার মধ্যে আছে এক গভীর লিঙ্গায়িত রাজনীতিও। এক্ষেত্রে, চৈতালীর সমালোচনার মূলগত রাজনৈতিক চরিত্র হল ভাবালুতামূলক। যাকে ইংরেজীতে বলা যেতে পারে সেন্টিমেন্টাল ক্রিটিক। তো, সেই ভাবালু ক্রিটিকের সাবটেক্সট দাঁড়াল অনেকটা এইরকম, মেয়েরা মায়ের জাত। রক্তপাত, হিংসা — হোক না সে বৈপ্লবিক হিংসা — এসব তাদের ঠিক ধাতে সয় না। অর্থাৎ, যে চশমা দিয়ে সমাজ, পিতৃতন্ত্র দেখে মেয়েদের, একধরনের লিঙ্গবোধের ধাঁচা তৈরি করে, তার সাথে খাপে-খাপে মিলে গেল চৈতালীর ক্রিটিক। নকশালবাড়ির রাজনীতি, বামপন্থী রাজনীতি, এমনকি সামাজিক রাজনীতিরও কোনও গভীরতর সমালোচনা মিলল না চৈতালীর কবিতায়। এক ধরনের সমীকরণ তৈরি হল বরং। সে সমীকরণের প্রকৃতি প্রধানত লিঙ্গায়িত। অনেকটা গল্পটা দাঁড়াল এইরকম। মেয়েরা ইকুয়ালটু হিংসার রাজনীতির সমালোচনা ইকুয়ালটু পারিবারিকতার জয়গান।
এবং, অতি নিশ্চিতভাবেই, কবিতাটির দ্বিতীয় স্তবকে আমরা পেলাম পারিবারিকতার রাজনীতির এক বয়ান। দ্বিতীয় স্তবকটি শুরু হল একটি পুনরাবৃত্তির মধ্য দিয়ে। আবার ঘুরেফিরে এল কবিতার প্রথম লাইনটি — “আমি কখনও বিপ্লব দেখিনি।” এবং তার বদলে কি দেখেছেন তাও আমাদের জানালেন কবিতার কথক — “শুধু, এই দেশে/ রাস্তায় পড়ে থাকা মোটা পাইপের মধ্যে/ অন্নপূর্ণাদের/ সংসার পাততে দেখেছি।” মানে, আমরা সবাই দেখেছি। কিন্তু চৈতালী, পথের ধারের দারিদ্র্য — মানে দারিদ্র্য বললে কম বলা হয় – যে চূড়ান্ত সর্বস্বান্ততার মধ্যেও জীবন গড়ে তোলে মানুষ, সেই বাস্তবতাকে এই কবিতার একটি কেন্দ্রীয় রূপকে পরিণত করলেন। সেই কেন্দ্রীয় রূপক দাঁড়াল ছয়-সাতের দশকের যে বিপ্লবী রাজনীতি, ঠিক তার বিপরীতে। এবং, এই যে বিপরীতে দাঁড়ালো, তার রাজনৈতিক আভ্যন্তরীণ আধেয়টি হল পারিবারিকতা। যে পারিবারিকতার সাথে, চৈতালী আমাদের মনে করিয়ে দিতে চাইলেন, ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে মেয়েদের প্রাত্যহিক সৃজনশীলতা, সহনশীলতা। এবং, সমাজতাত্ত্বিকভাবে, ঐতিহাসিকভাবে, এই জড়িয়ে থাকাকে অস্বীকার করার কোনও জো নেই। কিন্তু চৈতালীর কবিতায় মেয়েদের এই সৃজনশীলতা – বিশেষত দরিদ্র মেয়েদের এই সৃজনশীলতা — এল স্থিতিস্থাপকতার চিহ্নক হিসেবে। যে স্থিতিস্থাপকতা বিপ্লবের উত্তাল টালমাটালতার পরিপন্থী। চৈতালীর কবিতার আত্মন কিন্তু সেই পারিবারিক স্থিতিস্থাপকতা, গার্হস্থ্যতার স্থিতিস্থাপকতার মধ্যেই আশ্রয় খুঁজলেন। শুধু তাই নয়, সেই পারিবারিক স্থিতিস্থাপকতা খুঁজতে তিনি তাকালেন — খেয়াল করুন, পাঠক, মধ্যবিত্ত পারিবারিকতার দিকে নয়, সর্বস্বান্ত, সর্বহারা পারিবারিকতার দিকে। অর্থাৎ, নকশালবাড়ির রাজনীতির একটা দিক যদি হয় শ্রেণী-সমতার রাজনীতি, সেই রাজনীতিকে তিনি সম্বোধন করতে চেষ্টা করলেন দরিদ্র মেয়েদের সৃজনশীলতা-সহনশীলতাকে রূপক বানিয়ে। কিন্তু, সেই সম্বোধন করার চেষ্টার মধ্যে থাকল নকশালবাড়ির রাজনীতিকে একরকম ভাঙার চেষ্টাও। এবং, সেই ভাঙার চেষ্টা চৈতালী করলেন, শ্রেণী-সমতার রাজনীতি, নকশালবাড়ির রাজনীতি ও গার্হস্থ্যতার রাজনীতিকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে। একদিকে তাই তাঁর কবিতায় রইল আমূল বদলের শ্রেণী রাজনীতি, অন্যদিকে গার্হস্থ্য সহনশীলতার রাজনীতি। এবং, এই বিভাজনটি তাঁর কবিতায় এল লিঙ্গায়িত বিভাজন হয়ে। অর্থাৎ, চৈতালীর কবিতায় আমরা দেখলাম শ্রেণী‌ ও লিঙ্গের বিষাক্ত পরস্পরাশ্লেষণ। যেখানে, বিপ্লব-সমাজবদল থেকে দূরে থাকা বাঙালি মেয়ে রাস্তার ধারের দরিদ্র মেয়ের আত্মতাকে আত্মসাৎ করে গড়ে তোলে তার নিজের রক্ষণশীলতার বয়ান।
কিন্তু চৈতালীর কবিতাটি গুরুত্বপূর্ণ অন্য কারণে। কবিতাটির ভরকেন্দ্রে রয়েছে একধরনের নতুন নারী বৈষয়িকতা। যে নারী বৈষয়িকতা বাম-বিপ্লবী রাজনীতি নিয়ে ওয়াকিবহাল, ভাবিত। কিন্তু, সে বৈষয়িকতাকে ঠিক রাজনৈতিক, কিংবা রাজনীতি-সচেতনও বলা যাবে না। তার সংবেদনশীলতা আছে, কিন্তু সে সংবেদনশীলতায় ভর করে ফেটে পড়ার সাহস বা ইচ্ছা কোনটাই নেই। এ নারী বৈষয়িকতাকে বলা যায় আগাপাশতলা মধ্যপন্থী। মিডল-ব্রাও যাকে বলে আর কী। আর, যেহেতু এই মধ্যপন্থার একটা বড় জায়গা ‌দাঁড়িয়ে থাকে মধ্যবিত্ত সমাজের কাছে নিজেদের নান্দনিক ও রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতার ওপর, তাই এই নতুন নারী বৈষয়িকতা কখনওই গার্হস্থ্যতার আশ্রয় ও ঘেরাটোপকে প্রশ্ন করার বা ভাঙার সাহস দেখাল না। এবং, এই মধ্যপন্থী, স্থিতিস্থাপকতাবাদী নারী কন্ঠস্বরই হয়ে উঠল আটের দশক ও পরবর্তী বাংলা মেয়েদের কবিতার মূল কন্ঠস্বর, প্রধান বৈষয়িকতা। এবং, বাংলা মেয়েদের আধুনিক কবিতা থেকে হারিয়ে গেল বাঙালি মেয়েদের বিবিধ বিদ্রোহের ইতিহাস।
অবশ্য, তার একটু আগে বিজয়া মুখোপাধ্যায় ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত তাঁর “আমার প্রভু” কাব্যগ্রন্থে “পুঁটিকে সাজে না” বলে একটি কবিতা লিখেছিলেন। কবিতাটি অনেকটা এইরকম:
“বিশ্বের সমস্যাপূরণের ভার
তোকে দেওয়া হয়নি, পুঁটি।
ভারতবর্ষ বোমা বানাবে কিনা
আমেরিকা ভিয়েতনাম ছাড়বে কবে
অটোমেশনের বিরুদ্ধে গণসাক্ষর জরুরি…
এসব ভাবনা তোর নয়।
বিকেলে গা ধুয়ে তুই খোঁপা বাঁধ
লক্ষ্মীবিলাস তেল দিয়ে,
মাসির দেওয়া পার্ল পাউডার
মুখে আলতো করে মাখিয়ে
কাগজ পোড়ানো ঝুরো টিপ পর কপালে
সন্ধ্যামালতীর থোকা গুঁজে দে খোঁপায়
বর্ষায় ঘন সবুজ শাড়ি
তোকে মানায় ভালো।
পুঁটি, তোর এ বয়সে
প্যাঁচামুখ সইতে পারি নে
এ কি তোর বাড়াবাড়ি নয়
উল্ফ-এর তুই কী বুঝিস
পিকিং পার্জ- এ তোর এসে যায় কী।
তুই তোর ঘর গুছিয়ে নে
প্রদীপের সলতে পাকা
মনে রাখিস পুঁটি
এই তোকে ছেলে মানুষ করতে হবে
ধিঙ্গিপনা তোকে কি সাজে, ছি!”
বলা বাহুল্য, কবিতাটির মূল সুর ব্যঙ্গাত্মক, তির্যক। কবিতাটি লেখা হয়েছে প্রতিষ্ঠানের কন্ঠস্বরে। সে কন্ঠস্বর “পুঁটি”কে বলে ছোট হয়ে থাকতে। তার রাজনৈতিক হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন নেই তার গভীর সাহিত্যচর্চায়। বরং, পুঁটির জগৎ বিরাজ করে লক্ষ্মীবিলাস তেলে, পার্ল পাউডারে, ঝুরো টিপে। সৌন্দর্যচর্চার জগৎ পুঁটিদের খর্ব করে, এই কবিতায় এমনটাই বললেন বিজয়া। অর্থাৎ, সৌন্দর্যচর্চার হাত ধরে যে যৌনায়ন, তার মধ্যে কোন মুক্তিবোধ দেখতে পেলেন না তিনি। যেমনটি দেখে থাকেন তৃতীয়ধারার অনেক নারীবাদীই। এবং, যে ধারার মুক্তিবোধের দিশা পাওয়া যাবে পরবর্তী সময়ের বাংলা আধুনিক মেয়েদের কবিতাতেও। প্রথম স্তবকে যদি থাকে যৌনায়ন, বিজয়ার কবিতায়, দ্বিতীয় স্তবকে তবে এল গার্হস্থ্যতা — ঘর গোছানো, প্রদীপের সলতে পাকানো, ছেলে মানুষ করা। অর্থাৎ, দুটি জিনিস এখানে করলেন বিজয়া। এক, যৌনায়নের সাথে গার্হস্থ্যতার একটি লিঙ্গায়িত সম্পর্ককে ছিঁড়ে ছিঁড়ে দেখালেন। দুটিকেই রাখলেন একই লিঙ্গায়িত সামাজিক দ্বন্দ্বের ধারাবাহিকতায়। দুই, গার্হস্থ্যতার রাজনীতি ও যৌনায়ন দুটিকেই দেখালেন মেয়েদের সামাজিক খর্বায়নের যে পয়সাটি, তার দুটি পিঠ হিসাবে।
আরো খেয়াল করে দেখুন, বিজয়ার কবিতায় তিনি মেয়েটির নাম রাখলেন “পুঁটি”। কাব্যমণ্ডিত আকাশলীনা নয়, এমনকি আনুষ্ঠানিক, নিয়মনিষ্ঠ নীরাও নয়। কিন্তু, “আকাশলীনা” ও “নীরা” দুইয়েরই ছায়া রয়ে গেল বিজয়ার পুঁটির মধ্যে। মানে, ক্ষুদ্রত্ব ছাড়া কী-ই বা আছে “পুঁটি” নামটির মধ্যে? গতানুগতিক নগণ্যতা ছাড়া কী-ই বা আছে? আর, সত্যিই তো, এই সমাজে অধিকাংশ মেয়েরা — মধ্যবিত্ত মেয়েরা — সারাজীবন পুঁটি হয়েই থাকেন। কাজেই একধরনের আক্ষরিকতার মধ্য দিয়ে বিজয়া লিখলেন কবিতাটি। এবং, এই আক্ষরিকতার নন্দনতত্ত্বের মধ্য দিয়েই তিনি জীভ ভ্যাংচালেন আকাশলীনা-নীরা নন্দনতত্ত্বকে। আসলে, আকাশলীনা-নীরা নন্দনতত্ত্ব তো খর্বাকৃতি কাব্যিক নারী প্রতিমূর্তি গড়ে তোলারই নন্দনতত্ত্ব। সে তাকে আমরা রোমান্টিকতাই বলি, অথবা উন্মুক্ত যৌনতা অথবা কাব্যিক পরীক্ষানিরীক্ষা। বিজয়ার এই আক্ষরিকতা বাংলা কবিতায় — বিশেষত মেয়েদের কবিতায় — একধরনের নতুন লিঙ্গ রাজনীতি তাই নিয়ে এল। বিজয়ার কবিতার সাথে নীরা-আকাশলীনার নন্দনতত্ত্বের মূলগত ফারাক এই জায়গায় যে, যে কাব্যিক হাতিয়ার ব্যবহার করে নীরা বা আকাশলীনার ভিত্তিগত নন্দনতত্ত্ব গড়ে উঠল, তাকেই উন্মোচন করে করে দেখালেন বিজয়া তাঁর কবিতায়।
সেই লিঙ্গ রাজনীতির ভরকেন্দ্রে দাঁড়াল মধ্যবিত্ত মেয়েদের যে সামাজিক খর্বায়ন, তার নতিভুক্তিকরণ। কিন্তু বিজয়ার কবিতায় যে শুধু সামাজিক খর্বায়ন আছে, তাও তো নয়। সেখানে তো আছে এই খর্বায়নের বিরুদ্ধে পুঁটির প্রতিরোধও। মানে, পুঁটি ঠিক সবার মনজুগিয়ে চলা মেয়ে নয়। তাই তার “প্যাঁচামুখ”। পুঁটির হাতে ভার্জিনিয়া উল্ফের বই। মাথায় পিকিং পার্জ। এর সাথে সাথে ইঙ্গিতও করলেন বিজয়া যে খোঁপা বা লক্ষ্মীবিলাস তেলে বড় একটা মন নেই পুঁটির। মন নেই তার খোঁপায়। প্রদীপের সলতে পাকানোর সম্ভাবনাও তার মধ্যে কোনও উদ্দীপনা গড়ে তোলে না। অর্থাৎ, ঠিক যে যে ধরনের চিত্রকল্পের মধ্য দিয়ে বাংলা কবিতায় রোমান্টিক (পড়ুন, যৌনায়িত, কিন্তু আনম্র, রুচিশীলা, আপাদমস্তক নিরামিষ, মধ্যবিত্ত) নারীত্বের বা শান্তির-নীড়-গৃহকোণ মার্কা রূপায়ন ঘটানো হয়, তার গুষ্টির তুষ্টি করে ছাড়লেন বিজয়া। অর্থাৎ, দাঁড়াল কী? তাঁর কবিতায় পু্ঁটির মধ্যে পুঁটিত্ব বড় একটা নেই। খেয়াল করুন, কবিতাটির প্রকাশনার সময় ১৯৬৭ সাল। অর্থাৎ, নকশালবাড়ির সমসাময়িক। পৃথিবীজোড়া ডামাডোল। সেখানে দাঁড়িয়ে মেয়েদের সামাজিক নন্দনতাত্ত্বিক খর্বায়নকে প্রশ্ন করার মধ্যে কি লিঙ্গ রাজনীতির সাথে বৃহত্তর পরিবর্তনের রাজনীতিরই একটি যোগসূত্র চোখে পড়ে না?
কিন্তু, কী অদ্ভুতভাবে, পরবর্তী সময়ের বাংলার মেয়েদের কবিতায় এই পুঁটিত্বই উদযাপিত হতে শুরু করল। প্রসঙ্গক্রমে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পরে কবি যশোধরা রায়চৌধুরী, সুনীলকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে গিয়ে একটি চিঠি লিখলেন। চিঠিটার শুরু হল অনেকটা এইভাবে: “নীলুদা, তোমাকে চিঠি লিখছি এ বাংলার সেইসব মেয়ের হয়ে, অবলুপ্ত প্রজাতির সেই মুখচোরা ছোটখাটো মেয়েদের হয়ে। নাম? নাম নীরা থেকে মনীষা, যা খুশিই হতে পারে। ভীষণ ভিতু ভিতু, ভাল ভাল, মধ্যবিত্ত, শান্ত মেয়ে। কলেজে পড়ি আমি। কোনদিন আমার কলেজে পড়া শেষ হয়না কেন বলতো?” তাঁর বাস্তবিক ব্যক্তিগত জীবনে যশোধরা মুখচোরা না ছোটখাটো সে নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। হতেই পারেন। কিন্তু, এই বর্ণনা দিয়ে লেখাটি শুরু করার মধ্যে বাঙালি মধ্যবিত্ত মেয়েদের একটি বিশেষ রাজনীতি আছে। খেয়াল করে দেখুন, গোটা অনুচ্ছেদটিতে মেয়েটির কোন নিজস্ব পরিচিতি নেই। সে কথা বলে না। এমনকি তার নিজস্ব কোনও নামও নেই। মানে, খর্বায়নের চূড়ান্ত যাকে বলে। অর্থাৎ, সেই খর্বায়নের চশমা পরেই যশোধরা এই রূপায়নের কাজে নামলেন। নিজে-নিজেই পরে নিলেন এই চশমাটি। স্ব-খর্বায়নই হয়ে দাঁড়াল বাঙালি মেয়ে-কবির এজেন্সি ও বৈষয়িকতার প্রতিভূ।
তাই, লিখলেন: “তোমার চোখে মেয়েরা ঠিক কেমন? যেমন হলে গড়পড়তা ছেলেদের মনের মত হয়। হয়তো, তোমার গল্প উপন্যাস পড়ে পড়ে পড়ে, আমার মতই অনেকেই নিজেকে দেখেছিল, নিজেকে গড়েওছিল অনেকটা। চারপাশের ছেলে বন্ধুদের চোখে নিজেকে বাজিয়ে নিয়েছিল। তুমি তো শান্ত, চুপচাপ একটু অন্যমনস্ক আর ভীষণ মিষ্টি একটা মেয়েকে বার বার এঁকেছ। যেমন, প্রতিদ্বন্দ্বীর কেয়া।
“…মেয়েদুটির নাম মালবিকা আর কেয়া। মালবিকা তার পায়ের জুতো, শাড়ির রং, আংটির পাথর, হাতব্যাগ, টিপ সব মিলিয়ে পরেছে। চুল বাঁধার ধরন দেখলেই বোঝা যায়, সে এক-এক দিন এক-এক রকমভাবে চুল বাঁধে। নিজের রূপ সম্পর্কে মেয়েটি সজাগ। মুখে সেই হালকা অহংকারের ছায়া পড়েছে। কেয়া মেয়েটি খানিকটা এলোমেলো স্বভাবের, পোশাকের পারিপাট্য নেই, কিন্তু মুখখানি তার ভারী সুন্দর — বড় বড় চোখদুটিতে সরল সৌন্দর্য।”
এই যে মালবিকা, একে তো আমরা চিনিই, তবু আমরা তো কেয়াই হতে চাইব মনে মনে, তাই না? কেননা, কেয়ার জন্যেই তোমার কলম উপচে ওঠে ভালবাসা। এ এমন এক ভালবাসা, যা যাকে ভালবাসে, তাকে নির্মাণও করে নেয়।”
আমি অনেকটাই বিশদে এই অনুচ্ছেদটির উদ্ধৃতি দিলাম, তার কারণ, এখানে যশোধরা রঙচঙ মাখিয়ে মেলে ধরেছেন যাকে, তাকেই আমি বলছি খর্বায়নের নন্দনতত্ত্ব। সুনীলের যে অনুচ্ছেদটিকে যশোধরা উদ্ধৃত করলেন, সেটি কিন্তু অতীব বাঙ্ময়। একেবারেই নিতান্ত কাকতালীয় নয়। মানে, তাঁর লেখায় সুনীল যদি মালবিকা-কেয়া দ্বৈততার মধ্য দিয়ে দেখে থাকেন মধ্যবিত্ত বাঙালি নারীত্বকে, সেই দ্বৈততাকে বৈধতা দিলেন যশোধরা। সুনীলের দ্বৈততার মধ্যে কোনও বিশেষত্ব নেই। সুনীল একদিকে রেখেছেন সাজুনে-গুজুনে যৌনায়িত মেয়েদের — যাদের জন্য ঠিক কোনও শব্দ বাংলাভাষায় নেই। মালবিকা সেই গোত্রের মেয়ে। অন্যদিকে, কেয়া হল ঠিক সেই গোত্রের মেয়ে, যাদের আমরা বলে থাকি “ঘরোয়া মেয়ে”। সুনীলের মতে, এরা একে অন্যের বিপরীত মেরুতে অধিষ্ঠিত। কিন্তু, ঠিক কিভাবে দেখব আমরা সেইসব মেয়েদের, যারা না মালবিকা, না কেয়া? যারা মনে করে, মালবিকা এবং কেয়া আসলে একই পয়সার দুটো পিঠ?
কিন্তু, সেইসব জটিলতার দিকে যশোধরা হাঁটলেন না। তার বদলে, খুব সোজা-সাপ্টাভাবে বলে দিলেন পুরুষদৃষ্টি — বা মেল গেজ — দ্বারা নির্মিত হতে তাঁর কোনও আপত্তি নেই। এবং এটাই বাস্তব। যে বাস্তবটা আমরা প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে আমাদের নিজেদের চোখের সামনে দেখি। যেখানে আছে মেয়েদের বিপুল পরিমাণ প্রতিবাদহীনতা, আটকে যাওয়া। কিন্তু, এটাই বাস্তব বলে কবিতার কাছ থেকে কি ব্যতিক্রমী কিছু চাওয়ার নেই আমাদের? কবিদের কাছে?
আশ্চর্যের কথা এই যে, নয়ের দশক থেকে আমি যখন বাংলা কবিতার ইতিহাস নাড়তে-চাড়তে শুরু করলাম, তখন একটা অদ্ভুত জিনিস খেয়াল করলাম। যে, বাংলাভাষায় প্রচুর মেয়েরা লেখেন, কিন্তু বাংলা কবিতার যে ভিত্তিগত পিতৃতান্ত্রিকতা, তার কোনও সমালোচনা নেই। হয়তো কোথাও কোনও অনাম্নী ছোট পত্রিকায় বেরিয়েছে, যা আমার চোখে পড়েনি। হতেই পারে। কিন্তু আমাদের যে শহরকেন্দ্রিক মূলস্রোত বা ছোট পত্রিকার জগৎ, সেখানে অন্তত নেই। বিশেষত, পরিচিত, দাপিয়ে বেড়ানো নামগুলির কলম থেকে। অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বা ইংল্যান্ডে কিন্তু এই ধারার কাজ হয়েছে। ছয় এবং সাতের দশকের কবি-সমালোচকরা এই ধরনের কাজ করেছেন। কেট মিলেট থেকে অড্রে লর্ড লিখেছেন, সমালোচনা করে তুলোধুনো করেছেন তাঁদের সমসামইয়িক গদ্য পদ্য লেখা ও লেখকসমূহকে। এবং, বহুলাংশেই এই কাজগুলি ঘটেছে নারীবাদী আন্দোলনের সাংস্কৃতিক ও তাত্ত্বিক কাজকর্মের অংশ হিসেবে। অনেকাংশেই, আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে।
এই প্রতিস্পর্ধার অভাব বাংলা কবিতায়, তার কারণ কী এই যে, বাংলায় ঠিক সেইভাবে সংগঠিত হল না কোন প্রতিস্পর্ধী নারীবাদী আন্দোলন? অন্তত, হয়নি গোটা ছয় বা সাতের দশক জুড়ে? মানে এক ধরনের নতুন নারীত্বের সূচনা আমরা দেখলাম বটে এই সময়ে — যার কথা আমি আগেই কিছুটা আলোচনা করেছি — কিন্তু, সে নব-নারীত্বও তো এল আধুনিকতার বিবর্তনের হাত ধরে। তাতে, একধরনের স্বাধিকারের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত হল বটে‌ কিন্তু প্রতিস্পর্ধার হাত ধরে আসে যে বিদ্রোহের অভিব্যক্তি, তার কোনও বিকাশ আমরা বাংলা মেয়েদের কবিতায় পেলাম না। এবং, সেই প্রতিস্পর্ধার অভাবের হাত ধরেই এল বাংলা কবিতায় ভিত্তিগত পিতৃতন্ত্রের সমালোচনার অভাব। তাই, স্পষ্ট করেই বলি, আমার বড়ই জানতে ইচ্ছে হয়, সুনীল-মৃদুল-জয় ইত্যাদিদের কবিতায় আমি যদি দেখতে পাই প্রগাঢ় পিতৃতান্ত্রিকতা, তাহলে বাংলা বাজারের তাবড় মহিলা কবিরা সেটা দেখতে পান না, এটা কী হতে পারে? মানে, একজন-দুজন পান না, হতেই পারে। কিন্তু, কেউ পান না? ব্যাপারটা একটু কীরকম-কীরকম মনে হচ্ছে না?
কাজেই, প্রথমত আমাদের বুঝতে হবে, এই নৈঃশব্দটি ঠিক নিষ্পাপ নয়। এই নৈঃশব্দের একটি রাজনীতি আছে। সেই রাজনীতির নাম‌ সাহিত্য-বাজার, কবিতা-বাজার। বা গোদাভাবে বললে, বাজার। বাজার — বিশেষত সাহিত্য-বাজার, কবিতা-বাজার, সাংস্কৃতিক বাজার — একমুখী নয়। হয় না। তার নিজের মধ্যেও থাকে অন্তর্দ্বন্দ্ব। থাকে নতুনকে জায়গা দেওয়ার প্রয়াস। বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার সাথে সাথে‌ যে নতুন সাহিত্য-বাজার, তার সাথে মেয়েদের একটি জটিল সম্পর্ক তৈরী হল। মানে বাংলা সাহিত্য-বাজারে মেয়েরা কিন্তু কোনওদিনই অনুপস্থিত ছিলেন না। অদৃশ্যও নয়। যে অদৃশ্যতা আমরা দেখতে পাই পাশ্চাত্যের বহু দেশে। কাজেই, একদিক থেকে দেখতে গেলে, উনিশ শতক থেকে শুরু করেই, বাংলা সাহিত্যবাজার বাঙালি মধ্যবিত্ত মেয়েদের লেখালেখি বিষয়টিকে নির্মাণ করেছে। তার গতিপ্রকৃতি কি হবে, নির্ধারণ করেছে। যদিও, সচেতনভাবে “মেয়েদের লেখা” – এইরকম কোনও স্বয়ংসিদ্ধ, স্বয়ংসম্পূর্ণ বিভাগ বা রীতি তৈরী হল না বটে, কিন্তু বাজার নির্মাণ করল মেয়েরা কী লিখবে, কেমনভাবে লিখবে, কতটা লিখবে। রবীন্দ্রনাথের “নষ্টনীড়”-এর নায়িকা চারুলতাকে মনে পড়ে? তারও কিন্তু একটি আত্মজীবনীমূলক রচনা প্রকাশিত হয়েছিল সেইসময়ের একটি নামজাদা পত্রিকায়! কাজেই, বাজার বিষয়টিকে বাদ দিয়ে বাংলার মেয়েদের সাহিত্যরচনাকে দেখা যাবে না।
অতএব সাতের দশক পরবর্তী সময়ে যে সাহিত্য-বাজার, কবিতা-বাজার বাংলার মেয়েদের কবিতাকে নির্মাণ করবে, এতে কোনও নতুনত্ব নেই। যদিও আটের দশকের বাজারের মেয়েদের কবিতা নির্মাণ ও উনিশ শতকের মেয়েদের সাহিত্য নির্মাণের মধ্যে রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক ফারাক রয়েছে বইকী! আটের দশকে যে জটিল সামাজিক বিবর্তনের হাত ধরে নতুন নারীত্বের ধারণা এল বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজে, সেই সামাজিক বিবর্তনের হাত ধরেই বাংলা সাহিত্য ও কবিতা বাজারে প্রয়োজন হল একধরনের লেখিকা ও মেয়েদের লেখনীর। তাই, চালু হল একধরনের লেখিকাদের সাহিত্য-কবিতা বাজারে অন্তর্লীন করার কোটা-ব্যবস্থা। হ্যাঁ, খুব খারাপ লাগবে জেনেও বলছি কোটা-ব্যবস্থা। যাকে, ইংরেজিতে বলে, টোকেনিজম। মানে, একটিও নারীনামরহিত একটি নামী কবিতার বা সার্বিক সাহিত্য পত্রিকার সূচিপত্র দেখতে নিজেদেরই কেমন লাগে, না? কেমন নিজেদের পিতৃতান্ত্রিক-পিতৃতান্ত্রিক বলে মনে হয়, তাই না? কাজেই, একভাবে মেয়েদের নিজের পরিকাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করা — এবং সার্থকভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে পারার মধ্যে বাজারী উদারনৈতিকতারও স্বার্থ একভাবে জড়িয়ে ছিল, আছে। এই অন্তর্ভুক্তিকরণের সাথে মেয়েদের প্রতিবাদ, প্রতিরোধ বা স্বাধিকার রক্ষার লড়াইয়ের বিশেষ সম্পর্ক নেই। কাজেই, এই স্বার্থরক্ষা — বাজারী উদারনৈতিকতার বিবর্তনের মধ্যে দাঁড়িয়ে নির্মিত হল আট ও আটের দশক পরবর্তী বাংলা মেয়েদের কবিতা।
আমি এমন কথা বলছি না যে বাজার এই মেয়েদের শুধুই উপর থেকে নির্মাণ করলো। এবং, এই কবিতালিখিয়ে মেয়েদের বাজারের সাথে সম্পর্কস্থাপনে কোনও বৈষয়িকতা ছিল না, কাজ করেনি বা নেই। বরং, ঠিক উল্টোটাই ঘটেছে। আটের দশক ও তার পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যে যে মেয়েরা কবিতা বাজারে নাম করেছেন, তাঁরা অধিকাংশই বাজারের সহায়ক শক্তি হিসেবেই কাজ করেছেন। বাজারের ও কবিতা প্রতিষ্ঠানের সহায়ক শক্তি হিসেবেই নিজেদের কবিতার বয়ান নির্মাণ করেছেন। এবং, এই যে তারা সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছেন, এই বিষয়টিকে ঠিক শুধুই লিঙ্গ বা পিতৃতন্ত্র দিয়ে দেখলে হবে না। চর্বিতচর্বণ শোনাবে, তবুও বলি, এই গোটা প্রক্রিয়াটির মধ্যে খুব গভীরভাবে রয়েছে একধরনের বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণী গঠন। লিঙ্গায়িত শ্রেণী গঠন, কিন্তু শ্রেণী গঠন।
একটু খেয়াল করে দেখলে যেটা দেখা যাবে, তা‌ হল, এই যে আটের দশক পরবর্তী সময়ের বাংলা মহিলা কবিদল, তাঁদের কারুরই যাত্রাপথ তাঁদের শ্রেণীর পুরুষদের থেকে ঠিক আলাদা হয়নি। এঁরা প্রায় প্রত্যেকেই মধ্যবিত্ত — কখনও কখনও নিম্নমধ্যবিত্ত — অভিভূত হয়ে যাওয়ার মতো সংখ্যায় উচ্চবর্ণীয়। সবর্ণ যাকে বলে। তার ওপর, অধিকাংশই ব্রাহ্মণসন্তান। এঁদের প্রায় প্রত্যেকেরই জীবন শুরু হয়েছিল ছোট পত্রিকায় লিখে। পরবর্তীতে তাঁরা দেশ-আনন্দবাজারে ঠাঁই পেয়েছেন। এখন যেসব ছোট পত্রিকার সাথে দেশ বা আনন্দবাজারের নন্দনতত্ত্ব বা রাজনীতির তফাৎ বড় একটা দেখতে পাওয়া যায় না, তাঁরা সেসবেও লিখে থাকেন। কিন্তু, যেটা লক্ষ্যণীয় তা হল, কবিতাবাজার বা সাহিত্যবাজারে রাজনীতি নিয়ে তাঁদের তেমন কিছু বলার নেই। এবং, এই কবিতাবাজারের রাজনীতিতে, এই “বলার নেই”-টাই তাঁদের সবচাইতে বড় পাথেয়।
কিন্তু বাজার মোটেই একশিলাগোত্রীয় কোনও প্রতিষ্ঠান নয়। একদিকে, বাজারের যেরকম শেষ সত্য পু্ঁজি ও লভ্যাংশ, সেই পুঁজিজারিত লভ্যাংশে তাকে পৌঁছতে হলেও, তাকে একটা আখ্যান খাড়া করতে হয়। যে আখ্যানের দরকার হয় শ্রেণী, লিঙ্গ, জাতপাত, জাতীয়তা, বর্ণ — সবকিছুরই। কাজেই, সুনীল-শক্তি-জয়-মৃদুল ঠিক যে-যে ভাবে কবিতা লিখে বাজার বানালেন, সেই আলঙ্কারিত্বের ওপর, বলা বাহুল্য, চৈতালী-সংযুক্তা-যশোধরা-মন্দাক্রান্তার বাজার দাঁড়াবে না। কারণ, বাজারের অবশ্যম্ভাবীভাবে চাই বৈচিত্র্য। চাই বিবিধতা। কিন্তু, আবার সময়টা তো আটের দশক। এবং আটের দশক পরবর্তী বাংলা। তাই, ওই ঠিক পতির-পুণ্যে-সতীর-পুণ্য মার্কা লেখাও চলবে না। তাহলে?
আসলে সাহিত্যিক আধুনিকতাগত আত্মন-নির্মাণের একটি বড় জায়গা হল যে, তার চাই অসন্তোষ। অসন্তোষ বিনা সংঘাত হয় না। সংঘাত বিনা গল্প জমে না। তার উপরে আবার, ওই যে আগেই বললাম না, নতুন নারীত্বের গল্পে তখন বাংলা বাজার টইটম্বুর। কাজেই, সংঘাত-অসন্তোষের কথা এই কবিতা লিখতে আসা মেয়েকুলকেও লিখতে হবে, লিখে যেতে হবে। আর, আধুনিক মধ্যবিত্ত জীবনের রকমই এই যে, সেখানে অসন্তোষের কোনও সীমা-পরিসীমা নেই। মেয়েদের জীবনে তো নেইই। অতএব, একধরনের বাঙালি মধ্যবিত্ত নারীর অসন্তোষলিপি বাংলা কবিতায় এলো। তার সাথে এল একধরনের অগভীর, ভাসা-ভাসা নারীবাদের বয়ান। যেমন যশোধরা রায়চৌধুরী তাঁর “বাংলা আধুনিক কবিতার নারী-উপনিবেশ: অর্ধেক পৃথিবীর দিকে?” প্রবন্ধে লিখলেন: “একটি মেয়ের সামাজিক অবস্থানের ভেতর থেকেই, তাকে অস্বীকার না করেও, নিজের জন্য নিজের একটি কবিতা লিখে উঠতে পারা, এমনকি তার প্রথমবার কাগজে কলমের আঁচড় দেবার ঘটনাটিও একটি রাজনৈতিক ক্রিয়া বলে আমরা মনে করি, আমাদের সমাজে সচেতন একটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ। কারণ কবিতার উপনিবেশ প্রথাগত ভাবেই পুরুষের একচেটিয়া এবং মেয়েদের ভূমিকা সেখানে হয় বিষয়ের, ভোগ্যের, উদ্দীপনের, মিউজের অথবা বহিরাগতের।”
প্রথমেই প্রশ্ন করি, কোন মেয়েদের কথা বলছেন যশোধরা? কোন সময়ের? সেই মেয়েদের শ্রেণী কি, জাতপাত কী? তাঁরা কোন ধর্মীয় সম্প্রদায় অন্তর্গত? একইভাবে, কোন পুরুষদের কথা বলছেন যশোধরা? তাঁদের শ্রেণী কী? জাত-বর্ণ কী? তাঁরা কোন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ? বাংলা সাহিত্য বাজারে অথবা কবিতা-বাজারে কোনদিন দলিত, খেটেখাওয়া বা মুসলমান পুরুষের “একচেটিয়া” আধিপত্য বা কোনও আধিপত্যই ছিল কী? কিন্তু, এই যে সেইসব বিভাজন ঘুচিয়ে দিলেন যশোধরা, তার মধ্যে একধরনের প্রগাঢ় রাজনীতি আছে। সেই রাজনীতির মধ্য দিয়ে মধ্যবিত্ত, সবর্ণ, হিন্দুসমাজ ও তার সংস্কৃতিচর্চার বাইরে আর কিছু আমাদের কারুর চোখে পড়ে না। এবং, আরো বলব, চোখে পড়ার থেকে আমরা নিজেদের সক্রিয়ভাবে বিরতও করে থাকি।
যশোধরা যা বলেছেন, তার মধ্যে একধরনের আংশিক সত্য আছে। হ্যাঁ, বহু মেয়ে আছে যাদের কাছে খাতার পাতায় কলম ছোঁয়ানোটা একটা রাজনৈতিক পদক্ষেপ। কিন্তু, তারা কারা? তারা সমাজ-ইতিহাসের ঠিক কোন রেখায় অবস্থিত? বলতে বাধ্য হচ্ছি, গত তিন চার দশক ধরে কলকাতা অন্তঃস্থ প্রেসিডেন্সি-যাদবপুরে পড়া মধ্যবিত্ত অধিকাংশ মেয়েরা আর এই ক্যাটাগরিতে ঠিক পড়ে না। আর যদি তারা নিজেদের সেই বিভাজনে দাঁড় করাতে চায়, তবে সেটার নাম দাঁড়ায় সংরক্ষণবাদ। কোটাবাজি! মানে, মেয়েরা (বা পুরুষরা বা তৃতীয় লিঙ্গের কোনও মানুষ) কিছু লেখা মাত্রই তা‌ “রাজনৈতিক পদক্ষেপ” তো বটেই, কিন্তু, তার পরেও থেকে যায় একাধিক প্রশ্ন।
যেমন ধরুন, “রাজনৈতিক পদক্ষেপ” তো বুঝলাম। কিন্তু, কেমনতর “রাজনৈতিক পদক্ষেপ”? সে পদক্ষেপ কি সামাজিক স্থিতিস্থাপকতাকে বজায় রাখতে চায়, নাকি তাকে আমূল ভাঙতে চায়? নাকি, মধ্যপন্থী কোনও একটি জায়গায় তার স্থিতি? বিশেষ করে, সেই “রাজনৈতিক পদক্ষেপ” যদি হয় তার নিজের লেখালেখির মধ্য দিয়ে, তাহলে সেই টেক্সট, সেই বয়ান যা উৎপাদিত হল, তার বিষয় কী? তার আঙ্গিক কোন ধারার? সেই বিষয় ও আঙ্গিকের রাজনীতি ও সমাজতত্ত্ব ঠিক কোন প্রকারের? সেই টেক্সট প্রকাশ করে কারা? বাজারের ঠিক কোন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এ লেখা আমাদের হাতে এসে পৌঁছয়? কিন্তু, যশোধরা এইসব জটিলতায় গেলেন না। একধরনের অতীব সরলীকৃত, একদমই নিম্নস্তরের একটি বয়ান ও মাপকাঠি তৈরী করলেন নিজেদের লেখালেখি সম্পর্কে। যে দর্শন আসলে মেয়েদের ছাড় দেওয়ার দর্শন। যে দর্শন আসলে মেয়েদের সৃজনশীলতা ও বুদ্ধিমত্তার খর্বায়নের দর্শন। যে দর্শন আসলে আত্মবলিকরণ বা সেল্ফ-ভিক্টিমাইজেশনের দর্শন। এবং, সর্বোপরি, যে দর্শন আসলে পিতৃতন্ত্রের দর্শন।
তদুপরি, ওই যে যশোধরা লিখলেন না, একটি শান্ত-শান্ত, ভিতু-ভিতু মেয়ের নিজেকে সুনীলের নায়িকার ছাঁচে ঢেলে সাজানোর গল্প? সে গল্পের সাথে তাঁর এই “রাজনৈতিক পদক্ষেপ”-এর গোল গোল কথার একটি অচ্ছেদ্য যোগাযোগ আছে। খুব স্পষ্ট করে বলতে গেলে, ওই যে শান্ত-শান্ত, ভিতু-ভিতু, নরম-নরম মেয়ে হয়ে থাকাটা কোন মতাদর্শহীন ব্যাপার নয়। ওই ম্যাদামারা, মিষ্টি মেয়ে হয়ে থাকার মধ্যেও একটা রাজনীতি আছে, যাকে স্থিতিস্থাপকতার রাজনীতি বলে উল্লেখ করেছি একটু আগে। একধরনের আরাম আছে। নিশ্চিন্ততা আছে। যেমন আরাম ও নিশ্চিন্ততা থাকে মেনে নেওয়ায়, মানিয়ে নেওয়ায়। আর, কোথাও যেন এই মেনে নেওয়া-মানিয়ে নেওয়ার সংস্কৃতি আরো গভীরভাবে পেঁচিয়ে ধরে থাকে পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে। মেনে নেওয়া- মানিয়ে নেওয়া মেয়েদের আমরা “লক্ষ্মী মেয়ে” বলি। সমাজ ও পারিপার্শ্বিক তাদের পুরস্কৃত করে। অবশ্য সে পুরস্কারও দেওয়া হয় পিতৃতন্ত্রের নিয়ম মেনেই। কাজেই, এই যে বাংলা কবিতা বাজারে তথাকথিত শান্ত, ভিতু, নরম-নরম মেয়েদের আধিক্য, এটা কিছু কাকতালীয় নয়। ওই শান্ত-ভিতু-নরম প্রতিমূর্তি খাড়া করেই এই মেয়েদের কবিতা বাজারে জায়গা পেতে হয়েছে। আর, কবিতা বাজার মানে তো বিমূর্ত কিছু নয়। কবিতা বাজার মানে তো বিশেষ বিশেষ পত্রিকায় জায়গা পাওয়া। বিশেষ বিশেষ পত্রিকায় জায়গা পাওয়া মানে বিশেষ বিশেষ কবিতা — “দাদা”-দের নেকনজরে পড়া। তাঁদের নাম কখনও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। কখনও জয় গোস্বামী। নেকনজরে পড়তে গেলে তো লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থাকতে হয়। বাজারের কবিতা-ডনদের কবিতায় খুঁত বা মতাদর্শ খুঁজলে চলে না। আর, সেসব মনে মনে খুঁজলেও, মুখ খুললে চলে না। কাজেই, এই যে আটের দশক ও পরবর্তী সময়ের বাংলা মেয়েদের কবিতা, তার সিংহভাগের উন্মেষ ঘটল বাজারের নিয়মে, পিতৃতন্ত্রের নিয়মে। পিতৃতান্ত্রিক বাজারের নিয়মে।

ছয় ও সাতের দশকে বাংলা মেয়েদের কবিতার উন্মেষ ঘটল পিতৃতান্ত্রিক বাজারের হাত ধরে। কবিতার বিষয় ও আঙ্গিকও নির্ধারিত হল পিতৃতন্ত্রের নিয়মে। বাজারের পিতৃতন্ত্রের দাগিয়ে দেওয়া গণ্ডীর মধ্যে। কাজেই, আটের দশক থেকে বাংলার মেয়েদের কবিতা থেকে একদম প্রায় দুরমুশ দিয়ে ঘষে তোলার মত করে উঠে গেল — এমনও বলা যায় উঠিয়ে দেওয়া হল – প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ। তার বদলে গেঁড়ে বসল বিষাদ, বিবিক্তাবাদ। আমি আগেও অন্য লেখায় বলেছি,‌ আবারও বলি, বিবিক্তাবাদ হল গিয়ে সেই দর্শন যেখানে গিয়ে মধ্যবিত্ত বাঙালি তার মেনে নেওয়া, মানিয়ে নেওয়ার পাপস্খলন করে যায়। মানে, ওই আর কি, আমি সব মেনে নিয়েছি তো হয়েছেটা কী, দেখো না, সেই মেনে নেওয়া নিয়ে আমার অ্যাত্তো অ্যাত্তো খারাপলাগা আছে। কারণ, হাজার হোক, আমি হলাম গিয়ে সংবেদনশীল, মধ্যবিত্ত বাঙালি। তো, এই বিবিক্তাবাদ আটের দশকের মেয়েদের কবিতায় এক বিশেষ ভাষা নিয়ে হাজির হলো।
যেমন ধরুন, সংযুক্তা বন্দোপাধ্যায়ের “রান্নাঘর” কবিতাটি। ১৯৮৯ সালে তাঁর কাব্যগ্রন্থ “অবিদ্যা”- তে প্রকাশিত:
“[এক]
সারাদিন চাল বাছি, ডাল বাছি, ভাঁজ করি নতুন ও ব্যর্থ মশারী। কয়লার গুঁড়ো ছুঁলে আঙুল শিউরোয় খুব, যে – চামড়া আগুনের উষ্ণতা শেখেনি। প্রত্যেক রাতের পর একরকম আসে প্রত্যেক সকাল, অবিকল মানুষের মতো খায়-দায়-দাঁত মাজে প্রতিটি মানুষ, আমার কোনও মোহ হয় না। ‘মোহ’-র বদলে এইখানে ‘মায়া’ শব্দ যোগ্যভাবে ব্যবহার করলেই স্পষ্ট হবে কিছু সাহসী ও দরকারি অপরাধবোধ। আমার অনুষ্ণ আঙুলময় আজকাল তাই অপরাধবোধ খেলা করে, দশনখের অচেতন সেলে সেলে টোকা দিলে শব্দ হয় ‘অপরাধ’, ‘অপরাধবোধ’।
এইসব আগলে নিয়ে সারাদিন এককোণে ব’সে থাকি জবুথবু। চাল বাছি, ডাল বাছি, সারাদিন ভাঁজ করি নতুন ও ব্যর্থ মশারী।
[দুই]
বাজারের ধুলো আর জলকণা মেখে উৎফুল্লতা এখানেই ক্রমে জড়ো হয়।
আপার নার্সারির বালিকার মতো গালে-হাত উবু হয়ে বসে থাকি আনাড়ি বিস্ময়ে। মৃত পুঁইডাটা বেয়ে, দেখি, উঠে আসছে প্রকৃত নতুন তথ্য। জানলায় হাঁসপুকুরও ভেসে যায় চোরা জলে, শেষ জৈষ্ঠ্যের ভোরে মেঘ নেমে আসে প্রত্যেকটি প্রাকৃতিক পণ্যের ওপর। খোপ-খোপ গোল ডালাটিকে ছুঁই, সমস্ত ফোড়নশস্য আজ ঐতিহ্য জানায় ঢের। মোহ নেই, তবু আকস্মিক মায়া হয়। এই সমারোহে ব’সে থাকি, আনাজের ঝুড়ি থেকে বোঝা যায় মানুষের হাঁটা-চলা মৃদু ও সশব্দ কথা, বাজারের ধুলো, জলকণা…
[তিন]
অপরাধবোধ ও উৎফুল্লতার যথাযথ সমন্বয়ের পর সহসাই রান্নাঘর জুড়ে মেঘ ঘোর হয়ে আসে। পরে চোখ কচলে দেখি, মেঘ নয়, ফুটন্ত ভাতের বাষ্প উঠে আসছে সমস্ত আচ্ছন্ন করে, যে-ছায়ায় বেঁচে থাকে মানুষ ও মানুষের রন্ধনপ্রণালী। দেখে, দ্রুত আমি উঠে যাই উনুনের ধারে, আধখোলা হাঁড়ির ঢাকাটি সরিয়ে নেমে পড়ি উথলোনো জলে। হাঁড়িভরা ভাতের জীবন্ত গন্ধে তাপ-ও-জলের পরিণতি হেসে উঠে আমাকেও টেনে নেয়, গ্রাস করে অভিজ্ঞতা দিয়ে।”
প্রথমত বলি, কবিতাটি জটিল — মোটেও সরলরৈখিক নয়। কবিতাটির “রান্নাঘর” নামের মধ্যে একধরনের জটিল ব্যঞ্জনা আছে। আছে জটিল সামাজিক ইতিহাস। মানে, রান্নাঘর হল গিয়ে — ঐতিহাসিকভাবে — মেয়েদের জগত। না, একথা আমি কোনওভাবেই বলছি না যে হেঁশেল বা রান্নাঘরের মধ্যে এমন কোনও বস্তু আছে, যা তাকে মেয়েদের জগত বলে গড়ে তুলতে সাহায্য করে। রান্নাঘর মেয়েদের শ্রমের জগত। বলা যেতে পারে, কর্মস্থল। তবে, যে কোনও কর্মস্থলকে ঘিরেই তো থাকে আমাদের জটিল আত্ম-পরিচিতির জগত। বাড়ির রান্নাঘর ও তদঘনিষ্ঠ মেয়েদের জীবনও তার ব্যতিক্রম নয়।
অদ্ভুতভাবে, সংযুক্তার কবিতার রান্নাঘরে কোন শ্রম নেই। রান্নাঘরের শ্রমজাত যে সব উপকরণ — চাল, ডাল, ফোড়ন — সেসব আছে। কিন্তু, রান্না নামক কার্যটিই নেই। কবিতার আত্মন রান্নাঘরে স্থিত — বোঝা যায়। অথবা, সত্যি সত্যিই স্থিত না হলেও, তার ভাবনাচিন্তা, কল্পনা, সমস্ত রান্নাঘরকে ঘিরেই। কবিতাটি ঘিরে অদ্ভুত বিষাদ, অদ্ভুত হতাশাগ্রস্ত একটি পরিমণ্ডল। যেমন ধরুন, এই লাইনটি — “প্রত্যেক রাতের পর এরকম আসে প্রত্যেক সকাল, অবিকল মানুষের মত খায়-দায়-দাঁত মাজে প্রতিটি মানুষ, আমার কোনও মোহ হয় না।” একটু কান পেতে শুনলেই এই লাইনটিতে শুনতে পাওয়া যায় হাংরি-কৃত্তিবাসদের বিবিক্তিবাদের পদধ্বনি। যা এই কবিতায় নেই, তা হল হাংরি-কৃত্তিবাসসুলভ পুরুষালি ক্ষোভ, রাগ। নেই মধ্যরাত্রের কলকাতার রাস্তাশাসনের অঙ্গীকার। এবং সেই অঙ্গীকার ও বাস্তবতার মধ্যে নিম্ন-মধ্যবিত্ত বাঙালি যুবকের নিজেকে সম্প্রসারণের প্রচেষ্টা।
তার বদলে আছে রান্নাঘর। রান্নাঘরে উবু হয়ে বসে থাকা। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, এই চিত্রকল্পে আমরা পেলাম একটি জটিল সামাজিক ইতিহাস। মানে, সত্যি তো, যেভাবে শুঁড়িখানা আর মধ্যরাত্রের রাস্তা শাসন করে ব্যক্ত হয় যুবকদের সামাজিক বিচ্ছিন্নতাবোধ, সেই পথ মেয়েদের কাছে বন্ধ। তার বদলে মেয়েদের আছে রান্নাঘর। কিন্তু, আবার এও সত্য যে, যদি আমরা একটি বাড়ির ভৌগোলিক ও স্থানিক রাজনীতি নিয়ে ভেবে দেখি, তাহলে দেখব, হেঁশেল ব্যাপারটি বাড়ির মূলস্রোতের একটু তফাতে। সেখানে সচরাচর পুরুষদের পদচারণা শোনা যায় না। শোনা গেলেও, রান্নাঘরের খুঁটিনাটি নিয়ে তাঁরা ভাবেন না। হ্যাঁ, ঐতিহাসিকভাবে, মেয়েরা রাগে ও দুঃখে রান্নাঘরে আশ্রয় খুঁজেছেন। চোখের জল ফেলেছেন রান্নাঘরের কোণায় বসে। গোঁসাঘর বানিয়েছেন হেঁশেলকে। কাজেই, সংযুক্তার কবিতায় মেয়েদের সেই সামাজিক রাজনীতিই উঠে এলো। কিন্তু, এই যে রান্নাঘরে মেয়েদের আশ্রয় খোঁজা, তার মধ্যে তো কোন সম্প্রসারণের দাবি নেই। আছে বাস্তবতাকে নেওয়া। মেনে নিয়ে একটু দুদণ্ড খোঁজা। এবং, আছে নিজেকে ছোট করে নেওয়া। অর্থাৎ, আবার সেই খর্বায়ন। হ্যাঁ, এই খর্বায়নের বাস্তবতা উঠে এল সংযুক্তার কবিতাতেও। এল প্রত্যক্ষভাবে আত্মনের নিজেকে আপার নার্সারি বালিকার সাথে তুলনায়।
খেয়াল করে দেখুন, কবিতাটিতে আত্মন একা। তিনি রান্নাঘরে, কিন্তু আশেপাশে পরিবার নেই। ভাবতে ইচ্ছে হয়, এই না-থাকার মধ্যে আছে এক অন্যধরনের গার্হস্থ্যতা কল্পনা। পরিবারের বাইরে একক নারীর জীবন। যেমন থাকি আমি কিংবা আমার অনেক বন্ধুরাই। কিন্তু, কবিতাটিতে যে দমবন্ধ-বোধ, সে তো আমার/আমাদের জীবনে নেই! বরং, খুব আংশিকভাবে হলেও আছে উদ্‌যাপন। খুব ভাঙাভাঙাভাবে হলেও পরিবার থেকে বেরিয়ে আসতে পারার উদ্‌যাপন। ভয়ঙ্কর অসম্পূর্ণ হলেও নিজের জায়গা লড়ে নিতে পারার উদ্‌যাপন। কোথায় সেই উদ্‌যাপন? কোথায় সেই লড়াই এই কবিতায়?
নেই। একদম নেই। তার বদলে আছে হতাশা-বিলাস। যেমনভাবে ছিল কৃত্তিবাস-হাংরিদের কবিতায়। কাজেই, বলতে বাধ্য হচ্ছি, সংযুক্তার মতো আটের দশকে লিখতে আসা কবি মেয়েরা, সমাজ, লিঙ্গ মতাদর্শ, মেয়েদের লড়াইয়ের বাস্তবতা, অথবা কবিতার ভাষা, কোনটা নিয়েই কোনও গভীর বৌদ্ধিক চর্চা করেননি। একধরনের “আমি-খারাপ-আছি” জাতীয় কবিতার খোলস মিলেছিল ছয় ও সাতের দশকের পুরুষ কবিদের হাত ধরে। এবং, খুব দ্রুতই সেই খোলস বাজারের প্রসাদ লাভ করে। সেই খোলসেই কবিনীরা মূলত তাঁদের মেয়েলি কাঁচামাল একটু ঢেলে দিয়েছেন মাত্র।
কাজেই, খেয়াল করে দেখুন, এই বিবিক্ত-বিবিক্ত আত্মনের হাত ধরে কবিতাটি থেকে বাদ পড়ল পরিবার। বাদ পড়ল পরিবারের সাথে আত্মনিয়ন্ত্রণ খোঁজা একটি মেয়ের লড়াইয়ের বাস্তবতা। আর, আর… বাদ পড়ল মধ্যবিত্ত গার্হস্থ্যতা অন্তর্গত শ্রেণী-নিপীড়ন ও শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাসও। মানে, জীবনে ঠিক কটি মধ্যবিত্ত রান্নাঘর দেখেছেন, যেখানে কাজের লোক নেই? বলুন তো দেখি? তো, সে যাই হোক, এইসব বাদ পড়ার ভিতর থেকেই আমরা কবিতাটিতে পেলাম অমোঘ একটি পঙক্তি: “মোহ নেই, তবু আকস্মিক মায়া হয়। এই সমারোহে ব’সে থাকি, আনাজের ঝুড়ি থেকে বোঝা যায় মানুষের হাঁটা চলা মৃদু ও সশব্দ কথা, বাজারের ধুলো, জলকণা…” পংক্তিদুটির মধ্য দিয়ে কবিতাটির শরীরে তৈরি হয় একধরনের দ্বৈততা। ঠিক যেখানে আগের পংক্তিতে তৈরি হয়েছিল একধরনের প্রত্যাখানের পরিমণ্ডল — “মোহ হয় না” বলার মধ্য দিয়ে — ঠিক সেই পরিমণ্ডলটি দ্বিতীয় স্তবকে এসে ভেঙে ফেলা হল। অর্থাৎ, আত্মনের মোহহীনতা কবিতাটিতে রয়ে গেল অসমাপ্ত হয়ে।
এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। এই হল গিয়ে আটের দশকের বাংলা মেয়েদের কবিতার আধিপত্যকারী নারী প্রতিমূর্তি, লিরিকীয় বৈষয়িকতা। আধুনিক নায়িকা, তার পড়া আছে অল্প-অল্প নারীবাদ। জানা আছে, যে নারীবাদী হতে গেলে একটুআধটু পরিবার-বিবাহ এসব বিষয় নিয়ে একটু অসন্তোষ প্রকাশ করতে হয়। কিন্তু, আবার, সত্যি-সত্যিই পরিবার-বিবাহ এসব বিষয়কে প্রশ্ন করলে যে লড়াই ব্যক্তিগত ও সামাজিক স্তরে করতে হয়, তার ধক নেই। অতএব, সেই বিবিক্তাবাদ। সেই আমি-খারাপ-আছির সুপরিচিত মধ্যবিত্ত ন্যাকামো।
কিন্তু, ওই যে আগেই বলেছি, এই কবিতাটি জটিল। তাই, খেয়াল করে দেখুন, কবিতাটিতে “আনাজের ঝুড়ি” রূপকল্পটি অদ্ভূত বাঙ্ময় হয়ে উঠলো। মধ্যবিত্ত অন্তঃপুরে, আনাজের ঝুড়ি বেয়ে উঠে এল বাইরের সর্বজনীনতা – যাকে পোষাকি ভাষায় পাবলিক স্ফিয়ার বলে আর কী! “মানুষের হাঁটা-চলা,” “মৃদু ও সশব্দ কথা”, “বাজারের ধুলো,” “জলকণা”। মানে, সত্যিই তো, শাক-সব্জি, আনাজ, চাল মায় প্রতিটি ব্যবহার্য দ্রব্যের ছায়া ধরেই তো মধ্যবিত্ত গৃহস্থলীর অন্দরে উঠে আসে কৃষকের ক্ষেত, শ্রমিকের কারখানা!
কিন্তু, সেই উপলব্ধির সাথে সাথে যে ভাঙন আসতে পারত কবিতাটির আত্মনের জীবনে, বা কবিতাটির শরীরে, তা কিন্তু এল না। কবিতার আত্মন দরজা ভেঙে, বা নিদেনপক্ষে হাত দিয়ে ঠেলে রান্নাঘরের বাইরে এল না। কি ঘটল তার বদলে? “দেখে, দ্রুত আমি উঠে যাই উনুনের ধারে, আধখোলা হাঁড়ির ঢাকাটি সরিয়ে নেমে পড়ি উথলোনো জলে। হাড়িভরা ভাতের জীবন্ত গন্ধে তাপ ও জলের পরিণতি হেসে উঠে আমাকেও টেনে নেয়, গ্রাস করে অভিজ্ঞতা দিয়ে।” অর্থাৎ, আমরা কোনও ভাঙন দেখলাম না। তার বদলে দেখলাম, আত্মনের আরও বেশি-বেশি করে লীন হয়ে যাওয়া। গার্হস্থ্যতার সাথে, হেঁশেলের উপকরণ সামগ্রীর সাথে। সেই অন্তর্লীনতার মধ্যে একধরনের অতিবাস্তব, জাদুবাস্তব, পরাবাস্তব — যাই বলি না কেন — তার ছোঁয়া রইল বটে। কিন্তু, সে অতিবাস্তবীয় মুহূর্তেও আসলে হয়ে রইল খর্বায়নের দর্শন ও নন্দনতত্ত্বের খতিয়ান। খুব অবশ্যম্ভাবীভাবেই, ভাতের হাঁড়ির উথলোনো ঢাকা বেয়ে নামতে গেলে মানুষকে ছোটই তো হতে হয়।
জানি, বহু পাঠক এই খর্বায়নের নন্দনতত্ত্বের মধ্যে একধরনের প্রতিরোধ দেখবেন। কিন্তু, এ কোন ধারার প্রতিরোধ যেখানে কবিতার আত্মন খর্বায়ন ও আত্মোৎপীড়ন ছাড়া আর কোনও ভাষা ও পথ খুঁজে পায় না? মার্কিনী মার্ক্সবাদী সমালোচক ফ্রেড্রিক জেমসন একবার বলেছিলেন, “It is easier to imagine the end of the world than to imagine the end of capitalism.” সংযুক্তা-তথা বাংলার কবিনীকুলের অবস্থাও অনেকটা সেইরকম। দরজা খুলে বাইরে বেরনোর থেকে, কোনও আত্ম-মুক্তি ও প্রতিরোধের বয়ান কল্পনা করার থেকে তাঁদের পক্ষে নিজেদের খর্বায়ন, আত্মনিপীড়ন মায় মৃত্যুর কল্পনা করাও সহজ। তাই, সংযুক্তার কবিতাটি হয়ে ওঠে শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, উচ্চবর্ণের মেয়ের প্রতিবাদহীনতার নথি, প্রতিরোধের ভাষা ও আঙ্গিক খুঁজে না পাওয়ার খতিয়ান। কিন্তু, তার সাথে সাথে আরেকটি বিষয়ও এখানে এসে পড়ে। মানে, মধ্যবিত্ত মেয়ে যদি সত্যি সত্যিই প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চায়, তাহলে তাকে প্রশ্ন করতে শিখতে হবে পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটির ভিত্তিগত রাজনীতিকে। মানে, বাড়িতে একটু চিল্লামিল্লি, দেওয়ালে মাথা ঠোকার হিস্টিরিয়া-ধর্মী নাটক মধ্যবিত্ত মেয়েরা প্রচুর পরিমাণে করে থাকেন, সেসবের কথা বলছি না। সত্যি সত্যিই গাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবারের ঘেরাটোপ ও তৎসংলগ্ন রাজনীতির প্রত্যাখানের কথা বলছি। কিন্তু, সেই প্রত্যাখানে তো ঝুঁকি আছে। আছে নিজেকে গড়ে তোলার প্রশ্ন। সাথে সাথে, পরিবার মানে তো একধরনের নিরাপত্তাও। সে যতই অবদমনপূর্বক হোক না কেন। আবার, পরিবার মানে তো সম্পত্তিও। আর সম্পত্তির সাথে অবশ্যম্ভাবীভাবে আসে শ্রেণী। অতএব প্রত্যাখানের চক্করে না গিয়ে, ঘরে বসে দুঃখবিলাস অনেক সহজ। কাজেই, যে মেয়েলি প্রতিবাদহীনতার কাব্যিক নীলছক আমরা সংযুক্তার কবিতায় পেলাম, সেই নীলছকটিকে কখনওই তার শ্রেণী রাজনীতি ব্যতিরেকে দেখা যাবে না।
কিন্তু, যেটা দাঁড়াল আমার কাছে — একজন ব্যক্তিগত পাঠক হিসেবে — তা হল, আমি মেয়েদের কবিতা পড়তে এসেও ঠিক সেই বোধটিই অনুভব করেছি, যা করেছি পুরুষদের কবিতা পড়তে গিয়েও, যে বাংলা কবিতায় আমার কোনও জায়গা নেই। আমার লড়াইসমূহেরও কোনও জায়গা নেই। যেমনভাবে বাংলার পুরুষ-কবিতায় একধরনের নারী-প্রতিমূর্তি তৈরি হল, যার প্রেম ছাড়া কিছু নেই। যার যৌনতা ছাড়া কিছু নেই, তেমনি মেয়েদের কবিতাতেও একধরনের প্রেম ও যৌনতাসর্বস্ব লিরিকীয় নারী বৈষয়িকতা তৈরি হল। আর, যেখানে পুরুষ-কবিতায় তৈরি হল রাত্রির কলকাতা শাসন করার উপমা, মাতলামো, লালবাতি-অঞ্চল গমন, মেয়েদের কবিতায় এল গার্হস্থ্যতা, ডিপ্রেশন-ডিপ্রেশন খেলা, বিষাদ-বিষাদ খেলে আরো বেশি ঘরের ভিতর সেঁধিয়ে যাওয়া। ছোট হয়ে যাওয়া। খুব স্পষ্ট করে বললে যেটা দাঁড়ায়, তা হল গার্হস্থ্যতা আর যৌনতা, এই দুই মেরুতেই প্রদক্ষিণ করল আটের দশক ও তার পরবর্তী সময়ের সিংহভাগ বাংলা মেয়েদের কবিতা, এবং সেটা করল স্থিতিস্থাপকতা রাজনীতিকে মেনে নিয়েই।
বিজয়া মুখোপাধ্যায়ের ছয়ের দশকের শেষে লেখা কবিতায় ধরা পড়েছিল মেয়েদের বৌদ্ধিক, পাঠকগত বৈষয়িকতা নিয়ে যে টানাপোড়েন, তা পরবর্তী সময়ের মেয়েদের কবিতা থেকে বিলকুল ধুয়েমুছে গেল। এবং, যেটা দেখা গেল, যে পুরুষপ্রধান কবিতা — প্রতিষ্ঠানসমূহ বাংলাভাষায়, তাঁরা এই খর্বাকৃতি মেয়েদের কবিতাকে দুহাত উপরে তুলে স্বাগত জানালেন। ইনিয়েবিনিয়ে লেখা, মেরুদণ্ডহীন মেয়েদের কবিতার বই একেরপর এক পুরস্কৃত হলো। একসময়ের রাগী যুবকেরা — মানে কৃত্তিবাস পত্রিকা ইত্যাদি — এই ধারার কবিতাকে পুরস্কৃত করলেন। অর্থাৎ, স্বীকৃতি জানালেন।
তো, সেই স্বীকৃতির ভাষা কেমন হলো? যেমন ধরুন, মন্দাক্রান্তা সেনের ‘প্রেমের কবিতা’-র সূচনায় মৃদুল দাশগুপ্ত লিখলেন, “সাহিত্যের বাজারি ব্যবস্থায় তসলিমার ওই উত্থানের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মেয়েদের এই বৈপ্লবিক অগ্রগতির সম্পর্ক নেই। বস্তুত তসলিমার নারীবাদ এই বঙ্গের, এমনকি এই ভারতের বিষয়ই নয়। মন্দাক্রান্তা এসেছে এই বাংলায় মেয়েদের নীরব বিপ্লবের ঢেউইয়ে ভেসে।” এই যে “মেয়েদের নীরব বিপ্লব” বলে একটি ধারণা খাড়া করলেন মৃদুল, সেখানে আমরা আবারও দেখলাম তাঁর পূর্বোক্ত কবিতা “বিবাহ-প্রস্তাব”-এর নারী প্রতিমূর্তির ছায়া — নীরব, বিনম্র, আনত। দেখলাম, যে নব-নারীত্বের কথা আমি এই রচনাতে আগে বলেছি, তার ছায়াও।
মানে, সমাজ তথা মৃদুলের চাই আধুনিকা নারী — স্মার্ট, মোটামুটি ঝকঝকে, অন্তঃপুরবাসিনী নয়, অন্তরালবর্তিনী নয়, নাটক-সিনেমা-কবিতা নিয়ে ফোড়ন কাটতে পারে পুরুষদের সাথে। যাকে পাশে নিয়ে হাঁটলে বেশ একটা আরে-কী-মাল-বাগিয়েছি জাতীয় গর্ব হয়। কিন্তু, সে আধুনিকা যেন কভুও প্রশ্নবিলাসিনী না হয়! তার বিপ্লবও, তাই, মৃদুলের ভাষ্য অনুযায়ী, হতে হবে “নীরব!” কিন্তু, বিপ্লব যে নীরব হয় না! নীরবও হয় না, সুন্দর পরিপাটীও হয় না — যেমনটি হয়ে থাকে চায়ের পেয়ালা-মোমবাতিদানের গার্হস্থ্য। এবং মৃদুল তাঁর অন্যান্য কবিতাতে নিজেও কিন্তু সশব্দ বিপ্লবই চেয়েছেন। তো, মেয়েদের এই “নীরব বিপ্লব”কে এত পিঠ-চাপড়ানি দেওয়ার কি আছে – বিশেষ করে মৃদুলের মত কবির? আসলে এরই তো নাম পিতৃতন্ত্র। চড়থাপ্পড় ধর্ষণের পিতৃতন্ত্র নয় যদিও। পিঠচাপড়ানো, মাথায় হাত বুলানো পিতৃতন্ত্র। যাকে ইংরেজিতে বলে, বেনেভোলেন্ট পেট্রিয়ার্কি। ঊনিশ শতক থেকে শুরু করে আজ অবধি বাঙালি মধ্যবিত্তের লিঙ্গ রাজনীতির ভিত্তি যার উপরে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু, যেটা ভাবার বিষয় তা হল, মৃদুলের এই “মেয়েদের নীরব বিপ্লব”-এর রূপকল্পের মধ্যে ধরা পড়ল পরোক্ষভাবে হলেও একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক সত্য। সেটা হল এই যে, আটের দশক ও তার পরবর্তী সময়ের এই যে এতসংখ্যক মেয়েদের বাংলা কবিতা লিখতে আসা, তার মধ্যে আর যাই হোক, কোনও প্রকৃত বিপ্লবী নারীবাদ নেই। নেই কোনও প্রতিবাদের সংস্কৃতিও।
তো, মৃদুল আরো লিখলেন, “কবিরা মুক্ত। কবিরা স্বাধীন। কবিরা পুরুষ। ব্যতিক্রমী কিছু মেয়ে কবিতা লিখতে আসেন। পুরুষের কাছে মুক্তি অনন্ত। দিকে দিকে তার দ্রোহ। যে মেয়ে কবিতা প্রয়াসী, তার মুক্তির প্রাথমিক শর্তই হল যৌনতার মুক্তি।” এই কয়েকটি লাইন পড়ে থমকে দাঁড়াতে হয়। যে প্রশ্নটা স্বতঃপ্রণোদিতভাবে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে, তা হল, মানে? মানেটা কী? একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে, মৃদুল এখানে পৌরুষ ও কবিতার একধরনের ভিত্তিগত সমীকরণ ঘটিয়েছেন। কিন্তু তার সাথে সাথে একটু বদান্যতা দেখিয়ে এও বলেছেন যে, কোনও কোনও “ব্যতিক্রমী” মেয়েরা কবিতা লিখে থাকেন। এবং, তার বদান্যতার দায় হিসেবে কবি মেয়েদের মুক্তির পথও দাগিয়ে দিলেন মৃদুল। এবং সেই মুক্তির প্রথম শর্তই নাকি হল যৌনতার মুক্তি।
প্রথমত, একটি প্রশ্ন না করে পারছি না — আমার মুক্তি, আমার কবিতার মুক্তি কীভাবে আসবে, তা মৃদুল ঠিক করে দেবার কে? যৌনতার মুক্তি ব্যতীত আমার বা অন্য কোনও মেয়ের বা তাবৎ মানবসমাজের মুক্তি ঘটবে, একথা আমি ভাবি না। কিন্তু, “প্রাথমিক শর্তই” যদি হয় যৌনতার মুক্তি, তাহলে ঠিক কী হবে সেই মুক্তির ধারা? মানে, কাকে বলব ঠিক যৌনতার মুক্তি? যে যৌনতার মুক্তির সাথে অর্থনৈতিক মুক্তি, রাজনৈতিক মুক্তি বা বৌদ্ধিক মুক্তির দৃঢ় সংযোগ থাকে না, সে কীসের যৌনমুক্তি? মৃদুলের “যৌনতার মুক্তি”তে সেসব থাকবে তো? কিন্তু, মৃদুল সেসব জটিলতার ধারপাশ দিয়ে গেলেন না। তো, দেখা যাক, যে ধরনের কবিতা, বা যাঁর কবিতা নিয়ে মৃদুল এত কথা বলেছেন — মন্দাক্রান্তা সেন — তাঁর লেখায় মেয়েদের যৌনমুক্তির ভাবনা কীভাবে এল:
একটি অসম পরকীয়া
কথা বলো মা-বাবার সাথে
আমার আপত্তি নেই তাতে
আমাদের কথা পরে হবে।
সবকিছু দারুণ সংযমী
গোপনে যে দুঃসাহসী তুমি
একথা জেনেছি যেন কবে?
মা তোমাকে পছন্দই করে
বাবাও ভাইয়ের মতো ধরে
কিন্তু তুমি বন্ধু তো আমারই
কাকিমা এল না কেন, সোনা?
ওকে যেন কখনও বোলো না
আমি ভালো চুমু খেতে পারি!
সদর দরজা খুলে দিতে
একসঙ্গে নামব সিঁড়িতে
সে-মুহূর্তে আমরা পাগল,
ঝড়ো শ্বাস, সিঁড়ির আড়ালে
অতর্কিতে বিছে কামড়ালে
রক্তময় জ্বালা অনর্গল
ধরে যাবে; ধরবে ধরুক
তোমার বুকের মধ্যে মুখ
ধরে যায় কেমন সহজে-
কাকিমা, মিতালি, ভালো আছে?
ওরা কি তোমার কাছে কাছে
আসে, দ্যাখ, কোনও দাগ খোঁজে?
কাল যাব তোমার অফিসে
ঠিক ঠিক চারটে পঁচিশে
তারপর ভুল দিগবিদিক…
শহীদ মিনারে উঠে গিয়ে
বলে দেবো আকাশ ফাটিয়ে
ইন্দ্রকাকু আমার প্রেমিক।”
দ্বিধাহীনভাবে বলি, কবিতাটি কৌতূহলোদ্দীপক। বাংলা ভাষায় এজাতীয় কবিতা খুব বেশি লেখা হয়নি। বিশেষ করে, মেয়েদের কলমে, কমবয়সী মেয়েদের ভাষ্যে। নয়ের দশকের গোড়ার দিকে তো হয়ইনি। কবিতাটিতে খুব সোজাসাপ্টা ভাষায়, বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের অকথিত, অপ্রকাশিতব্য নিম্নাঙ্গ — ইংরেজিতে যাকে বলে, আন্ডারবেলি — উঠে এসেছে। এই আন্ডারবেলি বাস্তব। আমরা সবাই জানি। কাজেই, এই যৌন আন্ডারবেলি সরাসরি, সোজাসাপ্টা একটি গল্পের মধ্য দিয়ে যখন লেখেন মন্দাক্রান্তা, তখন আমাদের ন্যাকা-ন্যাকা মধ্যবিত্ত সুস্থ সংস্কৃতির বাঙালি জগতে একটা ধাক্কা লাগে। অন্তত নয়ের দশকের গোড়ার দিকে যখন মন্দাক্রান্তা লিখেছিলেন, তখন লেগেছিল। আমরা বিশ্লেষণের ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলাম। মৃদুলও লেখার সূচনাতেও সেই বিশ্লেষণ হারানোর দায় এড়াতে চাইলেন কতগুলো গোল গোল কথা বলে: “আমি যখন পড়লাম মন্দাক্রান্তা লিখেছে “ইন্দ্রকাকু আমার প্রেমিক”, মনে হল আমরা যারা ’৭০-এর কবিতা প্রয়াসী, আমাদের ঠিক পরের ৭০-৮০-র সীমান্তবর্তিনীদের চেয়ে মন্দাক্রান্তা এক-দেড় দশক পরের হলেও, সেই ১০-১৫ বছরে মন্দাক্রান্তা-সহ পশ্চিমবঙ্গে তার সমবয়সীরা এক-দেড় ধাপ নয়, দু-আড়াই ধাপ এগিয়ে গেছে।”
এগিয়ে তো গেছে, বুঝলাম। কিন্তু, ও মৃদুলকাকু, কেমন করে এগিয়ে গেছে, কি সেই এগিয়ে যাওয়া, একটু খোলসা করে বলুন দিকিনি! যাই হোক, কবিতার ইতিহাসের দিক থেকে দেখতে গেলে যেটা দেখা যাবে, তা হল, মন্দাক্রান্তার কবিতাটি পূর্ববর্তী পুরুষ কবিদের লেখার একধরনের পুনর্লিখন। যেখানে ফাল্গুনী রায় থেকে শুরু করে ভাস্কর চক্রবর্তী পর্যন্ত বোন, ভাইঝি ইত্যাদিদের প্রতি যৌন আকর্ষণের সুড়সুড়ি দিয়ে চুদুরবুদুর কবিতা ইঙ্গিতে ইশারায় লিখলেন, মন্দাক্রান্তা সেখানে একটানে ওই ইঙ্গিত-ইশারার মুখোশ খুলে ফেললেন। লিখলেন মেয়েটির ভাষ্য। মেয়েটি এখানে আর নিষিদ্ধ অজাচারী আকর্ষণের বস্তু নয়। সে কথক। বিষয়। সাবজেক্ট।
মেয়েটিকে এখানে “পুরুষের লোলুপ স্পর্শের” শিকার বানিয়ে বাঙালি মধ্যবিত্তমার্কা কোনও ভিক্টিমোলজির ধারপাশ মাড়াননি মন্দাক্রান্তা। মেয়েটি, এই সম্পর্কটিতে অংশগ্রহণকারী। এজেন্ট। বিষয়। সাব্জেক্ট। এই সম্পর্কটিতে অংশগ্রহণ করার মধ্য দিয়ে মেয়েটি তৈরি করে তার পরিচিতি। পায় একধরনের রোমাঞ্চ। বোধ করে একধরনের আনন্দবোধ। তো, একভাবে দেখতে গেলে কবিতাটি হয়ে ওঠে সেই রোমাঞ্চ-যৌন সুখ-আনন্দবোধ ইত্যাদির মিশ্রণে তৈরি হওয়া মেয়েটির যৌন পরিচিতির নথি। অনস্বীকার্যভাবে, এই নথিভুক্তির মধ্যে একধরনের সাহসিকতা আছে। নিঃসন্দেহে, একধরনের নব-নারীত্ব তথা নারীবাদী লিঙ্গচেতনার সার্বিক বিকাশ ব্যতিরেকে এই জাতীয় লেখা বা লিরিকীয় বৈষয়িকতা তৈরি বাংলায় সম্ভব ছিল না।
কিন্তু যদি আরেকটু খুঁটিয়ে পড়ি কবিতাটা, তাহলে কী ধরা পড়ে? আমি বলব, সেই গড়পড়তা থোড়-বড়ি-খাড়া, খাড়া-বড়ি-থোড়ের স্থিতিস্থাপকতার রাজনীতি। অনস্বীকার্যভাবে, যৌনতার সাথে — বিশেষত বিষমকামী বিবাহিত যৌনতার সাথে — সামাজিক-অর্থনৈতিক স্থিতিস্থাপকতার সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এই লেখার মূল বিষয় সেটা নয়। এবং এঙ্গেলস-সাহেব থেকে শুরু করে অধুনাসময়ের লিঙ্গ-তাত্ত্বিকেরা এ নিয়ে বহু আলোচনা করেছেন। সেই আলোচনার পুনরাবৃত্তি এ লেখার গূঢ় উদ্দেশ্য নয়। যেখান থেকে আমি এই আলোচনাটি শুরু করব তা হল, এ কথা অনস্বীকার্য যে বিবাহবহির্ভূত প্রেম ও যৌনতার রূপায়নের মধ্যে দিয়ে একধরনের সম্ভাবনা তৈরি হয়। সম্ভাবনা তৈরি হয় বিকল্পকে দেখার, চেনার। সম্ভাবনা তৈরি হয় বিবাহ-পরিবার-রাষ্ট্র-অর্থনীতি — এর মধ্যেকার আন্তঃসম্পর্ককে উন্মোচিত করার। ভেবে দেখুন, “আনা কারেনিনা”, “মাদাম বোভেরি” থেকে শুরু করে বিশ্ব সাহিত্যের তাবড় তাবড় সাহিত্যকীর্তি দাঁড়িয়ে আছে পরকীয়া প্রেম ও বিবাহের টানাপোড়েনের ওপর।
পরকীয়া বিষয়টিকে যদি সামাজিক নৈতিকতাবোধ বাদ দিয়ে দেখি, তাহলে একটি সমাজতাত্ত্বিক অকথিত সত্যকে দেখতে পাব। খুব স্পষ্ট করে বলি, পরকীয়া নিয়ে আমার কোন নৈতিক বাধানিষেধের মনোবৃত্তি নেই। তবে, পরকীয়া বিষয়টি আমার কাছে একটি সীমিত, সীমাবদ্ধ রাজনীতি নিয়ে টিকে আছে। মানে, প্রতিটি পরকীয়াই আসলে আমার কাছে একটি বকলম, রাজনৈতিক স্বীকারোক্তি, যে বিবাহ বিষয়টির প্রাত্যহিকতা দাঁড়িয়ে আছে অবদমনের উপরেই। এবং, এই সত্যটিকে আমরা এখনো পুরোপুরি স্বীকার করতে ভয় পাই। যখন তো-তো করে মুখে বলিও, নিজেদের জীবনে এই সত্যটিকে মেনে নিলে ব্যাপারটা কীরকম দাঁড়াবে, এটা ভাবতে এবং কল্পনা করতে ভয় পাই। তো, প্রতিটি পরকীয়া আমাদের সামনে বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটির সত্যটিকে উদ্ঘাটন করে। সজোরে। বহু সময় গালে একটা থাপ্পড় মেরে।
কিন্তু, ব্যস! ওইটুকুই। মানে, এও একইভাবে সত্যি যে, পরকীয়া একটা রকমভাবে বিবাহের দমবন্ধকরা পরিবেশের মধ্যে ছোট্ট একটু শ্বাস নেওয়ার জায়গা এনে দেয়। অনেকটা সেফটি ভালভের মত আর কী! একথা আমি নতুন বলছি এমনটা নয়, কিন্তু পরকীয়া থেকে শুরু করে লালবাতি-অঞ্চল, আসলে হয়ে ওঠে বিবাহের সেফটি ভালভ মাত্র। টিকে থাকতে সাহায্য করে বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটিকেই। তো, মন্দাক্রান্তার এই কবিতাটিতেও পরকীয়া হাজির হয় তার সীমিত রাজনীতি নিয়েই।
মানে, মেয়েটি এখানে তার ইন্দ্রকাকুর সেফটি ভালভ। মধ্যবিত্ত মধ্যবয়স্ক জীবনের নিষিদ্ধ উত্তেজনা, বিবাহিত জীবনের দায়িত্বভারের থেকে সামান্য ক্ষণের জন্য হলেও মুক্তি। সাথে, অজাচারী গন্ধ সম্পর্কটিতে আরেকটা নিষিদ্ধ-নিষিদ্ধ মাত্রা যোগ করে। কিন্তু অজাচার বিষয়টিও কবিতাটিতে পূর্ণমাত্রায় বিকশিত হয় না। আসলে তো ইন্দ্রকাকুর সাথে মেয়েটির কোন রক্তের সম্পর্ক নেই। কাজেই, নিষিদ্ধতার মাপকাঠিতেও যদি বলি, কবিতাটি কোথাও মধ্যবিত্ত গ্রহণযোগ্যতার মাত্রাকে চ্যালেঞ্জ করে না।
কী আছে তাহলে কবিতাটিতে? পরিবার ও পারিবারিকতা-মিশ্রিত লৌকিকতার ঘেরাটোপ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া মুহূর্তকালের শারীরিক সম্পর্ক: “সদর দরজা খুলে দিতে/ একসঙ্গে নামব সিঁড়িতে/ সে মুহূর্তে আমরা পাগল।” আর আছে: “কাল যাব তোমার অফিসে/ ঠিক ঠিক চারটে পঁচিশে/ তারপর ভুল দিগবিদিক…।” আবারও, সেই লুকিয়ে, চুরিয়ে নেওয়া সময়। পারিবারিকতার হাত থেকে লুকিয়ে কাটানো সময়, সামাজিক নিয়ন্ত্রণের হাত থেকে লুকিয়ে ছিনিয়ে নেওয়া সময়, মধ্যবিত্ত প্রাত্যহিকতার হাত থেকে চুরি করে নেওয়া সময়।
কিন্তু, এই চুরি করে নেওয়া সময়ের আছে একটা স্থানিক রাজনীতি। মানে, সময় না-হয় চুরি করা গেল, কিন্তু চুরি করা সময় নিয়ে অসমবয়সী দুই প্রেমিক-প্রেমিকা যাবেটা কোথায়? মানে, যেতে তো হবে সেই এমন এক জায়গাতেই যেখানে দেখা হবে না কোন চেনা লোকের সাথে। অবশ্য, দেখা হলেও তেমন অসুবিধে নেই, “কাকু-ভাইঝি বেড়াতে এসেছি” মার্কা খেলা খেলে দেওয়া যাবে। ব্যাপারটা হলো, এই গোটা অবদমিত যৌনতার সামাজিক ভূগোলটিই যে আমাদের বড় চেনা! এরই নাম বাঙালি মধ্যবিত্ত যৌন দ্বিচারিতা, ঢ্যামনামো। তাই, নয়ের দশকে মন্দাক্রান্তা যখন এই ঢ্যামনামোর মুখোশ খুলে লিখলেন, আমরা ক্ষণিকের জন্য হলেও, ভাষা হারিয়ে ফেললাম। বিশ্লেষণের মাপকাঠি গুলিয়ে গেল। কিন্তু, তারপর?
তারপর, ব্যাপারটা অনেকটা এইরকম যে, ঠিক যেমনভাবে সংযুক্তার কবিতা সম্পূর্ণ বিস্ফোরণহীন, মন্দাক্রান্তার কবিতাও তাই। তবে, সংযুক্তার কবিতার বিদ্রোহহীনতা, বিস্ফোরণহীনতা এল একধরনের খর্বায়নের নন্দনতত্ত্বের মধ্যে দিয়ে। মন্দাক্রান্তার কবিতায় এই বিদ্রোহহীনতা ও বিস্ফোরণহীনতা এল প্রতিবাদের মোড়কে। এবং এই প্রতিবাদের মোড়ক গোগ্রাসে গিলেছিল মধ্যবিত্ত বাঙালি পাঠক।
ঠিক সেই সময়ে, যখন মন্দাক্রান্তার প্রথম বইটি — “হৃদয় অবাধ্য মেয়ে” — প্রকাশিত হচ্ছে, তখন এই কবিতার শেষ তিনটি লাইন বড়ই সাড়া জাগিয়েছিল। লাইন তিনটি হল: “শহীদমিনারে উঠে গিয়ে/ বলে দেবো আকাশ ফাটিয়ে/ ইন্দ্রকাকু আমার প্রেমিক।” আপাত অর্থে, এই লাইনক’টির মধ্যে রয়েছে একধরনের গূঢ় উন্মোচন।
যে লুকিয়েচুরিয়ে সিঁড়ির তলা বা অফিসের পরে পরকীয়া-নিষিদ্ধ সম্পর্কের ভূগোলের ছবি মন্দাক্রান্তা এতক্ষণ ধরে কবিতাটিতে এঁকেছিলেন, তার থেকে একধরনের মুক্তি পাওয়া গেল এই শেষ কটি লাইনে। কিন্তু, সত্যিই গেল কী? যেমন ধরুন, এই যে মন্দাক্রান্তার শহিদমিনারের স্থানিক নির্বাচন, তা কিন্তু কোনমতেই আকস্মিক কিংবা কাকতালীয় নয়। ভেবে দেখুন, শহীদ মিনারের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বাংলার বামপন্থী অ্যান্দোলনের ইতিহাস। কাজেই, মন্দাক্রান্তা যখন সেই শহীদ মিনারকেই করে তোলেন তাঁর কবিতার উন্মোচনের কেন্দ্রবিন্দু, তখন সে বামপন্থী আন্দোলনের ইতিহাসও উপ-বয়ান বা টেক্সট হিসেবে এসে হাজির হয় মন্দাক্রান্তার কবিতায়। তার সাথে উঠে আসে আরও একটি গূঢ় বাস্তবতা যে যৌনতা ও লিঙ্গজনিত প্রতিবাদের যে রাজনীতি, তার একাধিক অতীব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা, বাদ রয়ে গেছে সাবেকী বামপন্থী আলাপচারিতা ও চর্চা থেকে।
কিন্তু, বিষয়টা আরেকটু জটিল। কবিতার মেয়েটি নাহয় বলল শহীদ মিনারে উঠে গিয়ে যে ইন্দ্রকাকু তার প্রেমিক। কিন্তু, তাতে কার কী এসে যায়? তার এই চিল-চিৎকার বাতাসে বেমালুম ভেসে যাবে। কারুর কিচ্ছুটিও এসে যাবে না। তাহলে, কী ঘটছে ঠিক কবিতাটিতে? যা ঘটছে কবিতাটিতে, তাকে বলে প্রতিকল্প, প্রতিস্থাপন অথবা পথবিচ্যুতি। মানে, খেয়াল করে দেখুন, যেখানে ইন্দ্রকাকুর সাথে তার সম্পর্কের উন্মোচন ঘটলে ধুন্ধুমার বেঁধে যাবে, সেখানে কিন্তু কোন উন্মোচন নেই। অর্থাৎ মেয়েটির মা-বাবা তথা পরিবারের কাছে, ইন্দ্রকাকুর স্ত্রীর কাছে। কাজেই, সীমিত মাত্রায় হলেও, যেটুকু যৌন প্রথাবদ্ধতার ঘেরাটোপ ভাঙতে পারত এই সম্পর্কটি, ভাঙতে পারতে পারিবারিকতার দমবন্ধকরা মতাদর্শ, সেটুকুও ঘটল না। তার বদলে, আমরা পেলাম একধরনের উন্মোচন-উন্মোচন খেলা, যা স্থিতিস্থাপকতাকে টুসকিও মারল না। অর্থাৎ, মেয়েটি যদি হয়ে থাকে তার ইন্দ্রকাকুর সেফটি-ভালভ, তবে শহীদ মিনারে উঠে চিৎকার করাটি হয়ে দাঁড়াল মেয়েটির সেফটি ভালভ।
কাজেই, সেইভাবে দেখবে গেলে, মন্দাক্রান্তা বাংলা কবিতায় সূচনা করলেন একধরনের নয়া উদারনৈতিকতার। এই বয়ানকে পুরোপুরি নয়া-উদারনৈতিক নারীবাদ বলব কিনা জানি না। তবে, নারীবাদী দর্শনের কান-ঘেঁষা একধরনের নয়া-উদারনৈতিক মতবাদ তো বটেই। সেখানে দাঁড়িয়ে, ব্যাপারটা অনেকটা দাঁড়াল এইরকম। বাংলার কবিনীদের প্রতিবাদের আঁচটুকু/ওমটুকু চাই, প্রতিবাদী সত্তার সামাজিক সম্মান ও সাংস্কৃতিক পুঁজিটুকু চাই, কিন্তু চাই আবার স্থিতিস্থাপকতার আরামটুকুও।
তাই, বলতে বাধ্য হচ্ছি, মূলস্রোত বাংলায় এখনো পর্যন্ত কোন প্রকৃত নারীবাদী কবিতার জন্ম হয়নি। একধরনের বকলম নারীবাদী-নারীবাদী ন্যাকামো হয়েছে। এবং, একথা বলারও সময় এসেছে যে, মেয়েরা নিজেদের জীবনের কথা ইনিয়েবিনিয়ে লিখলেই সেটা নারীবাদ হয়ে যায় না। প্রগতিশীল দর্শনও হয় না। বাংলাসাহিত্যে যদি কোনও জটিল লিঙ্গবয়ানের কাব্যিক নথি তৈরি করতে হয়, তবে চৈতালী-সংযুক্তা-যশোধরা-মন্দাক্রান্তার কাব্যচর্চার বাইরে বেরিয়েই তা করতে হবে। আর সেটা করতে হবে আনন্দবাজারীয় কবিতাধারা ও কবিতাবাজারের বাইরে বেরিয়েও।
পরিশিষ্ট
পরিশেষে একটি কথা বলি। এই লেখাটি অসমাপ্ত। অসমাপ্ত কারণ এর বাইরেও রয়ে গেলেন অনেক, অনেক কবি, অনেক, অনেক কবিতা। বাংলাসাহিত্যের ক্ষুদ্রতম সাম্প্রতিক ইতিহাস রচনাও সহজ কাজ নয়। কত অনাম্নী পত্রিকা-ছোট পত্রিকায় বেরিয়েছে কত লেখা। সেইসব লেখা হয়তো চুরমার করে ভেঙে দেবে এই লেখার মূল প্রতিপাদ্য। এই লেখাটি একদমই ব্যক্তিগত পাঠের অভিজ্ঞতাপ্রসূত। আমি বাংলা কবিতার লিঙ্গ মতাদর্শ অথবা বাংলা কবিতায় মেয়েদের কবিতার কোনও পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস এই লেখায় লিখতে চাইনি। এই পরিসরে তা সম্ভবও নয়। যা চেয়েছি, তা হল কিছু পর্যবেক্ষণ, কিছু পাঠ তুলে ধরতে। কিছু বিতর্কের সূচনা করতে। যার বড়ই অভাব আজকের বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে। এই আলোচনা থেকে বাদ পড়ে গেছেন দু’জন কবি – তসলিমা নাসরীন আর মল্লিকা সেনগুপ্ত – যাঁরা লেখালেখি করেছেন অনেকটাই এই লেখায় চিহ্নিত লিঙ্গ মতাদর্শের বাইরে গিয়ে। তাঁরা আলাদা লেখা দাবি করেন। এইসব কারণেই, ওই যে বললাম, এই লেখা অসম্পূর্ণ। কিন্তু অসম্পূর্ণ অনেককিছুই তো আমাদের মনোযোগ দাবি করে। ভেঙে দেয় সম্পূর্ণতার বংশগৌরব। এই লেখাটির প্রাথমিক লক্ষ্য বাংলা কবিতার সেই সম্পূর্ণতার কাঁচের আলমারিতে ঢিল ছোঁড়া। সেই ঢিলের ধার পাঠকের গায়ে সামান্যতম লাগলেও বুঝব লেখাটি সার্থক।

1 thought on “’৭০-পরবর্তী বাংলা কবিতায় লিঙ্গ মতাদর্শ

  1. মুগ্ধ হয়ে পড়ে গেছি,,,,স্তব্ধ,,, ধন্যবাদ লেখিকাকে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.