শ্রীপর্ণা ভাদুড়ি
শ্রীপর্ণা পরিবেশ বিজ্ঞানের প্রাক্তন ছাত্রী, লিঙ্গবৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী এবং ‘চিত্রাঙ্গদা: একটি লিঙ্গবৈষম্য বিরোধী উদ্যোগ’-এর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।
“প্রতিবাদ ও সচেতনতা দারুণ জিনিস, কিন্তু অতি উৎসাহের চোটে ‘জিভ কাটো লজ্জায়’–এর ট্রেন এমন হুড়মুড় ছাড়লে, অবিলম্বে ‘মুখ ঢেকে যায় কারেকশনে’–র স্টেশনে ঢুকে পড়বে।
এই ঘোটালায় অ–পণ্ডিতদের একটা উপায় আছে, কথাবার্তা প্রায় বন্ধ করে দেওয়া। বোবার শত্রু নেই, ব্লগ–বাইলাইনের ঝাড়ও নেই। সলমন এ জন্যেই বলেছেন, এ বার থেকে কম বলব। আর এক হয়, সেলোটেপ দিয়ে মুখ এঁটে রাখা। কিন্তু নারীবাদীরা সব্বাই পহলাজ নিহলানির মতো দেখতে হয়ে গেলে, হাসির তোড়ে সেই সেলোটেপ ছিঁড়ে না যায়!” —চন্দ্রিল ভট্টাচার্য
দেখেছিল ঘুঘু/ আহা পড়ে গেছে ফাঁদে…
গত ৩০শে জুন সক্কাল সক্কাল অত্যন্ত আনন্দের সাথে বিখ্যাত দৈনিকের সম্পাদকীয়তে চন্দ্রিল ভট্টাচার্য, সলমন খানের ধর্ষণ সংক্রান্ত বক্তব্যের সারমর্ম উদ্ধার করে “স্বতঃস্ফূর্তি”র সাথে ভাষার এক বাজারীয় পরিবেশন করলেন যার সারবক্তব্য ছিল সলমন নাহয় ‘বোকার মতো’ একটা প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়েই ফেলেছেন কিন্তু তার জন্য এই যে সব্বাই (পড়ুন নারীবাদীরা) ‘ভয়ানক ইন্সেন্সিটিভ’ বলে চোখ কপালে তুলেছেন তা তিলকে তাল করা বই অন্য কিছু নয়। কারণ আমারা প্রত্যেকদিন নিজের ভাব প্রকাশ করতে গিয়ে এমন সব কথা বা বলা ভালো উপমা খুব অনায়াসেই ব্যবহার করে থাকি যা কোনো না কোনো ভাবে কোনো না কোনো মানুষের যন্ত্রণাকে ছোটো করে, অপমান করে। তাই ‘ধর্ষণ’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করার জন্য যারা ভাইজানের আসল ‘ইনটেনশন’ না বুঝেই তার ওপর রে রে করে তেড়ে গেছেন তারা “ওভার রিঅ্যাক্ট” ছাড়া অন্য কিছুই করছেন না। তিনি তার এই অকাট্য বক্তব্যকে সমর্থন করার উদ্দেশ্যে বেশ কিছু প্রচলিত শব্দের তুল্যমূল্য বিচারও করেছেন। ব্যবহারিক প্রয়োগের দিক থেকে যে শব্দবন্ধগুলির ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ প্রচলন অস্বীকার করে চন্দ্রিল বাবুর যুক্তিকে একেবারেই বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়া যায় না কারণ সত্যি একথা অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই যে আমাদের নিত্যনৈমত্তিক জীবনে প্রকৃত মর্মার্থ না ভেবেই আমরা এমন অনেক তুলনামূলক শব্দবন্ধ খুব সহজেই, খুব হালকা ভাবে ব্যবহার করে থাকি যেগুলো প্রত্যক্ষ হোক বা পরোক্ষভাবে, কোনো না কোনো মানুষের জীবন যন্ত্রণাকে লঘু করে দেখায়। উদাহরণ হিসাবে ধরা যেতে পারে বহুল প্রচলিত কিছু শব্দবন্ধ যেমন ‘কাজের লোকেদের’ মতো ঝগড়া করা, ‘মেথরের’ মতো নোংরা বা ‘গ্রাম্য অশিক্ষিত’দের মতো কথাবার্তা ইত্যাদি ইত্যাদি। ফলতঃ চন্দ্রিল বাবুর মতো অনেক সাধারণ মানুষেরই ‘ধর্ষণ’ শব্দটির ব্যবহারিক প্রয়োগকে আলাদা করে ‘গুরুত্ব’ দেওয়া একদিক থেকে, শস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার চেষ্টা বা যৌনতার সাথে সরাসরি যুক্ত থাকার কারণে নারীবাদীদের ‘প্রগতিশীল’ মননে আঘাত লেগেছে, বলে মনে হতেই পারে।
ছোট আছো ছোট থাকো/ শস্তা সাবান মাখো
কিন্তু এখান থেকেই প্রশ্ন ওঠে এই পুঁজিবাদী পিতৃতান্ত্রিক সমাজ যেখানে প্রতিনিয়ত আমাদের সামনে ‘প্রকৃত’ জীবনযাত্রার নিত্যনতুন মানদণ্ড নির্মাণ করে যাচ্ছে সেখানে এই মানদন্ডের ঋণাত্মক অবস্থানে থাকা মানুষগুলোর জীবনকে নীচু করে দেখানো এবং সাহিত্য থেকে কথ্য ভাষায় তার যথেচ্ছ ব্যবহারের মাধ্যমে তাকে স্বাভাবিকত্বের মান্যতা দেওয়া কি আসলে এই শোষণ কাঠামোয় উপস্থিত ভাষা কেন্দ্রিক বৈষম্যের বৃহত্তর রাজনৈতিক আঙ্গিক এবং তার সাথে ওতপ্রোত ভাবে জুড়ে থাকা জনপ্রিয় গণমাধ্যমগুলির দ্বিচারিতাকেই উন্মুক্ত করে দেয় না?
বিষয়টির গভীরতাকে আরও স্পষ্টভাবে জানাবোঝার জন্য প্রথমেই আরও একবার দেখে নেওয়া দরকার দাবাং বয় ঠিক কি মন্তব্য করেছিলেন সেদিন। কুস্তিবিদের ভূমিকায় অভিনয় করার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে আমাদের প্রিয় ভাইজান বলেছেন শ্যুটিং-শেষে নিজেকে একজন ধর্ষিতা মেয়ের সমতুল্য মনে হত কারণ তিনি নাকি সোজা হয়ে হাঁটতে পর্যন্ত পারতেন না। এখন তিনি যে মোটেও ‘ধর্ষিতা’ ব্যক্তির বেদনাকে অপমান করতে চাননি বরং শ্যুটিং চলাকালীন তার উদয়াস্ত খাটুনিকেই ইঙ্গিত করে এই উপমা টেনে এনেছেন সেটা চন্দ্রিল বাবু ফলাও করে না লিখলেও বুঝতে কারোরই খুব কিছু সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই বক্তব্যটি বেশ কতগুলি সমস্যাজনক আঙ্গিক আমাদের সামনে তুলে আনে।
প্রথমতঃ সলমন কোনো কৃষক বা শ্রমিক শ্রেণীর মানুষের সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের সাথেও তুলনা টানতে পারতেন কিন্তু তিনি এই ‘পিছড়ে’ বর্গের মানুষদের গাড়ির তলায় দেখতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, তাই বোধহয় তাঁদের কথা ওঁর মাথায় আসেনি, বরং প্রথমেই একজন ধর্ষিতা মহিলার উপমা তাঁর মাথায় আসে যা তাঁর চূড়ান্ত পিতৃতান্ত্রিক (পূর্বকীর্তি – প্রেমিকাকে উচিত শিক্ষা দিতে অবলীলায় বিরাশি সিক্কার চড় হাঁকানো থেকে হরিণ শিকার করে শিরোনামে আসা) মানসিকতাকেই মান্যতা দেয়। ফলত একশো কোটি পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত খান সাহেবের মুখে এইধরণের বক্তব্য ধর্ষিতা ব্যক্তিটির “অসীম অপমান, মনঃকষ্ট, সামাজিক কলঙ্ক এবং শারীরিক তছনছ”-এর ন্যূনতম আভাস তো দূরে থাকুক, নিতান্ত হাসিঠাট্টার খোরাক ছাড়া অন্য কোনো বার্তাই বহন করে না।
আজি এ পরাণে রবির কর/ কেমনে জাগাল ডাইনোসর
দ্বিতীয়তঃ এটা শুধু তার মানসিকতার সমস্যা বলে ছেড়ে দিলেও উচিৎ হবে না। কারণ আমরা যদি জনপ্রিয় মিডিয়া ‘সংস্কৃতি’র দিকে চোখ ফেরাই তবে দেখতে পাব প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রেই দুষ্টু ভিলেন থেকে প্রেমিক নায়কের যখনই প্রয়োজন পড়েছে তখনই তার ‘পুরুষত্বে’র প্রকাশ হয়েছে সুন্দরী নায়িকার যৌনতার ওপরই। আর তারপর প্রত্যেকবারই নায়িকা নায়কের প্রেমে গদগদ হয়ে নাচতে গাইতে শুরু করেছে। ফলতঃ সেই পেশী সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা একজন এইট প্যাক মাসলওয়ালা ‘তারা’র কাছে প্রতি ২২ মিনিটে একজন মেয়ের ধর্ষিত হওয়ার সংখ্যাতত্ত্ব যে একটা সংখ্যার গ্রাফ বই অন্য কোনো গভীর মানে বহন করবে, সেটা ভাবা কষ্টকর।
ল্যাজ কাটা প্রেমিকের ডানা কাটা পরি হয়ে ত্বকের যত্ন নিন
আসলে সল্লু ভাইয়ের এহেন বক্তব্য গ্লোবালাইজ্ড ভারতের নয়া উদারনৈতিক মিডিয়ায় মেয়েদের শরীরকে ক্রমাগত ভোগ্যবস্তুরূপে প্রতিপন্ন করার ফল যে কি হতে পারে, তাই অত্যন্ত নগ্ন ভাবে আমাদের সামনে এনে হাজির করে দেয়। আর তাই আজকের বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আরও একবার তলিয়ে ভেবে দেখার সময় এসেছে জনপ্রিয় এবং প্রচলিত গণমাধ্যমগুলিতে প্রচারিত অনুষ্ঠানগুলো কি শুধুই বিনোদনের খাতিরে বানানো? নাকি, পুঁজিবাদী সমাজ, লিঙ্গ রাজনীতি এবং লিঙ্গ সাম্যের যাবতীয় পরিসরকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে গণমাধ্যমগুলিকে নিজের ইচ্ছে মতো ব্যবহার করে জনমানসে প্রতিষ্ঠিত করে দিচ্ছে নারী ক্ষমতায়নের মেকি ভাবনা? যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ পাওয়া যায় ‘ভোগ’ থেকে প্রকাশিত ভিডিও-য়; যখন দীপিকা পাডুকোন দৃপ্ত কন্ঠে জানান ‘My dress my choice’ আবার খুব সহজেই পন্ডসের বিজ্ঞাপনে স্বল্পবসনে যা ঘোষণা করেন, তার সারমর্ম হয়, “কি জিনিস বানিয়েছ গুরু!”
ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যাবে ৯০এর দশকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাওয়ের নেতৃত্বে বিশ্ব পুঁজি যখন ভারতীয় বাজারের কাছে উন্মুক্ত হয়ে যাচ্ছে তখন তার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠছে গণমাধ্যমগুলিই; যার ফলে সিরিয়াল সিনেমা বিজ্ঞাপন প্রভৃতি বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানগুলির চরিত্রায়নের ক্ষেত্রেও এক বিরাট পরিবর্তন আসছে। গণমাধ্যমগুলিতে এইসময়েই, একদিকে, নারী স্বাধীনতার নামে প্রথম বিজ্ঞাপিত করা শুরু হয় নারী শরীরকে, কারণ খাবার হোক বা সিনেমা, সবকিছুই জনপ্রিয় করার সবচেয়ে সহজলভ্য উপায়, সম্পূর্ণ বা অর্দ্ধনগ্ন শরীর বিশেষ করে নারী শরীর দিয়ে ঢেকে দেওয়া ‘প্রোডাক্টের’ মুখ। তাহলেই কেল্লা ফতে!
অন্যদিকে আবার এই সময়েই সিনেমা সিরিয়ালগুলিতে মেয়েদের চরিত্রায়নের উল্টো চিত্রগুলিও অত্যন্ত প্রবল ভাবে উঠে আসতে থাকে অর্থাৎ আদর্শায়িত করা শুরু হয় গৃহশ্রম এবং তাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ‘আদর্শ নারীর’ জীবনকে। কারণ ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানার ধারণাকে আরও বেশি বেশি করে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যই পুঁজিবাদী শক্তিগুলির কাছে ধর্মীয় আধারে এবং সামন্ততান্ত্রিক মননে গড়ে ওঠা ভারতীয় পরিবার ব্যবস্থার চিরাচরিত পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোকে টিকিয়ে রাখা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল, আর তার সবচেয়ে সহজলভ্য মাধ্যম ছিল গণমাধ্যমগুলি। এগুলির মাধ্যমে খুব সহজেই ঘরের অন্দরমহলকে মেয়েদের স্বাভাবিক এবং প্রধান ক্ষেত্র হিসাবে মহিমান্বিত করা যায়। কিন্তু এর আগে যেহেতু ভারতীয় পরিবারব্যবস্থায় মেয়েদের ঘরের চার দেওয়ালের বাইরে কোনো সামাজিক জীবনের বিশেষ অস্তিত্ব ছিল না, ফলতঃ অধিকাংশ মেয়ের কাছেই পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের এই ফাঁদটি তত পরিষ্কার হয়ে উঠতে পারেনি। এই যে গণমাধ্যমগুলির দৌলতে মেয়েরা নিজেদের যৌনতা এবং তার সাথে জুড়ে থাকা ‘নিষিদ্ধ’ প্রশ্নগুলিকে আজ সর্বসমক্ষে উন্মুক্ত করতে পারছে, এর ফলে নারী-স্বাধীনতার তথা নারী-ক্ষমতায়নের এক অন্য মানে বহন করে নিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছে।
আর তাই এই ভোগসর্বস্ব সংস্কৃতির বিরোধিতা না করে শুধু সলমন খানের বক্তব্যের বিরোধিতা করলে সামগ্রিকভাবে যে নয়া উদারনৈতিক সামাজিক মূল্যবোধের চাপে নারীবাদ এবং নারী শরীর আজ বাজারসর্বস্ব এক সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত হচ্ছে তার ক্ষতিকারক দিকটি লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে যাবে।
পাঞ্জাবীদের পাঁইয়া বলি, মাড়োয়ারি মাওড়া
তৃতীয় এবং মুখ্য আঙ্গিক, ভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রে সচেতনতার অভাব। যেখান থেকে আসলে আমিও চন্দ্রিলের লেখাটিকে সমালোচনা করার তাগিদ অনুভব করছি। চন্দ্রিল তাঁর লেখায় বজরঙ্গি ভাইজানের এইরকম এক চূড়ান্ত অসংবেদী বক্তব্যের সমর্থন করতে গিয়ে প্রকৃতিগতভাবে পৃথক তিন ধরণের উপমাই শুধু ব্যবহারই করেন নি, স্বতঃস্ফূর্ততার নামে তাদের খানিকটা জোর করেই এক পঙক্তিতে টেনে বসিয়ে দিয়েছেন। আমরা যদি চন্দ্রিলের লেখাটি আরেকটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করি তাহলে দেখবো ক্রিস গেইলের যথেচ্ছ চার ছয় মারা বোঝাতে গিয়ে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্তভাবে “পাগলের মতো” শব্দটি ব্যবহার করা কিংবা কারোর চাউনির তীক্ষ্ণতা বোঝাতে গিয়ে “বুকে ছুরি বসিয়ে” দেওয়ার মতো শব্দ ব্যবহারের সাথে চন্দ্রিল খুব সহজেই বাংলা শিল্পের দুর্দশা বোঝাতে ব্যবহৃত ‘বামনে ছেয়ে গেছে’ শব্দটির ব্যবহার বা কারোর কঙ্কালসার চেহারা বোঝাতে ব্যবহৃত ‘সোমালিয়ার প্রেসিডেন্ট’ শব্দটির ব্যবহার থেকে এস্টাব্লিশমেন্ট কর্তৃক বাংলা সাহিত্যের হতদ্যোম অবস্থা বোঝাতে ব্যবহৃত ‘ধর্ষণ’ শব্দটির ব্যবহারকে একই ‘স্বতঃস্ফূর্ততা’র নজরে দেখছেন। অথচ এই তিন ধরনের উপমা যথেচ্ছ ব্যবহারের যে সামাজিক প্রভাব ও তার গভীরতার পার্থক্য, তাকে কিছুতেই স্রেফ একই ‘স্বতঃস্ফূর্ততা’র ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে ফেলা সম্ভব নয়।
উদাহরণস্বরূপ—নিম্নলিখিত দুক্ষেত্রেই গাছ কেটে ফেলা হলেও, বাড়ির বাগানের ‘আগাছা’ পরিস্কারের স্বতঃস্ফূর্ততার সাথে শিল্প করার নামে পুঁজিবাদী শক্তিগুলির জল-জঙ্গল-জমি সাফ করে দেওয়ার স্বতঃস্ফূর্ততা এবং সেই কাজে প্রধান বাধারূপে সামনে আসা আদিবাসী সম্প্রদায়ের মহিলাদের যথেচ্ছভাবে যৌন নিপীড়ন করার ‘স্বতঃস্ফূর্ততা’র তুল্যমূল্য বিচার করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সমস্ত স্বতঃস্ফূর্ততা তুলনীয় নয়। এক্ষেত্রেও ‘বুকে ছুরি খাওয়া মানুষের তীব্র শারীরিক (হয়তো মানসিকও) যন্ত্রণা বা “মনোরোগীদের এলোপাথাড়ি ব্যবহারের মূলে যে অসুস্থতা” তাকে লঘু করে দেখে আপাত দৃষ্টিতে তাদের অপমানিত করার ‘স্বতঃস্ফূর্ত প্রবণতা’ থাকলেও, তা কখনোই একজন “ভার্টিকালি চ্যালেঞ্জড” মানুষের তুলনা টেনে এনে কোনো একটি ক্ষেত্রের দুর্দশা বোঝানোর জন্য বলা যে সেই ক্ষেত্রটি “বামনে ছেয়ে গেছে”—এই অবমাননার সাথে তুলনীয় নয়। সমস্তরকমের স্বতঃস্ফূর্ততা সত্যিই যে দেশের মানুষ প্রত্যেকদিন অনাহার ও অপুষ্টিজনিত কারণে মারা যাচ্ছে, তাদের নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক শব্দ ব্যবহারের মতো বৈষম্যমূলক মনোভাবের ‘স্বাভাবিকত্ব’কে মান্যতা দেয় না। যদি দেয়, তাহলে সেই স্বতঃস্ফূর্ততা নিয়ে প্রশ্ন করা প্রয়োজন।
হিন্দু সেনা শাস্ত্রবান/ সিন্ধুনদে জল কমান
এখানেই শেষ নয়, চন্দ্রিল বাবু সহ সমাজের বহু পরিচিত এবং ‘পরিশীলিত’ বিদ্বজনেরাই উপরোক্ত উপমাগুলিরসাথে জনসাধারণের যে কোনো ভাবে নিগৃহীত, নিপীড়িত অবস্থা বোঝাতে ‘ধর্ষণ করলো’ শব্দটির সর্বজনীন ব্যবহারকে একই স্কেলে মেপেছেন। আজকের বাস্তবতা থেকে অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই যে ধর্ষণ শব্দটি বর্তমানে তার আভিধানিক অর্থকে ছাপিয়ে গিয়ে বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা নিয়ে সমাজে হাজির। আর সেই আঙ্গিক থেকেই ভাষাশিল্পী বাবুমশাইরা ধর্ষণ শব্দটির সামাজিক দ্যোতনা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এমন কিছু উদাহরণের আশ্রয় নিয়েছেন, যার ফলে তা আর শুধু সল্লু ভাইয়ের দেওয়া বিবৃতির মধ্যে আটকে না থেকে পাশের বাড়ীর অমুক বাবু থেকে আপামর জনতার মৌখিক ভাব প্রকাশের মধ্যে যে চরম লিঙ্গবৈষম্যের প্রকাশ, তাকেই সর্বসমক্ষে ব্যক্ত করে তুলেছে। ফেসবুকীয় এক সুধীজনের বক্তব্য এক্ষেত্রে একটি সাধারণ উদাহরণ হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন—
“‘গণতন্ত্রকে ধর্ষণ করা হল’ বা, ‘এস্টাবলিশমেন্ট ধর্ষণ করল সাহিত্যকে’, শুধু বিমূর্ত ‘গণতন্ত্র’ বা ‘এস্টাবলিশমেন্ট’ নামক ধারণা সম্পর্কেই এগুলো প্রযুক্ত হয় তা নয়, সাধারণ কথোপকথনেও এর সম্যক উপস্থিতি। যেমন, মৌখিক পরীক্ষা শেষে পরীক্ষার্থী বিধ্বস্ত হয়ে এসে বলতেই পারে, ‘এক্সামিনারটা আমাকে রেপ করে দিল পুরো’। যেমন সলমন কুস্তি প্রসঙ্গে বলেছেন, তিনি কুস্তিশেষে ধর্ষিত/ধর্ষিতারমতো বোধ করছেন।”
তিনি তাঁর এই বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে যে ব্যখ্যা দিয়েছেন তা আরও চমকপ্রদ—
“কিন্তু সমস্যা হল, যখন শোনা গেল যে, এতদ্বারা ‘ধর্ষণ’ নামক অপরাধটিকে ছোটো করে দেখানো হল বা ট্রিভিয়ালাইজ করা হল। সেটা একেবারেই এই ক্ষেত্রে বলা যায়না। কেন বলা যায়না ? কারণ, এর উত্তরে যিনি কুস্তি বা পরীক্ষাকে ধর্ষণের সঙ্গে তুলনা করছেন, তাঁরও কিছু বক্তব্য থাকে। তাঁর তুলনাটি ‘ভুল’, এমনকি সেটা মেনে নিয়েও তিনি বলতে পারেন, যে, ‘আমি যে কতটা বিধ্বস্ত, কেমন ভয়াবহরকম বিপর্যস্ত সেটা অন্য কোনো ভাবে বোঝানো যেতনা, তাই এই ভাষাবন্ধের আশ্রয় নিয়েছি’। অর্থাৎ ট্রিভিয়লাইজ করাটা একেবারেই উদ্দেশ্য নয়, সেটা হয়ওনি, বরং চূড়ান্ত বিপর্যয়, চূড়ান্ত নিগ্রহ বোঝানোর জন্যই ‘ধর্ষণ’ শব্দটিকে ব্যবহার করা হয়েছে। ‘খাটো করা’ অভিযোগটি এখানে একেবারেই অলীক।”
প্রশ্ন জাগে, সত্যি কি এইভাবে যত্রতত্র ধর্ষণের উপমা টেনে আনার মধ্যে দিয়ে কোনোভাবেই কামদুনি থেকে নির্ভয়া বা থাংযাম মনোরমা থেকে সোনি সোরির ছিন্ন যোনির যন্ত্রণা, তার ন্যূনতম আভাসও পাওয়া সম্ভব? ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে যদি পরিসংখ্যানের দিকে একটু চোখ বোলানো যায় তাহলে দেখা যাবে অন্যান্য যৌন হেনস্থা ব্যতিরেকেও প্রতিবছর শুধু নথিভুক্ত ধর্ষণের সংখ্যাই প্রায় লাখের কাছাকাছি পৌঁছে যায় (বৈবাহিক ধর্ষণ বা পুরুষদের ধর্ষণ – সেই সংখ্যাগুলি বিনা দ্বিধায় বাদ দিয়ে এই পরিসংখ্যান)। আর এই সংখ্যার তাত্ত্বিক হিসাবের মধ্যে ২৬ দিনের বাচ্চা থেকে ৮০ বছরের বৃদ্ধার ধর্ষণের ঘটনাও চলে আসে। ফলতঃ আমরা যখন অতি অনায়াসে কাউকে ‘চূণী কোটালের মতো হাসি’ (লোধা উপজাতির একমাত্র স্নাতক যিনি আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত হওয়ার কারণে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে প্রবল বর্ণ এবং জাতি বিদ্বেষের শিকার হন। এর ফলস্বরূপ তিনি ১৯৯২ সালে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন। কিন্তু মেদিনীপুর ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে এখনও তার কালো চামড়া ও শারীরিক গঠন একটি হাস্যকৌতুকের বিষয়) বা ‘চামারের মতো অভ্যেস’ বলি, তখন হয়তো চূণী কোটালের যন্ত্রণাময় মৃত্যুকে বা চামার পেশাভুক্ত কোনো ব্যক্তিকে তুচ্ছায়িত করার উদ্দেশ্যে বলি না। কিন্তু এই উপমাগুলি ব্যবহার করার ফলে তা শুধু আর ব্যক্তিবিশেষকে অপমান করার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না বরং যুগ যুগ ধরে চলে আসা বর্ণগত, জাতিগত, লিঙ্গগত বৈষম্যকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। যেমন এক্ষেত্রেও (হয়তো) উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে না চাইলেও ধর্ষণ এবং ধর্ষিতা ব্যক্তির যন্ত্রণাকে ‘খাটো’ করা হয়েছে।
এখন উল্টোদিক থেকে বক্তব্য উঠে আসতেই পারে, এবং চন্দ্রিল বাবুর বক্তব্যে খানিক এসেছেও বটে, যে ‘খাটো’ শব্দটিও যেহেতু একটি তুলনামুলক শব্দ তাহলে কার থেকে খাটো? অন্য আর পাঁচটা অপরাধের থেকে? তাহলে তো ধর্ষণকে আর পাঁচটা অপরাধের থেকে একটু উপরে স্থান দিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যা আসলে সমাজে সবচাইতে যে প্রচলিত ধারণা, যে পরিবার থেকে গোটা জাতির সম্মান নামক বস্তুটি আসলে মেয়েদের যোনিতে আটকে থাকে, সেই পশ্চাদপদ ধারণাকেই মান্যতা দেওয়া হয়। ফলে তা পরোক্ষভাবে ভারতে পিতৃতান্ত্রিক প্রাচীন মনুবাদী সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে সদাতৎপর সঙ্ঘ পরিবারের যে ধর্ষণকে ‘সর্বোত্তম অপরাধের’ তকমা দিয়ে ধর্ষকের মৃত্যুদন্ডের দাবী, তাকেই স্বীকার করে নেওয়া হয়। তবু কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়।
গাধাটাকে ঘাস দাও! / সুস্থ হলে তবে তো দেশে যাবে
ধর্ষকের মৃত্যুদন্ড না চেয়েও ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদ এবং সাধারণ নিগ্রহ নিপীড়নের ক্ষেত্রে যথেচ্ছ ধর্ষণের উপমা টেনে আনার প্রতিবাদ কি সত্যিই পরস্পরবিরোধী? মনে হয়্য না। বরং দুটি ক্ষেত্রেই প্রতিবাদের মূল লক্ষ্য নারীবাদী এবং একে অপরের পরিপূরক। কারণ যখন কেউ ২৬ দিনের শিশু থেকে ৮০ বছরের বয়স্কা কাউকে ধর্ষণ করে, সেখানে তার যৌন পরিতৃপ্তির তুলনায় পিতৃতান্ত্রিক দমনমূলক মনোভাব অনেক বেশি কাজ করে।
আসলে, একদিকে ধর্ম, সমাজ এবং তার সাথে জুড়তে থাকা ভোগসর্বস্ব মিডিয়া জীবনের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে, প্রতি মুহুর্তে বুঝিয়ে যাচ্ছে সমাজে একজন মেয়ের শরীর ব্যাতীত অপর সত্ত্বার কোনো স্থান নেই শুধু নয়, একজন মেয়েকে রক্ষা করা থেকে তার প্রতি প্রেম নিবেদন করা পর্যন্ত প্রতিটি পদে সর্বাগ্রে প্রয়োজন ‘পৌরুষ’। অন্যদিকে আবার ধর্মীয় আধারে ও সামন্ততান্ত্রিক মননে গড়ে ওঠা ভারতীয় পিতৃতান্ত্রিক পরিবারব্যবস্থা প্রত্যেক মুহূর্তে শিখিয়ে যাচ্ছে মেয়েদের স্থান সবসময় ঘরের চার দেওয়ালের ঘেরাটোপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিৎ। কারণ তার যৌনতার সাথে জুড়ে আছে তার, তার পরিবারের এমনকি তার সমগ্র জাতির ‘সম্মান’-এর প্রশ্ন। আর তাই প্রত্যেক মুহূর্তে যখনই প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করার প্রয়োজন পড়েছে, সমাজ বা রাষ্ট্র সবার আগে আঘাত নামিয়ে এনেছে একটি মেয়ের যৌনতার ওপরই – যার প্রত্যক্ষ প্রমাণ আমরা বানোয়ারি দেবী ধর্ষণকান্ড বা থাংযাম মনোরমা থেকে কুনান পোশপোরা ধর্ষণকান্ডের মধ্যেই পেয়েছি, যেখানে রাষ্ট্রই স্বয়ং ধর্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। শুধু তাই নয়, ১৯৭২ সালের মথুরা ধর্ষণকান্ডের পরবর্তী সময় থেকেই দেশে বারবার বিভিন্ন ধর্ষণবিরোধী আইন প্রণয়ন হয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও ধর্ষণের হার একটুও কমেনি বরং এক-একটি ঘটনা তার আগের ঘটনার যাবতীয় নৃশংসতাকে ছাপিয়ে গেছে। উঠে এসেছে এক মাসেরও কম বয়সের শিশু থেকে হিন্দুত্ববাদী দলের বৃদ্ধা নানকে ধর্ষণের মতো ঘটনা, উঠে এসেছে সমকামিতার ‘অসুখ’ সারাতে পরিবারের সদস্য কর্তৃক হওয়া ধর্ষণের মতো ঘটনাও।
এখন, বর্তমান সমাজে অবস্থিত পিতৃতান্ত্রিক শোষণ কাঠামো কোনো সমসত্ত্ব লিঙ্গগত শোষণ কাঠামো নয়, বরং তার সাথে বর্ণগত, ধর্মগত, অর্থনীতিগত, শ্রেণীগত অবস্থান এবং তাদের কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা নানান শোষণ কাঠামো ওতোপ্রোত ভাবে মিলেমিশে আছে। ফলতঃ শুধুমাত্র ধর্ষকের মৃত্যুদন্ডের দাবী জানালেই যে ধর্ষণের মতো সামাজিক ব্যধি থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না।
দেশী মুরগি ল্যাজ নাই/ বেশি বকে কাজ নাই
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে এতো প্রতিবাদ, এতো প্রতিরোধ সত্ত্বেও এই পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা কিভাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী স্বমহিমায় সমাজের বুকে টিঁকে আছে?
আর এই প্রশ্নের উত্তর থেকেই চন্দ্রিলের বক্তব্যের সাথে আমার প্রধান বিরোধিতার জায়গা তৈরি হয়। চন্দ্রিল, পিতৃতান্ত্রিকতা প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম ‘ভাব প্রকাশের ভাষা’কে খুবই অদ্ভুতভাবে এই শোষণ কাঠামোর উর্দ্ধের কোনো বস্তু হিসাবে গণ্য করেছেন। অথচ ছোটোদের সহজপাঠ থেকে ঠাকুমার ঝুলি এমনকি হালকা চালে বলা চুটকি থেকে কফিশপ বা চায়ের দোকানে বসা আড্ডা – সর্বত্র, কোনো কিছুকে লঘু করে দেখাতে গিয়ে সমাজে প্রচলিত অসাম্যগুলোকে ‘স্বতঃস্ফূর্ততা’র মোড়কে মুড়ে ঠাট্টার খোরাক বানিয়ে হাজির করার রীতিই বিদ্যমান। ফলে একথা অনস্বীকার্য যে লিঙ্গবৈষম্য থেকে শুরু করে বর্ণবৈষম্য, জাতিবৈষম্য, আর্থিক বৈষম্য, শারীরিক গঠনগত বৈষম্য সবই বর্তমানে বিশুদ্ধ ‘খিল্লি’র বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে, এবং তা একমাত্র ভাষার মাধ্যমেই স্বাভাবিকত্বের সামাজিক শিলমোহর পায়। ফলে যদি সবাইকে একজোট হয়ে এক বৈষম্যহীন সচেতন সমাজ গড়তে হয়, তাহলে তা কখনোই ভাষার – সে কথ্যভাষা থেকে শিল্পের ভাষা বা জনপ্রিয় গণমাধ্যমগুলিতে ব্যবহৃত ভাষা, যাই হোক না কেন – মধ্যেকার অন্তর্নিহিত বৈষম্যের প্রকাশকে অগ্রাহ্য করে সম্ভবপর হবে না। আর তাই নিজেকে সমাজের এগিয়ে থাকা অংশ মনে করলে, শব্দচয়নের ক্ষেত্রে আমি সলমন খান হই বা পাড়ার জনৈক হরিদাস পাল, আমাকে অতিরিক্ত সচেতন হতেই হবে। ক্যামেরার সামনে হলেও হবে, পাড়ার চায়ের দোকানে আড্ডা দেওয়ার সময় হলেও হবে, খবরের কাগজে লিখলেও হবে।
কিন্তু চন্দ্রিল ধর্ষণের মতো অপরাধের সামাজিক গুরুত্বকে ‘সচেতনতার’ বোধ দিয়ে লঘু করে দেখাতে গিয়ে এই ভাষা এবং ভাষাকেন্দ্রিক বৈষম্যের অস্তিত্বকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে সবটাই ভাব প্রকাশের ‘স্বতঃস্ফূর্ততা’র আওতায় ফেলে দিয়েছেন। তার পিছনের যুক্তি দিয়েছেন – যেহেতু ‘পলিটিকালি কারেক্ট’ পৃথিবীর অস্তিত্ব ‘তাত্ত্বিক সম্ভবনা’ বই অন্য কিছু নয়, তাই
“মানুষের ভাষা বাধ্যতামূলক ভাবে শুধু ঔচিত্যকে ভজনা করতে শুরু করলে, পৃথিবী থেকে প্রায় সব আনন্দই উবে যাবে। পর্নোগ্রাফি, চুটকি ও গালাগালি তো উধাও হবেই (কারণএদের মূল রসটাই উৎসারিত হয় অসমীচীনতা থেকে), বিশ্বসাহিত্যের অনেকটাই বাতিল হয়ে যাবে। রূপকথা তো একেবারে প্রথমেই ডাস্টবিনে, কারণ তার মধ্যে অন্যায়ের ছড়াছড়ি […] ক্যান্টিন ও বৈঠকখানার আড্ডালীলারও দফা গয়া”।
এমন বক্তব্য পরোক্ষভাবে বক্তার সামাজিক সচেতনতা বোধ সম্পর্কে প্রশ্ন তোলে।
চলো ভালো হই, জমকালো হই/ বড়দার বাতেলা শুনি
বর্তমান দুনিয়ায় প্রত্যহযাপনে রাজনৈতিক ঔচিত্য বা অনৌচিত্যবোধের গুরুত্ব এবং এই প্রেক্ষিতে তার ভূমিকাকে বিনা আলোচনায় ছেড়ে দিলে এই লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তাই প্রথমেই প্রশ্ন তুলতে হয় ‘পলিটিকালি কারেক্ট’ থাকা বা না থাকা বলতে ঠিক কি বোঝাতে চাইছেন চন্দ্রিল? আসলে রাজনৈতিকভাবে সচেতন আর রাজনৈতিকভাবে সঠিক থাকার মধ্যে একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। কিন্তু চন্দ্রিল এই পার্থক্যকে মান্যতা না দিয়ে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক পরিশীলনকেই রাজনৈতিকভাবে সঠিক থাকার অতিরিক্ত দায় রূপে প্রকাশ করেছেন। এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় যখন তিনি খুবই স্পষ্টভাবে বলেন, ধর্ষণের মতো অপরাধের সাথে সাধারণ নিগ্রহের তুলনা টেনে আনার বিরোধিতা যারা করছেন তারা আসলে ধর্ষণের “বেদনা-কৌলীন্য”কেই মান্যতা দিচ্ছেন। কিন্তু সেইভাবে দেখতে গেলে খুন হয়ে যাওয়া ব্যক্তির বেদনা-কৌলীন্য সবথেকে বেশি, কারণ ধর্ষিতার পক্ষে জীবনের চেনা ছন্দে ফেরা সম্ভব, কিন্তু খুন হয়ে যাওয়া ব্যক্তির “সব শেষ হয়ে গেল নিশ্চিত ও নিঃশর্ত ভাবেই”!
কিন্তু যে সমাজে এখনও পর্যন্ত একজন মহিলাকে ধর্ষণ করলে ধর্ষিতার চরিত্র থেকে জামার ঝুলের মাপই প্রধান বিচার্য বিষয় হয়, যে সমাজে এখনও মেয়েদের জিন্স পরাকে ভূমিকম্পের কারণ হিসাবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়, যে সমাজে পণপ্রথার নামে মেয়েদের শ্বশুরবাড়ীর কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়, যেখানে কন্যা ভ্রূণ হত্যার মতো অপরাধ অতি অনায়াসেই ঘটে চলে কারণ অধিকাংশ সাধারণ মানুষ মনে করে কন্যা সন্তান ‘বোঝা’ বই অন্য কিছু নয়, যেখানে মেয়েরা ঋতুমতী হলে শিক্ষার পাঠ বন্ধ করে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার প্রচলন আছে, উপরন্তু মিডিয়ানির্ভর, ধর্মনির্ভর পরিবার ব্যবস্থা প্রতিটি ক্ষেত্রে মেয়েদের ভোগ্যবস্তু ব্যতীত অন্য কোনো ন্যূনতম অস্তিত্বের স্বীকৃতি দিতে নারাজ, সেখানে জনসচেতনতার স্তর না বুঝে ধর্ষণকে অন্য পাঁচটা ‘সাধারণ’ অপরাধের পর্যায়ে নামিয়ে আনলে তার ফল যে কি হতে পারে তা এক জটিল তর্কসাপেক্ষ বিষয়।
আসলে সত্যি ধর্ষণের মতো অপরাধের বিরুদ্ধে জনপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে গেলে মেয়েদের যৌনতার সাথে পবিত্রতা এবং সম্মানের ভ্রান্ত ধারণাকে প্রশ্ন করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। আর তাই ধর্ষণকে অন্য অপরাধের তুলনায় অধিক গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি যে আপাতভাবে সেই ‘সম্মান’-এর পক্ষেই সওয়াল করার সাথে তুলনীয়, তা পুরোপুরি অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু তার অপর দিকটি হয় যদি বাজার চলতি ভাষাকেন্দ্রিক বৈষম্যমূলক মনোভাবকে মান্যতা দেওয়ার সমার্থক হয় তাহলে তা নারীবাদকে সত্যি সত্যি পহলাজ নিহলানির সাথে এক বেঞ্চে বসিয়ে দেওয়ারই সমান হয়।
ভেবেছ কৌটোর মাঝখানে/ ভোমরা রাখা আছে সাবধানে
যে ব্যক্তি আদপেই লিঙ্গ রাজনীতি বিষয়ে সচেতন, সে তার অনুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্রেই হোক বা অন্যত্র, এই সচেতনতাকে বাদ দিতে পারবেন না। ফলতঃ আমাদের প্রত্যেকের লক্ষ্য হওয়া উচিত কিভাবে জনমননে সেই সচেতনতার স্বতঃস্ফূর্ত স্ফূরণ ঘটানো যায় এবং তার সাথে ভাব প্রকাশের প্রধান মাধ্যম ‘ভাষা’র বৈষম্যহীন রূপ কেমন হবে সে সম্পর্কে সম্মিলিত গঠনমূলক আলোচনার সূত্রপাত ঘটানো যায়। মেকি বাজারচলতি রাজনৈতিক সঠিক বক্তব্যের গুরুত্ব খুঁজে বেড়ানো, যার প্রত্যক্ষ তাগিদ আমরা চন্দ্রিলের লেখার মধ্যে ছত্রে ছত্রে পেয়ে থাকি, তার চর্চা নয়। যে মানুষটি সমাজে তার অস্তিত্বের জানান দেয় তার লেখার মাধ্যমে এবং যে তার আপাত প্রগতিশীল মননের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় সমাজে প্রচলিত মতাদর্শগুলির বিপরীতে, এক অন্য ধারার জীবনমুখী আদর্শ পরিশীলন করার উৎসাহে তারও অন্তর্নিহিত ভাবনার সীমারেখা আটকে যাচ্ছে এই বৈষম্যমূলক ভাবনার চেনা আবর্তেই।
ফলতঃ নিজেকে রাজনৈতিকভাবে সঠিক প্রমাণিত করার সোজা এবং সরলরৈখিক পন্থা অবলম্বন করে নিজেকে সময়োপযোগী বলে দেখানোর চেষ্টা, বা বলা ভালো সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা এক ব্যক্তিত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা সাময়িকভাবে এই নয়া উদারনৈতিক সমাজে নতুন ভাবে তৈরি হওয়া বিদ্বজন সমাজে খানিক পরিচিতি দিতে পারে, কিন্তু তার সীমাবদ্ধতাগুলিকে ছাপিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় বাতলাবে না। আর তাই এর বিপরীতে এই বৈষম্যমূলক ভাবনাগুলি জন্মানোর যে সামাজিক পরিসরগুলি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে তার বিরুদ্ধে একজোট হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশী।
***
প্রতিটি অনুচ্ছেদের শুরুতে বাংলা ব্যান্ড ‘চন্দ্রবিন্দু’র গানের লাইন ব্যবহার করা হয়েছে।
2 thoughts on “সলমন থেকে চন্দ্রিল: ধর্ষণ ও তার বাজারী লঘুকরণ”