সৌমিত্র ঘোষ
(প্রথম প্রকাশ – আয়নানগর বইমেলা সংখ্যা ২০২০)
একটি রাজনৈতিক প্রস্তাবনা বা ইস্তেহার
এই প্রস্তাবনা / ইস্তেহারটি বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে নির্মিত একটি খসড়া।
প্রস্তাবনাটি চারটি অংশে বিভক্ত। প্রথম অংশে, আজকের পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে বিশ্লেষণ, মন্তব্য, সমস্যাকে বোঝার চেষ্টা। দ্বিতীয় অংশে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী রাজনীতির ক্রম-বিনির্মাণ ও ক্ষয়ের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াটিকে বোঝার চেষ্টা। তৃতীয় অংশে আছে, বিরুদ্ধ সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন বলতে আমরা কি বোঝাতে চাইছি, এবং কেন আজকের সময়ে সে আন্দোলনের বিশেষ প্রয়োজন। চতুর্থ ও শেষ অংশে আজকের সময়ে নতুন আন্দোলন শুরু করার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব।
পরিপ্রেক্ষিত : আজকের ভারতবর্ষ, সংগঠিত দক্ষিণপন্থার উত্থান ও আধিপত্য বিস্তার

২০১৪-র সাধারণ নির্বাচনে বিজেপির উত্থান ও ২০১৯-এ শক্তি বাড়িয়ে শাসনক্ষমতায় ফিরে আসার মধ্য দিয়ে যে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক নিসর্গে এক সার্বিক বদলের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। এ নিয়ে নানাবিধ চর্চা চলছে, সুতরাং বিস্তারিত আলোচনার দরকার নেই। যা সবাই মোটামুটি জানেন, সেগুলিকেই সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করা যাক।
(১) ২০১৪-য় বিজেপির উত্থানকে সাধারণভাবে দেখা হয়েছিলো ভারতবর্ষে পুঁজিবাদী আধিপত্য বিস্তারের প্রকল্পটির এক ঐতিহাসিক তুঙ্গবিন্দু হিসেবে। তার আগে সামাজিক-রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে পুঁজিবাদ এত ক্ষমতা ও আধিপত্য নিয়ে ভারতবর্ষের জটিল ও বিচিত্র সমাজব্যবস্থায় প্রভাব ছড়াতে পারেনি। জনকল্যাণমুখী বা ওয়েলফেয়ার অর্থনীতি থেকে সরে এসে নিওলিবরল বাজার অর্থনীতির দিকে যে যাত্রা ভারত রাষ্ট্র শুরু করেছিলো ১৯৮০-র দশকেই, এক অর্থে তা একটি নির্দিষ্ট চেহারা নেয় ২০০৯ থেকে ২০১৪-র মধ্যেই, যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় কংগ্রেসী জোট। যেহেতু বহুদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় ছিলো, এবং বহুক্ষেত্রেই সেই সরকারকে ওয়েলফেয়ার অর্থনীতির ধাঁচাটিকে বাঁচিয়ে রাখতে বাধ্য হতে হয়, নিওলিবরল অর্থনৈতিক সংস্কারের কাজ অসমাপ্ত থাকে, এমনকি বাধাপ্রাপ্তও হয়। ২০১৪-র নির্বাচনে ভারতীয় পুঁজি সংহত ও একত্রিত হয়ে বিজেপির ‘শক্তিশালী’ রাষ্ট্রভাবনার পিছনে দাঁড়ায়, এবং নয়া-উদার পুঁজিবাদী প্রকল্পের সহায়ক ও অনুসারী এক একদলীয় সরকারকে ক্ষমতায় আনার বিষয়টি নিশ্চিত করে। ১৯৮৯ থেকে চলে আসা কোয়ালিশান রাজনীতির বিকল্প হিসাবে এক নেতা-এক দল-এক রাষ্ট্রের শ্লোগানটিকে হাজির করা হয়। এমন নয় যে এর আগে এই তত্ব নির্বাচনের ময়দানে ছিলো না। ১৯৭১ এবং ১৯৮০তে কংগ্রেস ইন্দিরা গান্ধীকে সামনে রেখে এ জাতীয় একীভূত ভারতবর্ষের ভাবনাকে সামনে রেখে নির্বাচনে নেমেছিলো। তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক, জনকল্যাণমুখী ও ধর্মনিরপেক্ষ এই রাষ্ট্রভাবনা কিভাবে জাতিসত্ত্বা-নির্ভর আঞ্চলিক রাজনীতি, বর্ণ-রাজনীতি ও পরবর্তীতে ধর্মীয় রাজনীতির চাপে এলিয়ে পড়ে, তা এখন ইতিহাসের বিষয়। নয়া-উদার পুঁজিবাদী প্রকল্প পুঁজির যে কেন্দ্রীভবন চায়, এবং যে ধরনের সহায়ক রাষ্ট্র চায়, সেক্ষেত্রে কোয়ালিশান রাজনীতি চালিত বিবিধ(প্লুরাল), অসংহত ও বিকেন্দ্রিত কেন্দ্রীয় সরকার বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ/মধ্য আমেরিকার বিভিন্ন দেশে যেভাবে লাগাতার গঠনগত সংস্কার (স্ট্রাকচারাল রিফর্ম) চালিয়ে আইন-কানুন ও সরকারি নীতিকে আগাপাশতলা বদলে ফেলা হয়, সেভাবে এই দেশে এই কাজ করা যায়নি; উল্টে অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্র/সরকারকে গত ১০ বছরে স্রোতের বিরুদ্ধে গিয়ে একের পর এক জনকল্যাণমুখী (ওয়েলফেয়ার) আইন/নীতি তৈরি করতে হয়েছে। বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য অর্থ-সংস্থার যাবতীয় চেষ্টা সত্ত্বেও গঠনগত সংস্কারের কাজ ক্রমাগত হোঁচট খেতে থাকে—রাষ্ট্রের আপাত অসংহত অবয়বের সুযোগ নিয়ে প্রথাসিদ্ধ বামপন্থী দল এবং বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনগুলি সরকারী কাজকর্ম ও নীতিকে বেশ খানিকটা প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়।
(২) শক্তিশালী এক-দলীয় সরকার থাকা সত্বেও, বিজেপি সরকারের প্রথম পাঁচ বছরের শাসনকালে গঠনগত সংস্কার(স্ট্রাকচারাল রিফর্ম)-এর কাজ ঠিকভাবে চালানো যায়নি। অর্থনীতিতে যে দুটি বড় কাজ এই সরকার করে, যথা নোটবন্দী ও জিএসটি, তাও পুঁজির বিপক্ষে যায়, বাজারকে সামগ্রিকভাবে দুর্বল করে। পেটোয়া কিছু কোম্পানিকে বিভিন্ন ছাড় দেওয়া ও বরাত পাইয়ে দেওয়া ছাড়া এমন কিছু করা হয়নি যা থেকে পুঁজি দীর্ঘমেয়াদি পুষ্টি পেতে পারে। ২০১৪-১৯-এর মধ্যে, ক্ষেত্র নির্বিশেষে বেকারি বাড়ে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে, শিল্প উৎপাদনে ভাঁটা আসে, কৃষিতে চূড়ান্ত সঙ্কট তৈরি হয়। সরকারের কাছে এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার কোন উপায় ছিলো না। ফলে ইউপিএ জমানার যে সব কল্যাণমুখী প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাবে বলে মনে যাচ্ছিলো, তা চালু রাখতেই হয়, অন্য নতুন ওই জাতীয় প্রকল্প চালু করতেও হয়।
(৩) ২০১৯-এর নির্বাচনের প্রাকমুহূর্ত থেকে আজ পর্যন্ত বিজেপি যা করছে, তা তার মূল রাজনৈতিক দর্শনের অনুসারী। নিরবচ্ছিন্ন প্রচার ও দমন চালিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে, রাষ্ট্র, সরকার ও দেশ অভিন্ন। যে আপাত গণতন্ত্রের আবহ নয়া-উদারতাবাদী বাজার অর্থনীতিতে থাকা সম্ভব, জাতীয় নিরাপত্তা ও আইনের শাসনের নাম করে, তাও নষ্ট করা হচ্ছে। যে ‘শক্তিশালী রাষ্ট্র’ তৈরী করতে চাইছে বিজেপি, সেখানে গণতান্ত্রিক বার্তালাপের অবকাশ নেই, এমন কি বিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও না। সংসদে আইন পাশ না হলে অর্ডিন্যান্স, দরকারমতো সংবিধান বদল। যে কায়দায় ৩৭০ ধারা বিলোপ করা হয়, নতুন সিএএ আইন পাশ করানো হয় এবং রাজ্যসভায় দল ভাঙিয়ে এবং লোভ ও ভয় দেখিয়ে গরিষ্ঠতা তৈরি করা হয়, তা দেখিয়ে দিচ্ছে বর্তমান শাসক দল ইচ্ছামতো যে কোনো রাজনৈতিক বদল আনতে পারে। রাষ্ট্রের হাতে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে, কেন্দ্রকে শক্তিশালী করে, রাজ্যগুলিকে কমজোর করা হচ্ছে পরিকল্পনামাফিক।
(৪) রাষ্ট্র তার আধিপত্য বাড়াচ্ছে প্রতিদিন। এই আধিপত্য একাধারে সামরিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক, ডমিনেশান এবং হেজিমনি উভয়ত। রাজনৈতিক বিরোধিতার পরিসর ক্রমশ ছোট হচ্ছে; বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে শাসনযন্ত্রের যথেচ্ছ ব্যবহার চলছে, একইসঙ্গে সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করা হচ্ছে নিছক রাজনৈতিক কারণে। পুলওয়ামা-বালাকোট কান্ড এবং কাশ্মীরের বর্তমান অবস্থা থেকে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ সত্বেও, এই অবস্থাটি তুলনারহিত বা ইউনিক নয়। যা তুলনারহিত তা হচ্ছে সামরিক-রাজনৈতিক আধিপত্যকে একটি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিষয় করে তোলা, এবং সেই কাজে পরিকল্পনামাফিক ও দীর্ঘকাল ধরে দলীয় সামাজিক সংগঠন—অর্থাৎ আরএসএস-কে ব্যবহার করা। সামরিক শক্তিকে সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আধিপত্যের অংশ করে তোলা, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কাজে সামরিক অভিযানকে ব্যবহার করার কাজ এর আগেও হয়েছে— ১৯৬২-র ভারত-চীন যুদ্ধ ও ১৯৭১-এর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়, ১৯৯৯-এ কার্গিল কান্ডে। আজকে আমরা যা দেখছি তা তাৎক্ষণিক বা ঘটনানির্ভর নয়, দীর্ঘদিন ধরে গড়ে তোলা এক নির্মাণ, যা সঙ্ঘ পরিবারের কাজ ভিন্ন সম্ভব হতো না। আরএসএস-এর সংগঠন ও ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন স্তরে তার উপস্থিতি সমসাময়িক বিশ্বের বহু রাষ্ট্রবাদী শক্তির থেকে বিজেপিকে আলাদা করে চিনতে শেখায়। সামরিক শক্তিতে বলবান, এক-ধর্মীয়, অভিন্ন-সংস্কৃতির ধারক ও রক্ষক, এমন এক ভারতবর্ষের নির্মাণের কথা আরএসএস বহুকাল ধরে বলে আসছে। পুলওয়ামা-বালাকোট কান্ড পরবর্তী সময়ে দেখা গেলো, ভারতবর্ষের যে একরৈখিক সাংস্কৃতিক নির্মাণটি বিজেপি সাধারণ্যে নিয়ে আসছে, তা এদেশের মানুষের এক গরিষ্ঠ অংশের কাছে গ্রাহ্য হয়ে উঠছে। অর্থাৎ লোককল্পনায় ভারতবর্ষ আর ‘বিবিধের মাঝে মিলন মহানে’র তীর্থভূমি থাকছে না, যেখানে সবাই স্বাগত। বরং তা হয়ে উঠছে মূলত পুরুষ, পেশীবহুল ও আপাদমস্তক সামরিক এক পরিসর। এই পরিসরে রাষ্ট্রবিরোধিতা মানেই দেশবিরোধিতা, দেশজ সংস্কৃতিরও বিরোধিতা, অর্থাৎ বিজাতীয় ও বিদেশি সংস্কৃতির তথা বিদেশি রাষ্ট্রের তাঁবেদারি করা। এই পরিসরে বিদেশিদের, অর্থাৎ যে বা যারা আরএসএস-এর সাংস্কৃতিক নির্মাণকে গ্রাহ্য মনে করেন না, তাঁদের স্থান নেই। তাঁরা অনুপ্রবেশকারী, ঘুসপেটি অথবা গুপ্তচর, যাদের নিকেশ করা দরকার, নিদেন চিহ্নিত করে জেলে ভরার, অথবা ডিটেনশান ক্যাম্পে পাঠানোর।
(৫) ভারতবর্ষের গত নশো-হাজার বছরের ইতিহাসের মধ্যে হিন্দু-মুসলমানের দ্বন্দ্ব ও দ্বিত্বের যে যুগপৎ সামরিক ও সাংস্কৃতিক নির্মাণ নিহিত আছে, আরএসএস সেটিকে দীর্ঘকাল ধরে সামনে নিয়ে আসতে চাইছিলো, সে উদ্দেশ্যে কাজও করছিলো। এই কাজের সঙ্গে নেহাতই পশ্চিমী জাতি-রাষ্ট্রের ধরণে গড়ে তোলা আধুনিক ভারতের সম্পর্ক সেভাবে না থাকলেও, ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের মধ্যে এবং তৎকালীন দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী জাতিদাঙ্গার মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব/দ্বিত্বটি যে ফিরে এসেছিলো সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। স্বাধীনতা-উত্তর পর্বে যে মূল ধারার রাজনীতি বা পলিটি ভারতীয় রাষ্ট্রের সঙ্গে জড়িয়ে যায়, তাতে এই দ্বন্দ্বটি প্রধান ভূমিকা না নিলেও, কখনোই অনুপস্থিত ছিলো না। ভারতীয় বামপন্থীরা এই বিষয়টিকে উপযুক্ত গুরুত্ব দিয়ে বুঝে উঠতে পারেননি। পরিচয়ের রাজনীতির নির্মাণ, বিন্যাস ও প্রসার বিষয়ে বামপন্থীদের স্পষ্ট ধারণা ছিলো না। হিন্দু-মুসলমান দ্বিত্বের সমান্তরালে, ষাটের দশকের শেষ থেকে শুরু করে আশির দশকের শেষাশেষি নাগাদ ভারতের মূল ধারার রাজনীতিতে জাত (caste) ও জাতির (এথনিসিটি) প্রশ্ন প্রবলভাবে উঠে আসতে আরম্ভ করে, ফলে পরিচয়ের রাজনীতির এক নতুন ধারার সূচনা ঘটে। যে কোন পরিচয়ের রাজনীতির উৎসে এক/একাধিক সাংস্কৃতিক কল্পনির্মাণ বা ইম্যাজিনারি থাকে। এই নির্মাণ ‘অন্যের’ দমনের বিরুদ্ধে নিজেকে তুলে ধরবার মধ্য দিয়ে যেমন ঘটে, তেমনি অন্যের সাপেক্ষে নিজেকে বেশি শক্তিশালী প্রমাণ করার মধ্য দিয়েও। রাজনীতিতে এই নির্মাণ প্রসারিত হয় রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদারিত্বে বা সরাসরি দখলে। কল্পনির্মাণ প্রক্রিয়াটি কখনোই একরৈখিক বা লিনিয়র থাকে না। নানান উপাদান ও পরিপ্রেক্ষিতের সমাহারে এই নির্মাণ ঘটে, ঘটতে থাকে। ভারতবর্ষে জাত বা জাতিকে ধরে যে সব পরিচয়ের রাজনীতি গড়ে উঠেছে, তাতে ধর্ম, ইতিহাস ও পুরাণ থেকে আহরিত কল্পকথা যেমন আছে, তেমনই আছে বাস্তব অর্থনৈতিক প্রসঙ্গ, রাষ্ট্রকেন্দ্রিক লড়াইকাজিয়া। জাত ও জাতির পরিচয়, যা বস্তুত কল্পনির্মাণ, রাষ্ট্ররাজনীতির পরিসরে তা অনায়াসে মিশে যাচ্ছে অর্থনৈতিক ক্ষমতাবৃদ্ধির দাবীর সঙ্গে, রাজনৈতিক ক্ষমতাবৃদ্ধির উপায় হয়ে উঠছে। সংরক্ষণকে কেন্দ্র করে ভারতের রাজনীতি যেভাবে গত কয়েক দশকে বারম্বার আলোড়িত ও বিবর্তিত হয়েছে, তা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় কিভাবে প্রচলিত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা-সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস ঘটিয়ে পরিচয়ের রাজনীতি পুষ্ট হয়ে ওঠে। এই পুনর্বিন্যাসের চূড়ান্ত উদাহরণ, ধর্মভিত্তিক পরিচয়ের সফল কল্পনির্মাণ, যা ভারতবর্ষের বর্তমান শাসকদের রাজনৈতিক ক্ষমতার মূল উৎস। জাত-জাতি-বর্ণ নির্ভর অন্য নির্মাণগুলিকে তা অনেকাংশে গিলে নিতে পারে, এটাও দেখা যাচ্ছে।
(৬) কল্পনির্মাণ-নির্ভর পরিচয়ের রাজনীতির বোলবোলা এসময়ের রাষ্ট্রীয় রাজনীতির অন্যতম চরিত্রলক্ষণ। শুধু ভারতবর্ষে নয়, পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কোষে কোষে ঢুকে পড়ছে ‘অন্য’-বিরোধী পরিচয়, সে পরিচয়ের কল্পনির্মাণ। অথচ এমনটি ঘটার কথা ছিলো না। নিওলিবরল পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পুঁজি ও শ্রমের এক ধরণের বিশ্বব্যাপী চলন থাকে, পুঁজি ক্রমাগত জায়গা বদলায়, এক দেশে অর্থাৎ এক জাতিরাষ্ট্রে উদ্ভুত পুঁজি অনায়াসে অন্য দেশ/জাতিরাষ্ট্রে ঢুকে পড়তে পারে, পুঁজির যাতায়াতে রাষ্ট্র সহায়ক ভুমিকা নেয়, বা তার অংশ হয়ে ওঠে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অর্থ প্রতিষ্ঠান, নানান আন্তর্দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তি, সেই চুক্তি রূপায়ণের জন্য তৈরি প্রতিষ্ঠান, এসবে নজর দিলে ব্যাপারটা খোলসা হয়। তদুপরি, পুঁজির দৃশ্য ও বোধগম্য চলনের বাইরে থাকে বিশ্বব্যাপী অর্থপুঁজির দুর্জ্ঞেয় রহস্যাবৃত মায়া, যেখানে কি রাষ্ট্র/রাষ্ট্রপরিচয় কি লগ্নিক্ষেত্র সবই গুলিয়ে ঘেঁটে একাকার— কে কোথায় কেন লগ্নি করে, কে কিভাবে তা থেকে মুনাফা করে, বোঝা দুষ্কর। এই অবস্থায় শ্রম বিশেষ ভূখন্ডে কি জাতিরাষ্ট্রের সীমানায় আবদ্ধ থাকতে পারে না, এমন কি বিশেষ কেন্দ্রীভূত উৎপাদনপরিসরেও নয়। পুঁজি গড়িয়ে গড়িয়ে কি উড়ে উড়ে রাষ্ট্রসীমা ছাড়ায়, উৎপাদনপ্রক্রিয়া ক্রমশ বিকেন্দ্রিত হতে থাকে, একদা জমাট-বাঁধা শ্রম তরল কি উদ্বায়ী হয়ে ওঠে। গ্রামের কৃষক হস্তশিল্পী কারিগর ভূমিহীনের দল শহরে আসেন, শহরে জায়গা/কাজ না থাকলে দেশান্তরী হন। উচ্ছেদ ও স্থানান্তরণের প্রক্রিয়া নিরবচ্ছিন্ন ভাবে প্রচলিত পরিচয়কাঠামোকে ভাঙে, শ্রেণী পুনর্নিমিত হয়, অন্যান্য বর্গপরিচয়ও স্থির থাকে না। কিন্তু চারপাশে যা দেখা যাচ্ছে এখন, পরিচয়ের রাজনীতির উদগ্র ডানমার্গী বাহুল্যও নিওলিবরল বাস্তবতারই আর এক প্রকাশ। স্থানান্তরিত জনগোষ্ঠীদের ভিন্ন ধর্ম-আচরণ, জাতিসত্বা ও ভাষা-সংস্কৃতি নিরন্তর জন্ম দিতে থাকে তথাকথিত ভূমিপুত্র-গোষ্ঠী নির্ভর ডানমার্গী পরিচয়ের রাজনীতির, যা জাতিরাষ্ট্র ও ধর্ম/জাতি নির্ভর জাতীয়তাবাদের (ন্যাশনালিজম) কথা বলে, যা কিছু ‘অন্য’ বা ভিন্ন, তাকে আক্রমণের নিশানা করে। পরিচয়ের রাজনীতি প্রথমাবধি পুঁজিতন্ত্র থেকে পুষ্ট হয়, রাষ্ট্রবাদ ভিন্ন এই রাজনীতিকে ভেবে ওঠাও যায় না। পরিচয়ের রাজনীতির উৎসে ও বিস্তারে যে ডানমার্গী চিন্তা ক্রিয়াশীল, তা সবচাইতে স্ফীত ও বিপজ্জনক হয়ে দেখা দেয় ফ্যাসিবাদে, ফ্যাসিবাদি ভাবনায়। যেহেতু ফ্যাসিবাদ আসলে পুঁজিতন্ত্রেরই চূড়ান্ত রাষ্ট্রবাদী প্রকাশ, নিওলিবরল পুঁজি-বাস্তবতা-আরোপিত তরল পরিচয়ের সময়েও সে বিপদ নির্মূল হয় না, যেকোন পরিচয়ের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে তা দানা বাঁধতে ও পল্লবিত হতে পারে।
(৭) বিশ্বের অন্যত্র, বিশেষ করে য়ুরোপ কি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে স্থানান্তরিত জনগোষ্ঠীদের লক্ষ্য করে ডানমার্গী পরিচয়ের রাজনীতি বেড়ে উঠছে, যা জাতিরাষ্ট্র ও জাতি(মুখ্যত Race)-নির্ভর জাতীয়তাবাদের (ন্যাশনালিজম) কথা বলে। ভারতবর্ষে আরএসএস-বিজেপি-র উত্থান ও রাষ্ট্রদখলের মধ্য দিয়ে সেই রাজনীতিরই অন্য এক রূপ প্রকাশিত হচ্ছে, যেখানে জাতি (race)-র জায়গা নিচ্ছে ধর্ম। এই ফারাকটা ছাড়া এবং আরএসএস-এর সংগঠনের বিষয়টাকে সরিয়ে রাখলে, আরএসএস-বিজেপি-র উত্থান ও আধিপত্য পৃথিবীর অন্যত্র ঘটে চলা ডানমার্গী উত্থানের অনুবর্তী। ঐতিহাসিক নাজি ফ্যাসিবাদ থেকে এই আধুনিক ডানমার্গী পরিচয়ের রাজনীতিকে আলাদা করে চেনা যায় মূলত তিনটি বিষয়ে। এক, আপাত-গণতন্ত্রের আবহ, যা সংসদীয় রাজনীতির নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। দুই, সামরিক প্রক্রিয়া থেকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে আলাদা রাখা। যদিও জাতিরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি ও আগ্রাসী চেহারা হামেশা ডানমার্গী পরিচয়ের রাজনীতিতে ব্যবহৃত হয়, সামরিক বাহিনী সরাসরি রাজনীতিতে ঢুকে পড়ছে বা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসছে, বড় (ক্ষমতাশালী, প্রভাবশালী অর্থে) জাতিরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এমনটা সচরাচর চোখে পড়ে না। তিন, সাংখ্যমাধ্যম বা ডিজিটাল মিডিয়ার ব্যবহার। যদিও সংসদীয় রাজনীতি থাকা সত্বেও, রাজনৈতিক বিরুদ্ধতাকে নির্মূল করে ফেলা যায়, সামরিক প্রক্রিয়া যেকোন মুহূর্তে রাজনৈতিক হয়ে উঠতে পারে এবং পুরোনো আমলে ডিজিটাল মিডিয়া ছিলো না, আধুনিক সংসদীয় অতি-ডানমার্গী রাজনীতি, যাকে অভিহিত করা হচ্ছে ‘electoral authoritarianism’ বলেও, সেখানে ফ্যাসিবাদী দমনের চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে না, অর্থাৎ নাজি আমলের গণহত্যার সমতুল কিছুর প্রয়োজন হয় না। ভারতবর্ষে যেমন ঘটছে ইদানীং, গণ-মাধ্যম ও সাংখ্যমাধ্যমকে চূড়ান্তভাবে ব্যবহার করে পরিচয়ের রাজনীতি প্রতিদিন বেশি বেশি করে সামাজিকভাবে গ্রাহ্য হয়ে উঠছে। যে সব সাংস্কৃতিক কল্পনির্মাণ ওই রাজনীতিকে পুষ্ট করে, তা মিডিয়া মারফত ছড়িয়ে পড়ছে টিভিপর্দায়, কোটি কোটি স্মার্টফোনে। বাস্তব ও অবাস্তব, সত্য ও অসত্যের মাঝখানের দেয়াল ভেঙে পড়ছে। ধর্ম, পুরাণ ও বানানো ইতিহাস মিশে যাচ্ছে আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের সঙ্গে, তার পুঁজিনির্ভর অস্তিত্বের সঙ্গে। এর ফল কি দাঁড়াচ্ছে আমরা সবাই প্রতিনিয়ত দেখছি।
(৮) পশ্চিমবঙ্গে আরএসএস-বিজেপি ও তার রাজনীতি ক্রমেই সমাজগ্রাহ্য হয়ে উঠছে— কলকাতা সহ জেলাগুলিতে আরএসএস ও বিজেপির সংগঠন প্রসারিত হচ্ছে। ডিজিটাল মিডিয়ার সাহায্যে ও সুসংগঠিত প্রচার চালিয়ে প্রতিদিন ক্রমশ আরো দৃশ্যমান হয়ে উঠছে সামাজিক-রাজনৈতিক দক্ষিণপন্থা, কয়েক বছর আগেও এই রাজ্যের রাজনীতিতে যার কোন প্রাসঙ্গিকতা ছিলো না। একদিকে রাজ্যের শাসক দলের লাগাতার প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ব্যর্থতা, তাদের নেতৃস্থানীয় কর্মীদের লাগামছাড়া দুর্নীতি, অন্যদিকে প্রতিষ্ঠিত বাম দলগুলির ক্রমাগত জন-সমর্থন হারানো, এই বিষয়গুলিও দক্ষিণপন্থার উত্থানের পক্ষে সহায়ক পরিপ্রেক্ষিত তৈরী করছে। কিন্তু বিজেপি-র উত্থানের বিষয়টা নিছক রাষ্ট্র-রাজনীতির পরিসরে বুঝে ওঠা যাবে না। যে সাংস্কৃতিক কল্পনির্মাণগুলি আরএসএস-বিজেপির উত্থান সম্ভব করে তোলে, তার স্বরূপ ও প্রকাশভঙ্গি না বুঝলে স্রেফ পুরোনো ধরনের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নিরিখ দিয়ে সমাজজীবনে আরএসএস-বিজেপির ক্রমবর্ধমান আধিপত্যকেও বোঝা সম্ভব নয়।
(৯) পশ্চিমবঙ্গে আরএসএস-বিজেপির উত্থান ঘটছে তার একটা কারণ, মুসলমান ও পাকিস্তান-বিরোধী, আধুনিক অথচ দেশজ, যে রাষ্ট্রীয় হিন্দুত্বের কথা আরএসএস-বিজেপি বলছে, রাজ্যের বহু মানুষ তা প্রতিনিয়ত বিশ্বাস করছেন। যে ভাষায়, ভঙ্গিতে ও প্রযুক্তিতে রাষ্ট্রীয় হিন্দুত্বের এই কল্পনির্মাণ বাজারজাত হচ্ছে তা যেমন আমাদের বর্তমান পুঁজিবাস্তব সময়ের মূলগত সাংস্কৃতিক শূন্যতায় পুষ্ট, অন্যদিকে তা ঐতিহাসিক হিন্দু ভারতবর্ষের অসংখ্য পুরাকথায় প্রোথিত। মূলগত সাংস্কৃতিক শূন্যতা বলতে আমরা আসলে বলতে চাইছি বিরুদ্ধ জ্ঞান ও বিরুদ্ধ যূথসংস্কৃতির অভাবের কথা। যা বর্তমানের ওপর রাষ্ট্রপুঁজির আধিপত্যকে প্রশ্ন করতে শেখায়, পণ্যসমাজের বিরুদ্ধে অ-পণ্যায়িত সামাজিক চলনের যূথবদ্ধতার ব্যারিকেড গড়ে তুলতে সাহায্য করে, স্থিতাবস্থা, অন্যায় ও অসাম্যের নিরন্তর বিরুদ্ধতার সেই সংস্কৃতি যখন বলহীন হয়ে পড়ে, পণ্যায়িত বাজারি সংস্কৃতি সমাজের গূঢ়চৈতন্যে শিকড় চালায়—এমনকি বিরুদ্ধতা বলতে এতকাল যা আমরা বুঝে এসেছি, সাংখ্যমাধ্যম অর্থাৎ ডিজিটাল মিডিয়া মারফত তাও পণ্যায়িত হয় প্রতিদিন। ফলত ছবি-শ্লোগান-গালাগাল নির্ভর রাষ্ট্রবাদী হিন্দুত্বের প্রচার যখন ঝাঁপিয়ে পড়ছে সমাজের ওপর প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে, এবং তার সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছে রাষ্ট্রের পেশীশক্তি এবং আরএসএস-এর সংগঠনের মাকড়শাজাল, অপ্রতিরোধ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে পুঁজিবাস্তবতার শাসন।
(১০) পুঁজিবাস্তবতা বলতে আমরা কি বোঝাতে চাইছি? যে বিশ্বায়িত সময়ের আমরা বাসিন্দা, সমাজ বিষয়টা সেখানে মোটামুটি দুভাবে দৃশ্যমান। এক, বাজার-পণ্য-পুঁজির চোখ-ধাঁধানো মাথা-গুলোনো সমাহারে, যেখানে ব্যক্তি-গোষ্ঠী নির্বিশেষে, সমাজ নানান রঙের/চেহারার ক্রেতা-বিক্রেতায় বিভাজিত। দুই, রাষ্ট্রের অ-পূর্ব উপস্থিতি। রাষ্ট্র এখানে নিছক সামরিক চরিত্রের শাসকই না, যে শাসন চালায় দমন-পীড়নের মাধ্যমে। বরং, তা সমাজের কোষে কোষে ছড়িয়ে যাওয়া এক দুরারোগ্য ব্যধির মতো, যা বাজার-পণ্য-পুঁজির সঙ্গে মিশে থাকে, সেই প্রক্রিয়া দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং প্রয়োজনমতো তাকে প্রভাবিত করে। এই বিশেষ অবস্থায়, যখন আপাতভাবে সমাজকে রাষ্ট্র-পুঁজির দখলদারীর বৃত্তের বাইরে খুঁজে পাওয়া রীতিমতো দুঃসাধ্য, সমাজ-বাস্তবতার যাবতীয় ধারণা নিরন্তর রাষ্ট্র-পুঁজির সম্ভাব্য সমস্ত প্রকাশ দ্বারা চিহ্নিত ও পুষ্ট হতে থাকে। এই বিশেষ অবস্থাটিকে আমরা সংক্ষেপে বলতে চাইছি পুঁজি-বাস্তবতা। পুঁজি-বাস্তবতা, বা বিলম্বিত পুঁজিবাদ কি লেট ক্যাপিটালিজম। এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সমাজ যেহেতু ধড়মুড়ো-সুদ্ধ রাষ্ট্র-পুঁজির ভিতরে ঢুকে থাকে, রাষ্ট্র-পুঁজির সমাজদখলের আপাত-একরৈখিক এই প্রক্রিয়ার বিপরীতে যে অনিবার্য প্রতিরোধসমূহ নির্মিত হয়, সেখানেও পুঁজি-বাস্তবতার প্রভাব একইভাবে ক্রিয়াশীল থাকে। প্রতিরোধ-আন্দোলনের সামাজিক শিকড় ছিঁড়ে পুঁজি-বাস্তবতা সে আন্দোলনকে নিজের ধাঁচে ঢালতে চায়, অন্য কথায়, ইন্টার্নালাইজ বা আত্মীকৃত করার চেষ্টা করে। এই আত্মীকরণের ধরনটি সবসময় একই রকম থাকে না। প্রতিরোধ-আন্দোলনের সামাজিক উপাদান কি সাংগঠনিক গঠন অনুযায়ী তা পুঁজি-বাস্তবতা দ্বারা প্রভাবিত হয়।
(১১) রাজনৈতিক বাগ্‌বাহুল্য বা রেটরিক দিয়ে পুঁজি-বাস্তব কল্পনির্মাণের মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। উপরন্তু, আজকের ভারতবর্ষের কথা ধরলে, অর্থনৈতিক দাবিদাওয়াকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলার পুরোনো বামপন্থী পদ্ধতিও এখানে কার্যকরী হবে কিনা সন্দেহ। বিজেপি-র অর্থনৈতিক নীতিতে ক্ষতিগ্রস্ত এমন জনসমষ্টিতেও হিন্দুত্বের কল্পনির্মাণের পক্ষে জনসমর্থন প্রচুর; নোটবন্দি এবং জিএসটি-র যুগপৎ ধাক্কায় কাজ হারিয়েছেন এমন মানুষেরাও আরএসএস-বিজেপি-র প্রচারে প্রভাবিত। এই রাজ্য সহ দেশের সর্বত্র আদিবাসিরা বিজেপি সরকারের নীতিতে আক্রান্ত, অথচ তাঁদেরও এক গরিষ্ঠ অংশ বিজেপি-র সমর্থক। এই অবস্থাটা সামগ্রিক ভাবে একটা নতুন অবস্থা, যা বামপন্থার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক নির্মাণকে নিরন্তর বিপন্ন করে।
(১২) বামপন্থার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক নির্মাণ নিরন্তর আক্রান্ত, বিপন্ন। কেন, কিভাবে? প্রথমত, পরিচয়ের রাজনীতির সাংস্কৃতিক নির্মাণের জটিল ও বিবিধ বাস্তবতার মোকাবিলা বামপন্থীরা করে উঠতে পারছেন না। জাত-জাতি নির্ভর পরিচয়ের রাজনীতির সঙ্গে বামপন্থীদের একাংশ যুক্ত হয়েছেন(যথা ঝাড়খন্ডে, ঝাড়খন্ড লাগোয়া বাংলায়, বাংলার উত্তরে), কিন্তু তা বামপন্থার মূল রাজনৈতিক প্রকল্পটিকে বিপর্যস্ত করেছে। বামপন্থী পরিচয়ের রাজনীতি বলে কিছু তৈরি হয়নি। যেহেতু বামপন্থার রাষ্ট্রবিরোধী সামাজিক নির্যাসের পুরোপুরি বিপ্রতীপে পরিচয়ের রাজনীতির রাষ্ট্রসম্পৃক্তি ও রাষ্ট্রনির্ভরতা, রাষ্ট্রের, রাষ্ট্রক্ষমতার নিরিখে এই রাজনীতির শিকড়বাকড় অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নির্মিত হয়, বামপন্থী পরিচয়ের রাজনীতির নির্মাণ সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, বামপন্থার দার্শনিক উৎসে যা ক্রিয়াশীল, তা রাষ্ট্র ও সমাজ-নির্ধারিত পরিচয়ের সীমাকে অতিক্রম করে অ-পরিচয়ের সমূহে ও সাম্যে পৌঁছোনোর আকাঙ্খা, শ্রেণির নয়, শ্রেণিহীনতার, তথাকথিত বামপন্থী জাতিরাষ্ট্রকেন্দ্রিকতা নয়, অ-রাষ্ট্রীয় আন্তর্জাতিকতার রাজনীতি।
(১৩) পশ্চিমবঙ্গে, এবং অন্যত্র, চিহ্নিত ও দলবদ্ধ বামপন্থীরা বামপন্থার বুনিয়াদি অর্ন্তবস্তুকে বহুদিন ধরে বিনির্মিত করেছেন। এই বিনির্মাণের প্রক্রিয়া সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে বামপন্থীদের ছিন্নমূল করে তুলেছে; যা তাঁরা বলেছেন বহুকাল ধরে, তাঁদের প্রয়োগ তার বিপরীতে গিয়েছে বারবার। নতুন শোষণহীন সমাজব্যবস্থার যে কল্পনির্মাণ বামপন্থী সংস্কৃতির আধার হিসেবে কাজ করেছে দীর্ঘকাল, তা থেকেও তাঁদের সাংগঠনিক-প্রায়োগিক কাজকর্ম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। নতুন অবস্থা মানে নতুন বিপদ, সেই বিপদের মোকাবিলা করার সামর্থ্য রাজ্যের বামপন্থীদের নেই। অর্থাৎ নতুন ও সময়োপোযোগী অন্য রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক নির্মাণ গঠন করার ক্ষমতা তাঁরা হারিয়েছেন।
আজকের পশ্চিমবঙ্গ : বামপন্থার বিনির্মাণ ও দক্ষিণপন্থার উত্থান
(১৪) পুঁজির বিরুদ্ধে, শ্রম এবং শ্রমজীবী মানুষের স্বপক্ষে যে গণ উদ্যোগ বা গণ আন্দোলন বামপন্থী দলগুলির কাছ থেকে মানুষ এক সময় প্রত্যাশা করতেন, তা থেকে এই দলগুলি সরে এসেছে অনেকদিন। বেলাগাম নির্মাণকাজ, জমিবাড়ির ব্যবসা, তৎসংক্রান্ত এবং আরো নানান ধরণের যে অর্থনৈতিক ফাটকাবাজি নয়া উদারনৈতিক রাজনীতির বহিরঙ্গ নির্মাণ করে, ২০১১-য় সরকারী ক্ষমতা হারানোর প্রাক্‌মুহূর্ত পর্যন্ত, এ রাজ্যের বামফ্রন্টভুক্ত যাবতীয় দলের তাতে প্রত্যক্ষ প্রশ্রয় এবং অংশগ্রহণ ছিলো। ট্রেড ইউনিয়ান আন্দোলনকে কুক্ষিগত করে, বিভিন্ন শিল্পমালিকদের নিয়ন্ত্রণহীন ফাটকাবাজিতে মদত দিয়ে, রাজ্যের ম্যানুফাকচারিং ক্ষেত্রের অর্ন্তভুক্ত শিল্পগুলিকে প্রায় পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে তথাকথিত ভূমি-সংস্কার মুখ থুবড়ে পড়েছে, পঞ্চায়েত ব্যবস্থার সুফল ভোগ করেছেন শুধুমাত্র একশ্রেণীর রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও তাঁদের অনুগৃহীতেরা, উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে যাঁদের প্রত্যক্ষ যোগ নেই বললেই চলে।
যেভাবে ম্যানুফাকচারিং ক্ষেত্রের (যথা ইঞ্জিনিয়ারিং, পাট, চা) অর্ন্তভুক্ত শিল্প ধ্বংস হয়েছে, তাতে যুক্ত লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কর্মহীন হয়েছেন বা অসংগঠিত/ঠিকা শ্রমিকে পরিণত হয়েছেন, প্রায় সেভাবেই কৃষিজমি নষ্ট হয়েছে, যদিও তুলনায় কৃষিক্ষেত্রে বহু মানুষ এখনো যুক্ত আছেন। কিন্তু নিঃসন্দেহে পশ্চিমবঙ্গে কৃষি আক্রমণের মুখে। শহর বাড়ার জন্য, নতুন ইঁটভাঁটা তৈরীর জন্য এবং নতুন বাগিচা তৈরীর জন্য (বিশেষত উত্তরবঙ্গে কৃষি জমিতে গড়ে উঠছে নতুন চা বাগান) যে জমির প্রয়োজন, প্রধানত তার যোগান আসছে কৃষিজমি থেকে।
কি শহরে কি গ্রামে, রাজনৈতিক দলভুক্ত এবং দলের অনুগত ফাটকাবাজ-দালাল-ফড়েদের হানাদারি থেকে বাঁচেনি সর্বসাধারণের জমি ও জলাভূমি, এ রাজ্যে যার পুরোটাই আইনত রাষ্ট্রমালিকানাধীন (খাস) কি ব্যক্তিমালিকানাধীন। ফলে চারণভূমি হিসাবে ব্যবহৃত হত যে জমি, সর্বসাধারণের ব্যবহার্য যে পুকুর কাজে লাগত সমগ্র গোষ্ঠীর, তাতেও হাত পড়েছে। রাজনৈতিক মদতে সংগঠিত বনধ্বংসের শুরুও বামফ্রন্টের শাসনকালে। ফ্রন্ট অর্ন্তভুক্ত বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীরা এ থেকে অর্থনৈতিক লাভ করেছেন, তার অসংখ্য নজির আছে।
অর্থাৎ ২০০৬ নাগাদ, সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণ বিরোধী কৃষক ও নাগরিক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংগঠিত জমিলুটের যে প্রক্রিয়াটি দৃশ্য হয়ে ওঠে, তার শুরু অনেক আগেই। বামপন্থার নামে, বামপন্থী শব্দবন্ধ ব্যবহার করে, শ্রমিকের বিরুদ্ধে, কৃষকের বিরুদ্ধে, অরণ্যনির্ভর আদিবাসীর বিরুদ্ধে যে রাজনীতি/রাজনৈতিক শাসন রাজ্যে মৌরসী পাট্টা গেড়ে বসেছিল, তা পুষ্ট হয়েছে গত তিন দশকের বেশি সময় ধরে। মনে রাখা দরকার ২০০২-৩ এ উত্তরবঙ্গের চাঁদমণি চা বাগান নিতান্ত গায়ের জোরে উচ্ছেদ করে রাজ্য সরকার, তা একটি নির্মাণসংস্থাকে বে-আইনিভাবে বেচা হয়। কলকাতার উপকন্ঠে রাজারহাটের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জলাভূমি, চারণভূমি ও কৃষিজমি অধিগ্রহণ তারো আগের ঘটনা।
(১৫) রাজ্যের বর্তমান সরকারের নেতৃত্বে থাকা তৃণমূল দলটির উত্থান ও রাজনৈতিক আধিপত্যের বিষয়টিকে এই পরিপ্রেক্ষিতে দ্যাখা দরকার। কর্পোরেট জমিলুটের বিরুদ্ধে, বামপন্থী শব্দবন্ধ ব্যবহার করেই, শ্রমিক-কৃষকের, আদিবাসীর স্বার্থরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এই দলটি ক্ষমতায় আসে। কিন্তু বামফ্রন্টের সময়কালের ফাটকাবাজ-দালাল-ফড়ে শাসনের বিরুদ্ধাচারণ তারা করেনি। করার কথাও না। যে নয়া উদারনৈতিক ফাটকা পুঁজি এ রাজ্যে ক্রমশ ক্ষমতাবান হয়েছে, তৃণমূলের সময়ে তা আরো শক্তিশালী হয়েছে। সারদা বা ঐ জাতীয় পনজি স্কিমের সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে পড়েছে রাষ্ট্রক্ষমতা ও রাজনীতি, তার সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিকতা নিয়ে।
পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম-শহরে বামফ্রন্টের সঙ্গে যুক্ত ছিলো যে লুম্পেন দুর্বৃত্তবাহিনী, জমি-জলা লুট থেকে শুরু করে শ্রমজীবী মানুষের, সাধারণ নাগরিকের অধিকারহননের যাবতীয় নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়ায় যারা ফাটকা পুঁজির প্রধান সহায়ক শক্তি ছিলো, তারা এখন তৃণমূলের অনুগত। বামফ্রন্ট থেকে তৃণমূল, এই আপাত রাজনৈতিক বদলটি মূলগতভাবে কোন রাজনৈতিক-সামাজিক বদল সূচিত করে না। যে অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া চলছিলো, তা-ই চলছে। আরো প্রকাশ্য ও উদ্ধত হয়েছে গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলিকে ‘অপরাধ’ হিসেবে চিহ্নিত করার রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়া, বিরোধী মতামত বিষয়ে সহনশীলতার অভাব আরো প্রকট। কিন্তু মূলত একই শাসন, এক দলীয় আধিপত্য, এক ফাটকাবাজি। কর্পোরেট জমি লুট প্রসঙ্গে তৃণমূলের এক ধরণের বিরোধিতা আছে। কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার জন্য এক্ষেত্রেও তারা যে কোন মুহূর্তে আপস করতে পারে।
নিতান্ত নির্বাচনী রাজনীতির স্বার্থেই, তৃণমূল দলটি পশ্চিমবঙ্গের সমাজজীবনকে গুরুতর, আরো দৃশ্যমান ধর্মীয় বিভাজনের দিকে ঠেলেছে।একদম বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারের ধর্মীয় রাজনীতির ধরনেই, তারা প্রকাশ্য প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে ঐস্লামিক মৌলবাদকে, মোল্লা-মৌলবীদের আধিপত্যকে।
(১৬) এই পরিপ্রেক্ষিতে, গত কয়েক বছর ধরে কলকাতা সহ জেলাগুলিতে আরএসএস ও বিজেপির উত্থান ঘটছে। কিন্তু এ রাজ্যে দক্ষিণপন্থার উত্থানের পক্ষে সহায়ক পরিপ্রেক্ষিত তৈরী হয়ে আছে দীর্ঘদিন ধরেই, যে রাজনীতি চলছে গত প্রায় চল্লিশ বছর ধরে, শেষ বিচারে তা আর যাই হোক, কখনোই বামপন্থী (বামপন্থা অর্থে এখানে আমরা নির্দিষ্টভাবে সমাজমুক্তির রাজনীতির কথা বলছি) নয়। উল্টে, কি গ্রামে কি শহরে ভোটনির্ভর রাজনীতির যে খাসদখল আমাদের সমাজজীবনে তৈরি হয়েছে গত কয়েক দশক ধরে, তার সমতুল কিছুর সন্ধান ভারতবর্ষের অন্যত্র খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ১৯৭৮-এ পার্টির নামে পঞ্চায়েত নির্বাচন শুরু হওয়া ইস্তক এই দখলদারি বাড়তে বাড়তে গেছে, শুরুতে যা সমাজজীবনে কমিউনিস্ট পার্টির আধিপত্য বাড়ানোর প্রকল্প ছিল, তা ক্রমে হয়ে দাঁড়িয়েছে পার্টিকর্মী ও নেতাদের জীবিকানির্বাহ ও ধনী হবার প্রক্রিয়ামাত্র। যেহেতু কি পঞ্চায়েত কি পুরসভা বিধানসভা লোকসভা, এ রাজ্যে ভোট হচ্ছে সমাজের ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বিষয়টাকে সমাজগ্রাহ্য করে তোলার প্রধান উপায়। প্রাত্যহিক সমাজজীবনে ভোট/ভোটপ্রক্রিয়ার গুরুত্ব যত বেড়েছে, সমাজে তত বেশি করে প্রোথিত হয়েছে রাষ্ট্রের, রাষ্ট্রক্ষমতার শিকড়বাকড়। সমাজ বিষয়টাই ভোট ওরফে পার্টি মারফত পুনর্গঠিত হচ্ছে, ফলে রাষ্ট্র / রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে সামাজিক ক্ষমতা সমার্থক হয়ে উঠছে। যেহেতু সমাজ কোনও জায়গাতেই সমসত্ব নয়, একটাই সমাজও নয়, বাস্তবে যে রাষ্ট্র ও সমাজ এক হয়ে যাওয়ার ঘটনাটা একই ভাবে সর্বত্র ঘটছে তা নয়। কিন্তু আধিপত্যের একটা পেশীভাষা বা জোরের ভাষা বা প্রকাশ থাকে, রাষ্ট্র মানে পুলিশ-পেয়াদা-আমলা-হাকিম, পার্টি মানে পার্টির দাদা-গুন্ডা-মন্ত্রী-সান্ত্রী। এ সবের একটা আপাত দৌরাত্ম্য এবং তান্ডব থাকে, তা পেরিয়ে সমাজ, নিছক সমাজ, যেখানে বহু বছর ধরে মানুষ একসঙ্গে থাকে, বাঁচে, ভালোবাসে, গান গায়, ঝগড়া করে, সেটাকে বুঝে ওঠা যায় না, কালক্রমে তা বিস্মৃত হয়ে পড়ে। অর্থাৎ সমাজ নিজেকে নিজে ভুলে যাচ্ছে, মনে রাখছে রাষ্ট্রকে, রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও দৌরাত্ম্যকে। বাংলায় রাষ্ট্র মানে মুখ্যত দল, পার্টি, যে যখন ক্ষমতায় থাকে সে। মোদ্দা কথা, সমাজ থাকে অথচ থাকে না, থাকলেও তা রাষ্ট্রের ভিতরে কি নিতান্তই অনুগত।
(১৭) অথচ, বামপন্থীরা যে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিয়ে রাষ্ট্রে গিয়েছিলেন, তা নিছক ভোট মারফত নির্মিত হয়েছিল, এমন আদৌ নয়। উল্টে, সেই ক্ষমতার উৎসে নিরন্তর, লাগাতার এক ধরনের রাষ্ট্রবিরোধিতা ছিল। তেভাগা থেকে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম পর্যন্ত সামাজিক আন্দোলনের যে প্রবাহকে বাংলার বামপন্থীরা স্মরণ করেন, তা ছিলো রাষ্ট্রের, রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন দলের আধিপত্যের বিরুদ্ধে সচেতন গণবিদ্রোহ। বামপন্থা বলতে যে সাংস্কৃতিক নির্মাণের কথা আমরা বুঝি, তা ঘটে রাষ্ট্রের ও রাষ্ট্রক্ষমতার শরিক শাসকদের আধিপত্যের প্রাচীরে ফাটলের পর ফাটল তৈরি করার, করতে থাকার মধ্য দিয়ে। এই নির্মাণ না থাকলে, সমাজে, সামাজিক ক্ষমতাসম্পর্কে বদল আসে না। ১৯৬৭-তে নকশালবাড়ি আন্দোলন হচ্ছে। ভোট দিয়ে, ভোটে জিতে, সমাজ বদলানো যায় না এই স্লোগান দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি ভাঙছে পাকাপাকিভাবে ১৯৬৯-এ। যুক্তফ্রন্ট সরকার তৈরি হচ্ছে কমিউনিস্টদের একাংশের উদ্যোগে, কিন্তু তার পরেও বামপন্থীরা, এমনকী যারা ভোটে জিতে সরকার গড়ায় বিশ্বাস করছিলেন, রাষ্ট্রবিরোধিতার এই বুনিয়াদি কাজটা ছেড়ে দেননি। ১৯৭৪-এ কৃষক আন্দোলন ছাত্র আন্দোলন হচ্ছে বাংলা জুড়ে, জরুরি অবস্থা জারি হবার পরেও নিঃশব্দে সংগঠন বিস্তার করছেন বামপন্থীরা। ১৯৭৭-এ তাঁরা রাজ্যে ক্ষমতায় এলেন, ১৯৮২ নাগাদ বোঝা গেল ক্ষমতায় থাকার ব্যাপারটা আর সাময়িক নয়, বরং বন্দোবস্তটি টেঁকসই। সামাজিক বিরোধিতা ও প্রতিরোধ সংগঠিত করার কাজটা ধীরে ধীরে তাঁরা বন্ধ করে দিলেন। সরকারে টিঁকে থাকার জন্য, ভোটে জেতার জন্য, মূলে রাষ্ট্রবিরোধী এমন সব সামাজিক আন্দোলনের প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দেওয়া হল। সমাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে যে সব সংগঠন বামপন্থীরা দীর্ঘদিন ধরে গড়ে তুলেছিলেন, তাদের চরিত্র বদলাল, পুরোনো ও নতুন, যে সব সংগঠনের সঙ্গে বামপন্থীরা যুক্ত ছিলেন, তা হয়ে দাঁড়াল আগাপাশতলা পার্টিশাসিত। বাকিটা, অর্থাৎ কী করে বামপন্থী শাসনের সঙ্গে যাবতীয় সম্ভাব্য অসম্ভাব্য দুর্নীতি ও বজ্জাতি সমার্থক হয়ে দাঁড়াল, কী করেই বা বামপন্থীরা নিওলিবরল পুঁজির পক্ষে প্রকাশ্যে ওকালতি শুরু করলেন, তা ইতিহাস, এবং খুব পুরোনো ইতিহাস নয়।
(১৮) বাংলায় যা ঘটল, তা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তিও বটে। রাষ্ট্রের অংশ হয়ে, রাষ্ট্রের মধ্যে থেকে, রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে সমাজে বিপ্লবী বদল ঘটানোর চেষ্টা দেশে-বিদেশের বামপন্থীদের একটা অংশ গত সোয়াশো-দেড়শো বছর ধরে করছেন। যে ইতিহাসপর্বের মধ্যে আমরা আছি, তা পুঁজিতান্ত্রিক, যার অর্থ আমাদের বিভিন্ন সমাজব্যবস্থা বিবিধ ভিন্নতা সত্বেও প্রধানত পুঁজিতান্ত্রিক ক্ষমতাসম্পর্কের অধীন। সেই ব্যবস্থায় যে রাষ্ট্র তৈরি হয়, তা কি করে, কোন যুক্তিতে বামপন্থার পক্ষে কাজ করতে পারে, যদি মনে রাখি, মনে করি, বামপন্থা মানেই পুঁজিতন্ত্র ও তার অনুপূরক রাষ্ট্রের নিরবচ্ছিন্ন, নিরন্তর সামাজিক বিরোধিতা? ভোট দেওয়া বা ভোটে অংশ নেওয়াটা সেই বিরোধিতার অঙ্গ হতে পারে না, এমন নয়। কিন্তু ভোটে জিতে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল, বা সে উদ্দেশ্যে সমাজকে পার্টির মধ্যে, এবং কালক্রমে রাষ্ট্রের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলাকে কোন যুক্তিতেই বামপন্থা বলে চিহ্নিত করা যায় না।
(১৯) মুশকিলটা হচ্ছে যে, বামপন্থার যে জীবন্ত সামাজিক প্রকল্প এক সময় এই বাংলায় আন্দোলনের পর আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে, তা বহুদিন যাবৎ সমাজবিচ্ছিন্ন ও রেটরিকসর্বস্ব, সমাজে সে ঐতিহাসিক বামপন্থার শিকড় পর্যন্ত নেই। ষাট-সত্তরের ঝোড়ো সময়ে যে নকশালবাড়ি আন্দোলন সমাজমুক্তির ডাক দিয়েছিলো, তার উত্তরাধিকার থেকেও গত চল্লিশ বছরে সমাজে এমন কোনো নতুন বিরোধিতা এবং আন্দোলনের পরিসর নির্মিত হয়নি, যা স্থায়ী প্রভাব রেখে যেতে পারে। রাষ্ট্র ও পুঁজির, শাসকের ও শাসক দলের বিরোধিতায় যখন সমাজ বিস্ফোরিত হয়েছে বারবার, সেই বিস্ফোরণ থেকে এ রাজ্যের তথাকথিত বিপ্লবীবাম, যা অ-সিপিআইএম, নিজেকে পুষ্ট করতে পারেনি। ২০০৬-৭ নাগাদ, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পরবর্তী সময়ে, এ বাংলায় রাষ্ট্রবাদী অ-বাম বামপন্থার বিপক্ষে, পুঁজিতান্ত্রিক উন্নয়নের ধারণার বিরুদ্ধে, পাড়ায় মহল্লায় স্বতঃস্ফূর্ত জনমত গড়ে উঠছিল। সেই জনমতকে সংহত করা তো গেলই না, উল্টে তৃণমূল কংগ্রেসের মতো একটি পপুলিস্ট ও লুম্পেনপুষ্ট দল তা কাজে লাগিয়ে ক্ষমতা দখল করল। ২০০৮ নাগাদ জঙ্গলমহল এলাকায় যে আদিবাসী-কুড়মি জনবিদ্রোহ দেখা দিল, মাওপন্থী কমিউনিস্ট দলের সর্বময় নিয়ন্ত্রণ সেই আন্দোলনকে নিয়ে গেল ব্যক্তিহত্যা ও সন্ত্রাসের সমাজবিচ্ছিন্ন আধিপত্যের পরিসরে। ফলে শক্তিশালী গণআন্দোলনের অস্তিত্ব সত্ত্বেও পুরো এলাকাটা চলে গেল পুলিশ আধাসামরিক বাহিনী ও তৃণমূলের কবলে, যাঁরা দুদিন আগে বিপ্লবী জনযুদ্ধ ও শ্রেণিশত্রু খতমে ব্যাপৃত ছিলেন, তাঁরাই রাতারাতি তৃণমূল হলেন, ইদানীং বিজেপিতেও যাচ্ছেন।
(২০) ২০১১ সালে সিপিআইএম যখন ক্ষমতাচ্যুত হল, সেসময় অ-সিপিআই এম বামদের প্রায় সবকটি খণ্ড ভেবেছিলেন পার্টিটা ভাঙবে, এবং দলছুট সিপিএম কর্মীরা অন্য ‘বাম বিকল্প’ খুঁজবেন। তাঁদের মনে হয়েছিল দলটিতে বহু বিপ্লবী মনোভাবাপন্ন বামপন্থীরা আছেন, যাঁরা ‘বাম বিকল্প’ খুঁজবেন। এই ভাবনার গোড়ায় যে ফাঁকি ছিলো, তা খতিয়ে দেখা হলো না। ভাবা হলো না যে সিপিআইএম মায় তামাম সরকারি দলগুলি উপায়হীনভাবে ভোটনির্ভর, তাঁদের গোটা রাজনৈতিক সংস্কৃতি রাষ্ট্রবিরোধী বামপন্থার প্রকল্প থেকে আলোকবর্ষ দূরে চলে গেছে, ফেরা সম্ভব নয়। সিপিএম-সহ অন্য প্রাতিষ্ঠানিক বামদলে ভাঙন শুরু হলো ঠিকই, কিন্তু তা থেকে লাভবান হলো তৃণমূল বা বিজেপি। অন্যদিকে, নতুন কোনও সামাজিক কাজ গড়ে উঠলো না, কাজের কথা ভাবাও হলো না। যে গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনটি তৈরি হল ভাঙড়ে, খানিক দূর গিয়ে সেটা মুখ থুবড়ে পড়ল। অনেকগুলো সংগঠন একসঙ্গে কাজ করছিলেন, জমি কমিটির মধ্য দিয়ে, এক নতুন সামাজিক সংগঠন গড়ে উঠছে, রাষ্ট্র ও পুঁজি বিরোধিতার নতুন সামাজিক পরিসর তৈরি হচ্ছে, মনে হচ্ছিলো। অথচ, খানিকদূর চলার পর, ভাঙড় জমি কমিটির সমগ্র প্রক্রিয়াটি একটি বিশেষ দলের অধিকারে চলে গেলো। সেই দলের নেতৃত্ব প্রায় একতরফা ভাবে সরকারের সঙ্গে চুক্তি করে আন্দোলন তুলে নিলেন।
(২১) আমরা সর্বার্থেই এক খারাপ অবস্থার মধ্যে আছি। পুঁজি বাড়তে বাড়তে নিয়ন্ত্রণবিহীন, রাষ্ট্রকে পুঁজি থেকে আলাদা করে বুঝে ওঠা যায়না, সমাজ থেকেও। যেসব বাস্তব অবস্থা ও পরিস্থিতি থেকে বিরোধিতার বামপন্থী রাজনীতি পুষ্ট হতো, সেই অবস্থাগুলোও প্রতিদিন বদলাচ্ছে। প্রচলিত ও নতুন বামপন্থী রাজনীতি দুইই সর্বার্থে রাষ্ট্রপুঁজি কবলিত, আন্দোলন প্রতিদিন পরিণত হচ্ছে রাষ্ট্রবাদী দলে, অন্যদিকে চটজলদি সংগঠনহীন ইভেন্টে, যা রাস্তায় নামে, আন্দোলন করে, কিন্তু টিঁকে থাকতে পারেনা। সমাজে মিশে থাকার, মিশে থেকে পুঁজিরাষ্ট্র বিরোধী বুনিয়াদি বামপন্থী রাজনীতি তৈরি করার যে ধীর দীর্ঘ প্রক্রিয়া, তা হবে কী ভাবে যখন সমাজ বলতে যা বোঝাতো কুড়ি বছর আগে, তা এখন দৃশ্যত নেই?
(২২) বামপন্থার সংসদীয় ও তথাকথিত বিপ্লবী মুখ, দুটিই আসলে রাষ্ট্রপুঁজি আরোপিত সামাজিক স্থিতাবস্থার পক্ষে যায়। শুধু পক্ষে যায় না, তা স্থিতাবস্থাগ্রস্ততায় আক্রান্ত হয়। অথচ, ইতিহাসের শিক্ষা, পৃথিবীর অন্যত্র যেখানেই বামপন্থার বিপ্লবী ও সংসদীয় রাষ্ট্রবাদের প্রকল্প ব্যর্থ হয়েছে, স্থিতাবস্থাও নড়ে গেছে, ফ্যাসিবাদী বা ফ্যাসিবাদী চরিত্রের ডানপন্থা মাথাচাড়া দিয়েছে। বামপন্থা মানে যে নিরবচ্ছিন্ন বিরোধিতার নির্মাণ, পুঁজিরাষ্ট্রের আধিপত্যের বিরুদ্ধে সামাজিক চৈতন্যের প্রতিরোধ গড়ে তোলা, রাষ্ট্রদখল বা রাষ্ট্রক্ষমতার অংশ হয়ে তা যে শুধু ফুরিয়ে যেতেই পারে, এই শিক্ষাও আমরা ভুলে যাই, যেতে থাকি। রাষ্ট্রের মধ্যে আমরা জনকল্যাণ খুঁজি, পুঁজিশাসন পুঁজিনিয়ন্ত্রণ চাই, ভেবে নিই যে ডানপন্থা ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নিজেকে বাঁচাতে সক্ষম। হালফিলের ইতিহাসের শিক্ষা, সংগঠিত ও অসংগঠিত বাম উভয়ত নিরন্তর ঢুকে যাচ্ছে রাষ্ট্র ও পুঁজি নির্মিত ও শাসিত এক প্রত্যক্ষবাস্তবের (এম্পিরিকাল) গহ্বরে। এই ঐশ্বরিক প্রত্যক্ষবাস্তবের মধ্যে বাজার ভিন্ন যা আছে তা হলো রাষ্ট্র ও তার পুরুষ, প্রায়-ঐশ্বরিক, পেশীবহুল অস্তিত্ব, যা থেকেও আসলে নেই তা হচ্ছে যুক্তিনির্ভর (রাশনাল) ও ন্যায়পরায়ণ (এথিকাল) গণতন্ত্রের প্রকল্পটি। বাজার থাকবে, পুঁজি থাকবে, মুনাফাবৃদ্ধির তাগিদ থাকবে, অথচ রাষ্ট্র নমনীয়, জনকল্যাণমুখী ও ‘বামপন্থী’ হয়ে উঠবে, এই সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক (কিম্বা লিবরল) খোয়াবটি যে বস্তুত খোয়াবমাত্র, এই ঐতিহাসিক শিক্ষা গ্রাহ্য না করে আমরা ধরে নিই যে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের মধ্যে সর্বজনগ্রাহ্য ও অপরিবর্তনীয় একটি যুক্তিক্রম অর্থাৎ রিজন আছে, তা ফ্যাসিবাদী বিপদকে আটকাতে পারে।
(২৩) ‘বাংলার সংস্কৃতি’-র সঙ্গে বিজেপি-আরএসএস-এর উত্থান সঙ্গতিপূর্ণ নয়, এমন এক ভাবনা চালু আছে। কিন্তু কোন সংস্কৃতিই যে অজর অমর অব্যয় কিছু নয়, তা যে একটি সামাজিক নির্মাণমাত্র, সেটা আমরা ভুলে যাই। ভুলে যাই যে রাষ্ট্রপুঁজিবিরুদ্ধ রাজনীতির মধ্য দিয়ে আমাদের সামাজিক সমূহ চৈতন্যের যে উজ্জ্বল অর্জন প্রকাশ্যে আসে, তা বাঁচিয়ে রাখতে গেলে সচেতন রাজনৈতিক সংগ্রাম চালাতে হয়।
(২৪) বর্তমান সময়ের যে প্রত্যক্ষবাস্তবের আমরা বাসিন্দা, সেখানে যে কোন শব্দ/ধারণা/অর্থ অমোঘ হয়ে দেখা দিতে পারে, শাসক/বাজারের ইচ্ছামাফিক ইতিহাস ও সময়প্রবাহকে ইচ্ছামতো দুমড়োনো মুচড়োনো যায়। বামপন্থার, বামপন্থী রাজনীতির কাজ, ইতিহাসের সঙ্গে সমাজকে আবার যুক্ত করা, সমাজের ভিতরে যে সব বিরোধিতা আগ্নেয়গিরির মতো সুপ্ত হয়ে থাকে, তাদের জ্বালামুখ খুলে দেওয়া। রাষ্ট্র ফ্যাসিবাদী হবে না কল্যাণমুখী হবে সে বিচারের চাইতে অনেক জরুরি, তা সমাজকে তাঁবে রাখতে, বশ করতে পারছে কিনা। বামপন্থীদের কাছে সেই রাষ্ট্র গ্রহণীয় যা দুর্বল, সামাজিক আন্দোলন যাকে প্রভাবিত করতে পারে। অন্যদিকে, ডানপন্থীদের, ফ্যাসিবাদের পছন্দ শক্তিশালী রাষ্ট্র। আমাদের দুর্ভাগ্য, বাংলায় এবং অন্যত্র, বহুদিন ধরেই বামপন্থীরা রাষ্ট্র ও সমাজকে এক/অভিন্ন করে দেখছেন। এই দেখাটা সচেতনভাবে না বদলালে, বিজেপি-আরএসএস-এর বিরুদ্ধে লড়াইতে আমাদের উপায়হীনভাবে রাষ্ট্রনির্ভর হয়ে থাকতেই হবে।
এই সময়ের কাজ : বিরুদ্ধ সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন
(২৫) এই সময়ের কাজ কি হতে পারে? এ সময়ের কাজ বলতে নতুন কাজ, স্থিতাবস্থা ভেঙে বেরুনোর কাজ, সমাজকে ঠিকভাবে দেখা-বোঝার কাজ, রাষ্ট্র-পুঁজির সর্বব্যাপী আধিপত্যের প্রাচীরে বিদ্রোহের ফাটল নির্মাণ করার কাজ। আগেই যা বলা হয়েছে, বিজেপি-আরএসএস-এর সাংস্কৃতিক কল্পনির্মাণ-এর মোকাবিলা করা পুরোনো বামপন্থার সাংস্কৃতিক চৌহদ্দির মধ্য থেকে করা সম্ভব নয়। সে সংস্কৃতিতে এখন বিপ্লবী রাজনৈতিক অর্ন্তবস্তু নেই, একদিকে পুরোনো ভাষা ও বাগ্‌বাহুল্য, অন্যদিকে রাষ্ট্রপুঁজি-অধিকৃত সমাজকে ঠিকভাবে বোঝায় অক্ষমতা তাকে চিরপঙ্গু করে রেখেছে। ফলত, যা এখন করতে হবে, যা বলতে হবে, তা করার জন্য প্রথমেই এক যথাযথ সাংস্কৃতিক পরিসর গড়ে তোলার প্রয়োজন। এই সংস্কৃতি রাষ্ট্রপুঁজির চিরস্থায়ী বিরোধিতার, সমাজকে যুথবদ্ধ-সামাজিক করে তোলার, স্বশাসনের অসংখ্য অথচ সংযুক্ত পরিসর নির্মাণের। এই সংস্কৃতি নতুন ভাষানির্মাণের, নতুন ভাবে কথা বলতে শেখার, সংঘায়নের। এই সংস্কৃতি আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের যাবতীয় প্রগতিশীল ভাবনাগুচ্ছকে সামনে নিয়ে আসার, পুনর্প্রতিষ্ঠা করার। এই সংস্কৃতি ঐতিহাসিক বামপন্থার উৎসে নিহিত শোষণমুক্ত সমাজভাবনাকে জনমানসে পৌঁছে দেবার।
(২৬) শাসকের মতাদর্শ যে সব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে সমাজে টিঁকে থাকে, সেই সব প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে তাদের সংস্কৃতির পীঠস্থান। সমাজের গভীরে প্রোথিত শোষণমূলক বিভিন্ন চিন্তা/আদর্শ (পিতৃতন্ত্র-জাত-বর্ণব্যবস্থা-ধর্ম-অসমকাম নীতিমালা বা হেটেরো-নর্ম্যাটিভিটি ইত্যাদি, এবং অবশ্যই অর্থনৈতিক বৈষম্য) সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রকাশিত হয়। রাষ্ট্রের পরুষ পেশীবহুলতা, পুঁজিবাদী পণ্য-সংস্কৃতি, পিতৃতান্ত্রিক সমাজকাঠামো, ধর্ম-জাত-বর্ণের বৈষম্য এসব মিলেমিশে এমন এক নির্মাণ তৈরি করে যা দৃশ্যতই এক সর্বগ্রাসী সাংস্কৃতিক পরিসরের জন্ম দেয়। বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিরুদ্ধ সংস্কৃতি নির্মাণের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়, রাজনৈতিক অর্ন্তবস্তুর অভাব তাকে পূর্ণ হতে বাধা দেয়। নিওলিবরল পণ্য-সংস্কৃতি আমাদের ইতিহাসবিস্মৃত করে তোলে, সমাজের যে যৌথজীবনের স্মৃতিগুলি ক্ষমতাসীন শাসনকাঠামোর বাইরের পরিসরকে সম্ভব করে তোলে তারা আমাদের প্রাত্যহিক সমাজজীবন থেকে নির্বাসিত হয়। অথচ ডিজিটাল মিডিয়া বা গণ-মাধ্যম মারফত বিজেপি-আরএসএস-এর হিন্দু ভারত, মিলিটারি ভারতের কল্পনির্মাণ অনায়াসে ঢুকে পড়ে সমাজজীবনের অন্দরমহলে।
(২৭) না-রাষ্ট্র-না-পুঁজি পরিসরের ভিতর থেকে উঠে আসা যে সব নিপীড়িতের আখ্যান ও দলিলের উত্তরাধিকারে বিরুদ্ধ সংস্কৃতি পুষ্ট হয়েছে এতাবৎকাল, সমাজে তার প্রকাশ, অভ্যাস ও অনুশীলন ক্রমক্ষীয়মাণ, অন্যদিকে গণসঙ্গীত, গণনাট্য ধারাও ক্রমশ হারিয়ে গেছে সংস্কৃতির বৃহত্তর সামাজিক পরিসর থেকে বিচ্ছিন্ন চর্চা ও প্রয়োগের কারণে। সংস্কৃতির স্বচ্ছন্দপ্রবাহ ও দার্শনিক পরিব্যাপ্তিকে দলীয় রাজনৈতিক লাইনের প্রচারের সঙ্গে যুক্ত করার নীতি সংস্কৃতির নির্মাণকে সংকীর্ণতর ও সমাজ-বিচ্ছিন্ন করেছে।
বিরুদ্ধ সংস্কৃতি বলতে কি বুঝতে চাই আমরা? রাষ্ট্রপুঁজি-অধিকৃত সমাজের বাস্তবতায় একজন ব্যক্তিমানুষের সামাজিক হয়ে ওঠার, পূর্ণ হয়ে ওঠার আর্তি লুকিয়ে থাকে তার সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তির মধ্যে। শ্রেণি-ধর্ম-জাত-জাতি-বর্ণ-লিঙ্গ-যৌনতা ইত্যাদি নানা বর্গপরিচয়ের মধ্যে যে শোষণ ও অসাম্য নিহিত, তাকে ছাপিয়ে গিয়ে, আরো পাঁচজনের সঙ্গে মিলে পূর্ণ হবার আকাঙ্খা থেকেই গড়ে ওঠে বিরুদ্ধ সাংস্কৃতিক নির্মাণ। শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে যে কোন ধরণের আন্দোলনের মধ্যে তাই খুঁজে পাওয়া যায় বিরুদ্ধ সংস্কৃতির বীজ বা সৃজনশীল আখ্যানের সূত্র। সমসাময়িক একটি রাজনৈতিক খসড়ায় লেখা হয়েছে—
“…পুঁজি তৈরী করতে চায় মিথ্যা ভোক্তা (consumer) ব্যক্তিমানুষ, যা তৈরি করে বাজার, যা বেঁচে থাকে বাজারেরই প্রয়োজনে। উল্টোদিকে সমাজ চায় যূথবদ্ধ হতে, এমন যৌথ গড়তে, যা ব্যক্তিমানুষকে মর্যাদা দেয়, সম্মান করে। সমাজজীবনে এই সব সাধারণ যৌথগুলি, যথা বড় পরিবার, পাড়া/পল্লী/গ্রাম, বড় কাজের জায়গা, যথা কারখানা অফিস শিক্ষাঙ্গন আজ সমানভাবে আক্রান্ত। কিন্তু সমাজ চায় আবার সামাজিক হয়ে উঠতে, যৌথের দিকে যেতে। এই সামাজিক প্রবণতা আমাদের রাজনৈতিক কাজে প্রতিফলিত হয় কম, আমরা পূর্বনির্ধারিত রাজনৈতিক ধারণার এক পরিমণ্ডলে আটকা পড়ে যেতে থাকি, যা থেকে কোন একটি নির্দিষ্ট সময়ে কি করতে হবে সে বিষয়েও আমরা চালিত হতে থাকি পুরোনো ধারণার দ্বারা।
সুতরাং, সমাজে প্রোথিত থেকে, সামাজিক বাস্তবতায় প্রতিনিয়ত যে পুঁজি-রাষ্ট্র বিরোধী ঝোঁক নিহিত, তার স্বপক্ষে আমাদের কাজ করতে হবে। এই কাজ সবজায়গায় একরকম হবে না। কিন্তু যেখানেই নতুন যৌথ তৈরির সম্ভাবনা আছে, এবং সেই যৌথ যেখানে যেখানে ও যে যে ভাবে পুঁজি-বাস্তবতার পরিসরের বাইরে গিয়ে নতুন সমাজ গড়ার কথা ভাবছে,আমাদের সেই কাজে অংশ নিতে হবে।… পুরোনো যৌথগুলিকে শক্তিশালী করতে হবে। নির্মাণ করতে হবে নতুন যৌথও…।”
এই মূল ভাবনাটিকে ধরে এ সময়ের কাজ ভাবা যায়। রাষ্ট্রপুঁজি-বিরোধী রাজনৈতিক কাজের সঙ্গে সাংস্কৃতিক কাজকে সমতুল হিসেবেই গণ্য করতে হবে। বিরুদ্ধ রাজনীতি যে একইসঙ্গে এক দীর্ঘমেয়াদি চলমান সামাজিক প্রয়োগ ও সাংস্কৃতিক নির্মাণ, এই বোধ আমাদের আন্দোলনভাবনাকে প্রাণিত ও শিক্ষিত করবে।
(২৮) বিরুদ্ধ সংস্কৃতি নির্মাণের উদ্দেশ্যে যে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কথা আমরা ভাবতে চাই, তাকে প্রথাগত রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যে প্রচারের মাধ্যম বা ‘অন্যধারার এন্টারটেনমেন্ট’ হিসেবে বুঝে নিলে চলবে না। গান-কবিতা-নাটক-সিনেমা-চিত্রকলার মত ‘পারফর্মিং আর্ট’গুলির পাশাপাশি মূল্যবোধ-আচার আচরণ সহ যাবতীয় সামাজিক-সম্পর্ক ও অনুভূতিও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অনুশীলনের ক্ষেত্র। অন্তর্ঘাতী যে বিরুদ্ধ প্রক্রিয়ার কথা আমরা বলতে চাইছি, তা পুঁজি-বাস্তবতা-অধিকৃত, প্রচলিত রাজনৈতিক ভাবনার মধ্যে পাওয়া সম্ভব নয়। রাজনৈতিক সমাজের বাইরে থেকে যাওয়া বৃহৎ সামাজিক পরিসরের মধ্যে জন্ম নিতে থাকা সাংস্কৃতিক আন্দোলন-আলোড়নগুলির সঙ্গে যুক্ত হবার চেষ্টা করাই আমাদের প্রাথমিক কাজ হওয়া উচিত। রাজনৈতিক সমাজ বলতে আমরা বলতে চাইছি পলিটি বা মূল ধারার রাষ্ট্রিক রাজনীতির কথা, যা সমাজকে গিলতে উদ্যত। পরিচয়ের রাজনীতির সাংস্কৃতিক কল্পনির্মাণের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন তুলে ধরবে সমাজসম্পৃক্ত ইতিহাসবোধ, অর্থাৎ শ্রেণিবৈষম্য, লিঙ্গবৈষম্য, ধর্ম-জাত-বর্ণ-জাতি নির্ভর রাষ্ট্রিক রাজনীতির বিরোধিতা।
যে সমাজকে রাষ্ট্রপুঁজির ও পরিচয়ের রাজনীতির সাংস্কৃতিক কল্পনির্মাণ প্রতিনিয়ত গ্রাস করে, সেই সমাজকে বা সামাজিক শক্তিকে শক্তিশালী করে তোলার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়াস সাংস্কৃতিক আন্দোলন, যা সমাজের ভিতরে থাকা বৈষম্যগুলির সঙ্গেও লড়াই চালাবে। বিজেপি-আরএসএস-এর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সমাজ-এর মুক্তিকামী অর্ন্তবস্তুকে চিহ্নিত, ঐক্যবদ্ধ ও তীক্ষ্ণতর করার কাজে অন্যতম ভূমিকা নিতে পারে এক নতুন সাংস্কৃতিক উদ্যোগ।
(২৯) বিরুদ্ধতাকে সংগঠিত করার, বিরুদ্ধ সংস্কৃতি নির্মাণের এই লড়াই যেমন আমাদের দেশের লোকায়ত দর্শন, বুদ্ধবাদ, সংশয়বাদ, ভক্তি আন্দোলন, সূফীমার্গ, ধর্ম-সংস্কার আন্দোলন, উনিশ-বিশ শতকের নবজাগরণ আন্দোলন, রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য প্রগতিশীল মানুষের চিন্তা ও সৃষ্টিকর্ম থেকে তার শক্তি আহরণ করবে তেমনই তা বিভিন্ন অন্যবর্গীয় বা সাব-অলটার্ন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বহুবর্ণ ও বিচিত্র শক্তিকেও আত্মস্থ করে সজীব হয়ে উঠবে।
(৩০) সাংস্কৃতিক আধিপত্য বা হেজিমনি নির্মাণ এক ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া। পুঁজিতন্ত্রের উদ্ভবের আগেও শাসক, প্রভু, সমাজের ক্ষমতাশীল অংশ বা কখনও ধর্ম কিংবা তন্ত্র একইভাবে বাকি সমাজের ওপর অধিকার বিস্তার করেছে, সমাজে ক্ষমতাক্রমের নীচে থাকা অসংখ্য মানুষের সংস্কৃতি-চেতনা, বিশ্বাস, জীবনযাপনকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে। অর্থাৎ, অধীনতা কখনই নিছক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক হয়না। অধিকারী সবসময়েই চায় অধিকৃতকে সাংস্কৃতিকভাবেও দখল করতে। উল্টোপিঠে, শাসনের বিপরীত প্রান্তে থাকা মানুষদের ভিতর থেকেও সচেতন বা অবচেতনভাবে এর বিরুদ্ধতা জারি থাকে। নিজস্ব সাংস্কৃতিক অভ্যাস-আচরণকে বজায় রাখা বা রাখার চেষ্টাই অনেকসময়ে সেই সক্রিয়তার উদাহরণ। যে কোনো সংস্কৃতি-পরিসর বিবর্তিত হয় এই সংঘাত ও দ্বন্দ্ব-প্রক্রিয়ায়। পুঁজি-বাস্তব সময়ে এই প্রক্রিয়া জটিলতর। বাজার তার নিজের চাহিদায় পণ্য-সংস্কৃতি নির্মাণের ধারাবাহিকতায় গিলতে থাকে বিরুদ্ধ বা না-পুঁজি সংস্কৃতির বিস্তৃত পরিসরকে। একসময়ের বিরুদ্ধ, না-পুঁজি সাংস্কৃতিক পরিসরও পুঁজির আওতাভুক্ত হয়ে পড়তে পারে। গিলে নেওয়ার এই ধরণটি পুঁজিবাদী বাস্তবতার বিশেষ ধরণ। গিলে নেওয়ার প্রক্রিয়ার পাশাপাশিই চলতে থাকে একধরণের বানিয়ে তোলা সংস্কৃতির নির্মাণ চাপিয়ে দেওয়ার খেলা। একদিকে বাজার চায় পণ্যের সমারোহ। অন্যদিকে, বাজারই ভাঙতে ভাঙতে বা বদলাতে বদলাতে যায় একটি বিশেষ সংস্কৃতি-বৃত্তের যাবতীয় নিজস্বকে। আসলে, পুঁজিব্যবস্থা চায় সমাজের রুচিবোধ ও সাংস্কৃতিক চেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে।
এই সময়ের সাংস্কৃতিক আন্দোলন দাঁড়িয়ে কোনো একমাত্রিকতা, ওয়াননেস বা সেমনেস-এর চর্চা হয়ে পড়লে চলবে না। আমাদের সমাজের সাংস্কৃতিক বাস্তবতা বহুস্বরিক ও বহুত্বময়। ফলে, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নামে কোনো বিশেষ কার্যক্রম বা তাত্ত্বিক কাঠামোর উপস্থাপনা ভুল হবে। সমাজ তাকে নাকচও করবে সহজেই। কারণ, আপাতভাবে পুঁজি-বাস্তবতার প্রতিস্পর্ধা হিসেবে হাজির হলেও তা ক্রমে হয়ে হয়ে উঠবে একটি অন্য সাংস্কৃতিক বয়ানের হেজিমনি। সমাজ নিজের নিয়মেই নিজেকে নানা সাংস্কৃতিক ভিন্নতায় প্রকাশ করতে চাইবে। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে একটি নির্দিষ্ট ও স্থির সাংস্কৃতিক বয়ান কল্পনা করে নিলে এইসব বহিঃপ্রকাশকে আমরা চিনতে পারব না, পড়তে পারব না। এ সময়ের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম বড় দায়িত্ব, এই স্বরগুলিকেও চিনতে শেখা, সেগুলোকে সামনে আনা। সেগুলোকে নিজের মতো করে গড়ে উঠতে সাহায্য করা।
(৩১) সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কর্মসূচি সর্বত্র সমান হবেনা, সমসত্ত্বও হবে না। যেমন, কোলকাতা, মফস্বল, শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, বর্ধমানের মতো শহরগুলোতে ইংলিশ মিডিয়ামের মতো স্কুলের বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একটি কর্মসূচি হতে পারে। মাতৃভাষায় পড়ার, ভাবার, নিজেকে প্রকাশ করার মধ্যে যে স্ব-সংস্কৃতির শিকড় মিশে আছে, তাকে উপড়ে ফেলার যে প্রক্রিয়া চলছে তার বিরুদ্ধতা করার বিশেষ দরকার আছে। অথচ এই বিশেষ ধরণের আন্দোলন অন্যত্র, যথা সুন্দরবনে, অবান্তর হয়ে পড়তে পারে। এই কারণে নয় যে সেখানে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল নেই, ফলে উদ্দিষ্ট আন্দোলনটি অপ্রাসঙ্গিক। বরং, ভিন্ন প্রেক্ষিত থেকেই সেখানে সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে স্থাপন করার প্রয়োজন হতে পারে, বাংলাভাষার স্থানিক, দেশজ বৈচিত্রকে রক্ষা করার আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে। তেমনই, কোথাও ভোগবাদী সংস্কৃতির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে, কোথাও নানা নেতিবাচক সংস্কার ও সংস্কৃতিকেও আক্রমণ করতে হবে। বিজেপি-আরএসএসের হিন্দুত্বের কল্পনির্মাণ সমাজে ক্রমে গতি নিচ্ছে, ফলে আজকের এই আন্দোলন জটিল হয়ে উঠতে বাধ্য। একদিকে, মান্ধাতার আমলের মনুবাদী হিন্দুত্বের বয়ান, অন্যদিকে ভিতরে পুঁজিবাদের উপাদানকে ধারণ করে রাখা— এই বিশেষ ধরনটির বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক লড়াই চালানোটা সহজ নয়। এমন এক সাংস্কৃতিক বয়ানকে আমাদের হাজির করতে হবে যা এ দেশের বহুত্ব, বৈচিত্র, ইতিহাস ও আবহমানের সঙ্গে গাঁথা থাকবে।
ভাষা, মাতৃভাষা ও নতুন ভাষা-আন্দোলনের অভিমুখে
(৩২) বিরুদ্ধ সংস্কৃতির নির্মাণের প্রক্রিয়া সচেতন, সামাজিক, বহুস্তরীয় ও দীর্ঘমেয়াদি। নানান সামাজিক পরিসরে এই নির্মাণ বিভিন্নভাবে ঘটবে, ভাবা যেতে পারে। আপাতত আমাদের প্রস্তাব, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি-আরএসএস-এর উত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে এক নতুন ভাষা আন্দোলনের দিকে যাওয়া। বাংলা বলতে যে ভূখন্ডটির ঐতিহাসিক অস্তিত্ব ছিলো, সেখানে বিভিন্ন সময় ভাষাকে কেন্দ্র করে সামাজিক-রাজনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিচিত্রধর্মী বিরুদ্ধ সংস্কৃতি মাথা তুলেছে, যার আদি উদাহরণ সম্ভবত চৈতন্যদেব ও ভক্তি আন্দোলন, এবং আধুনিকতম উদাহরণ ওপার বাংলায় শাহবাগ।
এক নির্দিষ্ট ভূখন্ডে এক বিশেষ সময়কাল ধরে সমাজ যেভাবে তৈরী হয়, বেড়ে ওঠে, আক্রান্ত হয় কি ভাঙে, সেভাবে ভাষাও জন্মায়, সম্বৃদ্ধ হয়, ভাঙে এমনকি বিলুপ্ত হয়। যদি বাংলা ভাষা নিয়ে আলোচনা করি, আর দশটি ভাষার মতো বাংলা ভাষা হিসেবে বিবর্তিত হয়েছে সামাজিক-ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায়। যেহেতু সমাজ ও ইতিহাস চলমান, ভাষাটিও ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, এমন ধরে নেওয়া যায়। অর্থাৎ, ভাষাটি স্থির ও অন্তিম এক রূপে পৌঁছে গিয়েছে, এমন ভাবা ঠিক হবে না, ভেবে নিলে ভাষা আর জ্যান্ত থাকে না, মরে যায়। ভাষা জ্যান্ত থাকবে কিনা, তা নির্ভর করে তার সামাজিক চলনের ওপর। মূলত যে ভূখন্ডে যে সমাজে সে ভাষা আচরিত হত, সে ভূখন্ড সে সমাজ যদি আপদশির বদলে যায়, ভাষা জ্যান্ত থাকতে পারে না। এই বদল যদি বহুকাল ধরে অল্প অল্প করে ঘটে, তা একরকম, ভাষাও নিজেকে মানিয়ে নিয়ে বদলাতে বদলাতে যেতে পারে। বদলটি যদি দ্রুতগতির ও বিস্ফোরণ-সদৃশ হয়, ভাষা সে ধাক্কা সামলে উঠবে, এমন নাও হতে পারে।
সম্ভবত বাংলা ও আরো বহু মাতৃভাষার ক্ষেত্রে এহেন বিস্ফোরক বদল উপস্থিত। নিওলিবরল বিশ্বব্যবস্থা যাবতীয় সমাজকে যে গতিতে ছিঁড়ছে খুঁড়ছে, মাতৃভাষার সামাজিক অভ্যাসে গুরুতর বদল দেখা দিচ্ছে, ভাষা আর সমাজগ্রাহ্য থাকবে না, এমন সম্ভাবনাও মাথা তুলছে। বিশ্বজোড়া পণ্যব্যবস্থার ও অর্থনৈতিক রাজনৈতিক আধিপত্যের মুখ হয়ে হানা দিচ্ছে, মাতৃভাষার সামাজিক অন্দরমহলে ঢুকে পড়ছে অন্য ভাষা, যথা ইংরেজী। ভাষা-অভ্যাস ও ভাষা-আচরণ যেভাবে বদলে যাচ্ছে তা সবারই জানা। বিশেষ শহরাঞ্চলে সমাজের এক গরিষ্ঠাংশে বাংলা ভাষা-আচরণ ক্রমে কার্যত পরিত্যক্ত হচ্ছে। প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থাই বাংলা ভাষা-বিবর্জিত এক সামাজিক পরিসরে ঢুকে যাচ্ছে ক্রমশ। শুধু বাংলাভাষা নয়, যাবতীয় মাতৃভাষার সামাজিক অভ্যাস দ্রুত কমছে, অন্তত এই বাংলায়।
(৩৩) বলা যেতে পারে, এমনই হবার কথা। বিশেষ, উত্তর-ঔপনিবেশিক ভাষ্য অনুযায়ী, আধিপত্যের নানান ধাঁচ-ধরণ থাকে। ঔপনিবেশিক সময় থেকে শুরু করে স্বাধীনতা-উত্তর কালপর্ব অবধি, বাংলা যে কায়দায় নানান জনগোষ্ঠীর স্ব-স্ব ভাষা-অভ্যাসকে বিপর্যস্ত করেছে, ঔপনিবেশিক শাসকদের দালালদের ও জমিদারদের ক্ষমতাচিহ্ন হিসেবে বাংলা ক্রমাগত তার অভ্যাসক্ষেত্রের ভৌগোলিক পরিসর ক্রমাগত বাড়িয়েই গেছে, একদিন আরো ক্ষমতাশালী আধিপত্যবাদী শাসনের সামনে বাংলাও যে পিছু হটবে, এ তো জানা গল্প। ক্ষমতা-বিস্তারের যাবতীয় আখ্যান তো এভাবেই নির্মিত হয়।
কিন্তু অন্য অন্য মাতৃভাষার মতোই, বাংলা শুধুই শাসকের ক্ষমতাচিহ্ন, ঔপনিবেশিকতার আধিপত্যের অভিজ্ঞান নয়। মধ্যযুগের ভক্তি আন্দোলন থেকে আরম্ভ করে ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী সামাজিক আন্দোলন, বামপন্থী আন্দোলনের দীর্ঘ প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার ইতিহাস, যাবতীয় ধর্মীয় আধিপত্যের দীর্ঘ বিরুদ্ধতা, এ সবের সঙ্গেও জুড়ে দেখতে হবে বাংলাকে, ভাষা হিসেবে তার সামাজিক বিবর্তনকে।
(৩৪) যা বলতে চাওয়া হচ্ছে, ভাষার সামাজিক আধারের, সাংস্কৃতিক দ্বান্দ্বিকতার কথা। ভাষা বেড়ে উঠছে সামাজিক অভ্যাসে, বদলাচ্ছে সামাজিক নিয়মে। একই সঙ্গে ভাষা নির্মাণ করছে সামাজিক সংস্কৃতি, যা যুগপৎ আধিপত্য ও প্রতিবাদ, ক্ষমতাভাষ্য ও ক্ষমতাহীনের চীৎকার। ভাষা থেকে সে কারণে আধিপত্যে ও ক্ষমতায় পৌঁছোনো যায় সহজেই। শাসকের হাতিয়ার হিসেবে ভাষা ব্যবহৃত হয়। অন্য প্রান্তে, ইতিহাসের অমোঘ দ্বান্দিকতায়, ভাষা নির্মাণ করে, করতে করতে যায়, আধিপত্য ও ক্ষমতা বিরোধী প্রতিস্পর্ধা।
(৩৫) মাতৃভাষার অধিকারের দাবিতে দেশে ও বিশ্বে অসংখ্য সামাজিক আন্দোলন হয়েছে, হয়ে চলেছে। ভাষা-আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক ক্ষমতা নির্মিত হচ্ছে, এমনকি জাতি-রাষ্ট্রও জন্মাচ্ছে। যথা বাংলাদেশ। ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্বে, এ রাজ্যের উত্তরে, ভাষা-আন্দোলন মিলে যাচ্ছে জাতিসত্বার (এথনিসিটি) অধিকার আন্দোলনে। সবসময় এই আন্দোলনগুলি যে ক্ষমতাবিরোধী, তা নয়। উল্টে ভাষা ও জাতিসত্বার আন্দোলন প্রায়শই হয়ে উঠছে আধিপত্য বিস্তারের প্রক্রিয়ামাত্র, যা অপরকে নিরন্তর অবদমনের, অত্যাচারের মধ্য দিয়ে পুষ্ট হয়। আসামের বোড়ো আন্দোলনের কথা বলা যায়, যা স্থানীয় সাঁওতাল ও অন্যান্য মধ্য ভারতীয় স্থানান্তরিত জনগোষ্ঠীকে, ও বাঙালি মুসলমানদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করে তুলেছে বারবার। মণিপুরে ও নাগাল্যান্ডে নাগা ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর ভিতর বিবাদ চলছে বহুকাল ধরে। এ রাজ্যের গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন স্থানীয় ক্ষমতাবানদের করায়ত্ত, যা সমর্থিত হচ্ছে ভারতীয় জনতা পার্টির মতো রাষ্ট্রবাদী ও ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী শক্তির দ্বারা।
(৩৬) যে ভাষা-আন্দোলন প্রসঙ্গে আসতে চাইছি, তা মাতৃভাষাকে রক্ষার, মাতৃভাষার অধিকারের সামাজিক আন্দোলন, ক্ষমতাবিস্তারের ও আধিপত্য প্রকাশের নয়। এই আন্দোলনের যদি কোন বিশেষ অপর/প্রতিপক্ষ থাকে তা হলে তা ঐতিহাসিকভাবে ঔপনিবেশিকতা, হালে নিওলিবরল পুঁজিবাদ। আমাদের দেশের, রাজ্যের বিশেষ পরিপ্রেক্ষিতে, অধীনতার ঔপনিবেশিক শিকড়বাকড় ও বাজারি পুঁজিবাদের সঙ্গে মিশে গিয়ে বিজেপি-আরএসএস-এর রাষ্ট্রিক হিন্দুত্বের নির্মাণ এক অভিন্ন সাংস্কৃতিক আধিপত্যের পরিসর তৈরি করে, যেখানে ইংরাজি ও হিন্দি ভাষা, ব্রাহ্মণ্যবাদ ও ডিজিটাল প্রযুক্তি যুগপৎ নিরন্তর ব্যবহৃত হতে থাকে মাতৃভাষা ও ভাষা-সংস্কৃতির উপর আক্রমণ শানানোয়। এই আক্রমণের আদর্শগত ও প্রায়োগিক বিরোধিতা ভিন্ন আজকের ভাষা-আন্দোলন নির্মিত হতে পারে না। মাতৃভাষার ওপর, ভাষা-অভ্যাস ও আচরণের ওপর যে সার্বিক আক্রমণ নামছে, তার প্রতিরোধে ভাষাবাদী-রাষ্ট্রবাদী নয়, অন্য অর্ন্তবস্তুর সাংস্কৃতিক আন্দোলন নির্মাণ করতে হবে। আমাদের বিষয়ী (সাবজেক্টিভ) চৈতন্য ও সমাজযৌথ বর্তমান পুঁজি-বাস্তব পণ্যব্যবস্থায় আক্রান্ত, এই আন্দোলনকে ছুঁতে হবে ব্যক্তি ও যৌথের সেই চৈতন্যকে, বলতে হবে চলমান ও পরিবর্তনশীল সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের কথা। বাংলা-সহ বহু মাতৃভাষাকে বাঁচানোর দাবীর মধ্য দিয়ে এই আন্দোলন আসলে বলবে যাবতীয় মাতৃভাষার সামাজিক অভ্যাসের প্রয়োজনের কথা, পুঁজি ও রাষ্ট্র বিরোধী প্রতিরোধের-প্রতিস্পর্ধার সামাজিক সংস্কৃতির সঙ্গে ভাষার মূলগত যোগাযোগের কথা।
(৩৭) ভাষাকে কেন্দ্র করে, ভাষার সামাজিক অভ্যাসকে পরিপ্রেক্ষিত হিসাবে দেখে তাহলে আমরা চাইছি এমন এক গণ-আন্দোলন, যা ভাষা-সংস্কৃতির ঐতিহাসিক প্রতিরোধ-বিন্দুগুলির ঐতিহ্যের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করবে, ইতিহাসের উত্তরাধিকার স্বীকার করবে। একই সঙ্গে এই আন্দোলন শাসকের ও ক্ষমতাবানের আধিপত্যবাদী পরম্পরা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করবে, সেই ইতিহাসকে অস্বীকারও করবে। অর্থাৎ এই আন্দোলন নিজের শিকড় খুঁজবে ভক্তি আন্দোলনের ধর্মীয় বিভাজন ও জাতিব্যবস্থা-বিরোধী সামাজিকতায়, বঙ্গ-ভঙ্গ আন্দোলনের ঔপনিবেশিকতা-বিরোধীতায়, বিশ শতকের মাঝামাঝি গড়ে ওঠা বামপন্থী আন্দোলনের সাম্যবাদী মতাদর্শে, উনিশ ও বিশ শতকের সামন্তবাদ ও কুসংস্কার বিরোধী নবজাগরণে। কিন্তু এই ঐতিহাসিক আন্দোলনগুলির আগে-পরে যে ধর্মীয় উন্মাদনা, জাতীয়তাবাদী-রাষ্ট্রবাদী মতবাদ ও সাংগঠনিক গোঁড়ামি সমাজচৈতন্যে বিস্তৃত হচ্ছিলো, তাকে সচেতনভাবে আজকের ভাষা-আন্দোলন নাকচ করবে।
(৩৮) এই আন্দোলন ভৌগোলিক অবয়বে আঞ্চলিক হতে পারে, কিন্তু তা অঞ্চলবাদী হবে না কোনোভাবেই। বরং পুঁজি-রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদী বিরোধিতা যে জাতিরাষ্ট্রের কাঠামোকে মতাদর্শগতভাবে অতিক্রম করা ভিন্ন সম্ভব নয়, এই আন্দোলন মনে করাবে সেই কথা। ২০১৯-এর শেষ দিক থেকে, বিজেপি-আরএসএস-এর আগ্রাসী রাষ্ট্রিক হিন্দুত্বের বিরোধিতায় বাংলা সহ প্রায় গোটা ভারতবর্ষে স্বতঃস্ফুর্ত গণ-আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে। এই আন্দোলনের সঙ্গে বহু ক্ষেত্রেই বিজেপি-বিরোধী প্রধান রাজনৈতিক দলেরা জড়িয়ে পড়ছেন। আন্দোলন থেকে যে দাবি উঠছে তার সারাৎসার, ভারতবর্ষের সংবিধান বিপন্ন, তাকে রক্ষা করতে হবে। আপাতভাবে এই দাবি নিয়ে আপত্তি থাকার কথা নয়। ঔপনিবেশিকতাবিরোধী দীর্ঘ লড়াইয়ের পর ভারতীয় সংবিধান তৈরি হয়, মানুষের অধিকারের কথা সেখানে বলা আছে। যে কথাটা বামপন্থীদের বলা দরকার, সংবিধান কি বলছে আর বলছে না, তা শেষবিচারে নির্ধারণ করবে রাষ্ট্র, যেখানে ঔপনিবেশিক আমলাশাহী ও বিচারব্যবস্থা, বড়ছোট রাজনৈতিক দল, মিডিয়া ও পুঁজি সব মিশে আছে। এই ব্যবস্থাটা যদি অনন্তকাল চালু থাকে, সংবিধান বিরুদ্ধ রাজনীতির, অর্থাৎ সমাজপরিবর্তনের রাজনীতির পক্ষে যেতে পারে না। লড়াইটা সংবিধান ও সংবিধান-বিরোধিতা, ধর্মনিরপেক্ষ ও ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের মধ্যে নয়। জাতিরাষ্ট্র ছাড়া জাতীয়তাবাদ হয় না, সামরিকশক্তি, পুঁজির আনুগত্য ও দমনক্ষমতা ছাড়া জাতিরাষ্ট্র বিষয়টাই ভাবা যায় না। সিএএ-এনআরসি চালু করা এবং আরো অসংখ্য কাজের মধ্য দিয়ে বিজেপি-আরএসএস আমাদের প্রাত্যহিক সমাজজীবনকে রাষ্ট্রের সরাসরি খাসদখলের জায়গা করে তুলতে চাইছে। সংবিধানমুখী, অ-বিজেপি ভালো রাষ্ট্রের সন্ধানে আন্দোলন যেন নিজেকে হারিয়ে না ফেলে। রাষ্ট্রকে, রাষ্ট্রবাদী জাতীয়তাবাদী যাবতীয় পরিচয়ের রাজনীতির বিরুদ্ধতায় আমাদের অ-রাষ্ট্র সমাজ, সামাজিক আন্দোলনযৌথ গড়ে তুলতে হবে।

***

এই ইস্তেহারে লেখক হিসেবে একজনের নাম দেওয়া আছে বটে, কিন্তু এই লেখাটি আসলে ‘উদ্যোগ’ নামক একটি যৌথ প্রক্রিয়ার প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষ ফসল। গত কয়েক বছর ধরে গত কয়েক বছর ধরে, বামপন্থী রাজনীতি ও চিন্তার সঙ্গে যুক্ত কিছু দল/গোষ্ঠী, সামাজিক আন্দোলন ও ব্যক্তি নিজেদের মধ্যে একটি রাজনৈতিক সংলাপ নির্মাণের চেষ্টা করছেন। সংলাপটি খোলামেলা, অর্থাৎ সেভাবে দেখতে গেলে, এই মুহূর্তে তার কোন সাংগঠনিক অবয়ব বা উদ্দেশ্য নেই। অর্থাৎ এই সংলাপ-প্রক্রিয়ার অন্তে আর একটি নতুন দল বা গোষ্ঠী তৈরি হয়ে উঠবে, সেরকম কোন ভাবনা প্রক্রিয়াটিকে প্রাণিত করছে না। বরং বুঝতে চাওয়া হচ্ছে, কিভাবে প্রক্রিয়ায় সংলগ্ন বিভিন্ন আপাত-বিচ্ছিন্ন টুকরো/খন্ড ভাবনা আরো সামাজিক ও যুথবদ্ধ হয়ে উঠতে পারে; কিভাবেই বা এই যূথবদ্ধতার আভাস প্রক্রিয়াবদ্ধ দল/গোষ্ঠী/আন্দোলন/ব্যক্তির প্রতিদিনের প্রয়োগ-অনুশীলনে দেখা দিতে পারে। সংলাপ-প্রক্রিয়াটিকে আপাতত ডাকা হচ্ছে ‘উদ্যোগ’ বলে। এই লেখায় যে রাজনৈতিক খসড়া থেকে উদ্ধৃতি আছে, তা ‘উদ্যোগে’র রাজনৈতিক খসড়া। অবশ্য এমন নয় যে এই ইস্তেহারে বিবৃত যাবতীয় ভাবনার সঙ্গে ‘উদ্যোগ’ প্রক্রিয়ায় যুক্ত সবাই সহমত, বা ইস্তেহারটি সহমতের ভিত্তিতে লেখা। মূল রাজনৈতিক ভাবনার বেশিটাই যৌথ প্রক্রিয়া থেকে উদ্ভূত, এটা বলা প্রয়োজন।
এই লেখা নির্মাণে ব্যবহৃত বিশদ তথ্যসুত্রের জন্য আগ্রহীরা যোগাযোগ করুন soumitrag@gmail.com ইমেল আইডিতে।

1 thought on “আজকের পশ্চিমবঙ্গ ও আমরা কি করবো?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.