এই সময়ে, কবি ও কবিতার উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নেমে আসার সময়ে, দেশ ও দেশবাসীর উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নেমে আসার সময়ে দাঁড়িয়ে কিছু কবিতা, কিছু প্রতিবাদের স্বর। প্রথম কিস্তি – রবিন এস ঙঙ্গোমের কবিতা। ভাষান্তর – শুক্লা সিংহ।

জন্মস্থা্ন

প্রথমে শুনতে পেলাম দুঃস্বপ্নে মারা যাওয়ার মতো একটি আর্তনাদ,
তারপর রেডিওতে একটি প্রতিবেদন, সেই সঙ্গে একটি সংবাদ –
ছয়জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, পঁচিশটি বাড়ি ভাঙচুর,
ষোলজনকে হাত বাঁধা অবস্থায় একটি গির্জার ভেতরে শিরচ্ছেদ…
দিনগুলো খানখান, ছিন্নভিন্ন হতে লাগল, আর বিজয়ীদের উল্লাস
এবং শিকারের সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে চলছিল,
এদিকে নিজের পুরু চামড়ার ভিতরে আমিও পাথর হতে থাকি
তারপর একদিন আমি আমার জরাগ্রস্ত মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলি।

দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা কুঁড়েঘরের ভেতরে আবদ্ধ সেসব পরিত্যক্ত শিশুরা
কী তখনও তাদের বাবা-মায়ের ফিরে আসার অপেক্ষায় ছিল? আমি এইসব চিন্তা করা ছেড়ে দিয়েছি।
মৃত্যুর আগের মুহূর্তে কি সেই শিশুরা শীতকালে ঘরের ভিতর উনুনের চারিদিক ঘিরে বসে শোনা ঠাকুমার গল্পগুলো মনে করার চেষ্টা করছিল? তারা কি কোনোদিন অক্ষরের জাদু কারসাজি শিখতে চেয়েছিল? আমি এটাও জানতে চাইনি।
গর্ভের সন্তানদের ভারে ন্যুব্জ সেই সব তন্বী মহিলার দল,
(ঠিক যেন ফসল কাটার গান শুনে নুয়ে পড়া পাকা ধানগাছ)
তারা কি মাথায় জংলি ফুলের মালা গেঁথে নিজ নিজ স্বামীদের অপেক্ষায় ছিল? আমি আর এইসব নিয়ে ভাবিনি।

আমার সত্যিটাকে আমি তাদের সাথে ওই আগুনে পুড়তে দিলাম,
নিজের অসুস্থ পৌরুষকেও তাদের সাথেই মাটিতে পুঁতে ফেললাম।
বহুদিন পরে হয়তো কোনো এক সময় আমি বিড়বিড় করে বলেছি,
“সহ্যের একটা সীমা আছে।“ কিন্তু যেদিন সেই কসাইদের মুক্তি দিয়ে দেওয়া হল,
আমিও নির্বিকার হয়ে বেঁচে রইলাম,

যেন কিছুই হয়নি।

কু –পাড়া

কোনো দোষ না থাকা সত্ত্বেও কীভাবে যেন একটি জায়গা কুখ্যাত হয়ে যায়। আড়ম্বরহীন কোনো সকালে আপনি যদি সেখানে যান, দেখতে পাবেন মাথার ওপর নীল রঙের একটি আকাশ ছড়িয়ে আছে, এবং গাঢ় সবুজ পাইন ও বাঁশঝাড় নীচু হয়ে ধুলোমাখা রাস্তায় চুমু খাচ্ছে। এটা সত্যি যে শীতকালে এই পাড়ার ঠান্ডা ঘরগুলো ভালোবাসায় মত্ত ছিল এবং সেইসব মৃতদের একটি শান্ত কবরে সমাধিস্থ করা হয়েছিল, তবুও আপনি হয়তো বুঝে উঠতে পারবেন না বেপাড়ার লোকেরা কেন এই জায়গাটিকে এত ঘৃণা করে।

হয়তো কোনো এক রাতে গোপন তথ্য পেয়ে, উত্তেজিত আধাসামরিক সৈনিকের একটি দল এই পাড়ার যে কোনো একটি অভাগা বাড়ির দরজায় বেশ কিছু তরুণ সংগ্রামীকে বন্দুকের গুলীতে ঝাঁঝরা করে দেয়। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, সেইসব সংগ্রামীরা কেউই এই পাড়ায় থাকত না। শুধু সেইদিন কী এক ভুল সময়ে তারা এখানে বেড়াতে আসে। অথবা এটাও হতে পারে যে এই নাস্তিক যুগে ডাইনি ও জাদুকরের খোঁজে মরিয়া কিছু নারী-পুরুষ মধ্যযুগীয় কায়দায় জ্যোৎস্না রাতে হানাবাড়ির মতো দেখতে একটি বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং ওই আগুনে এক অচেনা বৃদ্ধ ও তাঁর স্ত্রী পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

লোকে বলে এটা নাকি একটা গোপন ডেরা। তারা আরও বলে যে ওই বাড়ির দেয়ালের গায়ে ক্ষতচিহ্নগুলো আসলে গুলির দাগ। সে যাই হোক, আপনি কিন্তু ভুলেও এপাড়ার কোনো মেয়েছেলেকে নিয়ে ঘোরাঘুরি করবেন না, কারণ সন্ধ্যের পর জায়গাটা ঠিক সুবিধের নয়।

তবে এ ধরনের জায়গাগুলো এসব আশঙ্কার মধ্যেই ফুলেফেঁপে উঠে ।

আমার আবিষ্কৃত জন্মস্থান

আমার জন্মস্থানের মৃত্তিকা ঠাকুমার সেই রকমারি খাবার রান্না করা
মাটির জাদু-হাঁড়ির গায়ে লেপ্টে থাকা অগ্নিকণা থেকে নির্গত।
তবে আজীবন চেষ্টা করেও
সেসব সুস্বাদু খাবার চেখে দেখার সৌভাগ্য
আমার হয়নি।

আমার জন্মভূমির কোনো নির্দিষ্ট সীমানা নেই,
কোনো এক ভোরের প্রথম আলোকে পশ্চিমদিকে অবস্থিত একটি দেশের
ভেতরে সে নিজেকে খুঁজে পায়
(বর্ষাকালে বিদ্রোহীরা যখন তাকে উদ্ধার করার যুদ্ধে নেমে পড়ে, সে তখন পূর্বদিকে তাকিয়ে স্বপ্ন দেখতে থাকে) ।

আমার ভাইয়েরা তাদের ভুলে যাওয়া মৃত অক্ষর সব মাটি খুঁড়ে বের করেছে।
জরাজীর্ণ গ্রন্থাগারগুলো
তাদের জাতীয়তাবাদের আগুনে পুড়েছে,
এমনকি তারা স্থানীয় মহিলাদের
চিরাচরিত বিনুনিটি পর্যন্ত কেটে দিয়েছে।

তবে আমার জন্মস্থানটিকে এখনও কোনো বিশেষ নাম দেওয়া হয়নি।
আমার জন্মস্থান যেন এক অসম্পূর্ণ ভ্রমণকাহিনী
এক অতি লোভী ভোজনবিলাসীর সামনে রাখা
কাঁকর মেশানো ভাতের থালা

আমার জন্মস্থানে ছোটোদের স্বপ্নগুলো জোনাকির মতো
দপদপ জ্বলতে থাকে
এখানে বৃদ্ধদের চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেলে
অস্ত্রোপচার করে তাদের নতুন চোখের ব্যবস্থা করা হয়
তাছাড়া, ভাঁড়ে পরিণত হওয়া মজাদার কিছু নেতাও এখানে রয়েছে।

আমার জন্মস্থান কপালের দুই পাশে
ঠেকানো বন্দুকের নল
রাত যার কোনো শেষ নেই
প্রদীপ যার নীচে অন্ধকার
মৃতদেহের সংখ্যা গুনতে থাকা একটি কবিতা।
আসলে আমার জন্মস্থান
ধর্ষিত, পরিত্যক্ত এক নিয়তি।

রবিন এস ঙঙ্গোম (Robin S Ngangom) উত্তর-পূর্ব ভারতের এক বিশিষ্ট কবি। জন্ম মণিপুরের সিংজেমাই জেলায়, যদিও বিগত চার দশক ধরে মেঘালয়ে বসবাস করছেন। বর্তমানে নর্থ-ইস্টার্ন হিল ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক। তিনি মূলত ইংরেজি ভাষায় কবিতা লেখেন, এবং মৈতেই ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। ত্রিপুরার মনিপুরী কবি গম্ভিনি দেবী, মণিপুরের বিশিষ্ট কবি থাংজাম ইবোপিশক, শরতচন্দ্র থিয়াম, ওয়াই ইবোমচা সহ আরও অনেকের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ করেছেন। পাশাপাশি উত্তর-পূর্ব ভারতের দুটি বিশেষ কাব্য-সংকলন অ্যান্থলজি অফ নর্থ ইস্ট পোয়েট্রি (২০০৩) ও ড্যান্সিং আর্থ (২০০৯) এর সহ-সম্পাদক হিসেবেও কাজ করেছেন। তাঁর তিনটে কাব্যগ্রন্থ ওয়ার্ডস এন্ড দ্যা সাইলেন্স (১৯৮৮), টাইমস ক্রসরোডস (১৯৯২) এবং দ্যা ডিজায়ার অফ রুটস (২০০৬) পাঠকমহলে বিশেষভাবে সমাদৃত। তিনি ‘কথা পুরস্কার’ ও ‘উদয়ভারতী’ সম্মানে ভূষিত।

রবিন ঙঙ্গোমকে অনেকেই ‘রাজনৈতিক কবি’-র তকমা দিয়ে থাকেন। বলা হয় তাঁর কবিতা নাকি ‘রিডল্ড উইথ বুলেটস’। তবে বিশিষ্ট কবি আদিল জুসাওয়ালার ভাষায়ঃ “ভারতীয় কবিদের মধ্যে রবিন ঙঙ্গোম অন্যতম যিনি প্রেম এবং রাজনীতি এই দুই বিষয়, এবং তাদের সহাবস্থান সম্পর্কে অনায়াসে লিখতে পারেন।“

কবির নিজের ভাষায় – “আমি কোনো বিশেষ পরিকল্পনা নিয়ে কবিতা লিখতে বসি না। আমার কোনও পূর্ব নির্ধারিত এজেন্ডা নেই যে আমি প্রেম, রাজনীতি কিংবা পরিবেশ নিয়ে লিখব। আমি তাতে বিশ্বাসী নই। তবে কবিতা লিখতে গিয়ে বার বার নেরুদার কাছে শিখেছি – কীভাবে প্রেম, ইতিহাস ও রাজনীতি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।“

শুক্লা সিংহ সম্প্রতি ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে পিএচডি লাভ করেছেন। লেখালেখি করেন ইংরেজি এবং বাংলায়। Muse India, Yendai, The Sunflower Collective, Cafe Dissensus, ত্রিস্টুপ – এ তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে।

আরো পড়ুন: প্রতিবাদের স্বর । জি এন সাইবাবার কবিতা । ভাষান্তর – সিদ্ধার্থ বসু

3 thoughts on “প্রতিবাদের স্বর । রবিন এস ঙঙ্গোম-এর কবিতা । ভাষান্তর – শুক্লা সিংহ

  1. Pingback: aainanagar

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.