স্বাতী মিত্র

জন্ম-শিক্ষাদীক্ষা-বড় হওয়া সবই কলকাতায়। কলকাতা ইউনিভার্সিটি থেকে ফিজিওলজিতে মাস্টার্স,জীবনের তরীখানা বাইতে বাইতে ক্যানাডাতে, রকি মাউন্টেইনের কোলের কাছে ছবির থেকেও সুন্দর একটা শহর, নাম ক্যালগেরি, আপাতত সেখানেই নিবাস। আর পাঁচজন নর্থ আমেরিকায় থাকা প্রবাসী বাঙালীর মতই সদাব্যস্ত জীবন, বর্তমান পেশা টেকনিক্যাল রাইটার।
জীবনের প্রথম এবং একমাত্র প্রেম কবিতা। ফাঁক পেলেই আজও সাদা কাগজের সাথে নিত্য সহবাস। এই লেখালেখি স্বাতীর প্রাত্যহিকতার বসতে এক ফালি দক্ষিণের বারান্দা। পছন্দের কবি সিলভিয়া প্লাথ লিখেছিলেন….”I write only because there is a voice within me that will not be still”…. এই কথাগুলো স্বাতীর জন্যও সত্যি। কয়েকটাম্যাগাজিন (দুকূল, ঝোড়ো হাওয়া ইত্যাদি) আর অনলাইন ওয়েবজিনে (সোনাঝুরি, আদরের নৌকা, বাক, Writer’s Digest Poetic Aside, Rattle’s Poets Respond etc) প্রকাশিত হয়েছে কিছু লেখা। এছাড়া বই পড়া, অন্তহীন গান শোনাআর অনলাইন বাংলা ফোরামে আড্ডা মারার তুমুল নেশা। যে ফোরামে আড্ডা মারেন নিয়মিত, তার প্রথম শারদীয়া পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন এবার পুজোর জন্য। পত্রিকার নাম শিউলিপর্ব

.


কু-উ-উ-উ- উ-উ…..
ঝিকিঝিকি ঝিকিঝিকি ঝিকঝিক ঝিকিঝিকি …….
ছন্দটা কেমন যেন চেতনার মধ্যে মিশে গিয়েছিল ঠাণ্ডা কামরার একলা যাত্রায়। চলছে তো চলছেই – বহুদূর চলে এল সে এইভাবে। অভ্যেসবশে ডান হাতের কবজি উল্টে সময় দেখতে চেষ্টা করে সে, কিন্তু ঘড়িটা পরতে ভুলে গেছে সে আজ তাড়াহুড়োয়। কটা বাজে? কত বাকি আর এ পথের? কতদূর আর কতদূর? গন্তব্যের জন্য মনটা আজ বড় উতলা তার। কাছে দূরে সহযাত্রীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে, কত রকম স্বরক্ষেপ, কত রকম শব্দ, কিছু একটা ভাষা তো বটেই, কিন্তু কোনটাই ঠিক “কথা” হয়ে উঠতে পারে নি আর শেষ পর্যন্ত। তবে এই জানালায় সে একা, হ্যাঁ একাই তো এল সে এই দীর্ঘ পথ, স্রেফ নিজের সঙ্গে একা একা। ঝমাঝম, ঝমাঝম, ঝমঝম, ঝমাঝম …… মাঝে মাঝে এক একটা আলো আলো স্টেশন চলে যাচ্ছে ঝলক দিয়ে, তারপর আবার সেই মাঠভাঙা ছন্দ…. ধিকিধিকি ধিকিধিকি ধুকপুক ধিকিধিকি। হয়ত কখনো বা ব্রিজ পার হচ্ছে গু-উ-ম, গুম, গু-উ-ম, গুম ……
চোখটা লেগে গেছিল নাকি? হঠাৎ ঘোর কাটল। ট্রেনটা দাঁড়িয়ে আছে। কোন স্টেশন এটা? হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙে সে, নড়েচড়ে আঁচল গুছিয়ে জানালার কাঁচে মুখটা চেপে বাইরে দেখতে চেষ্টা করে। কিছুক্ষণ এইভাবে কাটল। হঠাৎ কি মনে হল, কোলের বইটা মুড়ে রেখে সে উঠে দাঁড়াল। খুব ছুঁতে ইচ্ছে করছে তার বাইরের রাতটাকে আজ, কাছ থেকে দেখতে ইচ্ছে করছে কাঁচের ওপারের প্ল্যাটফর্মটা। সহযাত্রীদের বেশির ভাগই ঘুমে অচেতন। গুটি গুটি পায়ে দরজার দিকে এগোয় সে। এইখানে স্রেফ গল্পটা বলার সুবিধার জন্যই তাকে একটা নাম দেওয়া যাক। ধরা যাক তার নাম তিস্তা।

প্ল্যাটফর্মের লাগোয়া খোলা দরজা দিয়ে স্টেশনের উগ্র গন্ধ, চা-ওয়ালার ডাকাডাকি, নিয়ন আলোর সঙ্গে মেশামেশি রাতের কালো-ও একটু আধটু চুইয়ে আসছে। টোপলাটুপলি, ব্যাগ-বাক্স সামলাতে সামলাতে কেউ উঠছে, কেউ বা নামছে। প্ল্যাটফর্মের উল্টোদিকের দরজাটা টেনে খুলতে চেষ্টা করে তিস্তা। এদিকটাতে ওঠানামা নেই, তাই ভিড়ও নেই, কারো পথ আগলে দাঁড়ানোর প্রশ্ন আসবে না। এই দিকের দরজাটাই ভাল, নির্ঝঞ্ঝাট। দরজা খুলতেই নিঃশ্বাসের মত উষ্ণ বাতাস এসে লাগল গালে কপালে। বাইরে বেশ গরম, ভেতর থেকে বোঝা যায় না। দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে একটু ঝুঁকে দাঁড়ায় তিস্তা। চকচক করছে পাশাপাশি দুটো ইস্পাতের লাইন ফিনফিনে চাঁদের আলোয়। তার ওপারের হলুদ হ্যালোজেনমাখা রাতের প্ল্যাটফর্মে শুয়ে-বসে প্রতীক্ষারত লোকজন।
খুব ভাল লাগছিল তিস্তার দরজায় চুপটি করে দাঁড়িয়ে কাঁচের আড়াল ছাড়া কয়েক গজ দূরের প্ল্যাটফর্মের দিকে চেয়ে থাকতে। মাঝে মাঝে মুখ তুলে দেখছিল সে অনেক দূরের আকাশে আধখানা চাঁদটা  কি যেন বলার চেষ্টা করছে প্রাণপণে, কিন্তু উপযুক্ত ভাষার অভাবে কিছুতেই আর বলে উঠতে পারছে না। হঠাৎ প্রায় নিঃশব্দেই আর একটা ট্রেন মসৃণ গতিতে এসে গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে পড়ে ওপারের প্ল্যাটফর্মে, পাশের লাইন দুটো ঢেকে যায়। এখন মুখোমুখি আর একটা আধাখোলা দরজা, আর থমকে থাকা আর একটা রাতের ট্রেনে প্ল্যাটফর্মের উল্টোদিকের দরজায় দাঁড়ানো হয়ত তারই মত আর একজন, মধ্যিখানে চাঁদের আলোয় ফিকে কয়েক হাতের অন্ধকার ব্যবধান। ফস করে একটু আগুন, সুখটানের ধোঁয়ার ফাঁক দিয়ে সাদা পাঞ্জাবি আগন্তুকের নজর পড়ে তিস্তার ওপর।
দরজায় হেলান দিয়ে ঘাড় হেলিয়ে দেখছিল তিস্তা। উল্টোদিকের চশমায় চোখ পড়তেই সোজা হয়ে দাঁড়াল। যাই কি না যাই ভাবতে ভাবতেই উল্টোদিক থেকে একটা মৃদু সম্বোধন ভেসে এল। সাড়া দেবে না ভেবেও দাঁড়িয়েই রইল সে। খুব জানতে ইচ্ছে করছে তিস্তার, কোথায় যাবে ঐ ট্রেনটা? কিন্তু সঙ্কোচ হচ্ছে যে, তাই তার বদলে শুধাল-
….. কটা বাজে জানেন?
….. বারোটার আশেপাশে কিছু হবে। আমি ঘড়ি পরি না। মোবাইল সীটে ফেলে এসেছি।
ভেতরে চলে গেলে হত, সীটে ফিরে যাওয়া উচিত, ভীষণ উচিত, কিন্তু যেতে ইচ্ছে করছে না তিস্তার। অস্বস্তি এড়াতে সে তাই জিজ্ঞাসা করে-
…… আধখানা চাঁদের এত আলো, এটা বোধ হয় শুক্লপক্ষ, তাই না?
…… হবে হয়ত, জানি না।
কয়েক মিনিটের বিরতি, তারপর–
….. আপনি ঘুমোবেন না? এত রাতে একা এভাবে ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন, একাই ট্র্যাভেল করছেন বুঝি?
….. নাহ, ঘুম আসছে না, আর হ্যাঁ একাই তো। আপনি?
…… হুমমমম।
তিস্তা বুঝল না উত্তরটা ইতিবাচক না নেতিবাচক। আর কিছু ভাবার আগেই আবার প্রশ্ন উল্টোদিক থেকে-
….. কোথা থেকে আসছেন আপনি?
মুচকি হেসে জবাব দেয় সে-
….. এই ট্রেনটা যেখান থেকে আসছে। আপনি?
উত্তর এল-
…… হুমমমম।
…… আপনার অভিধানে বুঝি ঐ একটাই উত্তর লেখা আছে সব প্রশ্নের জন্য?
…… হুমমমম।
বলেই হেসে ফেলে এবার আগন্তুক, তিস্তাও হাসে। হাসতে হাসতেই বলে-
….. জানেন, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে ট্রেনটা এই স্টেশনে। এতক্ষণ দাঁড়ানোর কথা নাকি এখানে?
…… জানি না, নিশ্চয়ই সিগন্যাল পাচ্ছে না কোন কারণে। আপনার বুঝি খুব পৌঁছানোর তাড়া?
এবার তার পালা-
….. হুমমমম।
ট্রেনের করিডোর থেকে আসা সামান্য আলোর রেশ তিস্তার মাথার পেছনে, মুখের একপাশে চাঁদের আলো, অন্যপাশে ছায়া।
সিগারেটে শেষ টান, আগুনের টুকরোটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আগন্তুক এবার বাইরে মাথা ঝুঁকিয়ে এপাশ ওপাশ জরিপ করে, তারপর দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ায় একদম তিস্তার সোজাসুজি-
….. ট্রেনটা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে বলেই তো আলাপ হল।
আগন্তুকের মুখ ছায়া ছায়া অন্ধকারে, পিছনে ট্রেনের ভিতর থেকে ছিটকে আসা হাল্কা আলো। চশমার কাঁচে দু’এক কুচি আলোর ফুলকি দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক তিস্তা জবাব দেয়-
….. আলাপই বটে। কিন্তু বড্ড লেট হয়ে গেল যে।
অদ্ভুত এই ঝোঝুল্যমান আলাপচারিতার সাক্ষী হয়ে থাকা আলো-আঁধারি অসম্ভব মুহূর্তগুলো ভেসে যেতে থাকে দুর্বার গতিতে, ভাসিয়ে নিতে থাকে কথার পিঠে কথায়, যার কোনটাই স্ক্রিপ্টে ছিল না বা থাকার কথাও নয়।
দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আগন্তুক সিগারেটের খালি প্যাকেটটাকে ভাঁজে ভাঁজে মুড়তে থাকে। তিস্তা অবাক হয়ে চেয়ে থাকে, তারপর অজান্তেই প্রশ্ন করে বসে-
…… ওটা কি করছেন?
…… নৌকো, একটা নৌকো বানাচ্ছি।
…… বাহ, দারুণ তো।
আগন্তুক জবাব দেয় না, এক মনে নৌকো বানায়, তিস্তাও চুপচাপ চেয়েই থাকে, যতটুকু দেখা যায় এই আধো আলোছায়াতে। বানানো হয়ে গেল, ছোট্ট নৌকোটা উঁচু করে তাকে দেখায় এবার আগন্তুক, ঠোঁটের কোণে একটু হাসির আভাস।
কেন যে তিস্তা হঠাৎ অপ্রস্তুত বোধ করে! কিছু তো বলতে হয়, কিন্তু যুতসই শব্দগুলো মনে পড়ে না কিছুতেই। তাই সে আবার বলে-
…… বাহ, দারুণ তো।
আগন্তুক আবার ঝুঁকে দেখে সামনের দিকে –
…… সিগন্যাল হয়ে গেছে মনে হচ্ছে।
কি ভেবেছিল তিস্তা? সারা রাত এইভাবে এখানেই কেটে যাবে? কথা হারিয়ে ফেলে তোতলাতে থাকে সে-
….. হয়ে গেছে?
তারপরই বোকার মত বলে বসে-
…… ইসস, আপনি যদি এই ট্রেনে থাকতেন, খুব ভাল হত, বেশ গল্প করতে করতে যাওয়া যেত। বড্ড ভাষাবিভ্রাটে পড়ে গেছি, জানেন?
আগন্তুক এবার শব্দ করে হাসে-
….. এক কাজ করুন, আপনি বরং এই ট্রেনে চলে আসুন, ঐ তো কটা সিঁড়ি, নেমে চলে আসতে পারবেন না? বেশ গল্প শুনতে শুনতে যাওয়া যাবে বরং।
ঠাট্টাটুকু বুঝতে পেরে মনে মনে ক্ষুব্ধ হলেও গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে তিস্তাও ঠাট্টাচ্ছলেই বলে –
…. নাহ, ঐ ট্রেনের টিকিট তো আর কাটি নি আমি। আর মধ্যিখানে ইচ্ছে হলেই অমনি ট্রেন বদলানো যায় নাকি!
….. যান ঘুমিয়ে পড়ুন গিয়ে, ডরপুক, ভীতু কোথাকার!
কয়েক সেকেণ্ড চুপচাপ। তারপর থমকে যাওয়া রাতটাকে চমকে দিয়ে আগন্তুক আবার বলে-
….. রাত অনেক হল, যান এবার ঘুমিয়ে পড়ুন গিয়ে, আমিও যাই। আপনার ট্রেনও এবার ছাড়বে বলে মনে হচ্ছে। আর এই নিন ধরুন, এটা আপনাকে দিলাম।
দুটো সিঁড়ি নেমে অনেকটা ঝুঁকে একটা হাতে নৌকোটা বাড়িয়ে ধরে আগন্তুক। তিস্তাও নামে দুই সিঁড়ি, এক হাতে হাতল ধরে বিপজ্জনক ভাবে ঝুলে পড়ে আর একটা হাত বাড়ায়। ও ট্রেন থেকে এ ট্রেনে চালান হয় কাগজের নাও, আর ঠিক তখনই ওপাশের ট্রেনটা নড়ে ওঠে, একটু একটু করে এগোতে শুরু করে। হাত নাড়ে আগন্তুক, নৌকোটা মুঠোতে শক্ত করে ধরে তিস্তাও হাত নাড়ে। তার ট্রেনটাও দুলে ওঠে একটু পরে, চলতে শুরু করে। ওদিকে পাশের ট্রেনটা স্লো হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুটো ট্রেন আবার পাশাপাশি, দুই দরজা মুখোমুখি। প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে, স্টেশনের সীমানা পেরিয়ে সমান্তরাল দৌড়োয় দুটো ট্রেন কয়েকশ’ গজ। তারপর পাশের ট্রেনটা লাইন পাল্টায় ধিয়াতাং ধিয়াতাং করে, বেঁকে চলে যেতে থাকে অন্য কোন দূরের পথে। তিস্তা দাঁড়িয়ে থাকে দরজায় সেই চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে, হাতের মুঠোয় কাগজের নৌকোটা গলার কাছে ধরা। হলই বা কাগজের, হলই বা মিছিমিছি, তবু তো নৌকো। হঠাৎ মনে পড়ল তিস্তার, যাঃ, কোথায় যে যাচ্ছে ঐ ট্রেনটা, সেটাই তো জানা হল না।
রাতের বুক চিরে দুটো বাঁধা লাইনে তিস্তার ট্রেনটা আবার ছন্দে ফিরতে চেষ্টা করে পূর্ণ গতিতে যাত্রা শেষের পথে।
কু-উ-উ-উ- উ-উ-উ-উ-উ-উ……নতুন বোল বাজতে থাকে ট্রেনের চাকায় চাকায়—
মিছিমিছি মিছিমিছি মিছিমিছি মিছিমিছি……

*

চিত্রণ: বিবেকরঞ্জন পাইক

1 thought on “আদরের নাও

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.