শুভদীপ্ত বিশ্বাস

পিঙ্কি শুধু একটা ড্রেসিং টেবিল চেয়েছিল। খাট না, আলমারি না, আলনা না, এমনকি বিয়ের বেনারসি নিয়েও সে ভাবেনি – সে শুধু চেয়েছিল – একটা ড্রেসিং টেবিল। বিল্টু যেদিন প্রথমবার কথাটা শুনেছিলো, হেসে উঠেছিল। ঘিঞ্জি শহরের মোড়ে মোড়ে ওঁত পেতে থাকা সিসিটিভি আর অসুখী মানবকুলের শ্যেন নীতিদৃষ্টি এড়িয়ে, ব্যস্ততার নিষ্ঠুর বিজ্ঞাপনে মুহুর্মুহু বেজে ওঠা হর্নের তাণ্ডব থেকে দূরে, একটু নিভৃতে কয়েকটা মুহুর্ত একসাথে কাটাবে বলে, ওরা যখন পার্কে এসে বসেছিল, সূর্য ডুবে গেছে একটু আগে কিন্তু সন্ধ্যে তখনও নামেনি । বিল্টু দ্যাখে, গাছের আড়ালে বসা যুগল মূর্তিগুলো আবছায়ায় একে ওপরের শরীরে মিশে গিয়ে পাহাড়ের আকার নিচ্ছে। যারা আড়াল পায়নি, জলের মুখোমুখি বেঞ্চে বসে, তারাও সামান্য অছিলায়, ছুঁয়ে নিচ্ছে একে অপরকে। একই বেঞ্চে দুই জোড়া, কখনো তিনজোড়া বসে, কেউ কাউকে দেখছে না বা হয়ত দেখছে, কিন্তু তাতে কোন অসুবিধে হচ্ছে না। বিল্টু শুনেছিল, এখানে এসব হয়, কিন্তু চাক্ষুষ দেখবে ভাবেনি। সে আড়চোখে ওদের দ্যাখে, অকারণ ঢোঁক গেলে, জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নেয় শুষ্ক ঠোঁট নিজের, হরমোনের স্বাভাবিক ক্রিয়ায় জেগে ওঠা শরীরকে বশে আনতে, একরকম জোর করেই, মুখ ঘুরিয়ে পাশে বসা পিঙ্কির দিকে তাকায়। আকাশের কমলা আভা সেদিনের মত  নিভে যাওয়ার আগে, কয়েক মুহুর্তের জন্য পড়েছে পিঙ্কির গালে তখন। চেনা কালো মুখটা কেমন যেন অন্যরকম লাগে বিল্টুর চোখে। তারও হয়ত ইচ্ছা হয়, একবার… কিন্তু সাহসে কুলোয় না। ভাগ্যিস, পিঙ্কি তখন তার দিকে দেখছিল না। নয়ত, ধরা পড়ে যেত বিল্টু। পিঙ্কি একদৃষ্টে তাকিয়েছিল সামনের জলের দিকে। সেখানে তখন গোধূলি আকাশ আর গাছের ছায়া, জলের হালকা ঢেউয়ে দুলে এক অদ্ভুত দৃশ্য তৈরি করেছে। ‘তোমার কাঁচ ভালো লাগে?’- অনেকক্ষণ কথা না বলার কারণে, নাকি পরিবেশের গুণে পিঙ্কির গলার স্বরটা এত কম শোনায় কানে, বিল্টু কথাটা ধরতেই পারে না প্রথমে। হাঁটুতে মুখ রেখে পিঙ্কি যেদিকে তাকিয়েছিল, সেই জলের দিকে তাকিয়েই, ‘কি?’, বলে ওঠে বিল্টু, ভাবে, জলে বুঝি কিছু দেখবার কথা বলছে সে। ‘কাঁচ। আয়না’- শব্দদুটো আলাদা আলাদা করে উচ্চারণ করে পিঙ্কি।  বিল্টুর তাও সন্দেহ হয়, সে বুঝি ভুল শুনছে। ‘আয়না?’, হঠাৎ আয়নার কথা সে বলবে কেন!  পিঙ্কি জলের থেকে চোখ সরিয়ে তাকায় ছেলেটার রোদে পোড়া শুকনো মুখখানার দিকে। ওর কনুইয়ের ভাঁজে আলতো করে নিজের হাতটা গুঁজে দেয়, মাথাটা এলিয়ে দেয় কাঁধে। ‘বিয়েতে আমার আর কিছু চাই না – শুধু একটা ড্রেসিং টেবিল চাই। বড়ো আয়নাওয়ালা – একটা ড্রেসিং টেবিল’ – পিঙ্কির সোজাসাপ্টা আব্দারে বিল্টু হেসে ফ্যালে। হাসতে হাসতেই বলে – ‘আয়নায় কি দেখবে? নিজেকে কেমন দেখতে?’। পিঙ্কি উত্তর দেয়না সহসা। হাতটা সরিয়ে নিয়ে, আবার মুখ ফেরায় জলের দিকে। তারপর হাঁটুতে মুখ গুঁজে প্রায় বিড়বিড় করে বলে – ‘আয়নায় বুঝি শুধু নিজেকেই দেখা যায়?’ ‘তাহলে?’ – বিল্টুর অজ্ঞতায় ভান নেই কোনো। কিন্তু পিঙ্কি আর কোন উত্তর দেয় না। আকাশের নিজস্ব আলো মুছে যেতে দীঘির জল ধীরে ধীরে কালো হয়ে আসে। মুহুর্ত পর বিল্টু আবার জিগ্যেস করে – ‘কি হল? রাগ করলে?’ পিঙ্কি নিরুত্তর। আড়চোখে বিল্টুর উদ্বিগ্ন মুখের দিকে দ্যাখে একটুক্ষণ। ঠোঁট টিপে হাসে। সে হাসির অর্থ কি বিল্টু জানেনা। বিল্টুর খিদে পেয়েছিল। ওরা উঠে পড়ে।

তিন নম্বর গেটের দিকে আসতে বাঁদিকে একটা বড় ছাতিমগাছ। গাছটার পাশেই একটা বড় আলো। কিন্তু আলোটা সেদিন জ্বলছিল না। হাঁটতে হাঁটতে বিল্টু জিগ্যেস করে – ‘কি খাবে?’ ‘তুমি যা খাবে তাই’- পিঙ্কি বলে। ‘সিঙ্গাড়া  খাবে? আসার সময় দেখলাম উল্টোদিকের দোকানটায় ভাজছে, গরম গরম’ – কথা শেষ হওয়ার আগেই বিল্টুর হাতে টান পড়ে। অন্ধকার তো ছিলই, বিল্টু ভাবে, পিঙ্কির বোধহয় পায়ে কিছু লেগেছে। ‘কি হল?’ – জিজ্ঞেস করে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। কয়েক মুহুর্ত সময় নেয় পিঙ্কি, তারপর ফিসফিস করে বলে – ‘গন্ধ পাচ্ছ?’। বিল্টু নাক টানে, একবার – দুবার – তারপর বড় করে আরেকবার – ছাতিম ফুলের তীব্র ঘ্রাণে ভরে যায় ফুসফুস। কিছু একটা বলতে গিয়েও কি মনে করে চুপ করে যায় সে। নীরবতার নিজস্ব শব্দ আছে। কয়েক মুহূর্ত কান পাতলে পাশে দাঁড়ানো পিঙ্কির শ্বাসের শব্দ শোনা যায়। ঘটিগরমওয়ালার টুং টাং শব্দ দূর থেকে আরও দূরে চলে যায়। আচমকাই একটা হাওয়া ওঠে। সেই হাওয়ায় পিঙ্কির শ্যাম্পু করা চুল এলোমেলো হয়ে যায়, বিল্টুর ঘাড়ের কাছটা শিরশির করে ওঠে। এত মিষ্টি ফুলের গন্ধটা অথচ খানিকক্ষণ শুঁকলেই কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। হাতের তালুতে আলতো চাপ টের পায় বিল্টু। অন্ধকার সয়ে যাওয়ায় পিঙ্কির মুখটা এতক্ষণে আবছা বোঝা যায়। কালো মুখে আরও কালো চোখদুটো কেমন যেন চকচক করে। বিল্টু বোঝে না পিঙ্কির মুখটা খুব ধীরে এগিয়ে আসে ওর দিকে, নাকি সে নিজেই… কয়েক মুহূর্ত মাত্র আয়ু সেই চুমুর, কিন্তু তার রেশ রয়ে যায় অনেকক্ষণ।

সন্ধ্যের মৌতাতে মজে ওঠা গরবিনী শহরের বুকে, দুটো অপাংক্তেয় তরুণ হৃদয়ের গোপন ভালোলাগার কথা, কেউ সেদিন জানেনি। রাস্তার ধারের তেলেভাজার দোকানের বেঞ্চে বসে, বিল্টু খুব আস্তে ডানহাতটা রাখে পিঙ্কির বাঁ হাতের উপর, পিঙ্কি মুখ তুলে চায় না। ‘চাটনি?’ – দোকানের বাচ্চা ছেলেটা, শালপাতার বাটিতে সিঙ্গাড়া তুলতে তুলতে, জিগ্যেস করে রুক্ষ গলায়। বিল্টু মাথা নাড়তেই ছেলেটার ক্ষিপ্র হাত চাটনি দিয়ে অর্ধেক ভিজিয়ে দেয় সিঙ্গাড়াগুলো। বিরক্তিতে কুঁচকে যাওয়া বিল্টুর মুখের দিকে তাকানোর ফুরসত পায়না ছেলেটি, পরের অর্ডার এসে পড়ে। আঙ্গুল দিয়ে চাটনিটা জিভে ছোঁয়াতেই, মুখের মেঘ অবশ্য কেটে যায় বিল্টুর। বোধহয় সেই উৎসাহেই সিঙ্গাড়াটা তুলে প্রায় অর্ধেকটা একবারে মুখের মধ্যে ভরে নেয় সে। পাশে পিঙ্কি আঙ্গুল দিয়ে একটা কোণা খুঁটে মুখে দেয়। ‘একটা জায়গায় যাবে আমার সাথে?’ – পিঙ্কির গলা শুনে মনে হবে, সে বুঝি এখনও পার্কের নির্জনেই আছে। গরম সিঙ্গাড়া জিভের এদিক থেকে ওদিক ব্যালেন্স করতে করতে বিল্টু বলে – ‘কোথায়?’। ‘আছে একটা জায়গা ’- পিঙ্কির ছোট উত্তর রহস্য ঘনীভূত করে। কিন্তু বিল্টু একসাথে এতকিছু নিয়ে ভাবতে পারেনা। একে প্রথম চুমু খাওয়ার আনন্দ, তার উপর গরম গরম সিঙ্গাড়া সঙ্গে চাটনি, সে একপ্রকার রহস্যে জল ঢেলে দেয়ার মত করেই, জোরে ঘাড় নেড়ে দেয় অর্থাৎ সে যাবে। এরপর আর কথা এগোয় না। বিল্টুর ভাগের সিঙ্গাড়া শেষ, পিঙ্কির প্রায় গোটাটাই বাকি। ‘সিঙ্গাড়াটা ভালো না?’ – বিল্টুর সহজ প্রশ্ন। ‘আরেকটা নাও’ – পিঙ্কির আরও সহজ উত্তর। ‘না, ভালো জিনিস কম খাওয়াই ভালো’ – বিল্টুর কিপ্টেমির কারণ পিঙ্কির জানা। কিন্তু পিঙ্কি যদি নিজের পয়সায় কিনতে যায়, বিল্টু তাতেও রাজী হবে না। অগত্যা চিরকাল মেয়েরা যা করে এসেছে পিঙ্কিও তাই করে। অর্ধেকটা খেয়ে বলে – ‘আর খেতে পারছি না, তুমি খেয়ে নাও’।

সিঙ্গাড়ার দাম মিটিয়ে ওরা যখন দোকান থেকে বেরোয়, ততক্ষণে সন্ধ্যে গড়িয়েছে রাতের দিকে। অথচ, শহরের এ পথে কোন ছায়া নেই। দু’পা ফেলতে না ফেলতেই খাঁড়া হয়ে আছে একটা করে ল্যাম্পপোস্ট। আর প্রতিটি ল্যাম্পপোষ্টে সাদা বাল্বের আলোর নীচে, স্থানীয় নেতার হাস্যমুখের ছবি সহ আলোকিতকরণের বিজ্ঞাপন। তার নীচে আবার মাটি থেকে পোস্টের গা বেয়ে সাপের মত উঠেছে ঝিকিমিকি এল ই ডি আলো। খানিক এগোলে ফ্লাইওভারের নীচে আঁধার মেলে একটু। কেরোসিনের স্টোভে কালো হাঁড়িতে ভাত ফোটে সেখানে, রুগ্ন বউ দুধ খাওয়ায় কোলের বাচ্চাটাকে, স্বামী আরেকটার কান্না ভোলায়। কাছেই কোন অফিস ছুটি হয়েছে হয়ত। পাশাপাশি হাঁটতে পারে না ওরা- অনবরত লোকে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। পরপর দুটো এসি বাস যাবার পর একটা ভিড়ে ঠাসা এসডি সিক্সটিন আসে। পিঙ্কি বলে – ‘পরেরটায় যাব’। বাসে উঠে গেলেই তো, আজকের মত সব শেষ। আবার কবে এরকম ভাবে দেখা হবে, দুজনের কেউই জানে না। ফোনে আর ক’মিনিটই বা কথা হয়! সারাদিন মনে মনে কত কি ভাবনা আসে, অথচ যখন বলার সময় আসে, সব কথা কোথায় গিয়ে যে লুকিয়ে পড়ে! চোখাচোখি হতে দুজনেই হাসে। বিল্টু ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চায়, কি ভাবছে সে, পিঙ্কি মাথা নাড়ে দুদিকে। এত লোকজনের মাঝে হাত ধরতে কেমন যেন লজ্জা করে তার। বিল্টু অকারণ পকেট থেকে মোবাইল বের করে সময় দ্যাখে। পরের বাসেও ভিড় একটুও কমে না। কারখানা মোড়ে নামার সময় পাছে কেউ দেখে ফ্যালে, তাই দুজন বাসের দুদিক দিয়ে ওঠে। 

অসিতের চা’এর দোকানে দাঁড়িয়ে, পিঙ্কিকে রাস্তা পেরিয়ে দূর থেকে আরও দূরে চলে যেতে দ্যাখে বিল্টু। হাঁটতে হাঁটতে ইলেকট্রনিক্সের দোকানটার সামনে একবার বুঝি দাঁড়ায় সে, পেছন ঘুরে তাকায়। হাসে কি? সিগন্যালে গাড়ীগুলো হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলে আর দেখা যায় না তাকে। অসিতকে চায়ের কথা বলে ভিড় এড়িয়ে এককোণে গিয়ে দাঁড়ায় বিল্টু। অজান্তেই আঙ্গুল বোলায় ঠোঁটের কোণে। যেন কোন চিহ্ন রয়ে গেছে সেখানে। হঠাৎই কুকুরটার পানে চোখ পড়ে। কেমন দুখু দুখু মুখে তাকিয়ে আছে সামনের কেক খাওয়া বুড়ো লোকটার দিকে। লোকটার কোন হুঁশ নেই। অনেকক্ষণ পরে খাচ্ছে বোধহয়। শুকনো কেক চিবোতে চিবোতে, জিভ জড়িয়ে যাচ্ছে, চোখ বুজে আসছে।  একটু থেমে, দম নিয়ে, ফের চিবোচ্ছে। এরপর অনেকটা জল খাবে পেট ভর্তি করে। তারপর প্লাস্টিকের কাপে ছোট্ট চা। বিল্টু দুটো বিস্কুট নিয়ে কুকুরটার দিকে বাড়িয়ে ধরে। কুকুরটা কয়েকমুহুর্ত তাকায়, তারপর একগ্রাসে ছিনিয়ে নেয় বিস্কুট দুটো। অতি উৎসাহের চোটে একটা মাটিতে পড়ে গেলে, ওপাশ থেকে আরেকটা কুকুর ছুটে আসে। অসিত লিকার চা দেয় গ্লাসে। চায়ে চুমুক দেবার আগে নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শোঁকে বিল্টু। আদার গন্ধ তার বড় প্রিয়। এক গন্ধ বুঝি আরেক গন্ধকে টেনে আনে। বিল্টুর আবার পার্কে ফেলে আসা ছাতিমের গন্ধের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে যায় – সে তো জিগ্যেসই করেনি – পিঙ্কি কোথায় যাবার কথা বলছিল।

পিঙ্কি শুধু একটা ড্রেসিং টেবিল চেয়েছিল। কেন এত জিনিস থাকতে সে শুধুমাত্র এই জিনিসটাই চাইতে গেল, তা সে কোনোদিন ভাবেনি। বা বলা ভাল, ভাবার সময়ই পায়নি। জীবনের উনিশটা বছরের অধিকাংশ সময় সে কাটিয়েছে, অনেক রাত অব্দি তরকারি কেটে, খুব ভোরে উঠে উনুনে আঁচ দিয়ে সারা সকাল লুচির ময়দা বেলে, দুপুরে ডেচকি-কড়াই মেজে কোনমতে দুটো ভাত গিলে, আবার সন্ধ্যের জন্য শসা-পেঁয়াজ কেটে ; তারপর ছটা থেকে রাত দশটা অব্দি দু রকম সস ছিটিয়ে রোল, মোগলাই, চাউমিন লোকের হাতে তুলে দিয়ে, রাতে খাবার পর বাসন মেজে আবার পরেরদিনের সকালের জন্য তরকারি কেটে। যদিও কাজ সে একা করে না। ওর থেকে বেশী কাজ করে ওর মা – লতা। লতার বর মানে পিঙ্কির বাপ সুশান্ত একটা জুটমিলে কাজ করত। মিল বন্ধ হয়ে যাবার পর থেকে সে লটারি কাটতে শুরু করেছে। পেটে মদ একটু বেশী পড়লে সে স্বপ্ন দ্যাখে মিল আবার খুলে গেছে, কারখানার গেটে খুব ধুমধাম করে বিশ্বকর্মা পুজো হচ্ছে আর তার হাতের রান্না খিচুড়ি খেয়ে সবাই বাঃ বাঃ করছে। ফুটপাথে খাবারের স্টলটা সে’ই দিয়েছিল কিন্তু প্রশংসাহীন রোজকার খুন্তি নাড়া বোধহয়, তার ভাল লাগেনি। নানা আন্দোলন, নানা ফন্দি, নানা ধান্দা শেষে, মদ খাওয়াটাই তার মনে ধরেছে। পিঙ্কি যে কবে স্কুলের পাট চুকিয়ে মা’র হেল্পার হয়ে গেছে, সে কথা কারো মনে নেই, পিঙ্কিরও না। ঠিক যেমন মনে নেই কীভাবে ড্রেসিং টেবিলের ভাবনাটা তার মাথায় এল। হয়ত কালো মেয়ে বলে, কোনদিন সাহস করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখার সাধ মেটেনি। বাসন মাজতে মাজতেই গামলার ঘোলা জলে নিজের ছায়ার দিকে তাকিয়ে থেকেছে কয়েকটা বেশী পলক। হয়ত সেরকম কিছুই নয়, এ এক অনন্ত অপেক্ষার স্বপ্ন মাত্র। অভাগা মনুষ্য জীবনে, প্রতিদিন দুঃখ, কষ্ট, লাঞ্ছনার সাথে যুঝতে যুঝতে, হতাশায় ডুবে গিয়েও না মরে বেঁচে থাকবার জন্য, একটা স্বপ্নের অবলম্বন লাগে বৈকি। কিংবা সত্যিই হয়ত একদিন, কোনো এক পুরোনো ফার্নিচারের দোকানে, হয়ত কোন জমিদারনী বা বনেদী বাড়ীর মালকিনের ফেলে যাওয়া অ্যান্টিক ড্রেসিং টেবিলের দিকে, আটকে গেছিল চোখ। ফুটপাথের ধারে দাঁড়িয়ে, দোকানের কাঁচের দেওয়াল পেরিয়ে, মনে মনে যত কাছে পৌঁছানো যায়, পৌঁছে গেছে সে। সেদিনও বেলা পড়ে এসেছিল আর শেষ বিকেলের একছটাক আলো এসে পড়েছিল, ঐ ড্রেসিং টেবিলের সামনে রাখা সাদা গদিওয়ালা বসবার টুলের উপর। মা’র ডাকে ভোরে ঘুম ভেঙ্গে ওঠার আগে, কোন কোনদিন নিজেকে ওই টুলের উপর বসে থাকতে দ্যাখে পিঙ্কি। তার সামনে, ফুলের ঢেউখেলানো কল্কা করা সোনালী কাঠের টেবিল, নীচে তার বাঁকানো পায়াগুলোতেও শিল্পীর সূক্ষ্ম হাতের কাজ, উপরে ছিমছাম দুটো লম্বাটে ড্রয়ার, সেই ড্রয়ারের পিছন থেকে হাতির শুঁড়ের মত উঠেছে যুগল তোরণ, আর একেবারে মাঝখানে দুটি দ্বিতীয় বন্ধনী মুখোমুখি হয়ে তৈরি করেছে যে ফ্রেম, তাতে মুকুটের মত স্থান পেয়েছে একটি বড় আয়না। সেই আয়নায় দেখা যায়, তার সিঁথিতে সদ্য লাগা সিঁদুরের ছোঁয়া। যে ঘরটায় সে বসে আছে, সেই ঘরটা কেন জানি খুব চেনা মনে হয় পিঙ্কির। ডানদিকে ইঁটের দেয়ালের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত অব্দি একটা বাঁশের আড়া, তাতে যে শাড়ীটা ঝুলছে, ছোটবেলায় মাকে বহুকাল সেটা পরতে দেখেছে সে। ওই দেয়ালেই হেলান দিয়ে রাখা, বাবার হিরো সাইকেল। সাইকেলের সামনের রডে একটা ছোট্ট সিট বসানো। এ তো সেই ঘর, যেখানে পিঙ্কির জন্ম হয়েছে। সামনে তাকালে অদূরে সেই জানলা। জানলার ধারেই একটা ডুমুর গাছ ছিল। সেই ডুমুরগাছ পেরিয়ে ছোটনদের বাড়ীর উঠোনের গোয়ালঘর দেখা যেত। রোজ সকালে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে দাঁত মাজতে মাজতে সে দেখত, ছোটনের দাদু ময়লাটে সাদা ধুতি আর কালো পাম্প-সু পরে, পিতলের বালতি নিয়ে উবু হয়ে বসে, গরুর দুধ দোয়াচ্ছে। কিন্তু স্বপ্নের ভিতর জানলাটা বন্ধ। তবে কী এখন রাত? তাই হবে।  ঘরের ভিতর নিবু নিবু হলুদ আলো। এটা কি ঠাকুর্দার সেই ওই দেশ থেকে আনা লন্ঠনের আলো? জানলার বাঁ পাশে রাখা ঘুণধরা খাটটা ফুল দিয়ে যত্ন করে সাজানো। রজনীগন্ধা আর গোলাপ – পিঙ্কির সবচেয়ে প্রিয়। আজ কী তার ফুলশয্যা তবে? সেই ছোটবেলা থেকে, ‘বড় হয়ে তুই কি করবি?’  জিগ্যেস করলেই সে বলতো, ‘আমি বিয়ে করব’। বড় হওয়ার পর কেউ আর সে প্রশ্ন করেনা, সেও বুঝি নিজের জন্য কিছু চাইবার কথা ভুলে গেছে। নিত্যদিনের অভাব আর সেই অভাবে খারাপ হয়ে যাওয়া স্বভাবে, বাবা-মা’র ঝগড়া, চুলোচুলি, মারপিট, কান্নাকাটি দেখতে দেখতে, একটু একটু করে বন্ধ্যা-নির্জীব হয়ে আসে মন, শুকিয়ে যায় সবুজ ইচ্ছের ডালপালা। ঈশ্বরের কাছে হত্যে দিয়েও জীবনের হাল কিছুই পাল্টায় না জেনে, রুক্ষ-কর্কশ হয়ে যায় মুখের ভাষাও। তারপর হঠাৎ একদিন পথে কুড়িয়ে পাওয়া নোটের মত বিল্টুকে পেলো সে। তার চেয়েও কপালপোড়া সে ছেলে, এই এত বড় শহরে নিজের বলে তার কেউ নেই। তবু সেই বিল্টুই তাকে হাসতে শেখাল আবার, অজান্তেই খুলে দিলো মনের বন্ধ কুঠুরিগুলো। গতরের শ্রম ছাড়া, এ পৃথিবীতে পিঙ্কিরও যে কাউকে আর কিছু দেবার ক্ষমতা আছে, বোঝালো বিল্টু এসে। বয়স তাদের দুজনেরই বেশী নয়, তাই বর্তমানের অনিশ্চয়তার ভয়ে ম্লান হয়না তাদের ভবিষ্যতের স্বপ্ন। আজ বুঝি, সেই স্বপ্নপূরণের দিন! কিন্তু বিল্টু কই? সে এঘরে নেই কেন? নিশ্চয়ই আজকেও কারো ফরমাশ খাটছে, মুখের উপর না বলতে না পেরে। কেমন হবে, যদি পিঙ্কি এখন খাটে উঠে, দরজার দিকে পিঠ দিয়ে, ঘুমের ভান করে মটকা মেরে পড়ে থাকে! বিল্টু নিশ্চয়ই ঘরে ঢুকে খুব ঘাবড়ে যাবে। ফুলশয্যার রাতে বর ঘরে আসার আগেই, বউ ঘুমিয়ে পড়েছে! ছোটবেলায় ওই খাটে শুয়ে, অনেক বিকেলে ঘুমের ভান করে পড়ে থেকে পিঙ্কি লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছে, জানলার পাশে দাঁড়িয়ে মা চুল আঁচড়াচ্ছে। দেওয়ালের গা ঘেঁষে রাখা চালের ড্রামের উপর মুড়ির কালো টিন। সেই টিনের উপর রাখা সস্তা কাঠের ফ্রেমের ছোট্ট হাত আয়না। সেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মা। কোমর ছাপানো একঢল কালো চুল তার। নারকোল তেলের কড়া গন্ধ সেই চুল থেকে ছড়িয়ে পড়েছে ঘরময়। হাঁসেদের দলবেঁধে পুকুর থেকে উঠে আসার শব্দে, বেলাশেষের কোনো নিঃসঙ্গ পাখীর একটানা ডাকে, কাছের কোনও ঘরে বেজে ওঠা শাঁখের আওয়াজে আনমনা হয়ে, সন্ধ্যের সুর গুনগুনিয়ে ওঠে মা। চুল আঁচড়ানো শেষে, ঠোঁটের ফাঁকে ক্লিপ গুঁজে, আয়নাটাকে পিছনের হুক দিয়ে জানলার গরাদে বাঁধিয়ে, মা দু হাত দিয়ে চুলে খোপা করে।  তারপর এক মুহুর্ত আয়নায় নিজেকে দেখে, চিরুনির দাঁতে করে সিঁদুর নিয়ে সিঁথিতে পরে, হাতের শাঁখায় ছোঁয়ায়। চিরুনি, সিঁদুরের কৌটো কুলুঙ্গিতে রাখতে রাখতে মা বলে – ‘উঠে পড় – পিঙ্কি! – পিঙ্কি, উঠে পড়!’ চোখ খুলে মরা মাছের মত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে পিঙ্কি কয়েক পল। স্বপ্নের সন্ধ্যে আর বাস্তবের ভোর-এর ভিতর চট করে পার্থক্য করা যায় না।

মেঝেতে সুশান্ত এমনভাবে শুয়ে থাকে যে খাট থেকে নেমে, না ডিঙ্গিয়ে বাইরের দরজার কাছে পৌঁছনো যায়না। ঘুমচোখে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ায় পিঙ্কি। শীত শীত করে। চারদিক সব শুনশান। গলির মাথায় কমলা আলোটা এখন আর রাতের মত চোখে লাগেনা। কাছেই কোন ঘর হতে কাশির শব্দ আসে থেকে থেকে। মিউনিসিপ্যালিটির টাইম কলে জল আসবে সকাল ছটায়। এরই মধ্যেই কলের নীচে বালতির লাইন। পিঙ্কির আরেকটু ঘুমোতে ইচ্ছা করে। হয়ত ভাবে, আরেকটু ঘুমোলে স্বপ্নের শেষটা যদি দেখা যেত! সে সুযোগ অবশ্য তখন সে পায় না। শেষ না হওয়া রাতের চেয়েও কালো কয়লার টুকরোগুলো উনুনে এক হাতে গুঁজতে গুঁজতে, অন্য হাতে মশা তাড়াতে হয়। তবু ঘুম কাটে না। উনুনে হাতপাখার হাওয়া দিতে দিতে ঝিমুনি আসে ফের। দেওয়ালে টাঙ্গানো মা-বাবা’র বিয়ের ছবিটাতে, মার মুখে যে ঠোঁট চাপা হাসিটা আছে, স্বপ্নে ওই ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে, অনেকটা সেরকমই হাসি ফুটে আছে পিঙ্কির মুখে। ঘামে মুখের মেকআপ একটু ধেবড়ে গেছে বটে কিন্তু তবু, বউ এর সাজে তাকে খারাপ দেখাচ্ছে, একথা কেউ বলতে পারবে না। বিল্টু নিশ্চয়ই ঘরে ঢুকে চোখ বড়বড় করে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকবে তাকে দেখে। ওকে ওরকম ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে পিঙ্কির খুব হাসি পাবে, কিন্তু সে হাসবে না। মুখ নামিয়ে বসে অপেক্ষা করবে, যতক্ষণ না বিল্টু কাছে এসে তাকে ছোঁবে। সেই কাঙ্খিত স্পর্শে কয়েকপলের জন্য বুঝি মরেই যাবে সে, বুজে আসবে চোখ। বিল্টুর কড়া-পড়া হাতের খরখরে ছোঁয়ায় কেঁপে উঠবে তার প্রতিটি রোমকূপ। কয়েকমুহুর্ত পর একটি দীর্ঘ শ্বাসে কাঠের নতুন পালিশ আর প্রিয় ফুলের গন্ধ বুকে নিয়ে, ধীরে ধীরে চোখ খুলবে সে। একান্ত ব্যক্তিগত শুভদৃষ্টির সেই মুহুর্তের কোনও ছবি উঠুক বা না উঠুক, ওই আয়না নিশ্চয়ই তার সাক্ষী থাকবে। কিন্তু বিল্টু এখনও আসছে না কেন? ও কি জানে না, পিঙ্কি কতদিন ধরে এই ড্রেসিংটেবিলের সামনে ওর জন্য বসে আছে! ‘তোর মতো হারামজাদা’র মদ গেলার জন্য টাকা নিয়ে আমি বসে নেই’ – মা’র চিৎকারে তন্দ্রার ঘোর কাটতেই, পিঙ্কির দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায় উনুনের ধোঁয়ায়।  মেঝেতে আছড়ে পড়া বাসনের শব্দে, কলোনির সকালের পলকা নীরবতা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলে, দু একটা প্রতিবেশী মুখ নিতান্তই অনীহায় চোখ তুলে চায় তাদের দরজার দিকে। ‘বলছি তো সামনের সপ্তাহে দিয়ে দেব’ – সুশান্তর মিনমিনে স্বরে আগুনে ঘি পড়ার মত আরও জ্বলে ওঠে লতা। ‘কোত্থেকে দিবি শুনি? ভিক্ষা করে? সে মুরোদও তো নেই’ – ময়দায় জল ঢালতে ঢালতে শ্লেষে বিকৃত হয়ে ওঠে লতার মুখ, চকমকির মত ঘষা খায় দুই দাঁতের পাটি, গলার রগ ফুলে ওঠে। একদা ঘোমটা দেওয়া গ্রাম্য গৃহবধূর ‘এই শুনছ’ স্বামী সম্ভাষণ, সময়-অসময়ের ভেদে ‘তুই-তোকারি’তে নেমে আসায় পিঙ্কির চোখ আর্দ্র হয়ে এলেও, সুশান্ত নির্বিকার ভাবেই তিনদিনের বাসী দাড়িওয়ালা মুখে দরজার বাইরে এসে বসে বিড়ি ধরায় এবং মাঝে মাঝে খুক খুক করে কাশে। এর পরের ঘটনাক্রম পিঙ্কির প্রায় মুখস্ত। একটু বাদেই ময়দা মাখতে মাখতে, জন্মইস্তক তার সাথে কি কি অন্যায়-অবিচার হয়েছে গজগজ করে বলতে শুরু করবে মা আর বাবা কোন উত্তর না দিয়ে চুপচাপ শুনে যাবে। বিড়ি নিভে গেলে, লাইটার জ্বেলে আবার ধরাবে। পায়খানার বেগ চাপলে, গিয়ে পায়খানা করে আবার একই জায়গায় এসে বসবে। পিঙ্কি চা দিলে খাবে। কড়াইতে আলুর তরকারি বসিয়ে পিঙ্কি ছুটবে কলের দিকে। সেখানে জল ভরতে ভরতে শুনবে, সুশান্ত গলা খাঁকারি দিয়ে দিয়ে কফ তুলে এনে এক থুয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে বলছে – ‘যার পয়সা নেই, সংসারে তার আর কোন দাম নেই! শালা, এত লোকে রাস্তাঘাটে মরে, আমার যে কেন মরণ হয়না! যাব, যাব একদিন খ্যাংরা খেয়ে রেললাইনে গলা দিয়ে…’ কথাগুলো শুনতে শুনতে লতা ঠাণ্ডা চা’টা একঢোকে গিলে নিয়ে ঝুম হয়ে বসে থাকবে কয়েক মুহূর্ত, তারপর উঠে গিয়ে কাপড় পাল্টে নেবে। সাড়ে ছটা বাজলে ইউনুস ভ্যান নিয়ে আসবে। ওর ভ্যানে মালপত্র তুলে রাস্তার হোটেলের দিকে রওনা হবে মা-মেয়ে। বাড়ী থেকে খানিক দূর গিয়ে, মা তাকে বলবে ‘তুই এগো, আমি আসছি’। ব্লাউজের ভিতর থেকে মানিব্যাগটা বের করতে করতে আবার বাড়ীর দিকে ফিরবে লতা।

সকাল থেকে আর বিল্টুর কথা ভাবার সময় পায়না পিঙ্কি। সবারই বড় তাড়া। কেউ গয়নার দোকানে সিকিউরিটির নাইটডিউটি সেরে ফেরার ট্রেন ধরবে, কেউ বাস থেকে নেমে মলের ডিউটিতে ঢোকার আগে টিফিনটা সেরে নেবে। টোটোর লাইনে গাড়ী দাঁড় করিয়ে এসেছে দু-একজন। কেউ আবার মর্নিং ওয়াক সেরে ফেরার পথে বাড়ীর জন্য পার্সেল নিয়ে যাবে। তিনটে লুচি দশ টাকা। পিঙ্কি বেলে দেয়, লতা ভাজে। মাঝে মাঝে আবার বেলা থামিয়ে চট করে এঁটো প্লেটগুলো ধুয়ে নিতে হয়। পার্সেল এলে পিঙ্কিকেই দিতে হয়। তরকারি দেবার পাতলা প্লাস্টিকের পাউচ খুলতে এক্সট্রা সময় চলে যায়। লোকেদের খাওয়াতে খাওয়াতে নিজেদের খাওয়ার বেলা গড়িয়ে যায়। দুপুরে চুনো মাছের চচ্চড়ি দিয়ে ভাত খেতে গিয়ে বিল্টুর মুখটা মনে পড়ে। সেও চুনো মাছ খেতে ভালোবাসে যে। ভাবে, বিয়ে হলে বিল্টুকে রেঁধে একদিন খাওয়াবে আর সেই সঙ্গে খয়রা মাছের ঝালও। বিল্টু নাকি তা কোনদিন খায়ইনি। বিয়ের কথা ভাবতে গিয়ে মনে হয়, বিল্টুকে ওই ফার্ণিচারের দোকানটায় নিয়ে যেতে হবে একদিন। ওই দোকানেই তো সেই ড্রেসিং টেবিলটা আছে। বাঁদিকের এক কোণায় অযত্নে রাখা। দোকানদার বুড়োটা একটা হাতলওয়ালা লম্বা কাঠের চেয়ারে বসে একমনে বই পড়ে। কে জানে, সারাদিনে আদৌ কোন জিনিস বিক্রি হয় কিনা। তাই যেন হয় ঠাকুর! তাহলে দাম কম নেবে নিশ্চয়ই। খাওয়ার পর মা শুয়ে পড়লে পিঙ্কি সানসেটের মাথা থেকে একটা পুরোন ফিতে ছেঁড়া ব্যাগ পেড়ে আনে। কান পেতে মা’র শ্বাসের শব্দ শোনে। সকালে যে পাঁচ টাকা সরিয়েছে সেইটা রাখে ব্যাগের ভিতর। খুচরো বেশী রাখা যায়না। একটু খুচরো জমলেই পিঙ্কি নোট করে নেয়। দু দুবার গোনবার পরেও টাকার অঙ্ক বাড়ে না। হতাশ হয়ে ব্যাগের সামনের চেন খোলে সে। সেখানে ক’টা বাসের টিকিট, ময়ূরের ফল্‌স পালক, বাবা লোকনাথের ছবি, দুটো টিপের পাতা, আর একটা কান-গলার সেট। গতবছর রথের মেলায় বিল্টু এইটা কিনে দিয়েছিল। সে নিতে চায়নি, তবু জোর করে। পিঙ্কিও বিল্টুকে ঘড়ি কিনে দিয়েছে একটা। ঘড়িটা অবশ্য খারাপ হয়ে গেছে। বিয়ের সময় বিল্টুকে একটা ভালো ঘড়ি কিনে দিতে হবে। ঘড়িতে এখন বাজে চারটে। মা’র ঘুম ভাঙ্গতে আরও পনেরো মিনিট। ঘুমন্ত মা’র হাঁ করা মুখের দিকে কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে থেকে, টেবিলের উপর রাখা ব্যাগ খুলে নিঃশব্দে ফোনটা বের করে, পা টিপেটিপে দরজার বাইরে আসে পিঙ্কি। সারাদিন ভিজে থাকা কলতলাটা এখন শুকনো। ক্লাবের ঘর থেকে টিভি’র হিন্দি বই এর আওয়াজ, বন্ধ দরজা ছাপিয়ে, বাইরে চাতালে প্লাস্টিক পেতে তাস খেলতে বসা বুড়োদের দল অব্দি এসে পড়ছে। হাতে সময় খুব কম। পিঙ্কি অধৈর্য হাতে দশটা সংখ্যা টেপে। ফোন হয়ে গেলেই কল লিস্ট থেকে ডিলিট করে দিতে হবে। ফোন হাতের মুঠোয় নিয়ে সে হাঁটতে শুরু করে ঘরের পিছনের গলি দিয়ে। ফোনের রিং এর শব্দ আর তার নিজের হৃদস্পন্দন পর্যায়ক্রমে কানে আসে। এই শহরে পিঙ্কিদের কোথাও কী একটু একা হওয়ার জো আছে! গলির মুখে ছেলেগুলো বাইকের উপর স্ক্রীনটাচ মোবাইলে উপুড় হয়ে বসে। রুগ্ন চেহারার কালো মেয়েটা ভাগ্যিস ওদের নজর কাড়ে না! দুটো ঘর পরে পুরনো প্লাস্টিক এর দোকানে দাঁড়িপাল্লা দুলছে আর গলায় একগুচ্ছ চাবি ঝুলিয়ে কাঁটার দিকে জুল জুল করে তাকিয়ে আছে নিমাই বুড়ো। কাগজকুড়ানি বউটা সামনে দাঁড়িয়ে হাই তোলে। তার পাশেই সাইকেল রিপেয়ারিং এর দোকানে ভ্যানের সামনের চাকার টাল সারাচ্ছে কৃষ্ণদা। এফ. এমে অ্যাড শুরু হতেই খিস্তি দিয়ে চ্যানেল পালটায়। চায়ের দোকানে সদ্য খালি দুধের প্যাকেটের ভিতর জল ভরে শেষবিন্দু টুকু ঢেলে নিতে নিতে এক খরিদ্দারের উপর চিল্লোচ্ছে পুঁটুর মা। এতগুলো চোখের দৃষ্টি পেরিয়ে কলোনির মাঠের পাশে এসে দাঁড়ায় পিঙ্কি। একবার গোটা রিং হয়ে কেটে যায়, বিল্টু ধরে না। পিঙ্কি আবার করে। মনে মনে রাগ হয়। বিল্টু তো জানে, সে এইসময় ফোন করে। ফোনের কাছে একটু থাকতে পারেনা! আবার গোটা রিং হয়ে কেটে যাওয়ার কয়েকমহুর্ত আগে বিল্টু হাঁপাতে হাঁপাতে এসে ফোনটা ধরে – ‘হ্যালো’। পিঙ্কি চুপ করে থাকে, ও প্রান্তের হাঁপের শব্দ শোনে। বিল্টু উৎকণ্ঠিত হয়, ভাবে লাইন কি কেটে গেলো! এক নিশ্বাসে বলে যায় – হ্যালো – হ্যালো! হ্যালো? পিঙ্কি উত্তর দেয় এবার, কিন্তু অভিমানটা চাপতে পারে না গলায় – ‘হ্যালো’ টা বুঝি তাই রুক্ষ শোনায় একটু। ‘আরেকবার বলো’ – বিল্টু সঙ্গে সঙ্গে বলে। ‘কি বলব?’ – পিঙ্কি বুঝতে পারেনা। ‘হ্যালো! হ্যালো! হ্যালো!’ বিল্টু পিঙ্কির গলা নকল করে ভেঙ্গাতে থাকলে পিঙ্কিকে হাসতেই হয়। খুব হাসে পিঙ্কি – সব রাগ অভিমান ভেসে যায় সে হাসির তোড়ে। তবে বেশীক্ষণ স্থায়ী হয়না সে হাসি। কথা বলতে বলতেই হঠাৎ চুলের মুঠোয় টান পড়ে, পিছন ফিরতেই দ্যাখে – মা। বিল্টু বুঝতে পারে না ঠিক কি হয়েছে, একটা চিৎকারের শব্দ শেষ হওয়ার আগেই ফোনটা কেটে যায়। ইচ্ছা থাকলেও ঘুরিয়ে ফোন করতে পারে না সে। ব্যালেন্স থাকে না ফোনে। যাবার পথের তাকানো মুখগুলো ফেরার পথেও তাকিয়ে থাকে, কেউ কেউ নিজের কাজ ছেড়ে বেরিয়ে আসে পথে – কোনও শবযাত্রা, শোভাযাত্রা বা নতুন খোলা দোকানের আকর্ষণীয় অফারের কথা ঘোষণা করতে করতে যাওয়া গাড়ীকে দেখে যেমন বেরিয়ে আসে লোকে। প্রকাশ্য দিবালোকে মায়ের হাতে মেয়েকে একের পর চড় খেতে দেখেও কেউ আটকাতে আসে না। বাধা দেয় না পিঙ্কিও, লতার মুখ হাত দুটোই সমানে চলে। সে নাকি আগে থেকেই সব জানত, তক্কে তক্কে ছিল, হাতে নাতে ধরবে বলে, পিঙ্কির বাপ সারাজীবন তাকে জ্বালিয়েছে এখন সেই বাপের শয়তান মেয়েও তাকে জ্বালাচ্ছে, মা সারাদিন মুখের রক্ত তুলে খাটছে আর মেয়ে ফষ্টি নষ্টি করে বেড়াচ্ছে, সপ্তাহে সপ্তাহে ফোনের টাকা শেষ হয়ে যাচ্ছে, পিঙ্কি কি করে ভাবল যে মা কিছু বুঝতে পারবে না, তাকে আগেও লোকে বলেছে, সে বিশ্বাস করেনি, কেন পিঙ্কি এমন করল, সেও বাপের মতই বিশ্বাসঘাতক। একটানা কথা বলতে বলতে লতা’র মুখে ফেনা উঠে যায়, দম নেয়ার জন্য থামে একটু। এতক্ষণে বোধহয় তার খেয়াল হয় যে গলির দু ধারে লোক দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে। বাঁহাতে ধরা চুলের মুঠি আলগা হয়ে যায়। পিঙ্কি দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে যন্ত্রণা চাপে, চুলের গোড়াগুলোয় জ্বালা করে, ঘাড়ের পেশী মোচড়ায়, হেঁচকা টানে ছিঁড়ে যাওয়া হাওয়াই চটিটা আঁকড়ে ধরে পায়ের আঙ্গুলের ফাঁকে। হঠাৎ তাকে পথিমধ্যে রেখেই লতা দুদ্দাড় পায়ে ঘরের দিকে চলে যায়। পিঙ্কি কোথায় যাবে! সামনে, পেছনে কোথাও কী তার যাবার পথ আছে!  পায়ে পায়ে ফিরে আসে সেই ঘরেরই সামনে। বাইরে দাঁড়িয়েই পিঙ্কি বুঝতে পারে, মা কাঁদছে। পিঙ্কি একটু অপেক্ষা করে, বোঝে এ কান্না সহজে থামবে না। সে স্বাভাবিক ভাবেই ঘরে ঢোকে, পেঁয়াজের বস্তা থেকে রোজকার মত পেঁয়াজ নিয়ে কাটতে শুরু করে।

আর পাঁচটা দিনের মতই সন্ধ্যে নামে সেদিনও। বিশ্বকর্মা হোটেল এর তাওয়ায় তেল গরম হয়, ডিমের কুসুম লেপটে যায় ময়দার সাথে, মা খুন্তি দিয়ে নামিয়ে দেয়, মেয়ে তাতে শসা, পেঁয়াজ ছড়িয়ে এগরোল তুলে দেয় লোকের হাতে। ছেলে-মেয়েটা ওদেরই মত গরীব বোধহয়। দুজনে মিলে একটাই রোল নেয়। একটু আড়ালে গিয়ে দুজনে ভাগ করে খায়। মেয়েটা খায়, ওর হাত থেকে খায় ছেলেটা। কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে কী যেন বলে ছেলেটা, মেয়েটা কপট রাগে ঘুষি মারে। একটু পরে বোধহয় মাসির ফোন আসে, মা দূরে গিয়ে কথা বলে। পিঙ্কি বুঝতে পারেনা মা কী বলছে কিন্তু বারবার কপাল চাপড়াতে দেখে বুঝতে পারে যে তার ব্যাপারেই বলছে। বিল্টু কী জানে আজ কি হল! কীভাবেই বা জানবে! হয়ত আন্দাজ করে থাকবে। আজ যেন সে ভুল করেও এদিকে না আসে। মাথা তা ভাবলেও, মন চায় ঠিক উল্টো। গোটা সন্ধ্যে বারবার পিঙ্কির চোখ চলে যায় উল্টোদিকের চায়ের দোকানে। একটা ছেলেকে পিছন থেকে দেখে সে তো ভেবে বসেছিল, বিল্টুই হবে। ছেলেটা সিগারেট ধরাতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। সামনের সোমবার দিদার চোখের ছানি অপারেশন। কিছু একটা শরীরখারাপের অজুহাত দিয়ে, ওদিন বাড়ীতে থেকে যাবে পিঙ্কি। তারপর মা বেরিয়ে যেতেই বেরিয়ে পড়বে। বিল্টু স্টেশনে দাঁড়াবে। মেট্রোয় করে পার্ক স্ট্রীটে নেমে, বাঁদিকে গিয়ে তিনটে মোড় পেরিয়ে, রাস্তার ধারে ওই পুরোনো ফার্ণিচারের দোকানটা। ওর পরের পরের দোকানটাতে পিঙ্কির মাসি কাজ করে। কিন্তু সেও তো সেদিন হাসপাতালে যাবে। তাই ধরা পড়ার কোন চান্স নেই। দোকানটার নাম পিঙ্কির মনে নেই। নাকি কোন নাম ছিলই না! তাই হবে বোধহয়। বাঁদিকে কোণার দিকে আছে ওই ড্রেসিং টেবিলটা, পিঙ্কির স্পষ্ট মনে আছে। বিল্টু সঙ্গে থাকলে পিঙ্কির ভয় করবে না। সে দোকানে ঢুকে ওই বুড়ো মালিকটাকে জিগ্যেস করবে, জিনিসটার দাম কত। দাম যাই হোক, পিঙ্কি আগাম টাকা দিয়ে ওটা বুক করে রাখতে চায়, তার কাছে যেটুকু জমেছে সেটুকু দিয়েই। বিল্টু নিশ্চয়ই এই একটা জিনিসের জন্য রাগ করবে না তার উপর। সে তো আর কিছু চায় না, শুধু ওই ড্রেসিং টেবিলটা। মায়ের কথায় ভাবনায় ছেদ পড়ে। প্রয়োজন বড় বালাই – কয়েক মুহুর্তের জন্য হলেও রাগ তুলে রেখে, মেয়ের সাথে কথা বলতে হয় লতাকে। তেল কম আছে, আজ রাতটা কোনমতে চললেও, কাল সকালেই লুচি ভাজতে তেল লাগবে। অত সকালে তো মুদিখানার দোকান খুলবে না। পিঙ্কি অন্যদিন ক্যাশবাক্স থেকে নিজেই টাকা তুলে নেয়, কিন্তু আজ অপেক্ষা করে। লতা স্টিলের বাক্স খুলে দুটো একশ টাকার নোট বের করে দেয়। টাকা নিতে গিয়ে একপলক মা’র মুখের দিকে তাকায় পিঙ্কি। স্টোভের নীল শিখার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা লতার মুখে এক ইস্পাত কঠিন উদাসীনতা। মা বোধহয় ওর মুখও দেখতে চায় না আর! রাস্তা পেরোতে গিয়ে সে কী অন্যমনস্ক হয় একটু! নাকি রেসিং বাইকের স্পীড এখন ভাবনার চেয়েও বেশী! বাইকের পিছনটা এত উঁচু যে এক পলক দেখলে মনে হতেই পারে, মেয়েটি ছেলেটির কাঁধের উপর বসে আছে। রাস্তায় পা দিতেই ইঞ্জিনের নিষ্ঠুর শব্দটা সূচের মত কান ভেদ করে ধাক্কা দেয় মাথার ভিতরে। পিঙ্কি ভেবেছিল, সে পার হয়ে যাবে। কিন্তু ওপারের পার্টি অফিস আর তার মধ্যেকার দূরত্বটা যে ওই বাইকের অতিক্রম ক্ষমতার সামনে নগণ্য, নব-গণিতের সেই সূক্ষ্ম বোধ অথবা জওয়ানির লাগামহীন জোশ, কোনটাই তার ছিল না। তাই বাইকটা নির্দ্বিধায় বেরিয়ে গেলেও তার হাওয়ার ধাক্কায় পথের উপর আছড়ে পড়ে পিঙ্কি। ‘ভাগ্যিস সেইসময় কোন বড় গাড়ী পিছন দিক দিয়ে আসছিল না!’ ‘বাইক হাতে পড়লে আজকালকার ছেলেগুলোর আর হুঁশ থাকে না!’ ‘থাকবে কী করে, পেছন থেকে কেউ যদি ওরকম করে জাপটে ধরে!’ ‘হ্যা-হ্যা-হ্যা!’ ‘ খুব বাঁচা বেঁচে গেছে! একটা বাজে অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যেত আজ!’ ‘এই তো সেদিন সিরিয়ালের ওই ছেলেটা ভোর বেলায় গাড়ী নিয়ে ঠুকে দিল না, পাশে আবার একটা মেয়ে…!’ লতা যতক্ষণে ছুটে এসেছে, এই সব কথা শুনতে শুনতে উঠে দাঁড়িয়েছে পিঙ্কি। ডান হাতের কনুইয়ের কাছটা ছড়ে গেছে আর বাঁহাতের চেটোটার ছাল উঠে গেছে। হাতের মুঠোয় ধরা নোট দুটো একইরকম আছে। লতার বারণ না শুনেই ফের বাজারের দিকে পা বাড়ায় সে। চারপাশের সব কিছুও খুব দ্রুতই আগের ছন্দে ফিরে যায়। পার্টি অফিসের ছেলেরা ফিরে যায় টিভির আই পি এল ক্রিকেট ম্যাচে, মাংসের দোকানে হঠাৎ থমকে যাওয়া চপার নেমে নির্ভুল ভাবে আসে মুরগীর গলায়, কালো কড়াইয়ে টগবগ করে ফোটা তেলে লাল হয়ে আসা আলুর চপ উল্টে দেয় দোকানী। বাস, অটো, টোটো সব ছুটতে শুরু করে আবার, গাড়ী, বাইক চলে, রাস্তা পার হয় মানুষ, কারো মোবাইল বেজে ওঠে, কেউ কেউ আবার কয়েকপলকের জন্য দাঁড়িয়ে পড়ে হনুমান মন্দিরের সামনে। আজ যদি সে অ্যাকসিডেণ্টটায় মরে যেত, তাহলেও কি সব কিছু এত দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে যেত! কয়েক মিনিটের মধ্যেই সবাই নিশ্চয়ই তার কথা ভুলে যেত! পিঙ্কি হঠাৎ কেন যেন কেঁদে ফেলে। কয়েকটা মুহুর্ত মাত্র। কয়েকটা সেকেন্ডও হয়ত না। এই বুঝি মৃত্যু! বুকের ভিতর একটা বরফের পিন ফুটে গেল আর অন্তহীন সুড়ঙ্গের অন্ধকারে ঢেকে গেল চোখ! মৃত্যু! এই তবে! সব শেষ! সেই নিষ্ঠুর মুহুর্তের ভগ্নাংশে, পিঙ্কির চোখে ঘরের দেয়ালে টাঙ্গানো বাবা-মা’র বিয়ের ছবিটা ভেসে ওঠে আবার। আর দ্যাখে ঢলঢলে জামা পরা একটা বাচ্চা ছেলে হাসতে হাসতে তার দিকে এগিয়ে আসছে। চুল ছোটো করে কাটলে বড় ছেলে মানুষ লাগে বিল্টুকে। কাঁদতে কাঁদতে কখন যে মুদির দোকানে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল হয় না। তেল নিয়ে ফিরে দ্যাখে মা দোকান গুটিয়ে নিয়েছে। ঘরে ফেরার পথে, আজ কেউই কোন কথা খুঁজে পায় না।

অভ্যাসের নিয়মে সব কাজ চলে। লতা দুপুরের রান্না তরকারি গরম করে, ভাত বাড়ে, পিঙ্কি মেঝেতে চটের বস্তা পাতে, জ্যারিকেন থেকে জল ভরে বোতলে, সুশান্ত টিভি দেখতে দেখতে হাই তোলে। খেতে বসে ভাত মাখতে গিয়ে পিঙ্কির হাতে কাটা জায়গায় জ্বালা করে। নীরবতা ভেঙ্গে সুশান্তই প্রশ্ন করে ‘কি হয়েছে?’। মা-মেয়ে কেউই কোন উত্তর দেয়না। বোবা পশুর মত চিবিয়ে চলে সবাই। পিঙ্কি খাওয়ার পর আলু কাটতে গেলে লতা বাধা দেয়, বলে, কাল ছোলার ডাল হবে। সে নিজে ভিজিয়ে নেবে। অগত্যা চৌকিতে বসে টিভি’র দিকে তাকিয়ে থাকে পিঙ্কি। পুরোনো দিনের হিন্দি বইয়ের গান দেখতে দেখতে সুশান্ত ঢুলছে। পিঙ্কি একবার ভাবে শুয়ে পড়ে, তারপর কী ভেবে দরজার কাছটায় এসে দাঁড়ায়। ক্লাবের সামনের চাতালে এখনও তাসের আড্ডা চলছে, তবে এখন বুড়োরা নয় যুবকেরা খেলছে। বিড়ির ধোঁয়ায় তাদের কারো কারো মুখ দেখা যাচ্ছে না। কলতলায় উদোম গায়ে স্নান করছে সীমার বড় ভাই। চোখাচোখি হতে পিঙ্কি চোখ নামিয়ে নেয়। আকাশে কোন তারা নেই।  দূরে কোন ঘরে চিৎকার ওঠে। কাঁচ ভাঙ্গার শব্দ। তাসের চাল ভুল হলে খিস্তির ফোয়ারা ছোটে। ঘরের ভেতর থেকে লতার গলা শোনা যায় ‘রাত অনেক হয়েছে’। পিঙ্কি দেরী করে না। ঘরে ঢুকে দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে পড়ে তক্তপোষের উপর। লতা টিভি বন্ধ করতেই বরের ঘুম ভেঙ্গে যায়। লতা অবশ্য তাতে পাত্তা দেয় না। দরজায় খিল দিয়ে, জল খেয়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ে পিঙ্কির পাশে। সুশান্ত’র কথাগুলো কেমন আস্তে আস্তে জড়িয়ে যেতে যেতে মিলিয়ে যায়। টোটো নিয়ে ঘরে ফেরে পাশের ঘরের টুবলু। গাড়ী ব্যাকগিয়ারে নেয়ার মিউজিকে রাতের নিস্তব্ধতা চৌচির হয়ে যায়। আবার সব চুপচাপ। পিঙ্কির বাপ গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে। লতা চিৎ হয়ে শুয়েছিল, কাত হয়ে শোয়। এত দীর্ঘ রাত! হাতে ব্যাথা করে পিঙ্কির। অন্ধকারে ক্ষতের উপর হাত বুলোয় সে। মশার ধূপের সাথে মশাদের লড়াই এর তীক্ষ্ণ শব্দ ঘরের এদিক থেকে ওদিক করে। পিঙ্কির তেষ্টা পায় কিন্তু বিছানা ছেড়ে ওঠে না। তারপর অনেক রাতে, সে আসে।

সেই আলো। সেই ঘর। সেই মুহুর্ত। সেই ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে মুখ নিচু করে সে বসে। গোলাপের গন্ধ ঘরের বাতাস ভরেছে কানায় কানায়। ঘড়ির কাটার টিকটিক শব্দে রাত গভীর হয় আরো। হঠাৎ দরজায় খুট করে শব্দ। এতদিনের অপেক্ষা বুঝি এবার হল শেষ! অনেক রাত্রি পেরিয়ে সে এল। আর কয়েক পল। কয়েকটি মাত্র পল। দরজা বন্ধের শব্দটা নিষ্ঠুর। এবার সে আসবে। আসবে সে এবার। ধীরপায়ে পিছনে এসে দাঁড়াবে সে, আর হাত রাখবে কাঁধে। সেই স্পর্শ। সেই স্পর্শে কেঁপে উঠবে চাতক হৃদয়, ফুটে উঠবে প্রতিটি রোমকূপের ফুল আর পিঙ্কি আয়নায় চোখ তুলে দেখবে – একি! এ কে! কালো ছোপওয়ালা দাঁতগুলো হেসে উঠে সজোরে আর জিভের ভেতর থেকে উঠে আসে লাল বুদবুদ – পিঙ্কি এক ঝটকায় সরিয়ে দিতে চায় কাঁধের উপর থেকে হাতটা – পারে না – থাবাটা ক্রমশ তার গলার দিকে এগোয় আর বলে – ‘অ্যাই ছেমড়ি – আয়, তোরে বিয়া করুম।’ ‘অ্যাই ছেমড়ি – আয়, তোরে বিয়া করুম।’



পিঙ্কি শুধু একটা ড্রেসিং টেবিল চেয়েছিল। এটাই তার অপরাধ। কারণ সেটা ছিল এক অসম্ভব স্বপ্ন। তার নিজের জন্য, বিল্টুর জন্য, লতার জন্য। বিল্টু বলে – ‘আমার নিজেরই ঠিক করে থাকার জায়গা নেই, কাকার বাড়ীতে কোনমতে মাথা গুঁজে আছি, তুমি তো সব জানো, আমি তো চেষ্টা করছি, একটা ভাল কাজ পেলে… একটু সময় দাও আমাকে…’

মা বলে – ‘ তোমার কথা শুনে ফালতু সময় নষ্ট করার মত সময় আমার নেই, একবার যখন বারমুখো হয়েছ, তখন তোমাকে বিদায় না করা অব্দি আমার শান্তি নেই, মা’র চেয়ে সেই যখন আপন হয়েছে বেশী, তখন যাও তাদের বাড়ী গিয়ে পিরীত করো – আমায় মুক্তি দাও…’ । পিঙ্কিও তাই চেয়েছিল। মুক্তি। কিন্তু এমন কপাল, গলায় বাঁধা ওড়নার ফাঁসটা ফ্যানে বেঁধে, পায়ের নীচ থেকে চেয়ারটা লাথি মেরে সরানোর আগেই, অসময়ে ভর দুপুরে মাতাল বাপটা এসে পড়ল। খবর পেয়ে মাসি এল। মা’র কান্নায় পাড়ার লোকেরা ঘরের দোরে ভিড় করল। ছেলেটাকে ডাক। ডাক ছেলেটাকে। মাসি বলল। একবার, দুবার, তিনবারের বার বিল্টু ফোন ধরল। সে তখন বুম্বাদার গাড়ী ধুচ্ছিল। পিঙ্কি নাক টানতে টানতে সব বলল।  বিকেলে আসবে, বলল বিল্টু। সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত হল, বিল্টু এল না। যা কোনদিন হয়নি তাই হল। বিল্টুর ফোন সুইচড অফ থাকল।

না। বিল্টুর উপর আর রাগ হয় না। সে তার জীবনে না এলে, সেই স্বপ্ন আসত না। স্বপ্ন সত্যি নাই বা হল, স্বপ্ন দেখতে পারার আনন্দ কি কম! হাতের উপর হাত রাখলে যে বুকের ভিতর কেমন করে, গায়ে কাঁটা দেয়, বিল্টু না আসলে সেকথা কেমন করে জানত সে! যদি আরেকবার, আর-একবার সেই ছোঁয়াটা পাওয়া যেত আজ, এই মুহুর্তে! স্টেশনের ডিজিটাল ঘড়ি জানান দেয় ট্রেন আসবে ঠিক ছ’মিনিট পর।

তারপর যা হবার ছিল তাই হল। একমাসের মধ্যে এক পাত্র ধরে আনল মাসি।  ছেলে ইলেকট্রিকের মিস্ত্রি। সঙ্গে আবার কোন কোম্পানির এজেন্ট।  এক ভাই, এক বোন। বোনের বিয়ে হয়ে হয়েছে গতবছর। বাবা নেই, মা আছে। নিজেদের পাকা বাড়ী। বয়সটা পিঙ্কির থেকে একটু বেশী। কিন্তু পাড়ায় খবর রটে গেছে, এরপর মেয়ের বিয়ে দেওয়া মুশকিল হবে। তারউপর ওই দিনের পর পিঙ্কিকে আর ঘরে একা রাখতে সাহস পায়না লতা। ‘বিয়ে দিয়ে দে – কদিন গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে – অল্প বয়সে এরকম একটু আধটু হয়’ – মাসি বলল। বিয়ে হয়ে গেল। খাট, আলমারি, আলনা, ড্রেসিং টেবিল, গয়না, তার উপর নগদ এক লাখ টাকা।  পিঙ্কি অবাক হয়ে দেখেছে, এতদিনের তিল তিল করে জমানো টাকা কীভাবে উপুড় করে ঢেলে দিয়েছে মা। অথচ কত না রাগের মুহূর্তে সে ভেবেছিল, মা বোধহয় কোনোদিন তার বিয়েই দেবে না, বিনা মাইনের হেল্পার হাতছাড়া হবার ভয়ে।

মা’র উপরও কোন রাগ নেই আজ আর। মা-ও তো ভালবেসে বিয়ে করেছিল বাবাকে। জাত মেলেনি বলে দাদু মেনে নেয়নি। এক কাপড়ে বাবার হাত ধরে বেরিয়ে এসেছিল মা। বাবার যদ্দিন চাকরি ছিল, সংসারে টানাটানি থাকলেও অশান্তি ছিল না। দূর থেকে বাবার সাইকেলের আওয়াজ শুনে মা ঠিক বুঝে যেত বাবা আসছে। হাতে গামছা নিয়ে দরজা খুলে উঠোনে গিয়ে দাঁড়াত। আর পায়ে পায়ে মা’র পিছনে গিয়ে দাঁড়াত সে। বাবা মিল থেকে ফেরা মানে ট্রেন থেকে কেনা লাল নীল হলুদ সবুজ গোল গোল পপিন্স লজেন্স পাওয়া। রোজ সকালে একটা করে ছড়া কেটে ওর ঘুম ভাঙ্গাত বাবা। ‘ইকির-মিকির-কিতকিত/ করছে নয়ন পিটপিট/ কুট কুট দিলাম কুটুৎ/ থার্টিটু হল আউট’। রোববার বিকেলে মা কাচা জামা পরিয়ে, চুল আঁচড়ে, গায়ে পাউডার লাগিয়ে দিত। বাবা সাইকেলের সামনে ওকে বসিয়ে নিয়ে ঘুরতে বেরত। শিস দিয়ে গান গাইতে গাইতে সাইকেল চালাত তার বাবা। মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সেই চেনা মানুষটা ধীরে ধীরে কেমন অচেনা হয়ে গেল। মা কত বুঝিয়েছে, ‘যা হয়েছে, হয়েছে; আবার নতুন করে শুরু করো -’

পিঙ্কি সেই চেষ্টাই করেছিল। নতুন করে শুরু করার। নাই বা হল স্বপ্ন সত্যি। সবার স্বপ্ন কী সত্যি হয়! আর এই যে জীবন সেও তো আরেক স্বপ্ন। সেদিন স্বপ্নের ভিতর ছোটনের দাদুর কালো ছোপওয়ালা দাঁতের হাসি দেখে ভয় পেলেও, সত্যি ফুলশয্যার রাতে বরকে ঘরে ঢুকতে দেখে ভয় পায়নি পিঙ্কি। মা’র দেওয়া ড্রেসিং টেবিলের সামনে কোন বসার টুল ছিল না। থাকলেও কি বসত তাতে! খাটের উপর ঝকমকে শাড়ী পড়ে জবুথবু হয়ে বসেছিল সে। বর ঘরে ঢুকতেই সিগারেটের গন্ধটা ঝাপটা মারে নাকে। বিছানায় ছড়ানো ফুলের গন্ধের থেকে সে গন্ধ অনেক তীব্র। গায়ের ব্লেজার, জামা খুলে আলনায় রাখে বর। গলায় নতুন সোনার হারটা স্যান্ডো গেঞ্জির ভিতর থেকে বের করতে করতে পিঙ্কির দিকে তাকায় সে। বলে – ‘জল খাবে?’  

ভয় পাচ্ছে নাকি সে! জিভ কেন শুকিয়ে যাচ্ছে তবে! বরের জন্যই কি সে এ কাজ করছে? হয়তো, হয়তো না। আর মানুষটা তো নিজের জন্য টাকা চাইছে না তার কাছে। কোম্পানি যে এরকম দুম করে উঠে যাবে সে কী জানত! মানুষজন এখন বাড়ী এসে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে, পাওনা টাকা না পেলে জানে মেরে দেবে! এই ঘটনার আগে ত মানুষটা তেমন খারাপ ছিল না, শুধু রেগে গেলে… ওসব কথা থাক। কারো উপরই কোন রাগ নেই তার আজ। ডানদিকে তাকায় পিঙ্কি। ঘড়ির সময় গেছে মিলে। ট্রেন আসছে। আসুক। সেদিন রেসিং বাইকের সাথে যে হাওয়াটা অজান্তে ধেয়ে এসেছিল, আজ নিজেই তার মুখোমুখি হতে চলছে সে।

এখনও গোটা শহরের ঘুম ভাঙেনি। মশারি জড়িয়ে ফুটপাথে শুয়ে ঘুমোচ্ছে কোনো উদ্বাস্তু। ঘুমোচ্ছে অনেক তলা উঁচু এখনও শেষ না হওয়া বিল্ডিংটার শ্রমিকরা। এক একটা মশারির ভিতর অনেকজন করে একসাথে শুয়ে আছে। বাইপাসের ধারে ওয়াসিমের চা-এর দোকান কিন্তু খুলে গেছে। সেখানে বেশ কিছু মানুষের জটলা। ওয়াসিমের প্রথম চা-এর অপেক্ষায় তারা সবাই। তাদেরও অনেকের চোখে ঘুম জড়ানো। হাত দুটো মুখের কাছে এনে গরম ভাপ নিচ্ছে যে ছেলেটি, তাকে অনেকটা বিল্টুর মত দেখতে।  ওর পাশে বসে আছে যে মাঝবয়সী লোকটা, তার হাতে একটা খবরের কাগজ। অন্ধকারে একে ওপরের মুখ দেখতে পাচ্ছে না ভালো করে কিন্তু লোকটা তারমধ্যেও কোন এক অদ্ভুত ক্ষমতায়, চোখের খুব কাছে এনে কাগজটা পড়ছে। শুধু পড়ছে তাই নয়, পড়ে শোনাচ্ছে এবং সবাই চুপ করে তা শুনছে। দূর থেকে দেখলে মনে হতে পারে যেন একদল শিশু ভূতের গল্প শুনতে বসেছে। লোকটা একের পর এক খবর পড়ে যায়। না, বড় কোন খবর সে পড়ে না। কাগজের একেবারে কোণার দিকে ছাপা, সব চেয়ে ছোট অদরকারী খবরগুলো সে এক এক করে পড়ে। ‘অস্ত্র সহ গ্রেপ্তার’, ‘নিখোঁজ কিশোর’, ‘বৃদ্ধার রহস্যজনক মৃত্যু’, ‘দমদমে খুন’, ‘পুকুরে উদ্ধার যুবকের দেহ’, ‘মাদক বিরোধী পদযাত্রা’, ‘মেট্রোয় আবার আত্মহত্যা’। যারা খবর শুনছিল, কোনো খবরেই তাদের মুখের অভিব্যক্তির কোন পরিবর্তন হয় না, একমাত্র বিল্টু ছাড়া। ‘আবারও মেট্রো স্টেশনে আত্মহত্যা। ব্যহত পরিষেবা। নাকাল যাত্রীরা। মেট্রো রেল সূত্রে খবর, বুধবার বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ পার্কস্ট্রীট স্টেশনে দমদমগামী একটি মেট্রোর সামনে ঝাঁপ দেন এক গৃহবধূ। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তাঁর। এর জেরে ময়দান ও দমদমের মধ্যে মেট্রো চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ সূত্রে খবর মৃত পিঙ্কি কর্মকার দমদম নাগেরবাজার সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা। মাস তিনেক আগে কৈখালীর অমিত পালের সাথে বিয়ে হয় তার। কেন আত্মঘাতী হলেন পিঙ্কি? পরিবারের দাবি, বিয়ের পর থেকেই পণের জন্য চাপ দিতে থাকে পিঙ্কির স্বামী এবং শ্বাশুড়ী। টাকা আনতে রাজী না হওয়ায় মার-ধরও করে পিঙ্কিকে…’ বিল্টু আর শুনতে পারেনা। ছিটকে বেরিয়ে আসে বাইরে রাস্তায়। দু-তিন লাইন বাদে অন্য খবর শুরু হয়। ঢিকচিক ঢিকচিক শব্দ করতে করতে, সকালের শিশির মাড়িয়ে চলে যায় রাতভর পার্টি করা বড় লোকের কাঁচ তোলা কালো গাড়ী। আরেকটু হলেই বিল্টুও হয়ত আগামী সকালের কাগজের একটা ছোট্ট খবর হয়ে যেত। মুহূর্ত পরেই ভিতর থেকে ডাক আসে। চা হয়ে গেছে। এ শহরে শোকের জন্য ক্ষণিক নীরবতাও বড় দুর্লভ! বিল্টুর মনে হয়, মাথার ভিতর যেন একটা ড্রিল চালিয়ে দিয়েছে কেউ – কিছুতেই থামছে না। ভিতরে থেকে হঠাৎ হাসির রোল ওঠে।  খবরের কাগজটা একদিনের পুরনো বলে। যারা মরেছে তারা এতক্ষণে আরও একবার মরে গেছে। আরও অনেক কথা। অনেক হাসি। বিল্টু চা খাবে না শুনে একজন জানতে চায় তার সকালে হাগা হয়েছে কিনা। বাকীরা হেসে ওঠে। আরও অনেকক্ষণ এই অত্যাচার চলে। ড্রিলের শব্দটা আরও বাড়লে বিল্টুর চোখদুটো লাল হয়ে যায়। তারপর একসময় চা খাওয়া শেষ হলে, ওই খবরের কাগজ পড়া লোকটা সবাইকে ডাকে। কে কোন তলায় যাবে বুঝিয়ে দেয়। সবাই সার বেঁধে রাস্তা পেরিয়ে ঢুকে পড়ে অনেক লম্বা বিল্ডিংটার ভিতর।

শহরের উপকণ্ঠে জলাভূমি, গাছগাছালি, জীবের বসতি গিলে নিয়ে একরোখা লম্বা গম্বুজের মত মাটি ফুঁড়ে উঠছে যে বিল্ডিং – তার নাম ‘অ্যাটমোস্ফিয়ার’। পাশাপাশি দুটো বিল্ডিং এর ছাদ জুড়ে, শহরের প্রথম আকাশে ভাসমান সুইমিং পুল জন্ম নিচ্ছে সেখানে। সেই ছাদের থেকেও উঁচুতে লম্বা গলা বাড়িয়ে শকুনের মত ওঁত পেতে দাঁড়িয়ে আছে ক্রেনগুলো। আচমকা কোনো শ্রমিক ওপর থেকে পড়ে পেট ভেটকে মরে গেলে, ছোঁ মেরে ক্রেনের লোহার আংটাতে গেঁথে নিয়ে, এক টানে ছুঁড়ে ফেলে দেবে অদূরে ধাপার মাঠে আবর্জনার পাহাড়ে! আটতলার ফ্ল্যাটের জানলা দিয়ে বাইরের লোহার পাইপে পা রাখতে গিয়ে নীচের দিকে তাকায় না বিল্টু। উঁচু উঁচু ফ্ল্যাটবাড়ীতে জানলায় কাঁচ লাগানোর কাজ করে সে এখন। কাঠের পাল্লার বদলে স্লাইডিংই বেশী হয় আজকাল, কোন কোনটায় আবার পুরো দেয়াল জুড়ে কাঁচ। বাইরে রোদের তাপে শহর ঝলসে গেলেও, ভেতরে চব্বিশ ঘণ্টা এসি’র হাওয়ায়, বিন্দু বিন্দু শীতল বাষ্পের আলপনা ফুটে উঠবে সেই কাঁচের দেয়ালে। সূর্য এখনও কুয়াশায় ঢাকা, সকালের রোদ কাঁচের উপর পড়ে অন্ধ করে দেয়নি চোখ। তাই বাইরে দাঁড়িয়ে পার্টনার ছেলেটার পুডিং নিয়ে আসার অপেক্ষা করতে করতে, সামনের কাঁচে নিজের মুখটা দেখতে পায় বিল্টু। ইদানীং সে গোঁফ রাখে, চিবুকে দাড়িও উঠেছে কয়েকগাছি। এখন আর তাকে ছেলেমানুষ বলে হাসতে পারবে না কেউ!  হঠাৎ বুঝি, একঝলক ভেসে ওঠে পিঙ্কির সেই ঠোঁট চাপা হাসি মুখটা সামনের কাঁচে! পা’টা সামলে নেয় বিল্টু কোনমতে। পেটের কাছে দড়ি বাঁধা আছে, এত সহজে পড়বে না সে। পরমুহুর্তেই একটা অদ্ভুত চিন্তা মাথায় আসে বিল্টুর । পিঙ্কি কী যেন বলেছিল! পার্ক-স্ট্রীটে নেমে বাঁদিকে গিয়ে, দুটো না তিনটে মোড়ের পর সেই একটা দোকান। ওই দোকানে বাঁদিকে, হ্যাঁ বাঁদিকেই তো বলেছিল… তবে কি সত্যি, ওইজন্য সে সেদিন পার্কস্ট্রিটে… পিঙ্কি কি শুধু একটা ড্রেসিং টেবিলই চেয়েছিল!

শুভদীপ্ত বিশ্বাস চলচ্চিত্র সম্পাদনা নিয়ে শিক্ষালাভ করেছেন এস আর এফ টি আই, কোলকাতা থেকে। চলচ্চিত্র সম্পাদনার পাশাপাশি নিজ পরিচালনায় নির্মাণ করেছেন কয়েকটি তথ্যচিত্র এবং স্বল্প দৈর্ঘ্যের কাহিনীচিত্র। স্কুল জীবনে কাঁচা হাতের কবিতা লেখা দিয়ে শুরু করে, পরবর্তীতে নাটক, গল্প, চিত্রনাট্য লেখা। আগ্রহ, সামাজিক ভাবে তুচ্ছ,পীড়িত অথচ প্রতিদিন লড়ে যাওয়া মানুষের বর্ণময় জীবনকে দেখা, অনুভব করা। মাধ্যমের ভাষা এবং শৈলী নিয়ে স্বতস্ফূর্ত পরীক্ষা নিরীক্ষায় মেলে আনন্দ। আর্থিক বা অন্যান্য সঙ্গতির অভাবে সিনেমা না হতে পেরে কিছু গল্প লেখার অক্ষরেই থেকে যায় যেমন, কিছু কাহিনী ঝড়ের মত আসে, ঘোরের মধ্যে নিজেই নিজেকে লিখিয়ে নেয় অনুভবের দোয়াত উপুড় করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.