নীতা মণ্ডল

বাসুদেবের ছাত্রছাত্রীদের আজ নেমন্তন্ন। নিজের বিদায়ী অনুষ্ঠানের আয়োজক বাসুদেব নিজেই। অতিথি জনা তিরিশেক। দশ থেকে ষোল-সতেরোর মধ্যে বয়স ওদের। চেহারা রুগ্ন, মলিন এবং হতদরিদ্র। ওদের ফ্যাকাসে চোখে দৃষ্টি শূন্য। ওরা আহত এবং আশাহত। বাসুমাস্টারের চলে যাওয়ার খবরে ওদের চোখের সামনে নেমে এসেছিল অন্ধকার। শোকের প্রাথমিক অভিঘাতটা সম্ভবত সয়ে গিয়েছে।

ঘসঘস করে পা টেনে আসার শব্দ হতেই বাসুদেব সচকিত হয়। তালঢ্যাঙা চেহারাটা ঈষৎ ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে এগিয়ে আসে বাসুদেবের কাছে। পশুপতি। গ্রামের মানুষ, ছেলেমেয়েরা ডাকে ‘পশু’। এ কী অমানবিক সম্বোধন! শুরুতে একথা শুনে বাসুদেব পশুপতির গোটা ক্লাসকে শাস্তি দিয়েছিল। কান ধরে দাঁড় করিয়েছিল সবাইকে। তারপর থেকে বাসুদেব পশুপতিকে ডাকত, ‘পশুরাজ’।

ছেলেটার বাঁ-পায়ে গোদ। মা নেই। কোন ছোটবেলায় মারা গিয়েছে। তারপর থেকে মামার বাড়িতে আগাছার মত বেড়ে উঠেছে। স্বভাবে খামখেয়ালী, খ্যাপাটে। মাধ্যমিকটা পাস করার বড় ইচ্ছে। সেই ইচ্ছেকে লালন করতে বাসুদেব প্রাণ ঢেলে দিচ্ছে শুনেই একদল মাস্টারমশাই হেসেছিলেন। বলেছিলেন, ‘পশুর মাথা নয়, থান ইট। ড্রিল করে ঢুকিয়ে দিলেও কিস্যু হবার নয়।’ রাগে বাসুদেবের কান, মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। বাসুদেবের এই এক জ্বালা। ওর রাগ যেন আগুনের মত। প্রকাশিত হবার সুযোগ না পেলে ওকে ভেতর থেকে পুড়িয়ে মারে। থামাতে পারে না। আর এর থেকে বোধ হয় সারাজীবনে মুক্তিও নেই। চারপাশে রাগিয়ে দেওয়ার মত উপাদানের তো অভাব নেই। ছাত্রদের শাস্তি দিয়েছিল ও, কিন্তু এসব ডিগ্রীধারী মূর্খ অহঙ্কারী মানুষদের কী করে মানবিকতার শিক্ষা দেবে?

বাসু টেনে নিয়েছিল পশুপতিকে। পরপর দুবছর অকৃতকার্য হয়েছে ছেলেটি। তবুও বাসুমাস্টার লড়ে যাচ্ছিল। লড়ছিল পশুপতিও। না বুঝে মুখস্ত করে, মাস্টারের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধায় বিগলিত হয়ে, তাঁর সেবাযত্ন করে, যত ভাবে সম্ভব।

এপথে আসতে যেতে দুবেলা মাস্টারের খবর নিতে কোন দিন ভুল হয় না ওর। মাস্টারমশাই কী খাবে, রাঁধুনি মহাদেব হাজির কিনা, সে খবর নিয়ে যায় দুইবেলা। যোগান দেয় লাউ, কুমড়ো, পুঁই, কচু। বলা বাহুল্য, সেসব ওর মামার বাড়ি থেকে আসে না। গ্রামের সবার কাছ থেকেই সংগ্রহ করে বাসুমাস্টারকে দেয় ও। বাসুর ধমক-ধামকে থামে না। কতগুলো ছেলেমেয়েকে বিনা পয়সায় পড়ানো মানুষকে গুরুদক্ষিণা স্বরূপ এটুকু দিতে অস্বীকার করার ক্ষমতা পাগলা পশুপতির সামনে কারোর হয় না। সেই প্রথম দিকের কথা। বাসুদেব স্নান করে বেরিয়েছে, খেতে মিনিট দশেক দেরি। উঠোনে ধুপ করে শব্দ হতে বাসু দেখেছিল দুটুকরো কাঁচা মাছ কাগজের ঠোঙ্গায় ভরা। মহাদেব বলেছিল, নির্ঘাত পশুর কাজ। পরে জানা গিয়েছিল তাড়াহুড়ো ছিল বলে ভেতরে আসে নি, পাঁচিলের ওপার থেকে ছুঁড়ে দিয়েছে।

সেই পশুপতি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে বাসুমাস্টারের দিকে। ভালো করে দেখলে বোঝা যায়, ওর চোখের কোণগুলো চিকচিক করছে। বাসুদেবের দীর্ঘশ্বাস পড়ে, পশুপতিকে মাধ্যমিক পাসটা করিয়ে যাওয়া হল না।

পশুপতির পর একে একে জুটেছে আরও কয়েকজন। ওরা বাসুদেবের প্রাণ। বাসুদেবের মধ্যে ওরা রক্তকণিকার মত ছড়িয়ে আছে, অথবা বাসুদেব নিজেই শতধা হয়ে আছে ওদের সবার মধ্যে। বাসুদেবের বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, এরা সবাই একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। শিক্ষক হিসেবে বাসুদেব নিভন্ত প্রদীপে অগ্নি সংযোগ করার চেষ্টা করেছে এতদিন। সে চেষ্টা নিশ্চয় ব্যর্থ হবে না। তবে পথ যে মসৃণ নয়, সে কথা ওর চেয়ে ভালো আর কেই বা জানে! সকলের মাথা উঁচু করে বাঁচার অধিকার থাকলেও ক’জন পারে? তার জন্য যে নিরন্তর সংগ্রাম করতে হয়। সংগ্রাম করলেই কি জয় হয়? কতজনের হয়? সেই সংঘর্ষের পথে পাশে একজন এসে দাঁড়ালে দশজন পেছন থেকে টেনে ধরে। সেই দশজন তো ওই একজনের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। তাই যদি না হবে, তাহলে কেনই বা অসময়ে এত সাধের চাকরি আর কলজের টুকরো এসব ছেলেমেয়েদের ছেড়ে চলে যাবে বাসুদেব!

জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে নিচ্ছে দ্রুত হাতে। জিনিস বলতে কয়েকটা জামাপ্যান্ট, বেশ কিছু বই আর যৎসামান্য বাসনকোসন। বাসনপত্র মহাদেব নিয়ে যাবে। মহাদেব এতদিন ওর দেখাশুনো করেছে। বধির, দুর্মুখ, বিপত্নীক মানুষটাকে ওর কাছে কাজে পাঠিয়ে দিয়েছিল বিশ্বনাথবাবু। তার পেছনে যে খানিকটা র‍্যাগিং করার উদ্দেশ্য ছিল, তা পরে বুঝেছিল বাসুদেব। শুরুতে মহাদেবের গালাগালি আর চিৎকারে বাসুর অবস্থা হয়েছিল প্রাণান্তকর। অসুখী, হতাশ মানুষটাকে পাড়ার ছেলেরা উঠতে বসতে খেপাত। মহাদেব তারস্বরে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি দিত। বাসুদেব থামাতে পারত না। একদিন বদ্ধকালা মানুষটাকে নিয়ে হাজির হয়েছিল বর্ধমানে। ডাক্তার দেখিয়ে, কানের যন্ত্র কিনে দিয়েছিল। ক্রমে সেই মহাদেব বাসুদেবের অভিভাবক হয়ে ওঠে। ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে বাসুদেবের পরিবার বড় হয়। মুখঝামটা দিলেও সেই পরিবার মহাদেবের তত্ত্বাবধানেই চলে এসেছে এতদিন।

কয়েকটা পুরনো আর মলিন বই ব্যাগে ভরে বাসুদেব। এসব বই শুধু বই নয়, ওর জীবনের পথে উত্তরণের সিঁড়ি। ওর মাস্টারমশাইদের আশীর্বাদ। ওর জীবনের বুনিয়াদ। ওর মাস্টারমশাইরাও কি এরকম ছিলেন? এই যে বিশ্বনাথবাবু, পার্থসারথিবাবুর মত? সংকীর্ণ, নীচ! মাছি তাড়ানোর মত জোর করে চিন্তাটাকে সরিয়ে দেয় বাসুদেব। ওর কাছে ট্রাঙ্ক ভর্তি বই। সব ও নেবে না সঙ্গে। বেশ কিছু পাঠ্যবই ছাড়াও ওর নিজের সংগ্রহের বইগুলো বিলিয়ে দিল ছেলেমেয়েদের। প্রশান্তবাবু যেমন বই দেওয়ার আগে কোনও বিখ্যাত পঙক্তি লিখে দিতেন, সেরকম ও লিখতে গেল। কী লিখবে? ‘বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে!’ পেন থমকে গেল ক্ষণিকের জন্যে, মুহূর্তেই ওর আঙুল সচল। লিখল ‘ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো’।

পশুপতি হঠাৎ রেগে গিয়ে দেওয়াল থেকে একটা পোস্টার টেনে ছিঁড়ে প্রচন্ড রাগে ছুঁড়ে দিল অন্ধকারকে লক্ষ করে। বাসুদেবের দেওয়াল জুড়ে নানা রকমের পোস্টার সাঁটানো। বেশিরভাগই এই ছেলেমেয়েদের হাতে তৈরি। পশুপতি যেটা ছিঁড়ল সেটা টাইমটেবিল। সপ্তাহে ছয়দিন দু’বেলা ওদের পড়ার তালিকা। ওরা দু’বেলাই পড়তে আসত। সবাই যাতে সবক’টা বিষয় এখানেই পড়তে পারে, সেই হিসেবে তৈরি। এমন অদ্ভুত তালিকা একমাত্র বাসুমাস্টারের পক্ষেই প্রস্তুত করা সম্ভব। এছাড়াও বাসুর একটি গোপন ডাইরি আছে, সেকথা ছেলেমেয়েরা জানে না। তাতে ক্ষমতা অনুযায়ী কে কতক্ষণ কী বিষয় পড়বে সেসবও লেখা আছে। সবার দিকে ওর সজাগ দৃষ্টি। ছেলেমেয়েগুলো যে অবস্থায় আছে তার চেয়ে উন্নত অবস্থায় পৌঁছে দেওয়াই ওর একমাত্র লক্ষ।

ছেলেমেয়েগুলি ওদের পরিবারে প্রথম সাক্ষর প্রজন্ম। দুবেলা খাবার জোটাতে নাভিশ্বাস ওঠে ওদের বাবামায়ের। যেকোনো দিন ওরা পড়া ছেড়ে দিয়ে রোজগার করতে বের হতে পারে। বাধ্য হতে পারে খুঁটে খাওয়ার জীবন বেছে নিতে। বাসু তা মানতে নারাজ। নিজের ছোটবেলার কথা ভাবে। ভাবে, ও যদি পারে, ওর ছাত্রছাত্রীরা কেন পারবে না? বিগত কয়েক বছরে এই ছেলেমেয়েগুলোর পড়াশুনোর উন্নতি দেখে টিউশনি পড়ানোর অনুরোধ এসেছিল প্রচুর। ও সে পথে হাঁটে নি। তাতে মানুষের ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছে। রাগে ঈর্ষায় জ্বলেছে ওর সহকর্মীরা। ব্যঙ্গার্থে ওর নামকরণ করেছে ‘বিদ্যাসাগর’।

একদিন অগ্রজ সহকর্মী রামকিঙ্করবাবু চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছিলেন, ‘তা বিদ্যাসাগর মশাই, আমার মেয়েদুটিকে যে আপনাকে উদ্ধার করতে হবে! অঙ্ক আর ইংরাজি দেখাতে হবে। মাইনে কড়কড়ে পাঁচশ।’ অনুরোধ নয়, প্রস্তাব নয়, একেবারে সোজা আদেশ। টাকার অঙ্কটা ইচ্ছে করেই পাঁচজনের সামনে বলা। বাসুর পক্ষে ‘না’ বলা সম্ভব হয় নি। রামকিঙ্করবাবু স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক। দাপট প্রধান শিক্ষকের চেয়েও বেশি। বয়সে বড়, তদুপরি ইস্কুলটাকে তিনি পৈত্রিক সম্পত্তি বলে মনে করেন। প্রথমদিনই বাসু বুঝেছিল, এঁর মুখ থেকে উচ্চারিত শব্দ বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নেওয়া এখানকার অলিখিত নিয়ম। সেই প্রথমদিনের কথা আজ আরও একবার ছবির মত ভেসে ওঠে বাসুদেবের চোখে।

সন ১৯৯৯। সদ্য শুরু হয়েছে স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষক নিয়োগের নিয়ম। বাসুদেবের মত ছেলের কাছে যাত্রাপথটা যেন হঠাতই সহজ হয়ে গিয়েছে। এমএসসি পাস করে বিএড করতে করতে এসএসসি পরীক্ষায় বসে ও। ফর্ম পূরণ করার সময় প্রশান্তবাবুর কাছে গিয়েছিল। যেমন চিরকাল গিয়েছে। ওঁর মত অভিভাবক আর বড় হিতাকাঙ্ক্ষী আর কেই বা আছে বাসুদেবের! অবসর গ্রহণ করলেও প্রশান্তবাবুর সবদিকেই সজাগ দৃষ্টি। ফর্মে কোন অঞ্চলকে বাসুদেব অগ্রাধিকার দেবে, সে পরামর্শ উনিই দেন। বাসুদেব প্রথম সুযোগেই সাফল্য পায়। না পাওয়ার কারণ ছিল না। সেই মাধ্যমিক থেকে শুরু করে সব পরীক্ষায় রেকর্ড নম্বর নিয়ে পাস করেছে ছেলেটা। জয়েন্ট এন্ট্রাসে ভালো ফল করেও ইঞ্জিয়ারিং না পড়ে মাস্টারি করার ভূত বহন করেছে ঘাড়ে। সেজন্যই পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশুনো। চিরদিন ছেলেটা নিজের লক্ষে স্থির।

ক্রমে স্বপ্নপূরণের দিকে বাসুদেব এক ধাপ এগিয়ে যায়। একদিন চাকরির চিঠি আসে। বীরভূম জেলার একটি গ্রামের মাধ্যমিক স্কুল। বোলপুরেও থাকা যায়, সিউড়িতেও। অজানা অচেনা জায়গার প্রতি বাসুদেবের জড়তা কবেই কেটে গিয়েছে। বরং আগ্রহ বেড়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একদিন বাক্সপ্যাঁটরা বগলে হাজির হয় কর্মস্থলে। প্রথমে ট্রেনে মেচেদা থেকে হাওড়া। তারপর হাওড়া থেকে বোলপুর। বোলপুর থেকে ঘণ্টা খানেক বাসে। বাস থামে একটা ঝাঁকড়া বটগাছের গোড়ায়। খরুই মোড়। ওর জন্যে একজন স্কুটার আরোহী অপেক্ষা করছিল। সেক্রেটারি গোপীমোহন চৌধুরী পাঠিয়েছেন। স্কুটার দুপাশের ধান খেতের মাঝে আঁকাবাঁকা সরু মোরামের রাস্তা ধরে যখন এগোচ্ছিল, বাসু ভাবছিল প্রশান্তবাবুর কথা। ওঁর মুখ থেকে বারবার শোনা, ‘স্বদেশে পূজ্যতে রাজা, বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে’। অবশেষে এক ছায়াসুনিবিড় গ্রাম। গ্রামের একেবারে কেন্দ্রে, লোকালয়ের ভেতরেই স্কুল। প্রায় বর্গাকার দোতলা বিল্ডিং। তিনতলায় ঘরদুটি বন্ধ। তবে মন্দিরের চূড়ার মত ওরা স্কুলের অস্তিত্ব জ্ঞাপন করে। স্কুলের পেছন দিকে অজয় নদ। একটা ছোট গেট থেকে চওড়া চওড়া সিঁড়ি নেমে গিয়েছে নদীতে।
অভ্যর্থনা মন্দ হয় না। বাসুর কাজে যোগ দেওয়াকে উপলক্ষ করে দুপুরে স্কুলেই খাওয়াদাওয়া হয়। এরকম নাকি ছুতোনাতায় হয়েই থাকে। গোপীমোহন চৌধুরী বেরিয়ে যান বাসু কাজে যোগ দেবার পরই। স্কুল ঘুরে দেখতে চাইলে প্রধান শিক্ষকমশাই বাসুদেবকে রামকিঙ্করবাবুর কাছে পাঠিয়ে দেন। রামকিঙ্করবাবু পার্থসারথি আর তারাপদ চৌধুরীকে ডাকেন। ওরা দু’জন দায়িত্ব নেয় বাসুদেবকে স্কুলের সঙ্গে পরিচয় করানোর।

স্কুল সহ গ্রামের ইতিহাস জেনে যায় বাসুদেব। সেক্রেটারি গোপীমোহন চৌধুরী, সহকারী প্রধান শিক্ষক রামকিঙ্কর চৌধুরী সহ এরা দুজন একই পরিবারের বিভিন্ন শাখার সদস্য। চৌধুরী পরিবারের সদস্য ছাড়া বেশিরভাগ শিক্ষক এই গ্রাম বা সংলগ্ন গ্রামগুলির বাসিন্দা। অন্তত এই জেলারই মানুষ তাঁরা। বাসুদেব সেই অর্থে প্রথম বহিরাগত শিক্ষক। তাই কতখানি দায়িত্ববোধ বা মমত্ববোধ এই স্কুল নিয়ে তার থাকবে এ নিয়ে ম্যানেজিং কমিটিসহ শিক্ষকরাও প্রত্যেকে চিন্তিত।

বাসুদেব বলে, ‘সে আমার কাজেই প্রমাণ পাবেন।’

ওর কথায় আমল না দিয়ে তারাপদ চৌধুরী জানান, ওদের প্রপিতামহ কিশোরীমোহন চৌধুরী এই স্কুলের জমি দান করেছিলেন। তাঁর ছেলেরা যথাক্রমে রামকিঙ্কর, পার্থসারথি ও তারাপদ চৌধুরীর ঠাকুরদা। ওঁরা তৈরি করেছেন এই বিদ্যালয়টি। স্কুলের নামটি তাই ওঁদের প্রপিতামহী অনিলাদেবীর নামে। কিশোরীমোহন চৌধুরী মুর্শিদাবাদ থেকে এখানে আসতেন ব্যবসা করতে। তারপর অজয়ের ধারে উর্বর জমি কেনা তাঁর নেশায় পরিণত হয়। দুশো বিঘের উপর জমি কেনার পর তিনি এই গ্রামেই পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন। ক্রমে তাঁর সম্পত্তি আরও বাড়ে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে প্রতিপত্তি। তারপর একদিন প্রায় অলিখিত জমিদার হয়ে বসেন এই গ্রামে। গ্রামের উন্নতিতে অনেক দানধ্যান করেছেন। স্কুল ছাড়াও গ্রামের কালভৈরবের মন্দির ওঁরই তৈরি।

কিশোরীমোহনের ছেলেরা বাবার মতই করিৎকর্মা। তবে বাবার মৃত্যুর পর ওঁরা নিজের নিজের সাম্রাজ্য অর্থাৎ ব্যবসা বিস্তার করেছিলেন। কেউ কয়লা ও কাঠের ব্যবসা, কেউ ইটবালির, কেউ আবার ধানচালের। কথা বলতে বলতে ওরা বাসুদেবকে গ্রাম দেখায়। রাস্তার একদিকে আধুনিক রংচঙে দোতলা পাকা বাড়িগুলি চৌধুরীদের বর্তমান বসতবাড়ি আর উল্টোদিকে ওদের পুরনো পৈত্রিক বাড়ি। উঁচু উঁচু বাড়িগুলোর দেওয়ালগুলো রংচটা, মলিন। জায়গায় জায়গায় বেরিয়ে আছে ক্ষয়প্রাপ্ত ইট। একেকটা দেওয়াল জুড়ে মাকড়সার জালের মত শেকড় ছড়িয়েছে গাছপালা। বহু আগে থেকেই এসব বাড়ি বসবাসের অযোগ্য। তবুও সেগুলো আছে পারিবারিক ঐতিহ্য ও অহংকারের সাক্ষী হয়ে।

একটা জায়গায় এসে পার্থসারথি থামে। উপরের দিকে নির্দেশ করে বলে, ‘আমাদের দাদুদের মধ্যে একসময় নিজের বড়লোকি দেখানোর খুব প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল। আমাদের ছোটদাদু মানে আমার ঠাকুরদা ঠিক করেছিলেন মাটিতে পা দেবেন না। তাই বসতবাড়ি থেকে ঠাকুরবাড়ি যেতে সাঁকো তৈরি করেছিলেন। এই সাঁকো তিনতলার সমান উঁচু। ওদিকে ওদের বড়ভাই অর্থাৎ রমাপদবাবুর ঠাকুরদার ছিল হাতি পোষার শখ। ঘোড়া তো ওদের সবার ছিল। হাতি একটা অন্যরকম ব্যাপার, মারুতির পাশে মার্সিডিজের মত।’ তারপর ভাঙ্গাচোরা আস্তাবলে বাসুকে নিয়ে যায়। মোটামোটা রেলিঙঘেরা খোপগুলোয় বড় বড় তালা ঝুলছে। জং ধরা, বিচ্ছিরি গুমোট জায়গা। বাসুদেবের কেমন দম আটকে আসে।

ওর বুঝতে অসুবিধা হয় না, আজও এই পরিবার কেমন গোটা গ্রামে অলিখিত প্রভাব বিস্তার করে আছে। স্কুল সার্ভিস কমিশন শুরু হওয়ার আগে এদের পরিবারের ছেলেরাই চাকরি পেয়েছে। কেউ বিএ, কেউ বিএসসি, কেউ পাসকোর্সে পাস করেই ঢুকে গিয়েছিল। এর মাঝে যতজনের সঙ্গে দেখা হয়েছে, সবাই সসম্ভ্রমে রাস্তা ছেড়ে দিয়েছে ওদের। বাসুদেব বুঝতে পারে না, এ চৌধুরীবাড়ির সদস্যদের সামাজিক প্রভাবের ফসল, নাকি মাস্টারমশাইদের প্রতি সম্মান। ‘বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে’ কথাটা কি তবে সত্যি?

বছর তিনেক পেরিয়ে গিয়েছে। সামগ্রিক চিত্র ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়েছে ওর সামনে। যে সচ্ছলতার ছবি এই গ্রামে ও প্রথমদিন দেখেছিল, তা কেবল উপর উপর। দুধের উপর সরের মতো, একটুখানি। বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ বাস করে এই গায়ে গায়ে লেগে থাকা গ্রামগুলিতে। একদল শৌখিন, স্বাস্থ্যবান, ধনী, সুসজ্জিত। অন্যদল হতদরিদ্র, রুগ্ন, অভাবী ও অচ্ছুৎ। তাদের পল্লী আলাদা। প্রথমদিন যে ধারণা জন্মেছিল, তা ভেঙ্গেচুরে গিয়েছিল ছাত্রছাত্রীদের সংস্পর্শে আসতেই।

বাসুদেব এই গ্রামেই থাকতে শুরু করেছিল। স্কুলের সংলগ্ন একটি আধপাকা আধকাঁচা বাড়িতে। নীচে দুটো আর উপরে একটা ঘর। সিঁড়ি নেই, মই বেয়ে উঠতে হয়। স্কুলেরই সম্পত্তি। পনের-বিশ বছর আগে কয়েকজন মাস্টারমশাই মেস করে থাকতেন ওখানে। পরে গ্রামের মাস্টারমশাইরাও শহরে গিয়ে থাকতে শুরু করেছেন। বাসুদেব ভেবেছিল, এখানে থাকলে ছেলেমেয়েদের অনেক বেশি সাহায্য করতে পারবে। ওর ছোটবেলার মাস্টারমশাই সুকান্তবাবু বলতেন, ‘শিক্ষক হল সমাজের মূল স্তম্ভ। তাঁর ডিউটি শুধু স্কুল প্রাঙ্গণেই সীমাবদ্ধ থাকে না। তাঁর হাতে কত বড় দায়িত্ব! মানুষ তৈরি করার মত কাজ কি আর দশটা পাঁচটার গণ্ডীতে বাঁধার মত কাজ? যার দশটা পাঁচটার কাজ দরকার, সে আর যাই করুক, যেন শিক্ষকতা না করে।’ সুকান্তবাবু, প্রশান্তবাবু এঁরা যে শিক্ষা দিয়েছেন তা ঠিক বাসুদেব ছড়িয়ে দেবে ওর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে।

বেশ কয়েকটি গ্রামের ছেলেমেয়েরা পড়তে আসে এই স্কুলে। আশপাশের গ্রামগুলোর এখানকার মত কোনও ইতিহাস নেই। প্রায় সব গ্রামের মানুষই খেটে খাওয়া মানুষ। কেউ কেউ একেবারে নুন আনতে পান্তা ফুরনো।

বাসুদেব ভোরবেলা উঠে অজয়ের পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় সোনাঝুরির বন পর্যন্ত। আসতে যেতে পরিচয় গড়ে উঠে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে। কেউ লাঙ্গল নিয়ে জমিতে যায়, কেউ জাল নিয়ে পুকুরে, কেউ যায় গরুর পাল নিয়ে। কেউ ইটভাটায় মজুরি খাটতে। ওরা বাসুদেবের খবর নেয়। বাসুদেবও ওদের খবর নেয়। কার ক’টি ছেলে মেয়ে, ক’জন স্কুলে আসে, কে আসে না। কে কোন ক্লাস থেকে পড়া ছেড়ে দিল। সব খবর ওর জানা।

ওদের বাড়িতে দেখার কেউ নেই, তাই বাসুদেব ডেকে নিয়েছিল ওদের। শুধু একটুখানি পথ হাত ধরে এগিয়ে দেবে বলে। একে-একে জনা তিরিশেক কোনো না কোনো ভাবে বঞ্চিত, কোণঠাসা ছেলেমেয়ে আশ্রয় পেয়েছিল বাসুদেবের স্নেহছায়ায়।

বাসুদেবের অজ্ঞাতে গুঞ্জন শুরু হয়েছিল, বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল বের হতেই। যাদের পড়াশুনো ছেড়ে দেওয়ার কথা, তাদের অভূতপূর্ব উন্নতি দেখে কেউ কেউ চিড়বিড়িয়ে উঠেছিল – ‘মাস্টারি করতে এসেছ মাস্টারি কর। মাইনে নাও, শখ মেটাও। সমাজসংস্কারের ভূত মাথা থেকে বের করা দরকার। তুমি কী পাবে এদের কাছে? উলটে এরাই দেখবে একদিন তোমার-আমার ছেলেমেয়েদের ঘাড়ে চাপবে। আর তাছাড়া পায়ের জুতোকে মাথায় তুললেই কি আর সে রাজমুকুট হয়? জুতোর যেখানে জায়গা সেখানেই রাখো না বাপু।’ পার্থসারথি চৌধুরী বলেছিল। যে একদিন বাসুদেবকে নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল, ভিন জেলার ছেলের কি সত্যি মায়ামমতা থাকবে স্কুল নিয়ে, গ্রাম নিয়ে?

কথাগুলো বাসুদেবের গায়ে আগুনের ছেঁকার মত লাগে। চোয়াল শক্ত হয়। ওরা জানে, বাসুদেব সমাজের তলানির জাতিভুক্ত। যদিও সংরক্ষণ ছাড়াই এই চাকরি সে অনায়াসে পেতে পারত, তবুও জাতি পরিচয় তার জন্মগত। তা অস্বীকার না করে তার প্রতিনিধিত্ব করারই পক্ষপাতী সে। ওরা কি ইচ্ছে করেই বলে একথা? কী হবে জেনে! এই লাঞ্ছনা বুকে লালন করে শুধু ক্ষতিই হয়। এক কান দিয়ে ঢোকা কথা অন্য কান দিয়ে বের করে দিতে চায়। তবুও রাগ পুঞ্জীভূত হয়। রাগের মধ্যেও বুঝি শক্তি আছে। নাহলে আগ্নেয়গিরির মত ফেটে বেরিয়ে আসতে চায় কেন? বাসুদেব সেই শক্তিকে প্রাণপণে সৃষ্টির কাজে লাগাতে চায়। ধ্বংস কোনও ভাবেই কাম্য নয়। তাই নিজের কাজে নিমজ্জিত করে নিজেকে। সম্পূর্ণরূপে উজাড় করে দিতে চায় ওর অর্জিত বিদ্যা।
স্টাফরুমে বসে না, লাইব্রেরীতে যায়। টিফিনের সময় চলে যায় মেসে, ভাত খেতে। জানতে চায় না কী আলোচনা হয় স্টাফরুমে। শুধু জানে স্কুলের উন্নতি, ছেলেমেয়েদের উন্নতি নিয়ে কোনও কথা হয় না। গল্প আড্ডা হয় মূলত চৌধুরীবাবুদের ধনসম্পত্তিকে কেন্দ্র করে। ওঁদের প্রপিতামহের ঐশ্বর্য প্রদর্শনী চতুর্থ প্রজন্মেও বহমান। একথা বাসুদেব খুব অল্পদিনেই বুঝে গিয়েছিল। রমাপদ চৌধুরী গল্প করেন, তাঁর তিন কন্যার জন্যে দেড় কেজি করে সোনা রেখেছেন। পার্থসারথি সুযোগ পেলেই সরকারকে গালাগালি দেয়। তাদের সোনা ফলানো কয়েক শত বিঘে জমি বর্গা হয়ে গিয়েছে সরকারের কবলে। এত অপ্রাসঙ্গিক কথা আর কত শুনবে বাসুদেব! তবু একদিন কানে চলেই আসে ওদের আলোচনা।

আলোচনা স্টাফরুমে নয়, প্রধান শিক্ষকের অফিসে। মিটিং শুরু হবে। যে কোনও মিটিংয়ের আগে একটি আনঅফিসিয়াল মিটিং হয়। সে মিটিঙের সদস্য মুষ্টিমেয় বিশেষ ক’জন। সেদিন ওই বিশেষ মিটিং শেষ হবার আগেই বাসুদেব পৌঁছে যায়। ভেতরে আলোচনা হচ্ছে বাসুদেবকে নিয়েই – ‘ভিকিরি বাড়ির ছেলে। জাতে মুচি। বাবার সম্পর্কে তেমন কিছু তো জানা যায় না। মা লোকের বাড়িতে মুড়ি ভাজত, বাসন মাজত। সোজা কথায় ঝি। তো তার রুচি ওই ছেলেমেয়েগুলোর প্রতি হবে না তো কি এই চৌধুরীবাড়ির ছেলেমেয়েদের দিকে হবে? কথায় বলে না, শকুন যত উপরেই উড়ুক না কেন, নজর ঠিক ভাগাড়ের দিকেই।’

বাসুদেবের পায়ের তলার মাটি সরে যায়। হঠাৎ মনে হয় গায়ে যেন শক্তি নেই। কী করে এখানে টিকে থাকবে ও? ছিঃ ছিঃ। ছোটখাট ঈর্ষা, টিপ্পনি না হয় উড়িয়ে দেওয়া যায় তাই বলে এভাবে! ওর কাজ, পড়ানো, শিক্ষাদীক্ষার কোনও মূল্য নেই এদের কাছে?

বাসুদেব ফিরে এসেছিল। পিয়ন দুলালকে বলে এসেছিল ওর শরীর ভালো নেই। বাসুদেব জানত না, অপমানের এখানেই শেষ নয়।

দুপুরভর নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে শান্ত মনে সন্ধ্যেবেলা রামকিঙ্কর বাবুর দুইমেয়েকে পড়াতে গিয়েছিল। পড়াতে পড়াতেই কানে আসে রামকিঙ্কর বাবুর স্ত্রীর কর্কশ কণ্ঠস্বর। ওর কাজের মেয়ে বাসুর চায়ের কাপ নিয়ে পড়ার ঘর থেকে বেরিয়েছে। ‘এই কাপে চা দিতে তোকে কে বলেছিল? তিন কাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, তুমি জান না মাস্টারের চায়ের কাপ আমাদের বাসনের সঙ্গে ঠেকানো হয় না!’

বাসুদেব আর কিছু ভাবতে পারে নি। রাগে অন্তরাত্মা জ্বলেপুড়ে ছারখার। উত্তপ্ত মাথায় আর বিচার করতে পারে না যে এবার রাগের শক্তিকে সে ভালোর দিকে সত্যিই ঢেলে দিল কিনা! বাসুদেব একেবারে স্থির করেই নিল এখানে সে কিছুতেই থাকবে না। এ রকম অহঙ্কারী, মূর্খ একদল মানুষের সঙ্গ ওর বিষময় লাগে। সেই বিষময় মুখোশ পড়া মানুষগুলো ছাড়াও একদল কচি কচি নিস্পাপ মুখ যে কোথায় চাপা পড়ে গেল, বাসুদেব ভাবল না।

পুনরায় প্রস্তুতি নিতে শুরু করল। আবার বসল এসএসসি পরীক্ষায়। চাকরি পেল নিজের জেলায়।

বাসুদেবের মমতামাখা হাতের স্পর্শে পশুপতি শান্ত হয়েছে। বাসুমাস্টারের জিনিসগুলো এগিয়ে দিচ্ছে ওরা। কালো চামড়ায় বাঁধানো মোটা গ্রামার বইটি হাতে নিয়ে পাতা উল্টোয় বাসুদেব। বিবর্ণ একটি লাইনে হাত রেখে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। প্রশান্তবাবুর ছবি ভেসে ওঠে সামনে। মাস্টারমশাই তিন চারটে বই নিয়ে ক্লাসে আসতেন। শুরুতেই এমন গল্পের জাল বুনতেন যে ছেলেমেয়েরা আটকে যেত সেই মায়াজালে। তারপর গ্রামারের শক্ত শক্ত নিয়মগুলো সুচারুভাবে ঢুকিয়ে দিতেন মস্তিষ্কের ভেতর। বাসুরা যখন ক্লাস সেভেন, বললেন, ‘যে আশির উপর পাবি, তাকেই পুরস্কার দেব।’ সবাই জান-প্রাণ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। একেবারে ন’জন ছাত্রছাত্রী পেল পুরস্কার। একটি করে গ্রামার বই, সারাজীবন কাজে লাগবে। ওই গ্রামাঞ্চলের ছাত্রছাত্রী, যারা প্রথম প্রজন্ম স্কুল যাচ্ছে, ইংরাজিতে হাতেখড়ি হয়েছে সিক্সে ওঠার পরে, তাদের গ্রামার গুলে খাইয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব প্রশান্তবাবুকে আলাদা করে দিতেই হয়। এছাড়া ছিল তাঁর স্বপ্ন দেখানোর ক্ষমতা। চারিদিকে সজাগ দৃষ্টি। পুরষ্কারের বই হাতে তুলে দেবার আগে, অতি যত্নে দুটি করে লাইন লিখে দিলেন বইয়ের পাতায়। ‘স্বদেশে পূজ্যতে রাজা, বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে’। লাইন নয়, যেন বীজমন্ত্র। বাসু কতদিন মনে মনে জপ করেছে সেই মন্ত্র! প্রশান্তবাবু ক্লাস টেনের পর বাসুদেবকে আবাসিক বিদ্যালয়ে ভর্তি না করে দিয়ে আসলে আজ বাসুদেব কোথায় থাকত কে জানে! ওঁর ঋণ বাসুদেব কোনোদিন শোধ করতে পারবে না। মাস্টারমশাই বলেন, ‘ঋণ শোধ করার কি একটাই পথ? তুই কারোর কাছে পেলি, তুইও কাউকে দে না। হয়ে যাবে শোধবোধ। এই ব্রহ্মান্ডের জিনিস এখানেই থাকবে।’

বাসু তো দেবে বলেই এসেছিল। তাহলে কি বাসুর কোথাও ভুল হয়ে গেল? হঠাৎ দোলাচলে পড়ে বাসু। সেই রাগের আগুন বোধ হয় এত দিনে নিভে এসেছে। এই ছেলেমেয়েগুলোর যে লাঞ্ছনা বঞ্চনা তা এদের চিরকাল বয়ে বেড়াতে হবে। বাসুদেব ভাবত কঠিন পথটুকু পেরিয়ে গেলেই বুঝি তার শেষ হয়। কিন্তু তা তো হল না। কিছুই তো আলাদা নয়। নিজের বাড়ি থেকে এত দূরে এসেও দেখল চিত্রটা একই। এ সমাজে, আজও জাতি, ধর্ম, বর্ণের মূল্য শিক্ষাকেও ছাড়িয়ে যায়। ‘বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে’ আসলে একটি নির্মম ঠাট্টা।

মহাদেব কর্কশ কণ্ঠে ডাক দেয় ছেলেমেয়েদের। খাবার জায়গা করতে বলে। গরম ভাতের গন্ধ এতক্ষণে নাকে আসে বাসুদেবের। সেই ছোটবেলার মত মুখের ভেতর লালাসিক্ত হয়। ফিরে আসে আগ্রাসী খিদে। দু-তিন দিন পর হঠাৎ চাল জোগাড় হলে মা যখন ভাত রাঁধত এমনই লালাক্ষরণ হত মুখের ভেতর।

বাসুর পাততাড়ি গোটানো শেষ। চওড়া ম্যাপের বইটা সুটকেসের উপর রেখে ডালা বন্ধ করে। ম্যাপের বইটিও আর একজন শিক্ষকের দেওয়া উপহার। ভূগোলের মাস্টারমশাই নির্মল পাত্র মাধ্যমিকে লেটার পাওয়ার জন্য দিয়েছিলেন। বাসুদেবের সামনে ভেসে ওঠে, মা মাস্টারমশাইয়ের উঠোন পরিষ্কার করছে, বিনিময়ে মাস্টারমশাই ম্যাপ পয়েন্টিং শেখাচ্ছেন। বাসুদেব মাস্টারমশাইয়ের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে মাটিতে বসেছে। মাস্টারমশাই তিন হাত দূরে কম্বলের আসনে। ওঁর স্ত্রী থেকে থেকে দেখে যেতেন, ছোঁয়া লেগে গেছে কিনা! অপমানে অভিমানে সেদিনও চোয়াল শক্ত হতো কিন্তু ভাবত, এ আসলে বন্ধুর পথ। কষ্ট করে পরিশ্রম করে অতিক্রম করলেই সব সুন্দর, সব সুখের। মাস্টারমশাই ওকে নব্বইয়ের উপর নম্বর পেতে দেখে নিজের বইটাই দিয়েছিলেন! বাসুদেব বলেছিল, ‘কিছু লিখে দিন।’

নির্মলবাবু লিখে দিয়েছিলেন ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে।’

এই গান ওরা ছাত্রছাত্রীরাও রোজ গায়, প্রার্থনা সঙ্গীত।

খাওয়া শেষ ফিরবে ওরা। বাসুদেবের সঙ্গে এই ওদের শেষ সাক্ষাৎ। কাল ভোর থাকতেই বেরিয়ে পড়বে। ফার্স্ট বাসে না গেলে বিশ্বভারতী ফাস্ট প্যাসেঞ্জার ধরতে পারবে না। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বাসুদেব নেমে আসে উঠোনে। হঠাৎ ওরা বৃত্তাকারে ঘিরে ফেলে বাসুদেবকে।

চৌধুরীবাড়ির মাস্টারমশাই রামকিঙ্করবাবু তাঁর ছাদের বিলাসকক্ষে মদ্যপান করতে করতে শুনতে পান ‘নয়নের দৃষ্টি হতে ঘুচবে কালো, যেখানে পড়বে সেথায় দেখবে আলো।’
বিড়বিড় করে বলেন, ‘নাটক! ঢং! সমাজসংস্কার! বিদ্যেসাগর! দাঁড়া, কাল ব্যবস্থা করছি।’

লেখক পরিচিতি : নীতা মণ্ডল

নীতা মন্ডলের জন্ম বীরভূমের লাভপুর সংলগ্ন ইন্দাশ গ্রামে। বিপ্রটিকুরী উচ্চবিদ্যালয় ও বোলপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কর্মসূত্রে দেশের বিভিন্ন শহরে বিভিন্ন সময় থেকেছেন। পেশা অধ্যাপনা। নেশা বই পড়া, গান শোনা ও আড্ডা দেওয়া। ফলে যা হল, চোখের সামনে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনাকে দেখে মনে হতে লাগল ‘ঠিক যেন গল্পের মত!’ আবার, কখনও আড্ডার ফাঁকেই মনে হল, ঘটনাগুলো জুড়ে দিলেই তো নতুন গল্প। বিভিন্ন ওয়েব পত্রিকা ছাড়াও ‘কথা সাহিত্য’, ‘দেশ’ এর মত বাণিজ্যিক পত্রিকায় অণুগল্প, ছোটগল্প ও বড় গল্প লিখেছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে প্রথম উপন্যাস।

1 thought on “বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.