দেবাশিস আইচ

বর্তমানে ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনে কলকাতার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রধানত জেলা ও গ্রামীণ সংবাদ প্রচার ও সম্প্রচারের দায়িত্ব পালন করেছেন। মানবাধিকার, পরিবেশ, বন্যপ্রাণ, প্রান্তিক মানুষের কথা লেখালেখির প্রিয় বিষয়।  দ্য স্টেটসম্যান অ্যাওয়ার্ড ফর রুরাল রিপোর্টিং, ২০১২ পুরস্কার পেয়েছেন।  সাম্প্রতিক প্রকাশিত বই ‘মায়াবন্দরের রূপকথা’। প্রথম বই, ভাগলপুর দাঙ্গার প্রেক্ষিতে গল্পগ্রন্থ ‘দহননামা।’ কবিতার বই, ‘আমাকে জাগিয়ে রাখো’ ও ‘রাত্রিকাল রাত্রিকথা।’ ১৯৮৯-১৯৯৭ মানবাধিকার সংগঠন পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজ (পিইউসিএল)-এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এই প্রথম তাঁর লেখা কোনও ওয়েবম্যাগাজিনে প্রকাশিত হল।

joy1ফাগুন-চৈতে নিমগাছে ফুল এলে মানসীর কি মন হারাত! আজ আর জানা যাবে না। যখন নয়াগ্রামের লাল ডাঙর জমিতে উদ্ধত শিমুল, পলাশ, কুসুম আগুন ঝরায়, সে বসন্তে সদ্য কিশোরীর মন কেমন করত? আজ, সে কথা আর জানা যাবে না। এই জষ্টি মাসে নিমগাছের ডালে তার দেহ মিলেছে। আকাশে যখন ডানা মেলেছে অষ্টমীর চাঁদ। চাঁদ কি ডেকেছিল ষোড়শীকে -আয় আয়! সে কথাও আজ আর জানা যাবে না। চাঁদ ডুবে যাওয়ার বহু আগেই পোড়ামাটি শুষে নিয়েছিল মা বেহুলার চোখের জল। মলমের ছোট ঝরিয়া গ্রামে সনধা বাতাসের তাপের সঙ্গে মিশে গেল কত শত দীর্ঘঃশ্বাস। মানসীর কি হৃদয় জুড়াল? জানা যাবে না সে কথাও।
মাধ্যমিকের ফল বেরিয়েছিল সেদিন। যথারীতি আরও সকলের সঙ্গে স্কুলে গিয়েছিল মানসী ক্যুইলা। এক দশক যে পথ ধরে সে হেঁটেছে — সেই ধুলোপথ, রাঙাপথ, গাছ-গাছালির বুনোপথ — সে পথের মোড়ে ঝাঁকড়া মাথা নিমগাছটার কাছে এসে মেয়েটা হারিয়ে ফেলল বেঁচে থাকার সাধ। কালি ও কাগজে জীবনের শেষ অক্ষরগুলিতে মানসী দায়ী করেছিল তার জীবনকে। শালপাতা আর নিমকাঠির জীবন। অথচ, মানসী জিততে চেয়েছিল। সে নাকি সবসময় বলত, ‘আমাকে জিততে হবে।’ মা বেহুলা তো সে কথাই সকলকে ডেকে ডেকে বলছিলেন, কেমন করে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে সে বলত,’আমাকে জিততে হবে মা।’কয়েকটা বেশি শালের থালা বুনে দিতে বললে মেয়েটা কেমন রেগে উঠতো। পড়া আছে না। তবুও বসত পাতা বুনতে।
নয়াগ্রামের টাঁড়জমিতে বছরে একটাই চাষ। তাও সব জমিতে ফসল হয় না। ক্যুইলা পরিবারের জমি-জমা নেই। তারা আদিবাসী নয়, তফসিলও নয়। তাই, সে বাবদ কোনও সুযোগ এই মধ্যবর্গীয় জাতের জোটে না। পরিবারের কর্তা সন্তোষ ক্যুইলা। পেশায় দিনমজুর। কাজ যেখানে তিনমাস। ঘরে খাবার ছ’মাস। সেখানে এক দিনমজুর বাকি সময় কোথায় মজুর খাটে? দু’টাকা কেজি চাল রয়েছে। পুরো দু’কেজি মেলে না। পাঁচটাকায় সাড়ে-সাতশো আটার প্যাকেট রয়েছে। কেরোসিন প্রতি সপ্তাহে মেলে না। যখন মেলে তা দিয়ে রান্না চলে না। সারা পরিবারের জন্য, রেশনের চাল-আটা-কেরোসিন তুলতেও অর্থ লাগে। কর্মহীন অসময়ের দিনগুলিতে তা কোথায় মেলে? শালপাতার থালাবাটি সেলাই করে মেলে কিছু। হ্যাঁ, থালা সেলাই করেই নিজের পড়ার খরচ চালাত মানসী। শুকনো শালপাতা থেকে তখন গরম ভাতের গন্ধ ছড়াত নিশ্চিত। ভিজে উঠত ডালে। তা-না-হলে, কাঁটায় কাঁটায় সে কেমন করে বুনতো থালা? কত থালা বুনলে এককেজি চাল বাজার থেকে কেনা যায়। কম করে শ’তিনেক তো বটেই। চাল জুটলেও ডাল জোটে না। সব্জি মানে তো, মেটে আলু, কন্দ। শাক-পাতা জোটে। বর্ষার ছাতু আমিষের স্বাদ আনে। শরীরে কত পুষ্টি থাকলে অঙ্ক কষা যায়। কত কিলো ক্যালোরি লাগে জীবনবিজ্ঞান বুঝতে? লাশকাটা ঘরে এমন প্রশ্নের জবাব মেলে না।
ফাগুন মাসে নিমের ডালে ডালে ফুল ভরে ওঠে। নিমের ঝরাপাতা কুড়িয়ে শুকনো করে পাতার কাঠি জোগাড় হয়। নিমকাঠি দিয়ে বোনা হয় শালের থালা। ওই নিমগাছটার নীচেই ছিল তার ব্যাগ। ব্যাগের মধ্যে মার্কশিট আর একটা গোলাপি কাগজ। কাগজে লেখা ছিল, ‘দারিদ্রই সবচেয়ে বড় অভিশাপ। পারলাম না। বাবা, মা ক্ষমা কর। ক্লাস সেভেনের বোনের উদ্দেশে লিখেছিল, ‘মিনু তুই করে দেখাস।’ নিজের অপারগতাকে সে ক্ষমা করতে পারল না। ক্যুইলা পরিবারে সেই প্রথম স্কুলের মুখ দেখছিল। বই-ব্ল্যাকবোর্ড-স্যার-দিদি-বন্ধু… আর সামনে উঁচু উঁচু চূড়া। এমন কোনও চূড়ায় সে বেঁধেছিল তার মনোইচ্ছা। আত্মমর্যাদা বোধের প্রাবল্য নাকি অনেকসময় আত্মহত্যার পথে নিয়ে যায়। মানসীর মনে কোন বোধ কাজ করেছিল? খিদের অভিশাপ, দারিদ্রের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিল সে। ভয় থেকেও মুক্তি পেতে চেয়েছিল সে, একথাও বলে ফেলা যাক। তবে, অন্য কোন বোধ, অন্য কোনও বোধ তার রাঙামাটি, শালপাতা, নিমকাঠির জীবনকে অসহ্য করে তুলেছিল!

ঝাড়গ্রামের মর্গ থেকে সাদা চাদরে মোড়া লাশটা ঘরে ফিরল পরদিন বিকেলে। ক্লান্ত কান্নাগুলো ফের একবার প্রাণ পেয়ে ডুকরে উঠল। ছড়িয়ে পড়ল উঠোন, মাটির দেওয়াল, খড়ের চালে।বেড়া ছাড়িয়ে জানান দিল এদিক-ওদিক। মাথার কাছে চাদরের গিঁটটা খুলে দিল কেউ একজন। মুখটা শেষবারের জন্য দেখতে চেয়েছিল মা বেহুলা। বাবাও। কে যেন জ্বালিয়ে দিয়েছে দুটো হ্যাজাক। গ্রামের মেম্বার হরেন রানা হবে। শেষযাত্রা তো আলোর একটু জোর চাই। একরাশ প্রহসনের মতো কনে দেখার আলো ছড়িয়ে সূর্য ডুবে গিয়েছে দূর বুরু-বনের আড়ালে। ক্যুইলার উঠোনে অন্ধকার আরও কয়েক পোঁচ গাঢ় হল। ভীড় করে আসা মেয়ে-বউ, ছেলে-বুড়ো-বন্ধুদের শরীরের দীর্ঘ-হ্রস্য ছায়ায় উঠোনটা আলো-আঁধারিতে ভরে গেল।
কে যেন হাঁক ছাড়ল, সর সর মুখটায় লাইট পড়তিছে না। কারা একটু শরীর সরাল। তবু, একটা ছায়া আলো-ছায়া মুখে দোল খাচ্ছিল। ওরে, হ্যাসাকটা খুঁটিটায় ঝুলা। আবারও হাঁক পাড়ল কেউ। একটি অল্পবয়সী যুবক কাঁঠলগাছের পাশের বাঁশের খুঁটি থেকে নামিয়ে আনল হ্যাজাকটা। ছায়া ছড়াচ্ছিল কাঁঠালগাছের ডাল, সজনেগাছের এলোমেলো হাত, ঝুঁকে থাকা পেয়ারাগাছটা। কী করে জানবে তারা এতো আলো লাগবে আজ। কেরোসিনের বাতিতেই তো সংসার চলে যেতো। উঠোনের পশ্চিমে এই ছায়াঘেরা কোণটায় বইপড়া, মা-বোনের সঙ্গে থালা বোনা, বুনতে বুনতে গল্পগাছা। অসময়ে এমন আলোর বাহার দেখে হয়তো ধন্দেই পড়েছিল কাঁঠাল-সজনেরা। সুযোগ বুঝে ছড়িয়ে দিয়েছিল ডালপালা। না, এরমধ্যে নাশকতা খুঁজে লাভ নেই। লালমাটি ছায়াও ছড়ায়। যুবকটি হ্যাজাক হাতে ছেঁড়াকাটা শরীরটা ঘেঁষে এমনভাবে দাঁড়াল, আলো ছড়াল অনেকখানি।
কে এই যুবক? মানসী – মানুর দমবন্ধ লাগছে ভেবে খুলে দিয়েছিল মুখের গিঁটটা। হাঁক না মেলাতেই আলো ধরল শরীরে। নিজেই একটা খুঁটি হয়ে গেল। মানুর কি কোনও প্রেমিক ছিল? নিমগাছটা জানে নিশ্চয়ই। ওর গায়েই তো বাঁধা ছিল বাবুই ঘাসের দড়ির দোলনাটা। আচ্ছা, মানুকে কখনও দোল  দেবার ছলে একটু জোরে ধাক্কা দিয়েছিল ও! পড়ে গিয়েছিল মানু? হেসে উঠেছিল ওর বন্ধুরা? ক্ষিপ্ত মানু প্রবল আক্রোশে ওই যুবকের চুলের মুঠি ধরে বসিয়ে দিয়েছিল দু’চার কিল? স্কুলের পথে মানুকে সাইকেলে চাপিয়ে ওই কি ছুটে যেত বাদল হাওয়ার মতো! তড়তড় করে গাছের ডালে উঠে ডিগবাজি মেরে ওই কি নামত মানুর পায়ের কাছে? মনে হচ্ছে তো এই সেই যুবক। ওদের তখন নিশ্চয়ই মনে হত দুটো মিলন উন্মুখ শাহিবাজ। যুবকটিকে শাবাজ বলেই ডাকতো নিশ্চিত। ধারালো ছুরি দিয়ে ফালাফালা করা শরীরটায় ওরা শাবাজকে খোঁজেনি। পোস্টমর্টেম রিপোর্টেও তেমন কিছু লেখা নেই।
মায়ের পিছন থেকে দিদির মুখের দিকে চেয়েছিল মিনু। বোবা মুখটা যেন ওর দিকেই চেয়ে রয়েছে। বলছে, ‘মিনু তুই করে দেখাস।’ ডাকাবুকো দিদিটাই ভরসা ছিল ওর। বাপেরও। দিদিটা মরে গেল। খুব ভয় পেয়েছে সে। নিমগাছটার দিকে মুখ তুলে তাকাতে পারেনি আর। নিমগাছটা বড় প্রিয় ছিল দিদির। দোলনাটাও। পুটু এসে খবর দিয়েছে, দোলনার দড়িটা কেটে নিয়ে গিয়েছে পুলিশ। আবার কোথাও একটা খোঁচা মেরে চলেছে দিদির কথা। ওকি পারবে! ওর যে বড় খিদে পায়। ঘুম পায়। দিদির খিদে ছিল না, ঘুম ছিল না। পড়ত, থালা বানাত। বলত, কলেজে যাব মিনু। অনেক পড়ব। তোকেও পড়াব। আমাদের জিততেই হবে।
বাঁশ আর খেজুর পাতার দোলাটা কাঁধে তুলে নিল ওরা। সামনে সেই চওড়া কাঁধের পেটানো শরীরের সদ্য তরুণ। শ্লেট পাথরের মতো গায়ের রং। কালো একরাশ চুল ভরা মাথায় লাল গামছা জড়ানো। গোলাপি-সাদা ছোপ ছোপ টি-শার্ট। যেন পাক্কা শাহবাজ। মিনু জানতো, মানিকদাকে খুব ভালবাসতো দিদি। মানিকদাও। বেহুলা আছাড়িপিছাড়ি খাছে। কী অপরাধ, বুঝতে না পেরে জন্মদোষীর মতো মাথা নিচু করে হাঁটছে বাপ সন্তোষ।
ঝাপসা চোখের আড়ালে চলে গেল সবাই। বুক ফেটে যাছে মিনুর। বেইমান…খুনি… শাপশাপান্ত করতে করতে নিমগাছটার দিকে ছুটে গেল মিনু। আছড়ে পড়ল গুঁড়ির উপর। গাছটা থম মেরে রইল। এতটুকু শক্তিও যেন আর ওর শরীরে অবশিষ্ট নেই যেন। ‘বারণ করলি না বেইমান, খুনি…দিদি তোকে এতো ভালবাসতো,’ দমকে দমকে কেঁদেই চলল সে। কতক্ষণ কেঁদেছে জানে না। কারা যেন ওর নাম ধরে ডাকতে ডাকতে এদিকেই আসছে। লন্ঠনের আলো দেখা গেল। পুটু-কালি-হাসি বন্ধুরা। চোখ ভরা জলে ছোট্ট দু’হাত দিয়ে গাছটাকে আদর করতে করতে মিনু বলে উঠল, রাগ করিস না রে। কী বলতে কী বলে ফেলেছি। আবারও দোলনা টাঙাব, দেখিস। থরথর করে কেঁপে উঠল যেন নিমের শরীর।

***

চিত্রণ – জয়ীতা করণ

1 thought on “নিমকাঠির জীবন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.