মধুশ্রী বসু

“বেশ লেখেন আগা সাহেব। আর কাশ্মিরে বড্ড ঠান্ডা।” – মধুশ্রী

আগা শাহিদ আলীর কবিতা আগে কখনো পড়িনি। এবারে আয়নানগরের মার্চ ইস্যুতে লিখব কি লিখবনা করছি যখন, নন্দিনীদি ওদের ওখানকার লাইব্রেরি থেকে ওনার ‘The Country Without A Post Office’ বইটার একটা স্ক্যান করা পিডিএফ পাঠিয়ে বলল – ট্রান্সলেট কর। বেশ ভালো লাগল পড়ে। উনি কাশ্মির থেকে এখান ওখান করে শেষ পর্যন্ত সেই আমেরিকা অব্দি উজিয়ে গিয়ে পৌঁছেছিলেন। ইংরেজি সাহিত্যে পিএইচডি করে, ওখানে শিক্ষকতা করতেন। শেষে ব্রেইন ক্যান্সার হয়ে ম্যাসাচ্যুসেটসে মারা গেলেন বছর বারো আগে। কিন্তু ওই যা হয় – মাথা থেকে কাশ্মির বার করে উঠতে পারেননি। তাই সারাজীবন ধরে কাশ্মির নিয়ে কবিতা…কবিতাগুলো তো দারুণ। আর আরও একটা ব্যাপার হলো – আমাদের বেশিরভাগের অবস্থা তো সঙ্গীন – নিজের চারদিকে গন্ডি কেটে গম্ভীর হয়ে বসে আছি আর ভাব করছি, দেশের-দশের জন্যে কি না কি একটা করে ফেলতেই পারি; এই শুধুমাত্র ভীষণ দরকারী হাতের কাজটা সেরে নিয়েই উঠেপড়ে লাগব… যাই হোক – মনটা তো খারাপ হয়ই – আর আগা শাহিদ আলীর কবিতাগুলো কেমন ঠিক ওই জায়গাটায় গিয়ে ধাক্কা দেয়। হয়ত ওঁকেও দিয়েছিল।

‘The Country Without A Post Office’ বেরিয়েছিল বোধহয় ১৯৯৭ নাগাদ। এর মধ্যে বাংলায় ট্রান্সলেট হয়েছে বলে কোথাও দেখতে পেলুমনা। বরং এইখানে দেখছি – ওনার আরও কিছু খুব সুন্দর কবিতা আছে, আর এইখানে – অমিতাভ ঘোষ একটা বেশ লেখা লিখেছেন ওঁকে নিয়ে, আর এই একটা রিভিউ

.

পবিত্র শব্দের ভূমিকা

সেই মুহূর্তটি ক্রমশ এগিয়ে আসছে, আর চাঁদ তখন দ্বিফালিবিভক্ত‘ – কোরান, সুরাহ ৫৪.১
আমাদের দেখা হবে পুনর্বার, পিটার্সবার্গে‘ -ওসিপ মেন্ডেলস্ট্যাম

এক নামহীন কবিতার প্রথম ছত্রের গঠনশৈলীতেই হৃদয় ভাঙ্গার শব্দ ধ্বনিত হয় : কথা, যা তার খেলাপকে বহন করে – ‘আমাদের দেখা হবে পুনর্বার পিটার্সবার্গে / বুঝিবা সূর্য পুঁতে এসেছি সেখানে।’

কাশ্মিরের যে উপত্যকায় টাইটানেরা ঠাঁই নিয়েছিল, যেখানে স্যাটার্ন যেই সবে থিয়ার সঙ্গে কথা বলতে যাবে, ‘তার শ্রুতিতে এক ভয় জেগে ওঠে / যেন দুর্বিপাক আসন্ন।’ সেখান থেকে, ‘যেখানে কোনো দিনই সকালবেলা ঘর থেকে বেরোবার সময় বুকে হাত রেখে বলা যায়না ফেরা হবে কি না।’ ‘আমাদের দেখা হবে পুনর্বার, শ্রীনগরে’, আমি ইরফানকে জবাব দিতে চাই। শপথ উচ্চারণ করতে চাই মেন্ডেলস্ট্যামের মখমলি আঁধারে, মিশকালো মখমল শূন্যতায়।

আমি সেই শূন্যতাকে গলা চিরে বলতে চাই, আমি পারি। আমি সেই শূন্যতায় খোদাই করি – কাশ্মির, কশ্মির, ক্যাশ্মেয়ের, কেয়াশ্মির, কাশ্মায়ার, কাশ্মেরে, কাশেমায়ার, কুশ্মিয়ার, কাচমিয়েরে, ক্যাশ্মির।  কিম্বা কশেমার – এক কাহিনীসমুদ্রে? কিম্বা কাকমীর, ক্যাষ্মীর, কাসমেরে, কাচমায়ার, কাস্মির, কার্সিমেয়ার?

পিটার্সবার্গ (বা শ্রীনগর, আমার কাছে) এক কল্পিত স্বদেশরূপে পুনর্সৃষ্ট। তার ভিতরে নিজেকে এঁটে ভর্তি করে – স্বহস্তে ছিপি বন্ধ। কেননা সেই পবিত্র শব্দ যার কোনো অর্থ নেই, সেইসব ফুল যারা কখনো শুকিয়ে যাবেনা, গোলাপ যার চ্যুতি নেই, রাত, যাকে মেন্ডেলস্ট্যাম ভয় পাননি, আর যাতে কোনো পরিচয়পত্র লাগেনা। যেখানে পবিত্র মহিলারা আজও গান গেয়ে চলেছেন।
ব্রিজের উপর পুলিশী প্রহরা আর কোকিলের স্বরের মত তীব্র গাড়ির শিস।

হয়ত একদিন সেই সময়েরা মরে যাবে আর স্নিগ্ধ নারীদের প্রিয় হাতে হাতে লঘুভার ভস্ম জড়ো হবে।

শ্রীনগরের বুকে নিশিসূর্য। বন্দুকের নল আকাশে তারা ফুটিয়েছে, নক্ষত্রের ঝড় রাতের পর রাত, সীমাহীন। সেই রাত ছিল ইদুজ্জহার – ঈশ্বরের ব্যর্থতার দলিল, কারণ তাঁকেও মথিত হতে হয়, যাতে ইশমায়েলের পিতাই তার হন্তারক হয়ে উঠতে পারেন।

শ্রীনগরে সেদিন কার্ফ্যু চলছিল। পরিচয়পত্রগুলো – মনে হয়না তাতে ফাটল ধরাতে পারত।

সন্তানের পর সন্তান – সেই যে এক মর্মান্তিক যন্ত্রণার রাতে তাদের টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল – তারা কেউ ফিরে আসেনি।

আর সেইসব পবিত্র নারীরা কি হাতে হাতে একত্রিত ভস্ম মেখে নেবে? প্রতি হেমন্তে তারা চিনার গাছের পাতা জড়ো করে, চারশ বছর ধরে পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত গান গায়, হাব্বা খাতুনের গান, যাতে সেই এক চাষীর মেয়ে হয় রাণী। যখন মুঘল সম্রাট আকবরের আদেশে তার স্বামী নির্বাসিত হল সেই উপত্যকা থেকে, সে তার দুঃখভার নিয়ে মানুষের মধ্যে মিশে গেল। তার শোক, অদ্যাপি জিয়ন্ত, মানুষকে ঝাঁকি মেরে খেপিয়ে তুলল মুঘল শাসনের বিরুদ্ধে। সেই দিন থেকে কাশ্মির আর কোনদিন স্বাধীনতার মুখ দেখেনি।

আর সেইসব স্নিগ্ধ মহিলারা কি হাতে হাতে ছাই ঘষে নেবে একত্রিত? প্রতি হেমন্তে তারা সেই গান গায়। যতটুকু পারে শীতের

জ্বালানি সংগ্রহ করে : শুকনো পাতায় আগুন ধরায়, আর সেগুলো জ্বলে উঠলে তাতে দেয় জলের ছিটে – তারা তখন ভঙ্গুর কয়লায় পরিণত হয়।

কিন্তু খবরগুলো সব সত্যি, আর ওগুলোতে কোনো সুর নেই : গ্রামে গ্রামে গণধর্ষণ, শহরগুলো পোড়া কাঠ, দগ্ধ বসতিজন।

‘ক্ষমতামাত্রেই ঘৃণ্য / নাপিতের হাতের মতন।’ টাইমসের পাতা থেকে খাস শ্রীনগরের ধ্বংসাবশেষ আমার দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকে।

হয়ত একদিন সেই সময়েরা মরে যাবে – আমরা মেন্ডেলস্ট্যামের রাত্রির আজানে নত হব – আর নারীদের প্রিয় হাত একত্রিত করে নেবে লঘুভার ছাই।

আর সেই পবিত্র অর্থহীন শব্দ – কে তাকে উচ্চারণ করবে? কি সেই শব্দ? সেই নারীরা করবে কি? যেন বাতাসে প্রথম অক্ষরলিপি? অথবা শেষ?

শ্রীনগর এক বুনো বেড়ালের মত কুঁজো হয়ে আছে : একাকী দুঃখী পাহারাদার সব, শহরময় ব্রিজগুলোর গায়ে গায়ে তৈরী বাঙ্কারে, গৃহ থেকে দূর সমতলে, হত্যার পরোয়ানা নিয়ে … কখনো ঝিলাম নদী তাদের পায়ের তলা দিয়ে প্রত্যঙ্গহীন লাশ বয়ে নিয়ে যায়। জিরো ব্রিজের উপর জিপেরা তাড়াহুড়ো করে। মখমলি শূন্যতাকে আলোকিত করতে না পেরে, মোমবাতিরা পর্যটকের মত হারিয়ে যায়।

কি সেই পবিত্র শব্দ? মেন্ডেলস্ট্যাম কোনো সূত্র রেখে যাননি। একদিন প্রথমবার কাশ্মিরের মানুষ সত্যি সত্যি সেই শব্দ উচ্চারণ করে উঠবে।

(ইরফান হাসানের জন্য)

.

বিদায়

একটা পয়েন্ট অব্দি এসে তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি।
ওরা এক ঊষর মৃত্যুভূমি তৈরী করে সেটাকে শান্তিকুঞ্জ নাম দিতে চেয়েছে।
তুমি চলে গেলে, পাথরগুলো পর্যন্ত পুঁতে দেওয়া হলো,
যাতে করে, যেসব মানুষেরা এমনিতেই মরবে, তাদের হাতে কোনো অস্ত্র উঠে না আসে।

ভেড়া যখন পাহাড়ের গায়ে গা ঘষে, কে তার গায়ের থেকে খসে পড়া লোমগুলোকে তুলে তুলে রাখে?
হে তাঁতী, তোমার সেলাই হাওয়ায় সম্পূর্ণ মিলিয়ে যায়, আর তুমি বেনের দাঁড়িপাল্লায়
সেই লোম ওজন করে দেখ?
স্বর্গের ফটকে আজ রাতে পাহারাদার কে?

আমার স্মৃতি আবার একবার তোমার ইতিহাসের উল্টোদিকে এসে দাঁড়িয়েছে।
তামাম রাত ক্যারাভানের মত আর্মি কনভয়্গুলি চারণরত।
সমস্ত শীত নিভন্ত হেডলাইটের তেলচিটে ধোঁয়ায় গলন্ত সময় – গুঁড়ন্ত বীজ,
ওদের কি জিজ্ঞেস করা যায় – পৃথিবীটাকে নিয়ে যা যা করার সব করে ফেলেছে কিনা?

লেকের জলে মন্দির আর মসজিদের ছায়া এ ওকে জড়িয়ে।
আর তোমার ছায়ার গায়ে যে দেশটাকে আমি সুঁই দিয়ে সেঁটেছি,
তাতে কয়েক’শ বছর পর যখন ওরা এমনি জড়াজড়ি করেই আবিষ্কৃত হবে, তখন
ওদের গায়ে ঢালবার জন্যে যথেষ্ট পরিমাণ জাফরান শুকিয়ে রেখেছ তো?

এদেশে বেরোলে, হাতে দরজা নিয়ে বেরোতে হয়।
বাচ্চাদের জন্যে, জানলা।
আলোকিত করিডর বেয়ে – টেনে টেনে – নিয়ে যেতে হয়।
সুইচ মেরে দিলেই সমস্তকিছু থেকে বলপূর্বক বিচ্ছিন্নতা।

একটা পয়েন্টে এসে আমি তোমায় হারিয়ে ফেলেছি।
আমাকে তোমার প্রয়োজন ছিল, উপযুক্ত করে তোলার প্রয়োজন:
তোমার অনুপস্থিতি আমাকে মেজে ঘষে তোমার শত্রু বানিয়ে তুলেছে।
তোমার ইতিহাস আমার স্মৃতির উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে।
তোমার যা কিছু হারিয়েছে, সবই আমি। তুমি আমাকে ক্ষমা করতে পারনি।
তোমার যা কিছু হারিয়েছে, সমস্ত আমি – তোমার একদম লাগসই শত্রু।
তোমার স্মৃতি আমার স্মৃতির পথে বাধা।

একটা নরকের নদী বেয়ে দুপাশে স্বর্গের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে চলেছি:
হে মহীয়ান প্রেত, এখন রাত.
হাতে দাঁড়ের মত হৃদয়, পোর্সিলিনের ঢেউ চুরমার করতে করতে এগোচ্ছে।
এখনও রাত বাকি। হাতে দাঁড়ের মত পদ্ম :
আর আমাকে নৌকোয় চাপিয়ে নিয়ে যেতে যেতে তার পাপড়িগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে, আমার প্রতি যেন বা কৃপাশীল মৃদু থেকে মৃদুতর বাতাসের দিকে।

তোমাকে নিজের করে নিতে পারলে, পৃথিবীতে আর কি না হতে পারত?
তোমার যা কিছু হারিয়েছে সমস্ত আমি। তুমি আমাকে ক্ষমা করতে পারনা।
আমি আমার যন্ত্রণার ব্যাপারগুলো নিজের থেকেও গোপন রেখেছি; আমার যন্ত্রণা আমি শুধু নিজেকে খুলে দেখাই।
সবকিছু ক্ষমা করা যায়। তুমি আমাকে ক্ষমা করতে পারনি।
শুধু যদি তোমাকে আমার নিজের করে নিতে পারতাম,
পৃথিবীতে আর কী না করা যেত?

(প্যাট্রিশিয়া ও’নিলের জন্য)

.

শেষ জাফরান
জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে জাফরান চাষের পরেই ডাল লেকে নৌকা বাওয়া।  

আমার মৃত্যু হেমন্তে, কাশ্মিরে,
ছায়াচ্ছন্ন ধমনী নিত্যদিন
সংবাদ হবে, রক্ত সমালোচিত,
গেরুয়া সূর্যে, বিহানে বর্ষালীন

প্রথমে বাজারে, ধ্বংসে অতঃপর,
ট্যাক্সির চেনা স্ট্যান্ডে অবধারিত।
কে গেছে টাঙিয়ে ট্যাবলয়েডের কাঁদি
ব্যাঙ্কের ধারে বেড়ায় প্রলম্বিত,

নিরুদ্দিষ্ট যুবকের শিরোনামে
শোণিতচিহ্ন সন্ধান করে চলি –
গত বসন্তে বন্যা যাদের টেনে
ঘুলিয়ে মেরেছে, কন্ঠে ভরেছে পলি

জল নেমে গেলে ঝিলাম অপসৃত
মৃত মানুষের ধনভান্ডার খিঁচে,
টাকার ঝিলিকে ঝলসে বালির চড়া –
রেয়াত না করা নদী, তার পিছে পিছে

ঢেউ খুঁড়ে সেই ধন সন্ধান পেলে
হাঁকাবো সারথি, মজুরি পড়ুক ভারী,
মেপল পাতার মতন সবুজ চোখে
সারথি আমার প্রায় যথেচ্ছাচারী,

কার্ফ্যু ভেঙ্গেও আমার রথের খেই
অরোধ্য, শুধু মৃতের সমাধিতলে
পুষ্পস্তবক রাখার নিয়ম নেই।”

অক্টোবরের শেষদিকে ঐদিন আমি মারা যাব – অনেকদিন আগে :

সে আমাকে প্যামপোরে নিয়ে যাবে যেখানে আমি ফুল জড়ো করে তারপর দূরে রাখা ট্যাক্সিতে ফেরত আসব, কত সহস্র পুংকেশর আমার হাতে গুঁড়ো গুঁড়ো লাল: আমি চিত্কার করব : “জাফরান, আমার দামটা!” আর সে সমস্ত সীমা ভেঙ্গে আমার প্রত্যেকটা উড়ো খবরকে তাড়া করে যাবে। শাহিদের কি হয়েছে কেউ জানেনা”, আমরা বার বার শুনতে পাব প্রতিটি টী হাউসে – নিশাতের, নাসিমের। সে শালিমার ঘাটে রথ থামাবে আর আমরা সিঁড়ি বেয়ে জলের দিকে নামব। সে নদীর পাড় থেকে একমানুষ মাটি তুলে নেবে। আমি – তার শেষ যাত্রী। হঠাতই সে বুড়ো হয়ে যেতে থাকবে, তার গলা খুনখুনিয়ে যাবে, তার দৃষ্টি সবুজ জল টলটল আমাকে ধুয়ে… : “প্যামপোরের পোড়া মাটিতে এই স্বর্ণফসল আর কোনদিনও ফলবেনা।” আর সে সেই মুক্ত ক্ষেত রুয়ে যাবে সিকিউরিটি জোনের ওপার পর্যন্ত, যাতে ঢেউয়ের উপরে অস্তমান জাফরান সূর্যে আমার রক্ত সংবাদ হয়ে ওঠে।

হাঁ আমার মনে আছে,
আমার মৃত্যুদিনে, আমি গাঢ় লাল রং সম্প্রচার করেছিলাম।

বহুদিন আগেকার কথা – আকাশে বাতাসে 
রঙের পশলা, আর মাটির শিরা বেয়ে
রক্ত, তীর ছেড়ে মৃত্যুর দিকে যাবার সময় 
গার্ডদের পাশ কাটিয়ে যেতে হয়, আর সে
শেষ জাফরানের পাহারাদার, নৌকো বেয়ে বেয়ে 
আমাকে একটা লাশের সাইজের দ্বীপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, দুহাত
বাইলেই সূর্যাস্ত, যেখানে সব যন্ত্রণার অবসান।  
সবার মুখে মুখে,
আমার মৃত্যুর খবর, কিন্তু তার মৃত্যুসংবাদ
শুধুমাত্র সেই দুটি ছত্রে ধরা আছে :
“ভূস্বর্গ বলে যদি কিছু থেকে থাকে,
এখানে, সে এখানে, সে এখানেই। ”

(বিদুর ওয়াজিরের জন্য)

 .

“কাশ্মিরের জগত যেরকম

‘গোলাপ যদি ঘুষ দেওয়া যেত, / আমহার্স্ট থেকে কাশ্মির অব্দি যত ফুল ফোটে, / সব দিতাম ওদের
– এমিলি ডিকিনসন

এদিকে ফোনটা বাজলো আমহার্স্টে : “তোমার ঠাকুমা মারা যাচ্ছেন। আমাদের গ্রামটা – ফ্লাড চ্যানেলের উপরে মজ্হুর বলে যে ব্রিজটা – তার ঐপারে।”

“এরকম কোনো গ্রামের কথা আমি জানিনা!”

“পড়ে গিয়ে ভীষণ আঘাত পেয়েছেন। এদিকে সর্বত্র কার্ফ্যু। নিয়ে আসার কোনো উপায় নেই।  রাস্তাঘাটের অবস্থা সাংঘাতিক।  আশেপাশের বাড়ির কেউ কেউ এর মধ্যেই মারা গেছে।”

এরকম কোনো গ্রাম কখনো ছিলনা।

“আমরা তোমার মায়ের মা-দের দিকের লোকজন বাবা। তুমি আমাদের কথা শুনেছ ! আমরা কলকাতায় সিল্ক কার্পেটের ব্যবসা করতাম। এখন আমাদের অবস্থা খুব পড়ে গেছে তো, তাই হয়ত চিনতে পারছনা!”

ফোন নামিয়ে রেখে আমি বাইরে রোদের ভিতর ছুটে যাই, শ্রীনগরে, সেই মেয়েটির বাড়ির দিকে। বাগানের লাগোয়া বাড়ি । তার যে সাজগোজের আয়নাটা – সিকন্দর মরার পরেও যেটা কষে পরিষ্কার করে চলেছে, সেটা ছাড়া অন্য সমস্ত কিছু আর্মি থেকে ক্রোক করে নিয়েছে। বাড়িটাকে ঘিঞ্জি অফিস বানিয়েছে, আর পুরনো ফোনের উপর, স্যাঁতস্যাঁতে ফাইলের উপর, ভাঙ্গা ডেস্কের উপর রাশি রাশি ধুলো জমা করেছে। তার বাইরের ঘরটায় একজন ক্লার্ক বসে নির্দেশ শুনে শুনে টাইপ করে। যে কর্নেলটি পায়চারী করতে করতে কি লিখতে হবে না হবে – সেসব বলছিল, সে একবার ঘুরে তাকাতেই দেখি, বীর! আমার হারানো বন্ধু! শ্রীনগর তো তারও শহর। সেটাকে জ্বালিয়ে দেবার অর্ডারটা তার হবার কথা নয়। না, বোধহয় বীর নয় । কিন্তু ওইরকমই দরদী হাসি, আর মুখটাতেও ওরই মত – একটা দেশকে রক্ষা করার, একটা শহরকে গুঁড়িয়ে দেবার স্বপ্ন মাখা ।

“আমার ঠাকুমার খুব অসুখ। আমার সঙ্গে প্লীজ কাউকে দিতে পারেন? প্লীজ। আপনাদের একটা কোনো জীপ আমাকে একটু আমার গ্রামে ছেড়ে দিতে পারে?”

তার ঘরে তার বাবার একটা ছবির উপর রোদ পড়েছে। হাতে আঁকা ছবি – তার মধ্যে থেকে তিনি তাকিয়ে আছেন, পলকহীন, সকালবেলার সূর্যের দিকে।

আর ঠিক তখনি তার গ্রামের অন্যান্য লোকেরা আর তার মৃত ভাই তার দেহটাকে পপলার গাছের বনের ভিতর দিয়ে বহন করে আনছে, গোলাপবাগানের পাশ দিয়ে, ধীরে। আমি ছুটে বেরোলাম : ঈশ্বরকে ধন্যবাদ তুই বেঁচে আছিস ! সে তার ভাইকে বলছে, ভাগ্যিস তুই এসব বিশ্রী ব্যাপার শুরু হবার আগেই মরে গেছিস! আমার বাড়িটাকে ওরা আবার অফিস বানিয়েছে! তোকে বসতে-টা দিতাম কোথায়

আয়নাগুলো তার অনুপস্থিতিতে ম্লান হয়ে ছিল। দৌড়ে গেল – দরজা থেকেই তাকে আদর করে ভিতরে নিয়ে আসতে। তার-ই তো বাড়ি। সিকন্দর রেডিওতে মজ্হুরের গান লাগিয়েছে, রাজ বেগমের গলায় : “আমার কাছে এই গোটা পৃথিবীর চেয়ে তোমার দাম বেশি।” আমার সমস্ত শৈশব যে সূর্যের আলোয় আলোকিত, সেই সূর্যের নীচে আমি তার হাত ধরেছি, যে সূর্য চোখের জলের ফোঁটায় উজ্জ্বল, আর সেই জলের মধ্যে খোলা জানলা দিয়ে তার কণ্ঠ ধ্বনিত, ঈশ্বর দয়াময়, ঈশ্বর আমাদের দেখছেন।

 .

“দ্যাখো কাশ্মির ! / দ্যাখো একটা গোলাপ ফুটেছে !” 
-এমিলি ডিকিনসন 

আরেক গ্রীষ্মের কথা : ঠিক সূর্যাস্তের সময় বেল বাজলো, আমরা তখন রেডিও-কাশ্মির শুনছি : উপোস ভাঙার পরে : সবে তখন একটা গান শুরু হয়েছে :

আবার গরমকাল: আমাদের শেষ ইতিবাচক গ্রীষ্ম ছিল সেটা :  বারান্দায় বসে রেডিও-কাশ্মিরে গান শুনছি: “হৃদয় ছাড়া কিই বা দিতে পারি ?/ আমার বাকি বছরগুলোও সব তোমায় দিলাম।”

সে এখনো পৃথিবীটাকে কোনরকমে ধরে রেখেছে : গোলাপগুলোর নামকরণ করেছে :
ঈশ্বর প্রেমময়, ঈশ্বর আমাকে ভালোবেসেছেন, তোমাতে আমার যে প্রীতি, তিনি তাকে ঈর্ষা করেন, আর তুমিআমার সর্বাপেক্ষা প্রিয় দৌহিত্র। আমার কবি, তোমার কাব্যে সেই প্রীতি কোথায়

সে আমার সাথে একটা স্বপ্নের ভিতরকার স্বপ্নের ভিতরের স্বপ্নে বসবাস করছে। আয়নাগুলো তার প্রতিফলন পাবার জন্যে কাড়াকাড়ি লাগিয়ে দেয় : আমি তার আদিঅন্তহীন হাতের দিকে তাকিয়ে থাকি : শেষ শান্তির গ্রীষ্ম : শেষ ইতিবাচন : আমরা কোনরকমে পৃথিবীটাকে এখনো ধরে রেখেছি : গোলাপগুলোর নাম দিচ্ছি : সে তার ভাগ্যরেখা, জীবনরেখা, হৃদয়রেখা, মস্তিষ্করেখা – সবশুদ্ধ আমার হাতের খোলা পাতায় চেপে ধরছে আর আমার হাতের পাতা যেন পুড়ে যাচ্ছে। দ্যাখো, তার শূন্য হাত, গোলাপ !


“অতএব প্রতিদিনই হৃদয়ে বিপ্লব উদ্ভূত, / শোকের সমুজ্জ্বল স্বৈরতন্ত্র জাগরূক থাক।” 

আবার গরম পড়েছে : শেষ ইতিবাচকতার গ্রীষ্ম : আমরা বারান্দায়, শুনছি :

অতএব প্রতিদিনই হৃদয়ে বিপ্লব উদ্ভূত” … এটা তো ফৈজ , না? আমি না একবার সত্যি সত্যি প্রার্থনা করা ছেড়ে দিয়েছিলাম। একবারই। “আমি ভূঁয়ের উপর মাথা নত করলে পৃথিবী ককিয়ে ওঠে : / তোমার ভক্তির ভারে  – আমি সতত পিষ্ট।

 

সে কোনক্রমে পৃথিবীটাকে ধরে রেখেছে : গোলাপগুলোর নাম দিয়ে চলেছে :

শোন, কয়েকটি শীত আগে আমি নাসিরের সাথে দিল্লীতে ছিলাম। আমেরিকা থেকে খবর এসেছিল: নুজ্হাত মারা যাচ্ছে। তখন আমি একলা।  খালি ওর সেই মাতাল কাজের কাজের লোকটা আর আমি ! আমার এমন অসুখ হলো, যে আর হাঁটতে অব্দি পারিনা। কাজের লোকটি বলল : মাসবই তাঁর ইচ্ছে ! উল্টোদিকের ডিসপেন্সারির নার্স আমায় কি একটা ইনজেকশন দিল। আমি কেমন আধ ঘুম, আধ জাগরণে, স্বপ্নজ্বরেজানিনা কতক্ষণের জন্যদেখলাম তিনজন মহিলা, তার দুজনকে মনে হয় আমি চিনি, কিন্তু তৃতীয়জন কে? আমি নিশ্চয় মরে গেছি, আর ওরা আমায় মাটি চাপা দিতে এসেছে। না না, ওরা আবার আমায় বাঁচাতে চাইছে! নার্সিং হোমে আমায় একটা ভারি সুন্দর ঘর দিয়েছিল। আমার জানলার বাইরের বাগানটা ফুলে ফুলে ছয়লাপ। আর আমি মরে গেছি। এটা স্বর্গ। ঠাকুর আমায় কত ভালোভাবে রেখেছেন। 

স্বপ্নের ভিতরকার স্বপ্নের ভিতরের সেই স্বপ্ন:

জানলা দিয়ে আমার বাবাকে আর স্বামীকে দেখতে পাচ্ছিলাম। কি কম বয়েস ওদের ! ওরা আমার দিকেই আসছিল, আর অমনি আমি ঘুম ভেঙ্গে উঠে বসে ডাক্তারকে বললাম, আমার যন্ত্রণা আর বাড়াবেননা, দেখুন না, ওঁরা আমাকে ডাকতে এসেছেন। ডাক্তার তখন সেই মেয়েগুলিকে বলছে, উনি তো কোঅপারেট করছেননা। না না আমি ওষুধ খাব। আমি মরতে চাইনা। কিন্তু আমি যে বাবাকে আর ওনাকে দেখতে পাচ্ছিওঃ কতদিন হয়ে গেল ওরা নেই! এত কম বয়েসে গেছে সব! ওরা এখন ওই বাগানটায় আর আমিও বোধহয় মরে গেছি। নিশ্চয় ভগবানের খাতায় আমার বিস্তর ভালো ভালো কাজের হিসেব লেখা আছে, যাতে করে আমায় শেষমেষ এই সুন্দর বাগানটায় এনে ফেলেছে।      

 .

প্রিয় শাহিদ

‘যে মতবাদই হোক, তা এত মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পক্ষে যথেষ্ট নয়সে যদি রাশিয়ানদের মতে রাশিয়ার অবিভক্ততাও হয়।‘ – এলেনা বনার, চেচনিয়া নিয়ে ইয়েলত্সিনকে লেখা খোলা চিঠি

‘কোনো মানুষের বা কোনো দলেরই একটা গোটা শহরকে মৃত্যুদন্ড দেবার অধিকার নেই। -চার্লস সিমিচ

এক দূরদেশ থেকে এই চিঠিটা লিখছি। আমরা যারা এখানেই থাকি, তাদের পক্ষেও বেশ দূর। এখানে কেউ আর ঠিক বসবাস করেনা। পকেটে চিরকুটে লেখা ঠিকানা নিয়ে বেরোয়, যাতে তাদের দেহটা অন্তত দিনের শেষে ঘরে ফিরে আসে।
এ শহরে এমনিতেই কথা ওড়ে। কিন্তু সীমান্তের শহরতলিগুলো থেকে এখনো খবর এসে পৌঁছয় : পুরুষদের সব সারারাত খালি পায়ে বরফের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল।  মেয়েরা ঘরে একা।  আর সৈন্যরা হাতে হাতে বাড়িগুলোকে টুকরো টুকরো করছিল – রেডিও, টেলিভিশন আছড়ে চুরমার।

তুমি নিশ্চয় রিজওয়ানের খুন হবার খবরটা পেয়েছ। রিজওয়ান : স্বর্গের দরজার একজন পাহারাদার। মোটে আঠেরো বছর বয়েস। গতকাল হাইডআউট কাফেতে (ওখানে কিন্তু সবাই তোমার কথা জিজ্ঞেস করে) একজন ডাক্তার – সবে একটা ষোলো বছরের ছেলেকে দেখে এসেছেন – ইন্টারোগেশন সেন্টার থেকে বেরিয়েছে ছেলেটি – বলছিলেন : এইসব জ্যোতিষীদের কাছে আমার একটা প্রশ্ন আছে: এই ছেলেটার ভাগ্যরেখায় কি লেখা ছিল, যে ওর হাতদুটো ছুরি দিয়ে কেটে ফেলা হবে?  

এই চিঠিটা – ইনশাল্লাহ – কাল আমার ভাই যখন সাউথের দিকে যাবে, তখন পোস্ট করে দেবে। এ পোড়া জায়গায় পোস্টেজ স্ট্যাম্প অব্দি পাওয়া যায়না আজকাল। আজ আমি নদী পেরিয়ে পোস্ট অফিস গিয়েছিলাম। শ’য়ে শ’য়ে ক্যানভাসের ব্যাগ ভর্তি বিলি না-হওয়া চিঠি। ভাগ্য ভালো, আমি কি কারণে মাটির দিকে তাকিয়েছিলাম, আর তাইতে তোমার নামে লেখা এই চিঠিটা চোখে পড়ল।  তাই এটাও একইসঙ্গে পাঠিয়ে দিলাম।  আশা করি তোমার খুব কাছের কোনো মানুষের লেখা এটা – যার খবর পাবার জন্য তুমিও হয়ত উন্মুখ হয়ে আছ –

এখানকার ব্যাপারস্যাপার সব একইরকম, আর আমরা সবসময় তোমার কথা বলাবলি করি। তুমি কি শিগগিরই এর মধ্যে আসবে একবার? তোমার জন্য অপেক্ষা করাটা কেমন যেন বসন্তকালের জন্য অপেক্ষা করার মত। আমরা এখানে আমন্ড গাছের ফুল বেরোনোর জন্য বসে আছি। আর যদি উপরওয়ালার ইচ্ছে হয়, ওঃ! সেই শান্তিপূর্ণ দিনগুলো – যখন আমরা সবাই এ ওর প্রেমে পড়ে ছিলাম আর যখন যেমন চাইতাম বৃষ্টি নামত।

1 thought on “আগা শাহিদ আলীর ‘The Country Without A Post Office’ থেকে ৬টি কবিতার অনুবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.