এই সময়ে, কবি ও কবিতার উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নেমে আসার সময়ে, দেশ ও দেশবাসীর উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নেমে আসার সময়ে দাঁড়িয়ে কিছু কবিতা, কিছু প্রতিবাদের স্বর। তৃতীয় কিস্তি – সুমিত চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা।

 

এখনো সে বলতে চায়
(শহীদ কবি বেঞ্জামিন মোলায়েজ স্মরণে)

সে কি অনেক কথাই ব’লে ফেলেছিলো—
যা তার বলার নয়?
তাই তার গলার গর্বের কালো রঙে দোষ সাদা আঙুলের দাগ!

হিমেল হাওয়ায় জানলায় অন্ধকার—
কালো আফ্রিকার মানচিত্র
মানচিত্র জুড়ে রক্তের লাল স্রোত
সেই স্রোতে ভেসে আসছে কবি
কবির খোলা চোখে গোটা আফ্রিকা
আফ্রিকার কান্না, ঘৃণা, আশা, স্বপ্ন…
শব্দ… অজস্র অক্ষর…
কবির অনুভব—
যা তার মনের গভীরে একটু একটু ক’রে জমা হয়েছে
জন্মভূমির মাটি থেকে
বাতাস আর জল থেকে
সবুজ বনের গান থেকে
বিষাদমাখা আকাশ থেকে
সাদা হাতের চাবুক থেকে
জেল আর ফাঁসির দড়ি থেকে
কালো চোখের আগুন থেকে

সে কি অনেক কথাই ব’লে ফেলেছিলো—
যা তার বলার নয়? তবু

এখনো সে অনেক কিছুই বলতে চায়…

(৪ ডিসেম্বর ১৯৮৫)

মুখোমুখি
(বাসভাড়াবৃদ্ধি-বিরোধী আন্দোলনের উপর আক্রমণের প্রতিবাদে)

আকাশটা সারাদিন মুখ গোমড়া ক’রে আছে।
লাল পতাকা আজ লাল পতাকার মুখোমুখি!
একদিকে মোটা গরান কাঠের খোঁটায়
হাওড়া-হাটের লাল শালু—
বদ হাওয়ায় ভেসে-আসা কালো টাকায় কেনা!
অন্যদিকে হে মার্কেটের রক্ত-শপথ।
লাল পতাকা আজ লাল পতাকার মুখোমুখি!

দিনগুলো দ্রুত পাল্টায়, মুখগুলোও
পাল্টায় কথার বাঁধুনি;
পাল্টায় না ব্ল্যাক সার্ট, ব্রাউন সার্ট!
রক্ত ঝরে, মানুষের রক্ত—
গাঢ় লাল, হে মার্কেটের স্রোত…
যার পাশে লাল শালু ফিকে, কদর্য ফ্যাকাসে।
বিকেলের আকাশ শেষবারের মতো সে-সত্য জানিয়ে গেলো।

লাল পতাকা এখন লাল পতাকার মুখোমুখি

(১৫ মার্চ ১৯৮৩)

কিছুই পাল্টাতো না, তবু
(বীরেনদাকে নিবেদিত)

তুমি ছুঁলেই সব কিছু পাল্টে যেতো না
লোহা লোহাই থাকতো, সোনা হ’তো না;
রাস্তা, বাড়ি, ঘোর, বস্তি,
মানুষ—সবই এক থাকতো;
এমন কি শব্দগুলোও পাখা লাগিয়ে উড়তো না,
কিংবা বর্শাও হ’তো না। তবু
অন্যায়কে ঘোরতর অন্যায় মনে হ’তো;
আর ভালোবাসা
কেমন নির্মল পবিত্র…

(২৬ জুলাই ১৯৮৫)

বেড়া ভেঙে দাও

আর কতো অন্ধকারে ডুবে যাবে
চোখের সামনে সেই কবে নিভে গেছে সূর্যাস্তের শেষ ছটা
স্মৃতি থেকে মুছে গেছে রক্তাক্ত মুখ
অতীত শপথে বিবর্ণতা

বেড়া দাও—বেড়া ভাঙো—
এ-যেন শৈশব-খেলায় মাতা
শুধু সুফলা-প্রান্তরে আজও তাণ্ডব
খোড়ো ঘরে ছেঁড়া-খোঁড়া মুখ
বেড়া দাও—বেড়া ভাঙো—
একচালা বস্তির সারি সারি বদ্ধ ঘরে ধোঁয়াশা
কুপির আলোয় কম্পমান শীর্ণ শরীর

আর কতো অন্ধকারে ডুবে যাবে
ভাঙো—বেড়া ভাঙো—বেড়া ভেঙে দাও—
মাটির গভীরে কান পাতো
আর কতো অন্ধকারে ডুবে যাবে

(২৫ জানুয়ারি ১৯৮১)

করতলে মুখ

এ-দু’খানি হাতে শূন্যতা ছাড়া কিছু নেই।
আছে শুধু বুকের রক্তে আঁকা মেহেদী নকশা;
নকশার জটিলতায় হৃদয়ের যতো আবেগ।

শূন্য করতল শক্ত ক’রে কিছু ধরতে চায়;
সামনে তুমি
জন্মভূমি, করতলে তোমার মুখ।

হাত ফসকে প’ড়ে গেছে
টিনের রঙচঙে ঝুমঝুমি, ইস্কুলের ছেঁড়া খাতা
জ্বলন্ত সিগারেট, নারীর নিরাভরণ হাত
নিজেরই রক্তমাখা ছোরা, বেহিসেবী সময়…

শূন্য দু’খানি হাতে তুমি
জন্মভূমি, করতলে তোমার মুখ।

(২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬)

রোদের কম্বল

ডোঙাজোড়ার কচি ছেলেটা
শীতে কাঁপতে-কাঁপতে
আমার কাছে একটা কম্বল চেয়েছিলো

তার পেটের মধ্যে পৌষের ফাঁকা মাঠ
সে-মাঠে চাষ হয় না
খড়ও না

দশবার উত্তুরে বাতাস শরীরে মেখে
দশ বছরের কচি ছেলেটা
এখন কুড়ির ডাঁশো যুবক

জন খাটতে-খাটতে
হলুদ ধানের শীষে বুনে চলে
রোদের কম্বল

(৫ জুলাই ১৯৮১)

গ্রহণ

কে আবার অসুস্থ হ’লো
কে জড়ালো অসুস্থ সময়ের পাকে?

হাঁসের পালকে ভাসা রাতের দুপুর
খাঁ খাঁ নির্জনতায় জ্যোৎস্নার কান্না।
তবুও ছিলাম ভালো এই নোনা চরে
নুনের পুতুল নিয়ে।

পিচের রাস্তা থেকে পিছল জ্যোৎস্না
হঠাৎ শুকিয়ে কার গভীর অসুখ!
চাঁদের শোকেতে রাত নিষ্ঠুর আঁধার ছড়ালে
পেঁচার চোখের দৃষ্টি হারায় তীক্ষ্ণতা।

গভীর রাতের হিম মাথায় ছিটিয়ে
ভয়ে ভয়ে জেগে থাকি
কে আবার অসুস্থ হবে?
কে হ’লো অসুস্থ এই রাতে?

মুছে নিতে রাত জাগা চোখের জ্বলুনি
যার কাছে ঋণী চাঁদ
তার কাছে ঋণ পেতে
অপেক্ষায় ব’সে থাকি এই মধ্যরাতে।

(৯ জানুয়ারি ১৯৮৯)

কে আছো ঘুমিয়ে

কে আছো ঘুমিয়ে
ফাটল ধরেছে দ্যাখো প্রাচীন দুর্গে
আহা, বাতাস বইছে একাকী গাছের পাতায়
আহত ঘোড়ার খুর শব্দে শব্দে ভাঙছে পাথর…

কে আছো ঘুমিয়ে
সবুজ পাতা বসতি গেড়েছে ফাটলে
আহা, আলোয় রচিত বৃত্তে রঙের খেলা
আহত ঘোড়ার খুর শব্দে শব্দে ভাঙছে পাথর…

কে আছো ঘুমিয়ে
ঝরনার জলে শীতল প্রলেপ ফাটলে
আহা, আকাশ নেমেছে পুরোনো দুর্গ প্রাকারে
আহত ঘোড়ার খুর শব্দে শব্দে ভাঙছে পাথর…

কে আছো ঘুমিয়ে
লোহার দরোজা করাঘাতে থরো থরো
আহা, দিগন্তে মিশেছে রুক্ষ পথের রেখা
আহত ঘোড়ার খুর শব্দে শব্দে ভাঙছে পাথর…

(২৭ জানুয়ারি ১৯৮২)

আরওয়ালের আসরফ মিয়া

তার কথা ছিলো মাটির নীচে শুয়ে থাকার;
শেষ পর্যন্ত সে ধোঁয়া হ’য়ে আকাশে মিলিয়ে গেলো!
আসলে দুই-ই সমান
মৃত্যুর পরে প্রতিটি মানুষই একটি লাশ, আর
মৃতদেহ যত দ্রুত সম্ভব লোকচক্ষু র আড়ালে হারিয়ে যায়
তার জন্যেই সৎকার—যে যেমন ভাবে করে। তাই

তার কথা ছিলো মাটির নীচে শুয়ে থাকার;
শেষ পর্যন্ত সে ধোঁয়া হ’য়ে আকাশে মিলিয়ে গেলো!

কিন্তু ধর্ম! আদিম ঐতিহ্যের সেই সংস্কার!

সে জানতো না ধর্মনিরপেক্ষ তারও শ্রেণীভেদ আছে!
আর পুলিশের গুলিতে নিহত ব’লে স্পষ্টতই সে একজন
সমাজবিরোধী—আত্মীয়-স্বজনের হাতে তুলে দেওয়া বিপজ্জনক;
অতএব সে তখন গাদার মরা, মুর্দা লাশ—
তাকে নিয়ে হত্যাকারীরা যা-ইচ্ছে-তাই করতে পারে ।

সে এতো কিছু জানতো না
রিক্সা চালাতো আর বিবি-বাচ্চা নিয়ে ঘর করতো। কিন্তু
একদিন একটা রিক্সা এসে কোনো মিছিলের পিছনে
দাঁড়াতেও পারে; কিংবা
মিছিলের সামনে নতুন ভাবে যাত্রা শুরু করতে…
কারণ কোনো কোনো মিছিল সত্যি-সত্যিই স্বপ্ন দেখায়।

সে স্বপ্ন দেখলো…

কিন্তু গরীবের স্বপ্ন রইস আদমিদের ঘুম কেড়ে নেয় —
রাষ্ট্র তখন হত্যাকারীর ভূমিকায় নেমে পড়ে। তাই

তার কথা ছিলো মাটির নীচে শুয়ে থাকার;
শেষ পর্যন্ত সে ধোঁয়া হ’য়ে আকাশে মিলিয়ে গেলো।

সে হয়তো একবারই চিৎকার করতে পেরেছিলো।
আল্লা বলেছিলো কিনা জোর দিয়ে বলা যায় না;
বিবি আর বাচ্চাকে খুঁজে ছিলো নিশ্চয়ই।

বিবি তাকে খুঁজছে সর্বক্ষণ, বেটা তার বাপজানকে ।
তাদের অসহায় গোঙানিতে
দিল্লি নয়, পাটনা নয়, জাহানাবাদের এসপি সাহেবে র বাংলো নয়
এমনকি আরওয়ালের কোতোয়ালিও নয়;
তাদের ছোট্টো ঝোপড়ির আঁধার ছায়া
দিন রাত থিরথির কাঁপছে।

মিয়াজান, সে-কাঁপন তোমার গোর কিংবা দাহের বিভ্রাটে নয়
তিন চাকার সংসারে একটি চাকা ফেঁসে গেছে ব’লে।
অ-চল রিক্সায় তবে পর্দানসীন বিবি রোটি পাকাবে কী ভাবে?
উপোসি সন্তানের মুখে তাই নীরব গোঙানি;
ঘটনা-স্তব্ধ বিবির মাতৃহৃদয় থেকে আপনি বেরিয়ে আসা বোবা আর্তনাদ
ভাঙা ঝোপড়ির দেয়ালে দেয়ালে অসহায় আছড়ে পড়ছে।

এমনকি
খুন আউর পসিনা দিয়ে সংগ্রহ করা
চাওল কিংবা ছাতুর মতো তোমার স্বপ্ন—
যার কথা তুমি শুনিয়েছিলে রাত গভীরে
তার কী হবে?—তা-ও তারা এই মুহূর্তে জানে না।

শুধু তোমার সাথীরা
মশানে দাউ দাউ জ্ব’লে ওঠা তোমার শহিদ-শরীর থেকে
এক টুকরো আগুন তুলে নিয়ে
সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়েছে…

এই গ্রীষ্মে সব কৃষ্ণচূড়া গাছের চূড়ায়
সে-আগুন আগুন-শপথে লাল হ’য়ে জ্বলছে—
যেন একশো বছরের মে দিবস!

(“১৯ এপ্রিল ১৯৮৬। বিহারের জেহানাবাদ জেলার আরওয়ালে উচ্চবর্ণের জমিদারদের পক্ষ নিয়ে রাষ্ট্র নামিয়ে এনে ছিল বর্বরতম আক্রমণ। পুলিশি নৃশংসতার শিকার হন ২৪ জন গরিব খেতমজুর। এপিডিআর-এর তথ্যানুসন্ধান দল পৌঁছয় কয়েকদিনের মধ্যেই। সে দলের অন্যতম সদস্য সুমিত চট্টোপাধ্যায়ের ৭ মে ১৯৮৬-তে লেখা এই কবিতা ১৯৮৯-এ প্রকাশিত তাঁর বই আহত ঘোড়ার খুর-এ অন্তর্ভুক্ত হয়।“ – কথা, কবিতা, স্মৃতি: সুমিত চট্টোপাধ্যায়; এপিডিআর)

কবি এবং গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি(এপিডিআর)-র সাথে নানাভাবে যুক্ত নিরলস সামাজিক-রাজনৈতিক কর্মী সুমিত চট্টোপাধ্যায় এবছর ৪ জুন এক দীর্ঘ রাজনৈতিক ও মানবদরদী যাপনের ইতিহাস রেখে চলে গেলেন। সুমিত চট্টোপাধ্যায় ষাটের দশকে নকশালপন্থী ‘দক্ষিণ দেশ’ গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হ’ন। একাত্তরে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে, ১৬ মাস পরে মুক্তি পান। নানা পর্বে রাজনৈতিক মতের নানান পরিবর্তন ঘটলেও আজীবন বামপন্থী ভাবধারায় বিশ্বাসী থেকেছেন, বন্দীমুক্তি আন্দোলনে একনিষ্ঠ ভাবে কাজ করেছেন। যুক্ত ছিলেন নাটকের কাজেও।

আমরা আয়নানগর থেকে সংহিতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং নীলাঞ্জন দত্তর কাছে কৃতজ্ঞ, এই কবিতাগুলি আমাদের একত্রিত করে দেবার জন্য এবং সুমিত চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে এপিডিআর থেকে প্রকাশিত ‘কথা, কবিতা ও স্মৃতি’ বুকলেটটি আমাদের যোগাড় করে দেবার জন্য।  

আরো পড়ুন: প্রতিবাদের স্বর । রবিন এস ঙঙ্গোম-এর কবিতা । ভাষান্তর – শুক্লা সিংহ