সিদ্ধার্থ বসু
হাসপাতালের সামনে একটা পাগল
রাত্রিবেলার প্রার্থনা করছিল
দিনের যত হল্লা আমার মাথায়
তখনও তার সামান্য ঘোর ছিল
ভাবছি যে তাই ভুল শুনলাম নাকি
ওর কথাটার শেষ কিছুটা বাকি
ফিসফিসিয়ে বলছিল ‘ও পাথর
এই বাড়িটার সবাই যেন বাঁচে!’
শুনশান সব পথঘাট চারদিকে
ঈশ্বরও কেউ ছিল না তার কাছে
জপের শেষে পথ পেরোতে গিয়ে
উলটে গেল উলকামুখী বাসে
হাসপাতালের সামনে একটা পাগল
মরে রইল নিজেরই অভ্যাসে!
(‘হাসপাতালের সামনে একটা পাগল’; সমস্ত ক্ষতের মুখে পলি)
এই নিতান্ত অবান্তর পাগলেরও চিন্তাসূত্রে যে বাসা বাঁধতে পারে এক সম্পৃক্ত হিতৈষণা – এ পরাবাস্তব একমাত্র শঙখ ঘোষই মনে করতে পারেন, আর মনে করিয়ে দিতে পারেন আমাদেরকে।
গত এক দেড় বছরে বেশ কয়েকজন প্রবাদপ্রতিম শিল্পী সাহিত্যিক ছেড়ে গিয়েছেন আমাদের। প্রত্যেকেই নিজের নিজের দ্যুতিতে ভাস্বর। কিন্তু আমাদের মতো একেবারে সাধারণ, নির্বিশেষ জনগণের – যারা সম্পূর্ণ ক্ষমতাহীন হয়ে অক্ষম ঘৃণা আর বিরোধ বর্ষণ ক’রে চলে প্রায় অচেনা কোনো ক্ষমতাকেন্দ্রের দিকে – মাথার ওপর অভিভাবকের মতো ছিলেন তিনি। এতজন কবির মুগ্ধ পাঠক আমি, অথচ এই মৃত্যুতে যে আত্মীয়বিয়োগের বেদনা পেলাম, এমন এর আগে আর হয়নি। সব অস্থিরতায় একটা লিপ্ত অথচ নীরব, স্থিত অথচ অর্থময় করতলের ছোঁয়া পেতাম যেন। আলতো চাপ কাঁধের ওপর। বা পিঠে মৃদু চাপড় দিয়ে বলে উঠতেন কেউ:
হলে হলো, না হলে নেই।
এইভাবেই
জীবনটাকে রেখো।
তাছাড়া, কিছু শেখো
পথেবসানো ওই
উলঙ্গিনী ভিখারিনীর
দুচোখে ধীর
প্রতিবাদের কাছে
আছে, এসবও আছে।
(‘হওয়া’; মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয়)
শঙখ ঘোষ চলে গেলেন। রয়ে গেল তাঁর সবাক নৈঃশব্দ।
একদিকে আগুনঝরা দিনগুলোর লেখা:
এই দিকে ওই দিকে তিন চার পাঁচ দিকে
টেনে নেয় গোপন আখড়ায়
কিছু – বা গলির কোণে কিছু অ্যাস্ফল্ট রাজপথে
সোনার ছেলেরা ছারখার
অল্প দু-চারজন বাকি থাকে যারা
তেল দেয় নিজের চরকায়
মাঝে মাঝে খড়খড়ি তুলে দেখে নেয়
বিপ্লব এসেছে কতদূর
এইভাবে, ক্রমাগত
এইভাবে, ক্রমাগত
ক্রমাগত
(‘ক্রমাগত’; আদিম লতাগুল্মময়)
আবার অন্যদিকে:
যা কিছুই দেখিশুনি সবই যেন মনে হয় আমি।
ওই যে চলেছে গঙ্গা – আমি হয়ে চলে সে সাগরে
সেখানে সমুদ্রপাখি আমারই ডানায় দূরগামী –
যতই বাঁধো-না কেন, কিছুতেই থাকব না ঘরে।
…
মাথা তুলে আছি আমি হিমাচলে চূড়ায় চূড়ায়
আমিই মাঠের বুকে ছড়ানো সবুজ নত ঘাস
পথ হয়ে আছি আমি, আমি আছি পথিকেরও পায়ে
সবারই চলায় লেখা আমার একার ইতিহাস।
(‘আমি’; সুর-সোহাগি)
এই মানুষী ও অমানুষী, প্রাণ ও অপ্রাণ প্রকৃতির দিগন্তছাপানো তাঁর নম্র দৃঢ় স্বর।
– সিদ্ধার্থ বসু
………
তিনি
আমি তাঁকে চিনতাম না
আমি তাঁর কবিতা পড়েছি
কবিতা পড়িনি তত
দেখেছি তর্জনী তাঁর, বিনম্র, অমোঘ
পদভারে উৎসারিত পথ
হাঁটিনি সে পথে আমি
অথচ বিপথে ফিরে
কাঁধছোঁয়া উষ্ণ করতল
আমায় ডাকেননি তিনি
আমায় উদ্দিষ্ট করে লেখেননি একটিও শ্লোক
অথচ সমগ্র তাঁর
কলম, সংবৃত স্বর, স্পর্ধা ও ঋজুতা
আমায় লালন করে
আমায় আত্মস্থ করে
অভয়, অশোক
.
‘ধূম লেগেছে হৃৎকমলে’
যে যত নিবিড় করে দ্যাখে সমকাল
আবহমানের খোঁজ সেই পায় তেমন প্রসারে
বাকিদের প্রতীক্ষায় মুছে যায় এ মহাসময়
শাশ্বত তাদের শুধু ফাঁকি দিয়ে এড়ায় পালায়
আলোর মতন কোনো চিরায়মানের গরুখোঁজা
শেষ হলে দেখা যায় এ মহা দুর্ভাগ্য দেশ জুড়ে চিতা জ্বলে উঠছে সারি সারি
– যখন জ্বলেছে চিতা, তোমরা চাও আলোর কবিতা? –
এই হুতাশনপাশে ডানা মুড়ে বসেছে ত্রিকাল
.
অবিশ্বাসী
লোকে বলে,
ভিতরকে জানতেন না তিনি
ঘর না চিনে বাইরের খবর নিতেন
কিন্তু তারা জানে না সে বাইরের দিকে
ছড়ানো থাকত তাঁর খোলা দুটি হাত
অসুখী আহত হৃত বিবাগী বিরাগী
সেই আঙুলের স্পর্শে ফিরত জীবনে
সেই বাইরের দিকে মেলা থাকত খর দুটি চোখ
ঝরে পড়ত যুগপৎ স্পর্ধা ও শুশ্রূষা
তাঁর অকৃপণ স্বর
গমগম বেজে উঠে চেনাত কোথায় কার ঘর
কিছুই কোথাও নেই – এ ব্যাখ্যান টুসকিতে উড়িয়ে
তবুতো এখনো আছি কয়জন বাকি
– আয় আরো আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি –
এ ঘরের ছবি যিনি আঁকতে জানতেন
তাঁর ঘরে অনেক জায়গা
কুটুম্বিতা পুরোটা বিশ্বের
………
সিদ্ধার্থ বসু কবি ও শিক্ষক
ফিচার ছবি – পার্থ মুখার্জি