অনুবাদ – অঙ্কিতা, নয়না

প্রথম প্রকাশ – আয়নানগর বইমেলা সংখ্যা ২০১৮

সাবির হকা ইরানের মজদুর ও কবি। সাবিরের জন্ম হয় ১৯৮৬ সালে, কেরমানশাহ তে। উনি এখন তেহরান এ থাকেন এবং ইমারত বানানোর কাজে মজদুরী করেন।

সাবির হকা-র দুটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে এবং ইরানের শ্রমিক-কবি হিসাবে তিনি প্রথম পুরস্কারও পেয়েছেন। সাবিরের কবিতা চাবুকের মতো পাঠকের মন চিরে যায় ও বহুক্ষণের জন্যে সেই অনুভূতির রেশ ছেড়ে যায়। কিন্তু, কবিতা যেহেতু পেট ভরায় না, সাবিরকে পেটের ভাত জোগাড় করতে এখনো মাথায় করে ইঁট-বালি বইতে হয়।

এক সাক্ষাৎকার এ সাবির বলেছিলেন, “আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। অপরিসীম ক্লান্তি আমার ! আমার জন্মের আগে থেকেই ক্লান্ত আমি। আমার মা আমাকে গর্ভে লালন করার সময় লাগাতার মজদুরী করেছিলেন, আমি সেই সময় থেকেই মজদুরে রূপান্তরিত। আমি আমার মায়ের ক্লান্তি অনুভব করি। ওনার ক্লান্তি যেন এখনো আমার শরীরে লেগে আছে।”

14
ছবি – কৌস্তভ চক্রবর্তী

তুঁতফল 

“আপনি কি কখনো তুঁতফল দেখেছেন?
যেখানে পড়ে, সেইটুকু মাটির ওপর
ওর লাল রসের দাগ হয়ে যায়
পড়ে যাবার মতো যন্ত্রণাদায়ক আর কিছু নেই
আমি কত মজদুরকে দেখেছি
বড় বড় ইমারত থেকে পড়ে যেতে…
আর পড়ে গিয়ে,
ঠিক তুঁতফল হয়ে যেতে….”

সরকার

পুলিশ আমাকে খুঁজছে …
আমি কাউকে খুন করিনি
এমনকি সরকারবিরোধী কোনো লেখাও লিখিনি!
শুধু তুমি জানো আমার প্রিয়তমা
জনতার পক্ষে কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে,
যদি সরকার শুধু এই জন্যে ভয় পায় আমাকে
যে আমি একজন মজদুর!
যদি আমি বিপ্লবী বা বিদ্রোহী হতাম, তাহলে?
কি করতো এরা তাহলে?
তবুও বলি, সেই বাচ্চাটার জন্যে
পৃথিবীটা আজও খুব একটা বদলায়নি
যে স্কুলের প্রত্যেকটা বই এর প্রচ্ছদে
নিজের ছবি দেখতে চেয়েছিল…

ঈশ্বর

ঈশ্বরও নিশ্চয় একজন মজদুর!
ঈশ্বর যেন সর্বশ্রেষ্ঠ ঝালাই মিস্ত্রী
গোধূলি-আলোতে ঈশ্বরের চোখ লাল হয়ে ওঠে,
যেন জ্বলন্ত কয়লা
আর রাত্রি পর্যন্ত শতছিদ্র হয়ে যায় তাঁর জোব্বা!

ঘর

তোমরা যদি বলো, সারা দুনিয়াকে আমি ওই নামে ডাকতে পারি!
দুনিয়ার সব দেশ, সব গ্রামকেও ডাকতে পারি ওই নামে।
আর আকাশ? হ্যাঁ তাকেও দিতে পারি ওই নাম!
সারা ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত কিছুকে ওই নাম ধরে ডাকতে,
এক মুহূর্তও দ্বিধা করবো না আমি!
কিন্তু দোহাই তোমাদের!
তেহরান এর ভাড়া করা জানলাবিহীন এই কালকুঠরীকে
তোমরা ওই নামে ডাকতে বোলো না !
আমি একে ঘর বলে কিছুতেই ডাকতে পারবো না!

বন্দুক

ওরা যদি বন্দুক আবিষ্কার না করতো
কত মানুষ বেঁচে থাকতো আজ!
যাদেরকে দূর থেকেই মেরে ফেলতে পারলো ওরা!
শুধু তাই নয়, আমার মনে হয়,
আরও অনেককিছুই অনেক সহজ হতো।
মজদুরের যে আসলে কতটা শক্তি,
তাও ওদেরকে বোঝানো  সহজ হতো!
যদি বন্দুকের আবিষ্কার না হতো…….

কেরিয়ার নির্বাচন

ব্যাঙ্কের সাধারণ একজন কর্মচারি হওয়া আমার দ্বারা হত না
খাবার দাবার ফেরি করা সেলসম্যানও না
কোন পার্টির নেতা হওয়াও আমার কম্ম নয়
ট্যাক্সি ড্রাইভার তো নয়ই
প্রচারে লেগে থাকা মার্কেটিং এর বান্দাও আমি নই
আমি শুধু চাইতাম
শহরের সবথেকে উঁচু জায়গাটায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখব
নিচের ঝলমলে বাড়িগুলোর মধ্যে কেমন দেখায় ওই মেয়ের ঘর
যাকে আমি ভালবেসেছি
তাই শেষমেশ ঢালাইয়ের মজদুর হয়ে গেলাম…

আমার বাবা

বাবার ব্যাপারে কিছু বলার সাহস যদি করে উঠতে পারি
তাহলে বিশ্বাস করুন,
বাবার জীবনে আনন্দ বলে কখনোই তেমন কিছু ছিল না
এই লোকের জীবন নিজের পরিবারের জন্য নিবেদিত ছিল
পরিবারের ঘাটতি যাতে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকে
সেজন্য নিজের জীবনকে কঠিন, বন্ধুর বানাতে দ্বিধা করেননি তিনি
আর আজ
যখন আমার কবিতা ছাপা হয়ে বেরোয়
শুধু একটা কথা ভাবলেই মাথা হেঁট হয়ে যায় লজ্জায় –
বাবা আমার পড়তে পারেন না।

আস্থা

আমার বাবা শ্রমিক ছিলেন
আস্থাবান, নিষ্ঠাবান শ্রমিক
যখনি উনি নামাজ পড়তে বসতেন
(আল্লাহ) ওঁর হাতদুটো দেখে লজ্জিত হতেন

মৃত্যু

এক রাতে মা বলল
সে নাকি জানে মৃত্যুকে কেমন দেখতে
তার নাকি ইয়াব্বড় ঘন গোঁফ
আর চওড়া সুগঠিত কাঁধ, যেন কোন বডিবিল্ডার
সেই রাত থেকে আমার নিষ্পাপ নিরীহ মা’কে
আমি সন্দেহের চোখে দেখি

বন্ধুত্ব

আমার সাথে (ঈশ্বরের) বন্ধুত্ব হয়ে ওঠেনি
তার কারণ একটাই
বহুদিন আগে ঘটা একটা ঘটনা;
তখন আমাদের ছয় জনের পরিবার
একটা ছোট্ট কামরায় কোনমতে চাপাচাপি করে থাকত
অথচ (ঈশ্বর) থাকত একটা বিশাল বাড়িতে
একেবারে একা।

বর্ডার

কাফন যেমন লাশকে ঢেকে রাখে
বরফও অনেক কিছুকে ঢেকে দেয়।
ইট কাঠের কংকাল বেরিয়ে পড়া বাড়ি,
গাছ, কবর সবকিছুকেই সাদা চাদরে ঢেকে দেয় বরফ
শুধু বরফই পারে
দুনিয়ার সকল বর্ডারকে সাদা রঙে রাঙিয়ে দিতে।

একমাত্র ভয়

যখন আমি মারা যাবো,
সঙ্গে নিজের সব প্রিয় বই নিয়ে যাবো আমি!
আমার কবর-বাড়ি ভরে দেব তাদের ছবি দিয়ে,
যাদের আমি সীমাহীন ভালোবাসি।
ভবিষ্যতের কোনো দুশ্চিন্তাই আমার সেই নতুন বাড়িতে থাকতে পাবে না!
আমি শুয়ে থাকবো বেফিকির,
সিগারেটের পর সিগারেট জ্বালাবো
আর ফুঁপিয়ে উঠবো তাদের কথা ভেবে,
যে সব মেয়েদের আমি কখনো ভালোবেসেছিলাম,
আর যাদের জড়িয়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিলাম!
এই সমস্ত সুন্দর ভাবনার ভেতরেও শুধু একটা মাত্র ভয় থেকে যাবে কোথাও!
যদি কোনো এক দিন, ভোর না হতেই,
কেউ আমার কাঁধে ধাক্কা দিয়ে উঠিয়ে আমায় আবার বলে,
“চল রে সাবির! কাজে বেরোতে হবে!”

3 thoughts on “সাবির হকা-র কবিতা

  1. প্রকৃত অর্থেই লিটল ম্যাগাজিন এটি। সাবির হকার কবিতা নিয়ে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করুন । ওঁর দুটি বই পাওয়া যায়। উর্দু থেকে বাংলা করা যাবে। প্রয়োজন কবির একটি সাক্ষাৎকার নেওয়া।

    সাবির হকাকে নিয়ে বাংলায় এক মাত্র আপনারাই কাজ করেছেন।
    শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

    পত্রিকাটি সংগ্রহ করতে চাই।

  2. সাবির হকা যেন সত্যিই কোনো মজদুরের মতনই কবিতা লেখেন। তাঁর লেখা পড়ে মনে হলো, কাঁধে ভারী বোঝা নিয়ে ধীরে ধীরে উঠছেন। বুকভরা আঁকুতি নিয়ে কবিতার ইতিউতি ছড়ানো। একরাশ ধু ধু বালুরাশি, মধ্যিখানে কোনো এক খেজুর গাছের পাতা নড়ছে। সারাদিনের খাটুনি শেষে মৃদু বাতাসে যেন চোখ বন্ধ হয়ে আসে। দূরে আজানের সুর!

  3. সাবির হাকার বই এর বাংলা অনুবাদ থাকলে জানাবেন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.