নন্দিনী ধর

“কস্তুরী, দ্বৈপায়ন ব্যানার্জি‌ ও তাঁদের বন্ধুরা যাঁরা ফেসবুকে ‘আসা যাওয়ার মাঝে’ – সিনেমাটি নিয়ে আলোচনা জারি রেখেছিলেন তাঁদের সকলকে ধন্যবাদ। এই লেখাটি লিখতে গিয়ে তাঁদের আলোচনা আমায় ভাবিয়েছে এবং সমৃদ্ধ করেছে।” – নন্দিনী

আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্তর ছবি আসা যাওয়ার মাঝে (Labour of Love) নিয়ে সাম্প্রতিক কালের কলকাতার আঁতেল জগতে বিস্তর আলোচনা। মিথ্যে বলব না, এই মুহুর্তে  বাংলা ছবির যা বাজার, সেখানে দাঁড়িয়ে ছবিটি অন্তত কিছু প্রশ্ন তৈরি করতে পেরেছে। পেরেছে কিছু আলাপচারিতা বা বিনিময়ের ক্ষেত্র তৈরি করতে। তাই বা কম কিসে? কিন্তু, তার পরেও যে থেকে যায় আরও অনেক প্রশ্ন, থাকে চিত্রকল্প, শব্দ, সঙ্গীত  ইত্যাদির সমন্বয়ে তৈরি ছবিটির যে জটিল বয়ান, সেই বয়ানটি-র কাটাছেঁড়া, বিশ্লেষণ। না, যে উচ্ছাসমগ্ন সমালোচনা এ ছবিটির আমি দেখেছি আনন্দবাজারের পাতা থেকে সোশ্যাল মিডিয়ার ওয়ালে, তার আমি গলা মেলাবো না।  বরং শুরু করি ছবিটির একটি সমালোচনার কয়েকটি অংশ উদ্ধৃত করে।
Mad About Moviez ওয়েবসাইটে অমিতভূষণ ছবিটির ভূয়সী প্রশংসা করার পর, উপসংহারে লিখলেন,

There are obvious questions that remain unanswered- apart from the brief hints at mills closing down and people loosing jobs not much is made of the recession and its effect on this couple. They could very well have been a regular couple in Mumbai in the best of economic weather. However, flaws like these are a pure result of nitpicking in a film that otherwise is straight up the alley of a Jeanne Dielman and 23 Quai du Commerce.

তো, যাকে অমিতভূষণ বলেছেন “নিটপিকিং” অর্থাৎ, খুঁতখুঁতানি, আমি ঠিক সেখান থেকেই শুরু করব। অর্থাৎ, সেই অর্থে বলতে গেলে, যে যে বিষয়গুলিকে বেশিরভাগ প্রকাশিত সমালোচনায় ঠেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে মার্জিনে, ঠিক সেই সেই বিষয়গুলিই  থাকবে আমার এই সমালোচনার কেন্দ্রে।

তো, ছবিটার শুরু ঝাপসা শহরের অনুষঙ্গে, ব্যাকগ্রাউন্ডে ধারাভাষ্য — ১২,০০০ মানুষ চাকরি হারিয়েছেন ইদানিং সময়ে। ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের বিক্ষোভ, পথ অবরোধে ফেটে পড়ছে শহর কলকাতা। প্রথম বিশ্বের যে অর্থনৈতিক মন্দা, তার ছাপ এসে পড়েছে কলকাতা শহরে। কোথাও যেন একটা দর্শক হিসেবে আমাদের মন তৈরী করে দেয় এই কমেন্টারি। ইদানিংকালের বাংলা ছবির যে নিপাট গার্হস্থ্য-ইতিবৃত্ত, তার পুনরাবৃত্তি বোধহয় তাহলে ঘটাবে না এ ছবি। এই তো পর্দায় শুনতে পাচ্ছি আমাদের সমকাল। ২০০৮-পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দা-বিধ্বস্ত পৃথিবীর কাহিনী। ধন্দও জাগে। বিশেষত, ছবির বাংলা ধারাবিবরণীতে যখন বলা হয় ১২,০০০ মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবি-কর্মী বরখাস্ত হয়েছেন, অথচ, ইংরেজি সাবটাইটেলে লেখা হয় “workers” । মানে, “workers ” শব্দটির তো একটি লম্বা ইতিহাস আছে — রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক , সাংস্কৃতিক। মাইনেভুক যে কোন কর্মীকেই “ওয়ার্কার” বলে অভিহিত করাই যায়। কিন্তু, আমরা করি না। কারণ, ওই যে বললাম, শব্দটির আছে কিছু বিশেষ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সংস্কৃতিক দ্যোতনা। স্বাভাবিকভাবেই  তাই প্রশ্ন জাগে, পরিচালক ঠিক কি ভেবে মিলিয়ে দিলেন এই দুটি শব্দকে ? বা, বলা ভাল, শ্রেণী-অবস্থানকে ?
ছবি চলতে থাকে, ক্যামেরা নড়তে থাকে। পর্দায় বাড়ির দেয়াল — পলেস্তারা খসা। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে সানাই। পর্দায় টুকরো সাবানের শট, শেওলা ধরা বাথরুমের দেয়াল। আমরা বুঝি, এ সবই হলো নিম্নবিত্ত গেরস্থালির টুকরো টুকরো দৃশ্য। বলা যেতে পারে, পরিচালক আদিত্যবিক্রম সেনগুপ্তর জগত একধরনের বস্তুজগত। নিম্নমধ্যবিত্ত এক দম্পতির একচিলতে ঘরের  আনাচকানাচ তাই উঠে এসেছে ছবির ক্যামেরায়। ঘড়ি, বিছানার চাদর , আলমারি, মাসান্তের মাইনে রাখার টিনের বাক্স, জলের গেলাস, বাটি, টিফিনবাক্স, জলের কল, ভাতের থালা। আরো ছোটখাটো কত কি! অবাক হই না। বস্তুর সমাহারেই তো গড়ে ওঠে আমাদের জীবন। বিশেষত: মধ্যবিত্ত জীবন। বস্তু মানে তো গল্প, স্মৃতি, ইতিহাস। ছোট ছোট নাটক। প্রাত্যহিকতা। যা কিনা কত সময়ে হারিয়ে যায় “বড়”- র টানে। স্থান পায় না প্রথাগত টেক্সটবইয়ের ইতিহাসে। কিন্তু, আবার সেইসব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুগল্পের মধ্যেও তো ধরা পড়ে আমাদের পরিকাঠামোগত যাপন। আসলে, কোনো ছোটই তো তেমন ছোট নয়। নয় ক্ষুদ্র। তো, সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রে‌র প্রতি আদিত্যবিক্রমের  এই দৃষ্টিনিক্ষেপ আমাদের সেই কথাই আবার করে মনে করিয়ে দেয়।
যেমন ধরুন, ছবির দুই চরিত্রের অন্যতম মূল চরিত্র বাসবদত্তা চট্টোপাধ্যায়। ক্ষমা করবেন, পাঠক। ছবিতে চরিত্রদের কোনো নাম নেই। তাই, এ লেখার চিহ্নক হিসেবে ব্যবহার করছি অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নামই। তো, ট্রামে বসে বাসবদত্তা মোড়ক খোলেন একটি বাপুজি কেকের। অতীব সাধারণ দৃশ্য।  সাতসকালের বাসট্রাম ঠেঙিয়ে কর্মস্থলে যাবার মুখে চটজলদি কিছু একটা দাঁতে কেটে নিচ্ছেন নিম্নবিত্ত চাকুরিরতা মেয়ে।  কিন্তু, সেই কিছু একটা আদতে হলো গিয়ে বাপুজি কেক।  আর, ক্যামেরাবন্দী এই বাপুজি কেকের দিকে চোখ রেখে হলভর্তি দর্শক আমরা, দেখি শুধু সস্তার কেক নয়, কেকরূপী শ্রেণী পরিচিতির সুচক।
তো, এইভাবেই বস্তুরা আসাযাওয়া করে এ ছবিতে — রূপক হিসেবে, সামাজিক দৃশ্যমানতার সুচক হিসেবে। ঠিক যেভাবে তাই আদিত্যবিক্রমের ক্যামেরায় ধরা পড়ে গৃহের অভ্যন্তর, তেমনি করেই, তাঁর ক্যামেরায় ধরা পড়ে বাইরের পৃথিবীও — বিড়াল, উত্তর কলকাতার  কানাগলি, ট্রামলাইন, সাইকেল, সবজি  বাজার, কাক, ছাপাখানার অভ্যন্তর, মেশিন, মেশিন চালানো শ্রমিকের হাতের আঙুল। এই কারখানাতেই কাজ করেন বাসবদত্তার স্বামী ঋত্বিক। ক্ষমা করবেন আবারও। লেখার সুবিধার্থে অভিনেতার নামই ব্যবহার করলাম। আসলে এ ছবি তো এই দুই অনাম্নী নারীপুরুষের ছবি। স্বামী ও স্ত্রী। না, এই ছবিতে কোন পরিচিত প্লট নেই। আমাদের চেনা ছকের কোনো আখ্যান বা গল্প নেই। নেই কোন সংলাপ। যদিও, সাইলেন্ট ছবিও নয় এটি। এবং, পরিচালকও বারবার জোর দিয়ে বলেছেন সেকথা তাঁর বিভিন্ন সাক্ষাতকারে। কথোপকথন আছে এই ছবিতে — বাসবদত্তার  সাথে তার সহকর্মীদের। কিন্তু, কর্মক্ষেত্রের নিয়মমাফিক শব্দগর্জনে  ঢেকে যায় সে কথোপকথন।এবং, তাতে কিছু যায় আসে না। কারণ, আমরা জানি, ওগুলি হলো নিতান্তই কেজো, মামুলি কথা। কর্মক্ষেত্রের উৎপাদনব্যবস্থাতার  চলমানতার বাইরে অর্থহীন। তাই, কথোপকথন আছে এ ছবিতে। সংলাপ নেই।
আসলে, এ ছবি  তো আদতে এক নিম্নবিত্ত দম্পতির রোজনামচার ছবি, প্রাত্যহিকতার ছবি। বা, আরো বিশদে বলতে গেলে, এক নিম্নবিত্ত দম্পতির একটি নিয়মমাফিক, গড়পড়তা দিনের ছবি।তাঁরা কাজে যান, কাজ থেকে বাড়ি ফেরেন। বাড়ি ফিরে বাজার করেন। ঘরকন্নার নিত্যনৈমিকতায় ডুবে যান। সে নিত্যনৈমিকতায় কোনো অসাধারণত্ব নেই। নাইটডিউটি করেন স্বামীটি। কাজ শেষে সকালবেলা যখন বাড়ি ফেরেন, তখন তাঁর স্ত্রীর কাজে বেরোনোর সময়। স্ত্রী যখন বাড়ি ফিরবেন, ততক্ষণে আবার কাজে বেরিয়ে গেছেন তার স্বামী। কাজেই, সারাদিনের মধ্যে সকালের ওই কয়েক মিনিটমাত্রই তাঁরা একসাথে কাটান। বলতে গেলে, সেখানেই ছবিটির মূল সংঘাত। এ ছবিতে আমরা দেখলাম এমন এক দম্পতিকে যাঁদের আছে  এক নিপাট গার্হস্থ্য। নিম্নবিত্ত, টানাটানির সংসার, তবু নিপাট। শুধু সেই গার্হস্থে নেই কোনো নিপাট দাম্পত্যসুলভ যৌথতা। তার বদলে আছে ক্রমবর্ধমান কাজের দিন।পুঁজিনির্ধারিত সময়। সে সময়ের ঘড়ির কাঁটার শাসন মেনে উৎপাদনে অংশগ্রহণ। অর্থাৎ, চাকরি। তাই, কোথাও  যেন এই ছবিতে আছে গার্হস্থ্যের সাথে পুঁজির বিরোধ। কিন্তু আবার, পুঁজির সময়ের কাছে মাথা নত করার মধ্যে দিয়েই টিকে থাকে তাঁদের গার্হস্থ্য, তার নৈপাট্য। এবং, দ্বন্দ্ব সেখানেই।
তো, এই যে দ্বৈততা, এর মধ্যে সেরকম কোনো নতুনত্ব নেই। একভাবে বলতে গেলে, সেই কবেই তো এসব তাঁদের  মত করে বলে গেছেন মার্কসসাহেব এবং তাঁর বন্ধু-সহচর এঙ্গেলস। আর, যে গল্পের খোলসে তৈরী আদিত্যবিক্রমের  ছবি — অর্থাৎ, এক দম্পতির একটি দিন — সেও এর আগে আমরা পড়ে ফেলেছি। ইতালো ক্যালভিনোর ছোটগল্পে। ইংরিজি অনুবাদে গল্পটির নাম “দ্য আডভেন্চার্স অফ আ ম্যারেড কাপল।”
ক্যালভিনোর গল্পে মূল চরিত্র দুটি: আর্তুর মাসলারী ও তাঁর স্ত্রী এলিদে। পেশায় তাঁরা কারখানা শ্রমিক। রাতের শিফটে কাজ সেরে আর্তুরো যখন ঘরে ফেরেন, তখনও তাঁর স্ত্রী ঘুম থেকে ওঠেননি। গল্পের কথক আমাদের জানান, ঘড়ির অ্যালার্মের শব্দ আর তাঁর স্বামীর আগমন — পায়ের শব্দ — কোথাও যেন এক হয়ে যায় এলিদের মনে। ঘরে ঢুকেই কফি বসান আর্তুরো। আর, এলিদে সদ্য ঘুমভাঙ্গা আলুথালু বেশে রান্নাঘরে আসেন। কোনও কোনও দিন কফি হাতে শোবার ঘরে এসে স্ত্রীকে ডেকে তোলেন আর্তুরো। এই প্রভাতী প্রাত্যহিকতায় এইটুকুই তাঁদের বৈচিত্র। আর, ক্যালভিনোর গল্পে, এই মামুলি মুহূর্তগুলিই হাজির হয় একধরনের শরীরী ঘনিষ্ঠতাকে অনুষঙ্গের হাত ধরে। সে ঘনিষ্ঠতাকে যৌনতা বলা যেতে পারে। কিংবা, নয়।
ধরুন, এই মুহূর্তটি :

He had already lighted the stove and started the coffee. As soon as he looked at her, Elide instinctively ran one hand through her hair, forced her eyes open, as if every time she were ashamed of that first sight her husband had of her on coming home, always such a mess, her face, half-asleep. When two people have slept together it’s different, in the morning both are surfacing from the same sleep, and they’re on a par.

কিংবা:

Sometimes, on the other hand, it was he who came into the bedroom to wake her, with the little cup of coffee, a moment before the alarm rang; then everything was more natural, the grimace on emerging from sleep took on a kind of lazy sweetness, the arms that were lifted to stretch, naked, ended by clasping his neck. They embraced.

বলা যেতে পারে, এই  শারীরিক ঘনিষ্ঠতা, বা ঘনিষ্ঠতার অভাব  এবং আকাঙ্ক্ষা গল্পটিতে যোগ করে একটি অতিরিক্ত মাত্রা। তাই, সকালের ক্রিয়াকর্ম সারতে প্রায় নগ্ন তাঁরা যখন একে অন্যেকে  সাবান মাখানোর অছিলায় কাছাকাছি আসেন, তখন এলিদের হঠাৎ বলে ওঠা, “কটা বাজে এখন?” কোথাও একটা পাঠক হিসেবে আমাদের যেন ধাক্কা দেয়।
ধাক্কা দেয় কারণ আমাদের বড় হয়ে ওঠা, বেঁচে থাকা এসবের মধ্য দিয়ে এটাই তো আমরা শিখেছি — এই যে নারীপুরুষের মধ্যেকার যৌন ঘনিষ্টতা — তাও আবার বিবাহিত যৌনতা, এই নাকি সম্পর্কের অন্যতম পবিত্রতম রূপ। ব্যক্তিগততমও বটে। এই বিবাহিত যৌন ঘনিষ্ঠতার ওপরেই নাকি দাঁড়িয়ে থাকে আমাদের সুখী গৃহকোণ যত, সেসবের ভিত্তিভূমি — তেমনটিই তো শিখিয়েছে আমাদের এই সমাজ। তেমনটিই তো বলে বাণ্যিজিক সিনেমা, এই এত এত প্রেমের গান, আমাদের সাধারণ সামাজিক বুদ্ধি। অর্থাৎ, এই যে যৌন প্রেম, গার্হ্যস্থতা ও ব্যক্তিগততার সামাজিক সমীকরণ, এই-ই তো সামাজিক স্থিতিস্থাপকতার লিঙ্গ রাজনীতি। কিন্তু, আমাদের চোখের মণির ঠিক মাঝখানে আঙ্গুল খুঁড়ে ক্যালভিনো যেটা আমাদের বোঝালেন তা হল, আসলে এই ব্যক্তিগততার কোনো অস্তিত্ব নেই। যেমন অস্তিত্ব নেই  কোনো নিখাদ গার্হস্থ্য ব্যক্তিগততার। তাই আর্তুরো ও এলিদের যৌন ঘনিষ্ঠতা পরিচালিত হয় ঘড়ির কাঁটার নিয়মে। পুঁজির নিয়মে। পুঁজির সময়ে। এবং, আর এক পদক্ষেপ এগিয়ে বললে, পুঁজিই নির্মাণ করে তাঁদের প্রেম ও যৌনতার প্রতিদিনকার চলমানতা। আবারও, আমাদের নিখাদ প্রেম ও যৌনতার ধারণা ভাঙ্গতে থাকে। সত্যিই যদি এমনটি হয় যে আসলে পুঁজির দ্বারাই নির্মিত হয় আধুনিক প্রেম, তাহলে ঠিক কোথায় দাঁড়াবে এই যত পবিত্র প্রেম ও ব্যাক্তিগততার সমীকরণ?
পুঁজিচালিত সমাজে আসলে কোনও কিছুই ব্যক্তিগত নয়। নারীপুরুষের প্রেম নয়, যৌনতা নয়।  বিবাহ তো নয়ই। তাই, তাঁর গল্পে, ক্যালভিনো আর্তুরো ও এলিদের ব্যক্তিগততার আকুলতা, নির্জন শারীরিকতার আকুলতাকে একটি অন্য মাত্র দেন। যৌন ব্যক্তিগততা এখানে যে ঠিক পুঁজিবিরোধী প্রতিরোধের তীব্রতা নিয়ে হাজির এমনটি নয়। কিন্তু, পুঁজিবাস্তবতা, পুঁজিযৌক্তিকতার বিপরীতের একধরণের অন্যতার অন্বেষণের ক্ষেত্র হয়ে ওঠে নারীপুরুষের মধ্যেকার যৌনতা। অন্যদিকে, গল্পটির আখ্যান জুড়ে যে গার্হস্থ্যতার বুনোট, সেখানে ছোট্ট ছোট্ট  — প্রায় অদৃশ্য — কয়েকটি হস্তক্ষেপ ঘটান আর্তুরো। যেমন, গল্পের শুরুতেই আমরা দেখি, সকালের কফি বানাচ্ছেন আর্তুরো। এলিদে নন। রাতের খাবারও একইসাথে বানাচ্ছেন তাঁরা। এর মধ্যে দিয়ে পিতৃতন্ত্রবিরোধী কোনও আমূল পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে, এমন কোনো দাবি আমি করছি না। ক্যালভিনো করেছেন বলেও মনে করি না।  কিন্তু, এর মধ্যে দিয়ে উঠে আসে গভীরতর সত্য: যে পুঁজিযুক্তি একটি শ্রমিক পরিবারের ব্যক্তিগততাকে ধ্বংস করে দেয়, সেই একই পুঁজিযুক্তি আমাদের প্রচলিত যে গার্হস্থ্য লিঙ্গ-বিভাজন, তারও কোথাও যেন বিনির্মাণ ঘটায়। আর,এই দ্বৈততার দোলাচলেই জীবন কাটান ক্যালভিনোর আর্তুরো, ক্যালভিনোর এলিদে।
কেওয়ান করিমির অ্যাডভেন্চারাস অফ আ ম্যারেড কাপল :
ক্যালভিনোর গল্পের এই মূল বয়ানটিকে ঘিরেই একটি ছোট্ট এগারো মিনিটের ছবি বানালেন ইরানের তরুণ চলচ্চিত্রকার কেওয়ান করিমি। আখ্যানের কাঠামো সেই একই  — এক শ্রমিক দম্পতি, তাঁদের একচিলতে ঘর, ক্রমবর্ধমান কাজের দিন। পুরুষটি নাইট ডিউটি করেন, মহিলা কাজে বেরোন সেই সাতসকালে। শুধু যেখানে ক্যালভিনো দেখতে চেয়েছিলেন পারস্পরিক যৌন ব্যক্তিগততার মধ্য দিয়ে ব্যতিক্রমতার খোজ, সেখানে আমরা করিমির ছবির পর্দায় দেখলাম যৌনতা বা ঘনিষ্ঠতার ব্যাপক অনুপস্থিতি। এই দম্পতির মধ্যে তাই কখনো কোনো শারীরিকতার সামান্যতম কোনো বিনিময় ঘটে না। তাঁরা খেতে বসেন একইসাথে, একই টেবিলে। কিন্তু, কোনো বাক্য বিনিময় ঘটে না তাঁদের মধ্যে। গলা খাঁকারি, একে অন্যের দিকে চোরা চাহনি — এসবের মধ্যেই শেষ হয়ে যায় তাদের পারস্পরিক বিনিময়। যেন আর কিছুই বলার নেই তাঁদের একে অন্যেকে। সব কথা শেষ। দর্শক হিসেবে আমরা প্রশ্ন করি, কেন এই যৌথতা ? কেনই বা একসাথে থাকেন এই নারীপুরুষ ? থাকতে হয় বলে ? এই বিবাহিত যৌথতা ভাঙ্গার সাহস নেই বলে ? বিবাহিত ভালবাসার আরেক নাম কি অভ্যস্ততা? গার্হস্থ্য স্থিতিস্থাপকতা?
অন্যদিকে, যৌনতা যখন হাজির হয় করিমির ছবিতে, তখন তা আসে বাণিজ্যিকতার নিয়মে।পানীয় কারখানার অ্যাসেম্বলি লাইনে বোতলের পর বোতলের পর বোতলের হদিস রাখতে রাখতে ছবির অন্যতম মুখ্য চরিত্র নারীটি দেখেন তাঁর বসের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করছেন তাঁদেরই এক সহকর্মিণী। কর্মক্ষেত্র তাই আর শুধু কর্মক্ষেত্র থাকে না, হয়ে ওঠে যৌনায়িত একটি পরিসর। যে যৌনতাকে আবার ঠিক প্রেম বা ঘনিষ্ঠতার মাপকাঠিতে ধরা যাবে না।
অন্যদিকে,তাঁর স্বামী সিকিউরিটি গার্ড। কাজ করেন মানেকুইনের এক গুদামঘরে। ছবির পর্দায় আমরা তাই দেখি, সারি সারি মানেকুইন। কিন্তু, দোকানবাজারের ঝলমলে আলো-জাদু মাখানো মায়ারূপ রহিত, নগ্ন, কংকালসার। আসলে, এই কংকালসার দাঁত-খিঁচোনো বাস্তবতার নামই তো বাজার। ঝলরমলর জামাকাপড়, মুখোশ পরে যা হাজির হয় আমাদের সামনে। অন্যভাবে, আরেকটু বেঁকিয়েচুরিয়ে বলতে গেলে, বাজারবাস্তবতার মত পরাবাস্তব আর কি-ই বা আছে এ জগতে? আর, এই বাজারবাস্তবতা-পুঁজিবাস্তবতার জালেই তো জড়িয়ে আছে এই দম্পতির জীবন। সেখানে তাই প্রাত্যহিকতা আছে, প্রেম নেই।  গার্হস্থ্যতা আছে, উত্তরণ নেই।
আসা যাওয়ার মাঝে / লেবার অফ লাভ:
তো, যখন আদিত্যবিক্রম সেনগুপ্ত তাঁর লেবার অফ লাভ বাআসা যাওয়ার মাঝে বানালেন, তিনি ক্যালভিনো-করিমির ব্যবহৃত এই কাঠামোটিকে রাখলেন। কিন্তু, যেখানে করিমি আশ্রয় নিয়েছিলেন সংক্ষিপ্ততার নান্দনিকতায়, আদিত্যবিক্রম  সেখানে মুহূর্তগুলিকে টেনে টেনে প্রলম্বিত করলেন। তাই ক্যামেরার পর্দায় আমরা দেখলাম, রান্নাঘর, রান্নার প্রক্রিয়া, মাছের ঝোলে সবুজ পেঁয়াজকলি, পর্দা জুড়ে চাল, ডাল, মশলার গভীর নন্দনায়িত শট। দেখলাম, লাল সিমেন্টের মেঝেতে বাসবদত্তার ভেজা পায়ের ছাপ, ঋত্বিকের বাজার করা, মাইনের  চেক ভাঙানো, বাড়ির গলি, বেড়াল — এরকম হাজারো একটা প্রাত্যহিকতার ডিটেল।
দেখলাম। এবং, মুগ্ধ হলাম। কি অসাধারণ সব শট। কি সুন্দর ! কি দারুণ কামেরার কাজ। এবং, এখানেই যে আসলে ছবিটির দৃশ্যমানতার রাজনীতি। যেখানে ক্যালভিনো ও করিমি দেখাতে চেয়েছিলেন পুঁজিযুক্তি ভারাক্রান্ত গার্হস্থ্যতাকে, সমস্যায়িত করতে চেয়েছিলেন সেই গার্হস্থ্যতার বস্তুযুক্তির বুনোট, সেখানে আদিত্যবিক্রমের ক্যামেরা নন্দনায়িত করে তুলতে চাইল সেই একই বস্তুযুক্তি ভারাক্রান্ত গার্হস্থ্যতাকে।
আর, তা করতে গিয়ে আদিত্যবিক্রম শরণাপন্ন হলেন অন্যান্য নয়া-উদারনৈতিক সাংস্কৃতিক  ধারাগুলির। যেমন, ইনস্টা‌গ্রাম করা আলো-আঁধারি স্থিরচিত্র। সবেতেই তার কেমন যেন ভিনটেজ ভিনটেজ ভাব। অতীতকে রোমাঞ্চকর, রোমান্টিক করে হাজির করার প্রবণতা। পাতি বাংলায় যাকে এক্সোটিসাইজ করা বলে আর কি। যেমন, নব্যধারার  খাদ্যস্থিরচিত্র। ফুড ব্লগ, নতুন নতুন খাদ্যসম্পর্কিত বই– নব্যনির্মিত তথাকথিত “ফুডি কালচার” যেসব সাংস্কৃতিক ভিত্তির ওপর দাড়িয়ে আছে — সেই নান্দনিকতার যথেচ্ছ ব্যবহার। তাই, একদিকে উত্তর কলকাতার ঘুপচি গলি, নিম্নবিত্ত পরিমণ্ডল নিয়ে ভাবালুতা, অন্যদিকে সেই নিম্নবিত্ততাকেই অঢেলের প্রতীক হিসেবে ছবির পর্দায় হাজির করা — এই দৈততার ওপর দাঁড়িয়ে আছে আদিত্যবিক্রমের ছবি। পর্দায় চালডাল মশলার গ্ল্যামারাইজড ছবি একের পর এক দেখতে দেখতে তাই আমরা ভুলে যাই, এ হলো গিয়ে শ্রমিক দম্পতির জীবন, মধুর জাফ্রির রান্নার বইয়ের ছবি নয়।
প্রসঙ্গত:, ছবিটি দেখতে দেখতে প্রশ্ন জাগে অনেক।  আচ্ছা, পাড়াপড়শীদের সাথে একটিও কথা না বলে কি করে কাটানো সম্ভব নিম্নবিত্ত কলকাতায় একটি দিনও? যে ছোট কারখানা বা অফিসে কাজ করেন তাঁরা, সেখানেও কি তা সম্ভব ? আচ্ছা, গভীর  রাতে যখন স্বামীটি  ফোন করেন তাঁর স্ত্রীকে, কেন একটিও কথা বিনিময় করেন না তাঁরা ? মানে, ঋত্বিক তো ফোনটা করছেন তাঁর অফিসের ল্যান্ডলাইন থেকে, কাজেই তাঁর নিজের পয়সা ওঠার কোনো ব্যাপার নেই। নিজের মোবাইল থেকে করলেও না হয় কথা ছিল। তাহলে ? এরকম একাধিক প্রশ্ন তৈরী হয়  ছবিটি দেখতে দেখতে। মানে, বাস্তববাদের কঠোর যৌক্তিকতার কথা যদি ছেড়েও দিই, তবুও বলতেই হয়, ছবিটা দেখতে দেখতে বারবার কেমন যেন মনে হয়, আসলে যে জীবনটিকে পরিচালক দেখাতে চেয়েছেন এই ছবিতে, তার বাস্তবিকতা ও বস্তুজগতের সাথে তাঁর কোন গভীরগূঢ় পরিচয় নেই। তাই, যে বস্তুজগতকে তিনি আসলে ধরতে চেয়েছেন, চেয়েছেন তার অন্তস্থ শ্রেণীকাঠামোটিকে নিজের ক্যামেরা দিয়ে বিশ্লেষণ করতে — সেটা বড় সহজে এইসব খুঁটিনাটি প্রশ্নের মুখে  সামনে ধ্বসে পড়ে।  মনে হতে থাকে, কতগুলো বাহ্যিক চিহ্নকে তিনি ঠুসে দিয়েছেন ক্যালভিনো-র গল্পের খোলসে। যে বাস্তব তাই হয়ত আজ অনেকাংশেই উচ্চমধ্যবিত্ত কর্পোরেট কর্মীদের জীবনের বাস্তবতা, তাকেই তিনি গুঁজে দিতে চেয়েছেন নিম্ন মধ্যবিত্ততা এবং শ্রমিকজীবনের  খোলসে।
কিন্তু কেন? ছবিটি একটু খুঁটিয়ে  দেখলে কিন্তু এটা ক্রমশ পরিষ্কার হয় যে এই ঠুসে দেওয়ার প্রয়াস নিছক কাকতালীয় নয়, নয় আকস্মিক। খেয়াল করে দেখুন, ছবির সবচাইতে প্রগলভ মুহূর্তগুলি আমরা পাই স্ট্রিটকর্ণার/ গেট মিটিঙের আভাসে। জানতে পারি, ছাঁটাই শ্রমিক সনাতন মন্ডলের কথা। শুনতে পাই স্লোগানের শব্দ, অনুষঙ্গ। যা পাই না, তা হল সেই মিছিল, মিটিং বা জমায়েতের আস্ত-আকর ছবি। অর্থাৎ, শ্রেণী-সংগ্রামের বাস্তবতা এ ছবিতে হাজির হয় পরোক্ষ ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে। প্রত্যক্ষ, জীবন্ত উপস্থিতি হিসেবে নয়। সে ব্যাকগ্রাউন্ডকে পিছনে ফেলে আমাদের ছবির শ্রমিক দম্পতি একাকী সাইকেল চালিয়ে বাজার করেন, কাজে যান, বাড়ি ফেরেন, বাড়ি ফিরে অবসন্নতায় খাটের উপর ঢলে পড়েন। আন্দোলনের যৌথতা, শ্রেণীসংগ্রামের প্রতক্ষ্য বাস্তবতা– এসবের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই।
কিন্তু দর্শক হিসেবে আমরা কিভাবে দেখব এই বিচ্ছিন্নতাকে? গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তথাকথিত শ্রমজীবী-রাজনীতিভিত্তিক দলগুলির দেউলিয়াপনার লক্ষণের মূর্ত রূপ ? হতে পারে।কিন্তু, তাহলে ছবিতে কেন নেই সেইজাতীয় কোন প্রত্যক্ষ উচ্চারণ? কেন নেই আদিত্যবিক্রমের চরিত্রগুলির মধ্যে কোন বিকল্প ব্যতিক্রমতার খোঁজ? যে সমসময়ে তাঁর ছবি বানিয়েছেন তিনি , সেই সময়ের পৃথিবী তো সেই খোঁজে টইটম্বুর! সেখানে ২০০৮-পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দা যেমন আছে, তেমনি তো আছে অকুপাই আন্দোলন। আছে আরবি বসন্ত। গ্রীস। কিয়েভ। তুর্কি। আমাদের ঘরের কাছের নন্দীগ্রাম। লালগড়। কলিঙ্গনগর। মায়, যাদবপুর-হোককলরব। না। এ সমস্ত আন্দোলনের অভ্যন্তরে কোন মতাদর্শগত সমস্যা নেই, এমন কথা আমি বলছি না। সমস্যা আছে, প্রচুর প্রচুর পরিমাণে আছে। সার্বিক দিশাহীনতা আছে। কিন্তু, আছে অনন্যর সন্ধানও। কিন্তু, আদিত্যবিক্রমের ক্যামেরায়  সে খোঁজ ধরা পড়ল না।
এবং, সার্বিকভাবে দেখতে গেলে আমরা দেখব, আদিত্যাবিক্রমের ছবি বড়ই খোঁজবিরহিত। এমনকি, ক্যালভিনোর গল্পে যে যৌনতা-শারীরিকতার ব্যক্তিগত পরিসর হয়ে ওঠে একধরনের ব্যতিক্রমতার অনুসন্ধান, সে যৌনতা ও শারীরিকতাও অনুপস্থিত এখানে। তার বদলে আছে গার্হস্থ্যতার স্থিতিস্থাপকতা। আছে সে স্থিতিস্থাপকতার ভেতরে, আরও ভিতরে — এক্কেবারে অভ্যন্তরে– ঢুকে যাওয়া। তো, সেই অভ্যন্তরে যাত্রার চিহ্নক হিসেবে আমরা দেখি একধরণের প্যাচপ্যাচে নেকুনেকু প্রেম ফ্যান্টাসি। তাতে মধ্যবিত্ত বাঙালির আপাদমস্তক স্থিতিস্থাপকতামুখর নান্দনিকতার সব উপাদানই উপস্থিত — আবহে “তুমি যে আমার”, মুখের সামনে চা করে আনা হাসি হাসি মুখের বউ, স্বামীর কাঁধে লাজুক মুখের মাথা নোয়ানো — যৌন কিন্তু আবার যৌন নয় — আপাদমস্তক সুরুচিসম্পন্ন অবনমন।  অর্থাৎ, সেই একই গল্প।  পিতৃতান্ত্রিক  প্রেম ফ্যান্টাসি। আবারও বলি, পিতৃতান্ত্রিক প্রেম ফ্যান্টাসি। মানে, ক্যালভিনোর গল্পে যে ছোট্ট ছোঁয়াটুকু ছিল — সরাসরি পিতৃতন্ত্র বিরোধিতার খতিয়ান না হয়েও — যে আর্তুরোই করেন রোজ সকালের কফিটুকু — সেটাও উধাও হয়ে যায় আদিত্যবিক্রমের ছবিতে। তার বদলে যেন ছবিটির অন্যতম মুখ্য চরিত্র — ঋত্বিক অভিনীত স্বামী — নিরুচ্চারে জিজ্ঞাসা করছেন, কেমন হতো যদি আমার স্ত্রীকে না বেরোতে হত কাজে? অর্থাৎ, অতি পরোক্ষে হলেও, পুঁজির যুক্তিকে এখানে প্রশ্ন করা হয়, একধরনের মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত পিতৃতান্ত্রিকতার ছকে।
আদতে, তাই, একাধিক দিক দিয়ে, লেবার অফ লাভ হয়ে ওঠে ক্যালভিনোর গল্পটির ক্রমশ পশ্চাদপদতার দলিল। ইংরেজিতে যাকে বলে, ডি -র‍্যাডিকালাইজেশন। কাজেই, সেই জন্যেই এই ছবিতে সামান্যতমও কোন প্রতিরোধ নেই। আকার ইঙ্গিতেও নেই। প্রতীকি অর্থেও নেই। তার বদলে আছে পুঁজিযুক্তির সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া। মেনে নেওয়া। মানিয়ে নেওয়া। সাধারণ হয়ে থাকা। আর, মাঝে মাঝে স্বপ্নের জাল বোনা। সে স্বপ্নে থাকে, এক মিষ্টি হাসি মাখানো বউয়ের আত্মসমর্পণের কল্পনা। এই প্রেম ফ্যান্টাসিতে বাসবদত্তার অভিনীত চরিত্রটি কোন সক্রিয় যৌন বিষয় নন। বরং, তিনি হাজির হন সাদা পাতার মত, একতাল কাদামাটির মত — অবনত, নম্র। যে সাদা পাতার ওপর আঁকা যায়, খোদা যায় তাঁর স্বামীর যৌন ফ্যান্টাসি।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এই যে ছবির নারী চরিত্রটির স্বামীর কাঁধে মাথা রেখে বিনম্র আত্মসমর্পণ, এ তো হতে পারে তাঁর নিজের স্বপ্নও, তাঁর নিজের প্রেম ফ্যান্টাসিও। মানে, ওই সেই এক গল্প আর কি! সাধারণ মেয়ের সাধারণ ইচ্ছের দিনলিপির বয়ান  — রবি ঠাকুর থেকে শরৎ চাটুজ্জে থেকে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত  থেকে জয় গোস্বামী অবধি বাংলা সাহিত্য-চলচ্চিত্রে সে ঐতিহ্য চলছে তো চলছে তো চলছে। সেসব সাধারণ মেয়েদের মস্তিষ্ক নেই, মেরুদণ্ড নেই, মনন নেই। আছে খালি প্রেম, প্রেম আর প্রেম। আর, প্রেমের গণ্ডী বাড়িয়ে, বিবাহ, সংসার। মেনে নেওয়া, মানিয়ে নেওয়া। পিতৃতান্ত্রিকতার বয়ান, সাধসাধনা, ইচ্ছেকে নিজের করে তোলা। পিতৃতান্ত্রিক যৌন-রাজনৈতিক-বৌদ্ধিক নিষ্ক্রিয়তার মোড়কে নিজেকে গড়ে তোলা। কি যেন একটা কথা বলেছিলেন না চমস্কি সাহেব? ম্যানুফ্যাকচারিং অফ কনসেন্ট ? তো, আদিত্যবিক্রমের ছবিতে সেই সম্মতি উ ৎপাদনের  রাজনীতির ছড়াছড়ি। সেখানে, মূল  নারী চরিত্রটিকে এই চিরাচরিত ছকে বেঁধে ফেলার রাজনীতি আরো একটা বাড়তি দ্যোতনা নিয়ে হাজির হয়। ছবি দেখতে দেখতে চী ৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়, আর সইতে পারি না বাপু এই সাধারণ মেয়েদের থিকথিকে ভিড়। দেখি না একটু অসাধারণ মেয়েদের এবার পর্দায় ! তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন, রাজনৈতিক মনস্ক, সক্রিয় !
কিন্তু পিতৃতান্ত্রিক যৌন ফ্যান্টাসিরও তো আছে রকমফের। তাই , চায়ের কাপ হাতে অবনত গৃহলক্ষ্মীর ছবির পরিপূরক হয়ে ছবিতে আসে একটি খাট। সাবেকি আমলের রাজকীয় খাট। যেমনটি উত্তর কলকাতার বনেদী বাড়িগুলিতে দেখা যেত আর কি! বা, অন্তত: দেখা যেত বলে আমরা ভাবি, কল্পনা করি। একভাবে বলতে গেলে, ঘুরেফিরে আসা  খাটটি এই ছবিতে উপস্থিত একধরনের বৈপরীত্যের রূপকস্বরূপ: ক্রমবর্ধমান কাজের দিন, পুঁজিবাস্তবতার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে এই তো একমাত্র থাকে মানুষের কল্পনা। ফ্যান্টাসি। কল্পনাতেই তো ব্যতিক্রমের, অনন্যের প্রথম ছবি আঁকে মানুষ। কিন্তু, ঠিক কেমন হয় যখন সেই কল্পনাও হাঁটতে শুরু করে পেছনে ? তাই, নয়া উদারনৈতিক ক্রমবর্ধমান দিন, অর্থনৈতিক সংকটের বিপরীতে কল্পনা যখন হয়ে ওঠে সামন্ততান্ত্রিক নস্টালজিয়া, তখন সেই নস্টালজিয়াকে কিভাবে দেখব আমরা ? স্থিতিস্থাপকতামুখীন একটি নান্দনিক দার্শনিকতার দলিল হিসেবেই নয় কি?
অবশ্য, আদিত্যবিক্রমের ছবিটিকে বাংলা তথা কলকাতার সাম্প্রতিকতম অন্যধারা ছবির ইতিহাসে রেখে দেখতে গেলে দেখা যাবে, এ কোন অভূতপূর্ব ঘটনা নয়। বছর তিনেক আগে আমরা দেখেছিলাম রাণু ঘোষের তথ্যচিত্র “কোয়ার্টার নম্বর ৪/১১“; সেখানে দেখেছিলাম, সাউথ সিটি মলের কর্তৃপক্ষের বিরূদ্ধে শ্রমিক শম্ভুপ্রসাদ সিংয়ের একাকী লড়াই।  সে ছবিরও মূল সুর ছিল একই — শ্রেণীসংগ্রামের দিন শেষ। শ্রেণীসংগ্রামের দর্শন আজ অপ্রাসঙ্গিক। তার বদলে কি আছে ? রাণু ঘোষ আমাদের দেখিয়েছিলেন, তার বদলে আছে একাকী শ্রমিকের একাকী লড়াই। লড়াইও সেখানে আসলে ব্যক্তিগত। আমাদের ক্রমশ নয়া-উদারনৈতিক পুঁজির পাঁকে ছোট হয়ে আসা পৃথিবীতে অন্য সব কিছুর মত।
আদিত্যবিক্রম আমাদের বললেন, শ্রেণীসংগ্রামের  বদলে আছে সুখী গৃহকোণের স্বপ্ন, নিটোল গার্হস্থ্যতার চাহিদা। সেই বিষমকামী, বিবাহিত আগাপাশতলা সামাজিক আইনানুগতার পরিকাঠামোকে মেনে নিয়ে, তার মধ্যে মানিয়ে বেঁচে থাকার নামই নাকি ভালবাসা। প্রেম। প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, কি এসে যায় অমন প্রেমে যেখানে তুমি আর আমির বিবাহিত জীবনের বাইরে আর কিছু ভাবতে পারে না ব্যক্তিমানুষ? কি এসে যায় অমন প্রেমে যেখানে গার্হ্যস্থ্যতা আর বিবাহিত দাম্পত্য-যৌথতার বাইরে আর কিছু কল্পনা করতে পারে না মানুষ? দুটি মানুষের মধ্যে প্রেম যখন আসলে সামাজিক ও রাজনৈতিক কল্পনাহীনতার লক্ষণ নিয়ে হাজির হয়, তখন সেই প্রেমকে মহিমান্বিত করার ওপরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে আমাদের যত সংস্কৃতি বাণিজ্য — কালচার ইন্ডাস্ট্রি — প্রেমের গান, সিনেমার ছড়াছড়িতে। কিন্তু, শিল্পের কাছে আমার চাহিদা, আমাদের চাহিদা আরেকটু বেশি।
আশ্চর্য হই না তাই যখন দেখি আদিত্যবিক্রমের চরিত্ররা কোন অর্থবাহী আলাপচারিতায় লিপ্ত হয় না। কারণ, যে মানুষের কোন বিকল্পের খোঁজ থাকে না, তার ভাষার প্রয়োজনীয়তাও হয় না। ক্ষমতার কাছে, পরিকাঠামোর কাছে আত্মসমর্পণের প্রথম শর্তই তো নৈ:শব্দ, তাই না? তাই, এই যে বিনিময়্হীনতার আবহের মধ্য দিয়ে আদিত্যবিক্রম এই  ছবির যে মূলগত দৃশ্যমানতাকে গড়ে তুলেছেন, তার অন্যতম স্তম্ভই হলো স্থিতিস্থাপকতার রাজনীতি, চলমান মূলস্রোতের কাছে আত্মসমর্পণের রাজনীতি।
কিন্তু, সংলাপ নেই তো বুঝলাম ! আছে কি এমন কর্মকাণ্ড যা ছিন্নভিন্ন করে দেয় আমাদের শব্দনির্ভর, অক্ষরনির্ভর ভাষার জগতকে? চেপে ধরে আষ্টেপৃষ্ঠে ভাষার টুঁটি? যেমন ধরেছিলেন সদ্যপ্রয়াত বেলজিয় পরিচালক শন্তেল আকেরমান তাঁর জিন দিয়েল্মান  ছবিটিতে? প্রসঙ্গক্রমে, বহু সমালোচকের কলমেই আদিত্যবিক্রমের ছবিতির তুলনা করা হয়েছে আকেরমানের ছবিটির। যেমন করেছেন অমিতভূষণ। যাঁর উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করেছিলাম এই লেখাটি। হ্যাঁ, একভাবে দেখতে গেলে দুটি ছবিই প্লটবিহীন।  আদিত্যবিক্রমের ছবি যদি হয় এক নিম্নবিত্ত দম্পতির রোজনামচা, আকেরমানের ছবি তবে এক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইউরোপীয় বিধবার রোজনামচার ছবি।
২০১ মিনিট ধরে আমরা পর্দায় দেখি তাঁর প্রাত্যহিক জীবন — বাজার করা, রান্না করা, কিশোর পুত্রের হোমওয়ার্কে সাহায্য করা। দেখি আর নিজেদের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হয়। আদিত্যবিক্রমজাতীয় ক্যামেরার ইচ্ছাকৃত, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নান্দনিকতা সেখানে নেই। নিম্নবিত্ত গার্হস্থ্যতাকে মিউজিয়ামায়িত করে সেখানে দেখানোর কোন প্রচেষ্টাও সেখানে নেই। মূল চরিত্র জীন দিয়েল্মান যখন তাই মাংসের কিমার তাল মাখতে থাকেন তো মাখতে থাকেন তো মাখতেই থাকেন, আমরা পরিত্রাণ চাই। পরিত্রাণ চান তো জীনও। তাই, ছবির শেষ হয় এক রক্ত হিম করা দৃশ্যের মাধ্যমে। যুদ্ধপরবর্তী ইউরোপে জীবনধারণ করতে গিয়ে টুকটাক দেহব্যবসা করতেন জীন। সেইরকমই এক খরিদ্দারকে একদিন খুন করেন তিনি — ছুরিকাঘাতে।
ছবিটির শেষ হয় ঠিক ঐখানে — তাঁর খরিদ্দারের মৃতদেহের সামনে একা জীন।  কি হবে এরপর? আমরা জানি, কিন্তু জানি না। জীনও তাই — জানেন, কিন্তু জানেন না। কিন্তু, যা সত্যি তা হলো, জীনের জীবনে প্রাত্যহিকতার যে পুরনো ছক, তা ভেঙে গেছে। জীন নিজে ভেঙে দিয়েছেন। ভেঙে দিয়ে বুঝিয়ে ছেড়েছেন আমাদের জীবনের প্রাত্যহিকতার যে বুনোট, তার মধ্যেই আছে উৎপীড়নের বীজ। তাই , সেই প্রাত্যহিকতাকে মহিমান্বিত করার কোন চেষ্টা করেন না আকেরমান। তার বদলে, আমরা দেখি, ছবিটির শেষ হয় একধরনের বেপরোয়া বিপন্নতার মধ্য দিয়ে। না, জীনের এই হঠাৎ সক্রিয়তাকে প্রতিরোধ বলা যাবে না। সেখানে নেই কোন সচেতন বৈপ্লবিক রাজনীতিও। কিন্তু যা আছে, তা হল, এই চলমান প্রাত্যহিকতা , সাধারণ জীবনযাপনের জাল থেকে মুক্তি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। অন্যদিকে আদিত্যবিক্রমের ছবিটি দাঁড়িয়ে আছে সেই প্রাত্যহিকতাকে আঁকড়ে ধরার উপরে, রোমান্টিকতায় মুড়ে দেওয়ার ওপরে। কাজেই, বলতে বাধ্য হচ্ছি, যারা আদিত্যবিক্রমের ছবিটিকে শন্তেল আকেরমানের ছবির সমতুল্য বলে বর্ণনা করেছেন, তাঁরা না বোঝেন  সামাজিক রাজনীতি, না বোঝেন দৃশ্যমানতার রাজনীতি।
যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানেই আবার ফিরে যাই — মানে,” খুঁতখুঁতানি”র প্রশ্নে আর কি।  অর্থনীতি বা শ্রেণী বা শ্রেণীর রাজনীতি কোনটাই আসলে এ ছবির মার্জিন নয়। সেসবই আছে এই ছবির কেন্দ্রে। যেমনভাবে ক্রীতদাস প্রথা, ক্যার্রিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের অনুষঙ্গ ছিল জেন অস্টেনের উপন্যাস “ম্যানস্ফিয়েল্ড‌ পার্কে”র প্রান্তে হয়েও কেন্দ্রে, অদৃশ্য হয়েও অতি দৃশ্যমান।  এবং, যে বিষয়টি পরিচালক পাত্রিশিয়া রোজেমা তার অবলম্বনে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিলেন আমাদের। কারণ, ক্রীতদাস শ্রমের ওপর  দাঁড়িয়েই  তো চলত, ইংল্যান্ড-নিবাসী ভদ্রমহোদয়-ভদ্রমহিলাদের আমোদপ্রমোদের জীবন।  কিন্তু, যদি আমার ছবির বা উপন্যাসের তথাকথিত কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে ইংল্যান্ডের ভদ্র জীবনের লীলাখেলা, তাহলে কতটা গভীরতার সাথেই বা দেখানো সম্ভব ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের ক্রীতদাস জীবন? তেমনি, আদিত্যবিক্রমের ছবির কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছেন গার্হ্যস্থ্যতাকে টিকিয়ে রাখার লড়াই। তা দিয়ে যে আদতে সম্ভব নয় অনেক আরও জটিলতাকে ধরা। তাই, অর্থনীতি এ ছবির মার্জিন নয়। কিভাবে পরিচালক অর্থনীতিকে দেখাতে চেয়েছেন, সেটিই আসলে মূল কথা। এবং, সে স্থলে যা চলছে, যেমনভাবে চলছে এবং চলে এসেছে, তাকে প্রশ্ন করার বা আঘাত করার কোন ইচ্ছেই পরিচালকের নেই। কিন্তু আবার ওই যে বাঙালি মধ্যবিত্তসুলভ সংবেদনশীলতার মোড়ক! সেই মোড়কের আড়ালে বাঁচতে গেলে তো দেখানো যাবে না শ্রেণীভিত্তিক রাজনীতির কোনো স্পষ্ট, বা চলতি বাংলায় গোদা সমস্যায়িতকরণ। তাই, এই সংবেদনশীলতার মোড়কে শ্রেণী নিষ্ক্রিয়তার রাজনীতিকে ঢাকতে গেলে দেখানো চলবে না কর্পোরেট সেক্টরে কর্মরত কোনো দম্পতির জীবন। ফিরে যেতে হবে ওই শ্রমিক দম্পতির জীবনেই। তাই গেছেন আদিত্যবিক্রম। এবং, তাই তাঁর ছবিতে গুলিয়ে গেছে সব শ্রেণীর চিহ্নক।  এটাই তাই এই ছবির ভিত্তিগত রাজনীতি।

4 thoughts on “আদিত্যবিক্রম সেনগুপ্তর আসা যাওয়ার মাঝে : স্থিথিস্থাপকতার জয়, নিষ্ক্রিয়তার জয়

  1. আসা যাওয়ার মাঝে এর রিভিউ টি অভাবনীয়। এত সমান্তরাল আলোচনা করার ক্ষমতা তাও এই ভাষার বুনোটে আর বাঙালীর অবশিষ্ট নেই। হ্যাঁ আমি নিশ্চিত।
    সমস্যা হচ্ছে ছবিটা আমি মোটে একবার দেখেছি, তাও সল্টলেকের সিনেমা হলে, পেছনের সিটের নাসিকা নির্ঘোষ আর সামনে থেকে উড়ে আসা ‘মা আর কতক্ষণ চলবে’? আবহাওয়ায়। ফলে এখন স্মৃতি ফিকে হয়ে এসেছে।
    মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবি কে worker এ পর্যবসিত করার ‘ধৃষ্টতা’ আমার চোখ এড়িয়ে গেছিলো (এই সম্ভবত ইচ্ছাকৃত ‘ভুল’ হয়তো পরোক্ষে আমার মতামত কে সমর্থন করবে)।
    এই ছবিতে নায়ক নায়িকার গার্হস্থ, তাদের শ্রেণী সংগ্রামের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার কারন। খাঁটি কথা।
    “…এই ছবিতে আছে গার্হস্থ্যের সাথে পুঁজির বিরোধ। কিন্তু আবার, পুঁজির সময়ের কাছে মাথা নত করার মধ্যে দিয়েই টিকে থাকে তাঁদের গার্হস্থ্য, তার নৈপাট্য। এবং, দ্বন্দ্ব সেখানেই।… ”
    একশো ভাগ সত্যি। তবে আমার মনে হয় সম্ভবত এই বিরোধটা জিইয়ে রাখার চেষ্টাটাই ছবিটির উপজীব্য। ভারতীয় ছবিতে যেহেতু নাম মাহাত্ম এড়িয়ে যাওয়ার যো নেই তাই ছবিটির নাম কেন ‘লেবার অফ লাভ’ কেন ‘লাভ অফ লেবারস’ নয় সেটা ভাবাচ্ছে। যেখানে গোটা ছবিটাতে দ্বিতীয় ভাবনাটাই প্রকট। নামে একরকমের গোলমাল করে সহজ মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা সাহিত্যিক ও চিত্রপরিচালক গোষ্ঠীর সহজাত। আদিত্যবিক্রম কে সেই দলগত না ধরে এগোলে কয়েকটা বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করি।
    ছবিতে একটা সুন্দর সূর্যাস্তের দৃশ্য ছিল। যার আবহে জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। যেখানে শ্রমিক সমাজের ক্ষোভ উদগীরণ হচ্ছে। লম্বা সূর্যাস্ত। এর পরের ফ্রেমে দেখা গেল ঋত্ত্বিক ঘুম থেকে উঠছেন। অর্থাৎ সেই মুখ ফিরিয়ে থাকা। আমার মতে এই দৃশ্যটিই ছবির ফাল্ক্রাম। আগে যাকে টুইস্ট বলা হতো। এর পর থেকেই আমরা জানতে পারব এই ‘দাম্পত্য’ কেমনে নির্বাহ হচ্ছে।
    এইবার (আমার খুব ভালো মনে নেই তবে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই সম্ভবত শ্রমিকদের চাকরি হারানোর খবর বা বিক্ষোভ ইত্যাদি সিনেমাটিতে আছে নিউট্রাল গ্রাউন্ডে বা যেখানে কেবল ঋত্ত্বিক ফ্রেমে আছেন সেই সময়ে) কথা হলো শ্রমিক কে বা কারা? ঋত্ত্বিক শ্রমিক। কারন তিনি কারখানায় কাজ করেন। (যদি বাসবদত্তা ফ্রেমে থাকাকালীন ঐ বিক্ষোভের আবহ ব্যবহৃত না হয়ে থাকে তবে বাসবদত্তা নন। সেক্ষেত্রে অবশ্য আমি তার নারীজন্মের থেকে টেবিলের বা রাইটিং বোর্ডের পেছনে কাজ করাকেই গুরুত্ত্ব দেব) এখন শ্রমিকের এই আইডিয়া টি এলো কোথাথেকে?
    (আমার মতে ছবিতে অন্য জীবিকার কোন মানুষকে ব্যবহার না করার পেছনে হয়তো পরিচালকের এই ধূর্ততা কাজ করেছে)
    অর্থাৎ যারা কারখানায় হাতগন্ধ কচ্ছেন বা মাঠে লাঙ্গল দিচ্ছেন তারাই শ্রমিক? শ্রমিক শব্দটির সাথে আমরা ঠিক কবে থেকে নিম্নবিত্ত শব্দটিকে সমার্থক কল্পনা করে নিলাম জানা নেই। আমি সাতের কিলোমিটার দূরে ইশকুলে যেতুম। কোলকাতা শহরে বাসব্রজে সে খুব কম রাস্তা না। আমাদের সময়ে বই খাতার বিভীষণ আকার ছিল। আমি এবং আমার মত সব শিশু কে আমি শিশুশ্রমিক বলে গণ্য করি। দাঁড়ি। বলতে পারো শ্রমের বিনিময়ে আমার যা প্রাপ্য অর্থাৎ শিক্ষা সেটা আমি পরিমান মতো পেয়েছি। (আমি কতটা গ্রহন করেছি সেটা অন্য কথা) এবং সৌভাগ্যবশতঃ স্কুলে আমাকে যৌননিগৃহীত হতে হয়নি ফলে সুস্থ পরিবেশও পাওয়া গেছে। সেটা যে ছেলেটি বিড়ি বাঁধছে তার পক্ষে পাওয়া অসম্ভব। কিন্তু শ্রমটা অস্বীকার করা যাচ্ছেনা। আমাকে নিয়ে ছবি বানালে তাকে লেবার অফ এডুকেশান নাম দেওয়া যেতে পারত।
    অর্থাৎ এক গোত্রের মানুষের গায়ে আমরা শ্রমিক তকমা মারলাম। তাদের ঘাড়ে শুধু শ্রমিকত্ত্বই নয় তার সাথে সাথে ক্ষোভ, এবং বিদ্রোহের জন্মগত অধিকার চাপিয়ে দেওয়া হলো। কারন তারা তাঁদের শ্রমের বিনিময়ে যা পাচ্ছেন তা যথেষ্ট নয়। বা যা পাচ্ছেন তাকে তারা বা আমরা যথেষ্ট বলে মনে করছিনা।
    অথচ এই ছবিতে দেখুন আমাদের সেই অর্থে ‘স্বাভাবিক’ দাম্পত্যের তুলনায় কেবল দাম্পত্য টিকিয়ে রাখার জন্য এ ছবিতে নায়ক নায়িকা কে অনেক বেশি শ্রম করতে হলো। এবং তার বিনিময়ে যা পেলেন তাকে আমরা ‘দাম্পত্যের বিচারে’ যথেষ্ট পাওয়া বলে মনে করলাম না। কিন্তু সেই ‘বিফলে যাওয়া’ শ্রম তাঁদের বিদ্রোহী করে তুলল না। মূহুর্তভর যৌথ অবস্থান তাঁদের খুশি করতে পারল। তাঁরা মুখ বন্ধ রাখলেন, ছবিতে সংলাপের প্রয়োজন হলোনা।
    আদিত্যবিক্রম সম্ভবত তার ‘বাকহীন’ ছবিতে সেই বিক্ষোভে সোচ্চার হলেন। ( নায়ক নায়িকার চেনা অর্থে চাকুরিগত ‘শ্রম’ এর থেকে সাংসারিক শ্রমকে অধিক গুরুত্ত্ব দিলেন। লক্ষ্য করুন ঋত্ত্বিক বা বাসবদত্তার কর্মক্ষেত্রের শট খুবই সীমিত। এবং কোথাওই তাদের কায়িক কোন বাধা অতিক্রম করতে হয়নি। চাকুরি ক্ষেত্রে আরেকটি দিন মাত্র)
    নায়িকার লতিয়ে পড়া, এবং সাময়িক সংসর্গের মূহুর্তে বিছানা এবং দৃশ্যতঃই কোন পাহাড়ি ‘ছুটি কাটাবার জায়গা’র আভাস সম্ভবত আমাদের কাছে দাম্পত্যের চেনা ছবিটুকু তুলে ধরার জন্যে (অর্থাৎ এই যে এনারা এরই জন্য এতক্ষণ লড়াই কচ্ছিলেন) কিন্তু তা হলেও পৌরুষের আস্ফালণ এর লেখিকার যে অভিযোগ তা এড়িয়ে যাওয়া যায়না। কিন্তু সে দোষে আমি এবং আমার বিশ্বাস আমার সঙ্গে সেই হলে আর যত সৌভাগ্যবান ছিলেন (মানে যারা ঘুমিয়ে বা বাৎসল্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েননি) সকলেই কম বেশি দোষী। মধ্যবিত্তের চাকরি যাচ্ছে ঘোষণার পর বাসবদত্তার বাড়ি ছেড়ে বেরনোর মূহুর্তে আমি আঁতকে উঠলাম। নিশ্চই বেচারির বরের চাকরি গেছে মাগো। বরের চাকরি না গেলে এঁদো গলি দিয়ে বেরিয়ে মেয়েছেলে রোজগার করতে বাসে উঠবে কোন দুঃখে?
    আমি নিজে বেশ কিছু বছর রাতের শিফটেও চাকরি করেছি। কিন্তু ঋত্ত্বিককে সকালবেলা ঠাকুর সিংহাসন পেন্নাম করতে দেখে মনে হলো এবার নিশ্চই বৌএর লাঞ্ছনা নিদেন একটা পরকিয়া, হেরে যাওয়ার জ্বালা, ক্রমে…গামছা, সিলিং ফ্যান। চেনা ছক।
    বিশ্বাস করি পরিচালক একদিন ঠিক আমার মুখ লুকোনোর জায়গা কেড়ে নেবেন।

  2. অনেকদিন পর পড়লাম লেখা টা, ছবি দেখার পর আমার যেরকম অনুভূতি হয়েছিল সেটা এত সুন্দর গুছিয়ে লিখেছেন। আমার তো প্রথমেই খটকা লেগেছিল যে আরে এই বাড়িতে টিভি নেই কেন? টিভি থাকলেই একটা প্রচণ্ড ধাক্কা খায় এই আদ্যন্ত রোমান্টিক উপস্থাপনা। আর ফুড শট অসম্ভব বিজ্ঞাপনি সন্দেহ নেই। শুধু একটাই কথা, তবু তো কিছু হল, আলোচনা করার মত একটা ছবি অন্তত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.