সৌমিত্র ঘোষ

‘বিরুদ্ধ জ্ঞানের খোঁজে…’ – লেখাটি বেরিয়েছিল এবছরের (২০১৯) আয়নানগর বইমেলা সংখ্যায়। আমাদের গাফিলতিতে লেখাটিতে কিছু ছাপার গণ্ডগোল থেকে যায়, তাতে লেখার মাঝ বরাবর এক জায়গায় লেখাটির অর্থ বোঝা যায় না। আরও কিছু বানানের ভুলও থেকে যায়। এখানে লেখাটির যথাসম্ভব সঠিক সংস্করণ আবার করে ছাপা হল। লেখাটি যাঁরা এর মধ্যে পড়তে গিয়ে হোঁচট খেয়েছেন, তাঁদের কাছে আমরা ক্ষমাপ্রার্থী। – আয়নানগর টীম

প্রাককথন

জ্ঞান কি করে আসে? অর্থ মানে কি? জ্ঞান ও অর্থ নির্মাণের প্রক্রিয়ায় ভাষার ভূমিকা কি? ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির, ব্যক্তির সঙ্গে সমষ্টির যে যোগাযোগ ভিন্ন যৌথ গড়ে ওঠে না, তা কতদূর পর্যন্ত ভাষানির্ভর? কূট ও প্রাচীন এই প্রশ্নগুচ্ছ নিয়ে আজকে আমরা ভাবিত হবো কেন? বিশেষত, যখন গত ২৫-৩০ বছরের মধ্যে যোগাযোগ প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতি বিভিন্ন ভাষার মধ্যে সহজ সংযোগের সাঁকো গড়ে তুলেছে, এবং অবিশ্বাস্য ও দূরপনেয় এক নিরন্তরতায় আমরা সদা-সংযুক্ত আছি, থাকতে বাধ্যও হচ্ছি, জ্ঞানতত্ত্ব কিংবা ভাষাতত্বের চর্চা আমাদের সামনে নতুন কি দিগদর্শন হাজির করতে পারে?

বলে নেওয়া ভালো, জ্ঞানতত্ত্ব চর্চা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু ওপরের প্রশ্নগুচ্ছ এড়িয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়, বিশেষ যদি সামাজিক আন্দোলনের সংগঠিত হওয়া কি বেড়ে ওঠার নানান প্রক্রিয়াকে আমরা তলিয়ে জানতে-বুঝতে চাই, স্থিতাবস্থা ও শাসকের আধিপত্যের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা যাবতীয় প্রতিবাদ/প্রতিরোধের অন্তর্লীন চলনগুলিতে দৃষ্টিপাত করি। যোগাযোগ ও মৈত্রী স্থাপনের যে বিবিধ সামাজিক ইতিহাস এহেন প্রতিবাদ/প্রতিরোধের উৎসে সদা ক্রিয়াশীল থাকে, তা যদি আমাদের আলোচনার বিষয় হয়, তবে জ্ঞান-অর্থ-ভাষার কূট প্রসঙ্গে আমাদের ঢুকতেই হয়, পুরোনো প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হয় নতুন করে। প্রযুক্তিনির্ভর যে যোগাযোগ-বিপ্লব ইদানীং আমাদের সমষ্টি ও ব্যক্তিসত্বা সর্বক্ষণ ছেয়ে আছে, যা সম্ভব করে তুলেছে অসংখ্য নতুন যৌথকে, সমাজবদলের কি সমাজমুক্তির বিভিন্ন আন্দোলনে যার প্রভাব ক্রমবর্ধমান, তাকে বুঝতে গেলেও জ্ঞানচর্চার এই প্ৰতর্কে প্রবেশ নিতান্তই আবশ্যিক।

অর্থাৎ আমরা বুঝতে চাইছি জ্ঞান কি করে নির্মিত হয়। নিছক অবয়বহীন বিমূর্ত জ্ঞান নয়, যা দর্শনচর্চার বিষয়, অথবা তুলনায় শরীরী জ্ঞান, যার বিবিধ ব্যবহারিক প্রয়োগ ও কার্যকারিতা আছে। আমরা জানতে চাইছি সেই বিশেষ জ্ঞানের কথা, যা প্রকাশিত হয় বিরুদ্ধতায়, স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে, প্রতিবাদের ভাষায়, যে ভাষা আসলে বিরুদ্ধতার চাবুক, যা যোগাযোগ ও মৈত্রী স্থাপনের অবলম্বন ও উপায়, যা ভিন্ন সংগঠিত হওয়া যায় না, সংগঠন গড়ে তোলাও যায় না।

হালফিল মনে হচ্ছে যে, দৃশ্যমান পৃথিবীর সর্বত্রই প্রতিবাদ ও আন্দোলন ক্রমশ আরো ভাষানির্ভর হয়ে উঠছে প্রতিদিন, কি আমেরিকা-যুরোপের অক্যুপাই আন্দোলনে বা মধ্যপ্রাচ্যের বিখ্যাত আরব বসন্তে, কি এ দেশের ধর্ষণবিরোধী গণ জমায়েতে বা সাম্প্রতিক যৌন হেনস্থাবিরোধী মিটু আন্দোলনে, কি ঘরের কাছের এ বাংলায় ছাত্র আন্দোলনে। বিশেষ, ফেসবুক ট্যুইটার আদি সামাজিক সংবাদমাধ্যম যখন প্রায় প্রতি আন্দোলনের ক্ষেত্রেই যোগাযোগের সূত্র হিসাবে কাজ করছে, খুঁজে দেখতে হবে, দেখা দরকার, সামাজিক সংবাদমাধ্যমে যে ভাষায় কথোপকথন হয়, সেই কথোপকথন যে জ্ঞান প্রকাশ ও নির্মাণ করে প্রতিনিয়ত, তার প্রক্রিয়া। এই খোঁজ শ্রম ও সময়সাধ্য, বর্তমান লেখার সীমিত পরিসরে সে কাজ উপযুক্তভাবে সেরে ফেলা সম্ভব নয়, সম্পূর্ণ করা দূরস্থান। তথাপি, খোঁজ শুরু করা যাক অন্তত। যা চোখকানের গোচরে থাকে, তাকেই একমাত্ৰ ও অলঙ্ঘ্য বাস্তব বলে মেনে নেওয়াটা আজকাল নির্বিচার রেওয়াজ। না চাইতেই অফুরন্ত তথ্যের স্রোত ইন্দ্রিয় প্লাবিত করে স্মার্টফোন কি কম্পিউটারের পর্দায় আছড়ায়, খুঁজবার সুযোগ বা অবকাশ বিশেষ থাকে না, ফলে অনুসন্ধিৎসার মৃত্যু। অথচ অনুসন্ধিৎসা না থাকলে, প্রশ্ন থাকে না, প্রশ্ন না থাকলে জ্ঞানের নির্মাণ হয় না, বিশেষত বিরুদ্ধ জ্ঞান, যা প্রতিবাদের ভাষাকে সম্ভব করে তোলে। সে কারণে প্রশ্ন করা, করে যাওয়াটা প্রয়োজন। উত্তর না থাকলেও, না পেলেও।

জ্ঞান, অর্থ ও ভাষা : হ্বিটগেনস্টাইনকে ফিরে পড়া

আমাদের অনুসন্ধান ভাষাবেত্তার অনুসন্ধান নয়। এই লেখায় বুঝতে চাওয়া হচ্ছে না শব্দের ধ্বনিচিত্র, ব্যাকরণ, ব্যুৎপত্তি। বরং বুঝতে চাওয়া হচ্ছে ভাষা আর অর্থ, অর্থ আর জ্ঞানের সম্পর্ক, এমনকি আদৌ কোন সম্পর্ক আছে কিনা।

এই বোঝার ক্ষেত্রে, ভাষা-অর্থ-জ্ঞানের রসায়নের গূঢ়স্থাপত্যকে সাধারণ্যে বিধৃত করার প্রয়োজনে, জর্মন দার্শনিক হ্বিটগেনস্টাইনের শরণাপন্ন হতে হয়। আজ থেকে ষাট দশকেরও বেশি আগে হ্বিটগেনস্টাইন বলছেন, ভাষা আসলে ভাষাই, বেশি নয়, কমও নয়। অর্থাৎ, কিছু শব্দ ব্যাকরণসম্মত ভাবে জুড়ে বাক্য তৈরি করলে ভাষার শরীর নির্মিত হয় বটে, কিন্তু তা নিছক শরীরই থাকে, অর্থবহ হয়ে ওঠে না। অর্থ (meaning) অর্থে এখানে ভাষার সঙ্গে অচ্ছেদ্য বন্ধনে যুক্ত কোনও বিশেষ বাস্তবতা, ঘটনাক্রম (state of affairs)। হ্বিটগেনস্টাইনের প্রতিপাদ্য, ভাষার সঙ্গে, অর্থাৎ শব্দ-বাক্যের ব্যাকরণসম্মত বিন্যাসের সঙ্গে ভাষা-বহির্ভূত এহেন কোন বাস্তবের অচ্ছেদ্য সম্পর্ক থাকতে পারে না। অনেক কথা বলা, লেখা, প্রকাশ করা যায়। ভাষাগত ত্রুটি না থাকলেও সেই সব কথার বিশেষ কোনও অর্থ না থাকতেই পারে। অথবা, যে অর্থ তৈরি হয়, তা অবাস্তব, উদ্ভট, অদ্ভুতুড়ে, বা ননসেন্স। যথা, লাল গানে নীল সুর, হাসি হাসি গন্ধ, কিম্বা, তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম। কিম্বা, একটা লোক টিকটিকি পোষে, তাদের নাইয়ে খাইয়ে রোদ্দুরে শুকোতে দেয়। অথবা চেশায়ার বিড়াল, যে বেমালুম হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেও তার হাসি আকাশে লেগে থাকে।

ভাষা থেকে জ্ঞানে পৌঁছনোর কোন মহাসড়ক নেই। – লুডভিগ হ্বি‌টগেনস্টাইন

হ্বিটগেনস্টাইনের বক্তব্য, নিছক ভাষা দিয়ে প্রমাণ করা যায় না, যে ননসেন্স আসলে ননসেন্স, তার কোন মানে নেই। সবুজ রঙের ছাগল বেগুনি রঙের ঘাস খাচ্ছে, এই বাক্য অর্থহীন, এমন বলা যায় না। ছাগল যে সবুজ রঙের হবে না কোনদিন, এমন স্বতঃসিদ্ধ নির্ণয় অসিদ্ধ, যেহেতু ছাগল বা ছাগলের রঙের ওপর কোন বিশেষ বাস্তবতার অমোঘ শাসন নেই। অথচ, এইরকম বাক্য বা বাক্যবন্ধ ভাষা-বহির্ভূত কোনও বিশেষ বাস্তবতাকে সূচিত করে, এমনও বলা যাবে না। ফলে, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম যে ভাষা, ননসেন্স তাকে নিরন্তর বিপর্যস্ত করতে থাকে। ননসেন্সকে ননসেন্স বলা হয় মুখ্যত এই কারণেই — অর্থনির্মাণের প্রক্রিয়া থেকে ভাষা বিযুক্ত হয়ে যায়। নিজের পূর্ববর্তী বক্তব্যকেই নির্মম ভাবে খণ্ডন করে হ্বিটগেনস্টাইন বলেন, অর্থনির্মাণের এই প্রক্রিয়া আসলে ভাষা-বহির্ভূত, সামাজিক। বিশেষ শব্দ/শব্দবন্ধ বা বাক্য/বাক্যবন্ধ যে অর্থ সূচিত করে, তা নির্মিত হয় দীর্ঘ সামাজিক ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। অর্থ অর্থে  ব্যবহার, ব্যবহার অর্থে সামাজিক ব্যবহার। ভাষা-র যাবতীয় ব্যবহার হয় সমাজগ্রাহ্য নয় ননসেন্স, সেন্স/অর্থ নির্মিত হয় সমাজে, তা ভাষার সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে সম্পৃক্ত থাকে না। হ্বিটগেনস্টাইনের এই বক্তব্য পরবর্তী সময়ে নোয়াম চমস্কি খণ্ডন করেন ও বিশদ গাণিতিক অনুরূপ তৈরি করে দেখাতে চেষ্টা করেন, সব ভাষার সামাজিক ব্যবহার ও অর্থনির্মাণের প্রক্রিয়াটি নিতান্তই বহিরঙ্গের, সমস্ত ভাষার একটিই সাধারণ গভীর ভিতরকাঠামো ও ব্যাকরণ বর্তমান। সে তর্ক ভিন্ন, উপস্থিত তার অণুপুঙ্খ বিচারে যাবার সুযোগ নেই। চমস্কির ঘোষিত রাজনৈতিক অবস্থানের সঙ্গে তাঁর ভাষাতত্বের কতটুকু মিল, সে তর্কও আপাতত মুলতুবি থাক, যদিচ এই সর্বজনীন একভাষার বিষয়টি আমাদের এই আলোচনায় আবার ফিরে আসবে।

হ্বিটগেনস্টাইনের ভাষ্য অনুযায়ী, যেহেতু ভাষা নিজে থেকে কোন স্থির অর্থ নির্মাণ করে না, ভাষা থেকে জ্ঞানে পৌঁছনোর কোন মহাসড়ক নেই। প্রথম জীবনে তাঁর বিখ্যাত সন্দর্ভ ট্র্যাকটাটুস লজিকো-ফিলোজফিকুস-এ যা বলেছিলেন, শেষ জীবনে তার উল্টোপথে হেঁটে হ্বিটগেনস্টাইন বলেন, ভাষা নিজে থেকে কিছুই বলে না, যদি না সে বলায় সমাজের সিলমোহর থাকে; ভাষা যদি চিহ্ন হয়, সে চিহ্ন আসলে সমাজের সমষ্টিগত ব্যবহারিক জ্ঞানের অভিজ্ঞান। অর্থাৎ অর্থ নির্মাণের প্রক্রিয়া জ্ঞান তৈরির সামাজিক প্রক্রিয়ার অনুবর্তী, তার উল্টোটা নয়। অনেক মানুষের অনেকদিনের সমাজবদ্ধ অভ্যাস থেকে জ্ঞান আহরণ করে আমরা বিশেষ ভাষাচিহ্ন থেকে সাধারণ অর্থে পৌঁছই, অর্থ/সেন্স থেকে ননসেন্সকে আলাদা করে বুঝতে পারি। এ কারণেই নিয়মানুবর্তী, ব্যাকরণবদ্ধ ভাষাকে হ্বিটগেনস্টাইন বলেন ভাষা-খেলা (language game), যে খেলার বহুবিধ নিয়ম থাকতে পারে, অথচ গ্রাহ্য হয় সেই নিয়মটিই যা সামাজিক ভাবে ব্যবহৃত।

মনে রাখা দরকার, অর্থ/জ্ঞান নির্মাণের প্রক্রিয়াটি যেহেতু আদ্যন্ত সামাজিক, সেহেতু স্থির বা চরম অর্থের ভাবনাটি গোলমেলে — সমাজ ভাঙে, গড়ে, নতুন জ্ঞান তৈরি হয়, ফলে পুরোনো ভাষা থেকেই নতুন অর্থে পৌঁছনো যায়, একইসঙ্গে নতুন ভাষাও প্রচলিত হয়। যেহেতু সমাজ বিবিধ, পরিবর্তনশীল, অস্থির, অনিত্য, ভাষাখেলা ক্রমাগত বদলাতে থাকে, কখনো কখনো ভাষানির্মাণের প্রক্রিয়ার সঙ্গে সমাজগঠনের প্রক্রিয়া মিশে যায়।

বিরুদ্ধ জ্ঞান

আমাদের মূল আলোচ্য: বিরুদ্ধ জ্ঞান, knowledge in opposition. জ্ঞাননির্মাণ যদি সামাজিক হয়, সামাজিক ক্ষমতা-সম্পর্ক ও আধিপত্যবিন্যাস থেকে তা প্রভাবিত হবে, ধরে নেওয়া যায়। সেক্ষেত্রে, ভাষার ক্রমবিবর্তন ও অর্থনির্মাণের পুরো প্রক্রিয়াটিতে ক্ষমতাবানদের দখলদারি জারি থাকবে, শাসকের আধিপত্য শাসকের ভাষায়, শাসকের অর্থে, চেপে বসবে বাকি সমাজের ওপর। শাসকের আধিপত্যের বিরুদ্ধে সমাজ যদি বিদ্রোহ করে, সেই বিদ্রোহের মূলে বিরুদ্ধ জ্ঞান ক্রিয়াশীল থাকে অবশ্য। বিরুদ্ধ জ্ঞান থেকে বিরুদ্ধ অর্থ, বিরুদ্ধ ভাষাচিহ্ন, ভাষাব্যবহার। স্লোগানের, সমষ্টিগর্জনের, দেওয়াললিখনের কি পোস্টারের যে ভাষা তা বিরুদ্ধ জ্ঞান/বিরুদ্ধ অর্থ থেকে উদ্ভূত, পুষ্ট, এমন ধরে নেওয়া অযৌক্তিক হবে না। বিশেষ বিশেষ বিরুদ্ধ ভাষা-খেলা তৈরি হবার পিছনে যে যে সামাজিক প্রক্রিয়া উপস্থিত ছিলো, তা ঐতিহাসিক ভাবেই ক্ষমতাবান শাসকের বিরুদ্ধে ক্ষমতাহীনদের বিদ্রোহঘটনা/লড়াইয়ের। যথা, গত সহস্রাব্দের আঠারো শতকের শেষাশেষি ঘটে যাওয়া ফরাসী বিপ্লবের মূল স্লোগান, সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতা, উনিশ ও বিশ শতকের পুঁজিতন্ত্র বিরোধী সমাজবিপ্লবের আবহ থেকে জন্ম নেওয়া, বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক, ভারতবর্ষে যা কালক্রমে হয়ে দাঁড়ায় ইনকিলাব জিন্দাবাদ। সাম্প্রতিক অক্যুপাই আন্দোলনের স্লোগান ছিলো, আমরাই ৯৯ শতাংশ, অর্থাৎ বাকি ১ শতাংশ মানুষের অন্যায় আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হোক। বাংলায় গত সত্তর-আশি বছর ধরে চলতে থাকা বিপ্লবচর্চার প্ৰতর্কটিতে অনেক পুরোনো শব্দে নতুন অর্থ ও অনুষঙ্গ লেগেছে, যথা লাল, বাম, সেলাম, নিশান, কমরেড, ব্যারিকেড, যার প্রত্যেকটির সঙ্গে সামাজিক আন্দোলনের ও বিদ্রোহের বিভিন্ন ইতিহাস জড়িত। ভারতবর্ষের ব্রিটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রক্রিয়ায় নতুন ভাষা-খেলার জন্ম হয়েছে, যথা করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে, বন্দে মাতরম, জয় হিন্দ। ভাষা অর্থে শুধুমাত্র শব্দ/শব্দবন্ধ নয়, ছবি বা শারীরিক বিভঙ্গও, যার সাংকেতিক মূল্য আছে, যথা ওপরে ওঠানো মুঠো করা হাত।

বিরুদ্ধতা অর্থে তাহলে সামাজিক বিরুদ্ধতা — পুঁজিতন্ত্রের বিরুদ্ধে, ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই। বিরুদ্ধতা থেকে অন্য সমাজনির্মাণ, অন্তত সেই নির্মাণের ভাবনা। বিরুদ্ধ জ্ঞান-অর্থ-ভাষানির্মাণের যে কোন ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া এই বিরুদ্ধ সমাজবাস্তবে সতত প্রোথিত ও সম্পৃক্ত থাকবে, এটাই গ্রাহ্য। তা না ঘটে যদি জ্ঞান ও অর্থ নিছকই চিহ্নসর্বস্ব ও ভাষানির্ভর হয়ে ওঠে, ভাষা-খেলা থেকে বিরুদ্ধ জ্ঞানে/অর্থে পৌঁছনোর চেষ্টা হয়, সে প্রক্রিয়া দেখনদার ও সামাজিকভাবে ছিন্নমূল হতে বাধ্য। হ্বিটগেনস্টাইনের কথা ধরেই বলা যায়, যে বিশেষ সামাজিক প্রসঙ্গ/অনুষঙ্গ/ব্যবহার ওই ভাষা-খেলাকে অর্থ ও জ্ঞান নির্মাণের প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করে, তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে ভাষা নিতান্তই ভাষা, শব্দ বাক্যের ব্যাকরণবদ্ধ বিন্যাসমাত্র, যা অর্থবহ না অর্থহীন তা বুঝবার কোন গ্রাহ্য উপায় নেই।

এত কথা বলা এ কারণে যে সামাজিক সংবাদমাধ্যমের রমরমার এই সময়ে জ্ঞান নির্মাণের সামাজিক/ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া আধড়মুড়ো পুঁজিতন্ত্রের করতলগত। শাসকের আধিপত্য এতটাই সুদূরপ্রসারী ও আপাত অপ্রতিরোধ্য, বিরুদ্ধ জ্ঞান ও বিরুদ্ধ ভাষাখেলার আপাতবিপ্লবী বিশ্বজগতেও তা প্রতিদিন তীব্রতর প্রত্যক্ষতায় বিদ্যমান। ফেসবুক ও ট্যুইটার থেকে সাম্প্রতিক কিছু উদাহরণ তুলে ধরে আমরা তা বোঝার চেষ্টা করবো। তবে তার আগে হালফিলের প্রযুক্তিসঞ্জাত যে সমান্তরাল বাস্তবে জ্ঞান সতত সহজলভ্য ও ‘মুক্ত’, সেই বাস্তবে এক নজর।

সহজ জ্ঞানের নতুন দুনিয়া

গত তিন দশক ধরে যোগাযোগ প্রযুক্তির অবিশ্বাস্য অগ্রগতির ফলে জ্ঞান আপাতত সহজলভ্য। প্রায় বিনা পরিশ্রমে, নিজের স্মার্টফোন কি কম্পিউটারে দুবার আঙুল ছোঁয়ালেই জ্ঞানলাভ সম্ভব, যে কোন বিষয়েই। জ্ঞান নির্মিত হবার সামাজিক ও ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া, যা বিচিত্র, বিবিধ, বহুস্তরীয় ও অনিবার্যভাবেই বহুভাষিক, তা হ্রস্ব হতে হতে একটিই কেন্দ্রীয় ও বিপুল তথ্যলঙ্গরে সীমিত, যে লঙ্গরে প্রবেশ অবাধ, উন্মুক্ত। আপাতদৃষ্টিতে, এই লঙ্গরে কোন দ্বারপাল নেই, যে যেমনভাবে যত চাইবে তত তথ্য পেতে থাকবে। এখন এই তথ্য পাওয়া যাচ্ছে ফোন কি কম্পিউটার মারফত, ভবিষ্যতে হয়তো তারও দরকার হবে না, সোজা মানবমস্তিষ্কের কোষে ও নিউরনগুচ্ছে সে তথ্য এসে জমা হবে।

এই প্রক্রিয়াটি যে আদৌ সম্ভব হয়ে উঠছে, উঠবে, তার পিছনে মূলত যন্ত্রনির্ভর, যন্ত্রগ্রাহ্য ও সেকারণেই সর্বজনীন এক একভাষা নির্মাণের ইতিহাস আছে। ইন্টারনেট বা অন্তর্জালের জন্মের পিছনে কাজ করেছিল ভাষা নির্মাণের তাগিদ, যে ভাষায় কথা বললে কম্পিউটারযন্ত্র বুঝবে। কোনো বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থানে স্থিত একটিই যন্ত্র নয়, অবস্থান নির্বিশেষে যাবতীয় সমগোত্রীয় যন্ত্র। এই ভাষা যে মুহূর্তে নির্মিত হলো, ব্যবহারিক হয়ে উঠলো, তন্মুহূর্তে মানবসমাজের মূলগত ঐতিহাসিক বহুভাষিকতাকে অস্বীকার করাও সম্ভব হয়ে উঠলো। বহুভাষা অর্থে বহু সমাজ, বহু সমাজ অর্থে বহু জ্ঞান। নতুন যন্ত্রভাষায় এই যাবতীয় বহুত্বকে অনুবাদ করে একভাষায় নিয়ে আসা সম্ভব হলো, ফলত কেন্দ্রীয়, এক অর্থে অনন্ত, তথ্যলঙ্গরটিও বাস্তব হয়ে উঠলো।

জ্ঞান থেকে তথ্যকে(তথ্য অর্থে এখানে data ও information উভয়ত) পৃথক করে দেখা প্রয়োজন। একারণে নয় যে তথ্য থেকে জ্ঞানে পৌঁছনো যায় না, বা জ্ঞান তথ্যে রূপান্তরিত হতে পারে না। পৃথকীকরণ প্রয়োজন, কেননা যে পরিপ্রেক্ষিতে এই চর্চা, সেখানে জ্ঞান নিরন্তর বদলে যাচ্ছে তথ্যে, যে তথ্য যন্ত্র পড়তে বুঝতে পারে, অর্থাৎ যা যন্ত্রভাষার আকর উপাদান, অক্ষর। অন্যভাবে বললে, মানবেতিহাসের, মানবসমাজের বহুস্রোত ও বহুস্বর মিশে আছে যে জ্ঞানে, হালফিলের সাংখ্যসঙ্কেত বা ডিজিটাল সিগন্যাল মারফত তা অনূদিত হচ্ছে সর্বজনীন/এক-যন্ত্রভাষার অক্ষরে, চিহ্নে। কি লিখিত পাঠ বা টেক্সট, কি ছবি, কি শব্দ, যা কিছু আমরা অন্তর্জাল থেকে পড়ি, দেখি, শুনি, সবটাই আসলে আসে যন্ত্রভাষায়, যে ভাষা যন্ত্র বোঝে, আর বোঝে গুটিকয় যন্ত্রভাষাবিৎ কম্পিউটার প্রোগ্রামার। আমাদের দেখাবোঝাশোনার প্রয়োজনে, আবার একবার অনুবাদ করতে হয়, যন্ত্রভাষা থেকে প্রতিদিনের ব্যবহারিক ভাষায়। জ্ঞান ভেঙে তথ্য, তথ্য থেকে ভাষা, ভাষায় অনুবাদ, অসংখ্য যন্ত্রের সঙ্গে আরো অগণিত যন্ত্রের সংলাপ, আবার অনুবাদ, আমাদের দেখাশোনাপড়া, তথ্যলঙ্গরে ঢোকা, অবিরল জ্ঞানলাভ।

প্রশ্ন উঠতে পারে, এই প্রক্রিয়ায় আপত্তির কি আছে? প্ৰযুক্তির উন্নতি, বুদ্ধিমান ও সাক্ষর যন্ত্র, যন্ত্রভাষা, সেই ভাষায় যন্ত্রে-যন্ত্রে নির্বাধ অনায়াস সংলাপ, এ সবই তো বৃহত্তর সামাজিক ইতিহাসের অঙ্গ, যে ইতিহাস মূলত মানুষের। প্রশ্ন উঠতে পারে, সর্বজনীন যন্ত্রভাষার উদ্ভব ও অন্তর্জালের বৈপ্লবিক প্রযুক্তিকে কেন জ্ঞানের সর্বজনীন ও গণতান্ত্রিক প্রসারের পক্ষে অতি প্রয়োজনীয় প্রেক্ষিত হিসেবে দেখা হবে না? আর যদি জ্ঞান উন্মুক্ত হয়, সমাজ বন্ধ থাকতে পারে কখনো? যন্ত্র যে অনুবাদকর্ম অনায়াসে করে, তা অ-যন্ত্র মানুষের সাধ্যের অতীত। সেই অনুবাদের সূত্রে বিভিন্ন সমাজ এক বহুকাঙ্ক্ষিত অভিন্নতা অভিমুখে যেতে পারে, বহু জ্ঞান এক জ্ঞানে পৌঁছয়, যা সমগ্র মানবসমাজের।

সেভাবে দেখলে সত্যিই আপত্তির কিছু নেই। সব ভাষা যদি এক ভাষা হয়ে যায়, সব জ্ঞান যদি একটিই বিশ্বজনীন হাঁ-দরজা তথ্যভান্ডারে জমা হতে থাকে, তার চাইতে ভাল আর কি হতে পারে? যন্ত্র ও প্ৰযুক্তি যদি চিরবৈষম্যের, অমিলের, বিচ্ছিন্নতার পৃথিবী থেকে মহামিলনের আর সাম্যের ভুবনডাঙায় আমাদের নিয়ে ফেলতে পারে, তাতে ভূত দেখবার কি কারণ থাকে?

থাকে। কেননা জ্ঞান তার সামাজিক উৎসে অনিবার্যভাবে বিভিন্ন, বহু জ্ঞান থেকে এক জ্ঞানে পৌঁছনো যায় না, যেতে গেলে জোর করে সেই মূলগত সামাজিক বিভিন্নতাকে অস্বীকার করতে হয়। জ্ঞান নির্মাণের যে কোন প্রক্রিয়া উৎসে ও চরিত্রে সামাজিক, সমাজের পরতে পরতে যদি বৈষম্য, অসাম্য ও বিচ্ছিন্নতা মিশে থাকে, শুধুমাত্র এক একভাষা তৈরি করে বিশ্বজনীন সাম্যপ্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়, জ্ঞানের গণতন্ত্রীকরণও অসম্ভব। তা ভিন্ন, যন্ত্রভাষায় অনুবাদের সমগ্র প্রক্রিয়াটিতে (জ্ঞান-তথ্য-যন্ত্রভাষা-আন্তর্যন্ত্র সংলাপ-পুনরানুবাদ) প্রথমাবধি এক ধরনের জবরদস্তি ও কৃত্রিমতা ওতপ্রোত থাকে, যা জ্ঞান তৈরির স্বাভাবিক ও মানুষী প্রক্রিয়াসমূহ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। উপরন্তু, প্রক্রিয়াটি পুরোপুরি দূরনিয়ন্ত্রিত ও নজরবন্দী। বলা ভালো, এই দূরনিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির বাইরে আপাতত প্রক্রিয়াটি অস্তিত্বহীন। ফলে, সমাজ থেকে উদ্ভূত হওয়া সত্বেও, সর্বজনীন যন্ত্রভাষানির্ভর যোগাযোগ প্রযুক্তির এই প্রক্রিয়া কার্যত সমাজবিচ্ছিন্ন, যে অনুবাদকর্ম প্রক্রিয়াটিকে সম্ভব করে তোলে, তা শেষমেশ জ্ঞাননির্মাণের(কগনিশান) সামাজিক ক্রিয়াকে বিপন্ন করে।

জ্ঞান, বিরুদ্ধ জ্ঞান, যন্ত্রভাষা ও বিরুদ্ধ প্রয়োগ

মানবসভ্যতা যে বিচিত্র ঐতিহাসিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে এতাবৎকাল, তার প্রতিটি পর্বেই জ্ঞান ও বিরুদ্ধ জ্ঞানের দ্বন্দ্বটি উপস্থিত ছিল। জ্ঞান যেহেতু উৎসে ও চরিত্রে সামাজিক, সমাজের যাবতীয় ক্ষমতা-সম্পর্কের(উৎপাদন সম্পর্কেরও) সঙ্গে জ্ঞান নির্মাণের প্রক্রিয়া/প্রক্রিয়াসমূহ যুক্ত থেকেছে বরাবর। জ্ঞান কখনোই, কোনও অবস্থাতেই, নিরপেক্ষ নয়, ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ সাপেক্ষে তার চরিত্র নির্ধারিত হয়েছে বরাবর। শাসকের আধিপত্য যেমন কায়েম হয়েছে জ্ঞানের প্রাতিষ্ঠানিক বিস্তারের মাধ্যমে, তেমন সেই আধিপত্যের বিরুদ্ধতা সংগঠিত হবার পিছনেও ক্রিয়াশীল থেকেছে জ্ঞান। যে জ্ঞানের কথা আমরা বলছি তা একইসঙ্গে প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ, মূর্ত ও বিমূর্ত, স্থাণু ও পরিবর্তনশীল। কে কিভাবে জ্ঞান ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ করে তদ্বারা জ্ঞান নির্মাণের সমগ্র ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া/প্রক্রিয়াসমূহ প্রভাবিত ও নির্ধারিত হয়, অন্তত হয়ে এসেছে এতকাল। প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানের সবচাইতে বড় উদাহরণ সম্ভবত ধর্ম, অথচ ধর্মীয় জ্ঞান বলতে যা বোঝায় তা কখনোই একমাত্রিক ও সাধারণ নয়। ধর্ম শাসকের, তার আধিপত্যের হাতিয়ার, কিন্তু তা একইসঙ্গে বিরুদ্ধতার, বিদ্রোহেরও সুতিকাগৃহ। ধর্ম থেকে শাসকের প্রতিষ্ঠান যখন আলাদা হতে শুরু করছে, ধর্মীয় জ্ঞান রূপান্তরিত হচ্ছে শাসনজ্ঞানে(ধরা যাক রাজনীতিবিজ্ঞান বা সমাজবিজ্ঞান), সে জ্ঞানও অবস্থা/ব্যবহার সাপেক্ষে বদলে যাচ্ছে বিরুদ্ধ জ্ঞানে। অর্থাৎ, বলতে চাইছি যে যেহেতু জ্ঞাননির্মাণ(কগনিশান) ও জ্ঞান(নলেজ) সমাজে প্রোথিত, সমাজসঞ্জাত, তা একইসঙ্গে শাসকের ও বিরুদ্ধতার, জ্ঞানের ওপর কারুর চিরস্থায়ী খাসদখল থাকতে পারে না। জ্ঞান যেহেতু ভাষানির্ভর নয়, নিছক ভাষা থেকে সেখানে পৌঁছনো যায় না, জ্ঞান বিরুদ্ধ জ্ঞান হয়ে উঠতে পারে একমাত্র সেই সামাজিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যা শাসকের আধিপত্যের বিরুদ্ধতা করে, অন্তত করার ক্ষমতা ধারণ করে(immanence)।

যে যন্ত্রভাষা নিয়ে আমরা কথা বলছি, সে ভাষাটি জ্ঞাননির্মাণ ও জ্ঞান সংক্রান্ত প্ৰতর্কটিকে আগাগোড়া বদলে দিতে সক্ষম, এমন মনে করার কারণ আছে। যেহেতু ভাষাটি অ-মানুষী ও বহুলাংশে অসামাজিক, জ্ঞান নির্মাণের সামাজিক ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া/প্রক্রিয়াসমূহে যুক্ত না থেকেও সে ওই প্রক্রিয়া/প্রক্রিয়াসমূহকে প্রভাবিত করতে পারে, করছেও নিরন্তর। ফলে ভাষা আর জ্ঞানের, জ্ঞান আর তথ্যের মধ্যের ধারণাগত (conceptual) ও বাস্তব (actual) — অর্থাৎ সামাজিক — দেয়ালগুলি ভেঙে পড়ছে। ফলে এমন এক নতুন জ্ঞানতন্ত্র (knowledge system, epistemology) তৈরি হচ্ছে যেখানে জ্ঞান প্রকৃতার্থে সর্বজনীন, যা বিরুদ্ধ সামাজিক প্রক্রিয়া ব্যতিরেকে অনায়াসে বিরুদ্ধ জ্ঞান হয়ে উঠতে পারে। অর্থাৎ, যন্ত্রভাষা ব্যবহার করেই বিরুদ্ধ জ্ঞাননির্মাণ সম্ভব, যে বিরুদ্ধ জ্ঞান থেকে স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে বাস্তব সামাজিক অভ্যুত্থানও সম্ভব হয়ে উঠবে। উদাহরণ, আরব বসন্ত, অক্যুপাই, মিটু কি ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার, যার প্রত্যেকটিতে যন্ত্রভাষার যথাযথ ব্যবহার সামাজিক বিরুদ্ধতা নির্মাণের প্রধান উপাদান ছিল। এমনও বলা হচ্ছে, এই ভাষা ব্যবহার না করে আজকের পৃথিবীতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলাই যায় না। যেহেতু জ্ঞান বলতেই অন্তর্জালের সদা-সংযুক্ত জ্ঞান বা নেটওয়ার্কড নলেজ, বিরুদ্ধতার শুরু হতে হবে সেই জ্ঞানের জগতে।

স্থিতাবস্থা বিরোধী বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন যন্ত্রভাষানির্ভর হয়ে উঠছে, যোগাযোগ প্রযুক্তির দক্ষ ব্যবহার আন্দোলনের সাফল্য/ব্যর্থতার ক্ষেত্রে নিয়ামক হয়ে উঠছে ক্রমাগত। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এ লেখায় নেই। তবু দু-চার কথা বলা দরকার।

বিভিন্ন আন্দোলন যে যোগাযোগ প্রযুক্তির(অথবা সাংখ্য প্ৰযুক্তি, মানে ডিজিটাল টেকনোলজি) ব্যবহার করছে, তা অনস্বীকার্য। এই ব্যবহারের ফলে, আন্দোলন শুরুর যে দীর্ঘমেয়াদি সঙ্ঘায়ন (organising) প্রক্রিয়া, তাকে ডিঙিয়ে গিয়ে দ্রুত রাস্তায় নেমে পড়া যাচ্ছে। যথা, ইজিপ্টে ২০১১র বিপ্লব, যাতে হোসনি মোবারক গদিচ্যুত হন। বলা হয়, এই বিপ্লবের শুরু হয়েছিল যথাক্রমে ফেসবুক ও ট্যুইটারে, কায়রোর তহরির চকে যে জমায়েতগুলো থেকে মোবারক বিরোধী বিপ্লবের সূচনা হয়, তা ডাকা হয়েছিল সামাজিক সংবাদমাধ্যমে। মার্কিনদেশে অক্যুপাই শুরুর পিছনে তহরির প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিলো, সে কারণে ফেসবুকে/ট্যুইটারে ডাক দিয়ে জমায়েত শুরু হয়ে যায়। স্পেনের ইনদিগন্যাডোজ বা ১৫-এম আন্দোলন, যা থেকে বামঘেঁষা পদেমস দলটির জন্ম, তার শুরুটাও হয়েছিল সামাজিক সংবাদমাধ্যমে। কিছু পরের ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার বা মিটু তো পুরোপুরি সাংখ্যপ্ৰযুক্তিনির্ভর, ট্যুইটারের হ্যাশট্যাগ ঘিরে আন্দোলন দানা বাঁধে। একদম হালফিলের ফরাসীদেশের ‘হলুদ জামা’ আন্দোলনের শুরু হচ্ছে ফেসবুকে, এমন শোনা যায়।

ইয়েলো ভেস্ট‌ আন্দোলন। আন্দোলন শুরুর যে দীর্ঘমেয়াদি সঙ্ঘায়ন প্রক্রিয়া, তাকে ডিঙিয়ে গিয়ে দ্রুত রাস্তায় নেমে পড়া যাচ্ছে আজ।

পুরনো অর্থাৎ বড় সংবাদমাধ্যম, যাকে মাস মিডিয়া বলা হয়(বড় খবরের কাগজ, টিভি চ্যানেল, বড় সংবাদসংস্থা পরিচালিত সংবাদমঞ্চ বা নিউজ পোর্টাল), সেখানে সামাজিক আন্দোলনের সেভাবে ঠাঁই নেই, অন্তত যতক্ষণ পর্যন্ত না তা খবর হচ্ছে, অর্থাৎ দৃশ্যত বিপুল জনসমাগম বা হিংসার ঘটনা ঘটছে। সে তুলনায় সামাজিক মাধ্যম অনেক বেশী আয়ত্বাধীন, আন্দোলনের খবর ইচ্ছামতো অনেক মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়, ফেসবুক, ট্যুইটার বা হোয়াটসঅ্যাপ আদি মারফত আন্দোলন সংগঠিত করাও যায়। ফলে সাংখ্যপ্ৰযুক্তি বা সাংখ্যমাধ্যমগুলির ব্যবহারিক, প্রায়োগিক উপযোগিতা বিষয়ে অধুনা আন্দোলনগুলি ক্রমশই আরো ওয়াকিফহাল, আন্দোলনের কর্মীদের মধ্যে এই মাধ্যমের ব্যবহার ক্রমশ বাড়ছে।

অর্থাৎ নতুন সাংখ্যপ্ৰযুক্তি ও সাংখ্যমাধ্যমের সঙ্গে অচ্ছেদ্য বন্ধনে যুক্ত হয়ে পড়ছে সামাজিক আন্দোলন, যা স্থিতাবস্থা ভাঙে, জ্ঞানকে বিরুদ্ধ জ্ঞানে রূপান্তরিত করে, সেই জ্ঞানে পুষ্ট হয়। অর্থাৎ কার্যত বিরুদ্ধ জ্ঞানের সঙ্গে সাংখ্যপ্রযুক্তি/সাংখ্যমাধ্যমের এক অর্থে নাড়ির যোগ তৈরি হয়ে যাচ্ছে, যেন বিরুদ্ধতা ও বিরুদ্ধ জ্ঞান তৈরির সমগ্র প্রক্রিয়া এই প্রযুক্তি/মাধ্যম ব্যবহারের ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ যন্ত্রভাষা শুধু যে বিরুদ্ধ জ্ঞান ও বিরুদ্ধ ভাষা-খেলার মধ্যে ঢুকে পড়ছে তাই নয়। বিরুদ্ধ সমাজের যাবতীয় বিপ্লবী যৌথ সম্ভাবনা (revolutionary immanence), যৌথ বিষয়ীচৈতন্য (collective subjectivity) উপায়হীনভাবে সংযুক্ত হয়ে পড়ছে সেই ভাষার সঙ্গে।

গ্রামসি যাকে পুঁজিতন্ত্র ও শাসকশ্রেণীর আধিপত্য বলেছিলেন, ক্ষমতাবানের যে সংস্কৃতি ক্ষমতাহীনের ও নিম্নবর্গের চৈতন্য অধিকার করে রাখে, যা শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবী যৌথচৈতন্যের বিকাশের পথে সবচাইতে বড় প্রতিবন্ধক, যা না ভাঙলে স্থিতাবস্থা বস্তুত ভাঙে না, হালফিলের যন্ত্রভাষা ও সাংখ্যপ্ৰযুক্তিনির্ভর সামাজিক আন্দোলন কি সেই আধিপত্যের বিরুদ্ধতা করতে সক্ষম? না কি উপায়হীন এই প্ৰযুক্তিনির্ভরতা ও ভাষাকেন্দ্রিকতা আসলে পুঁজিতন্ত্রের সর্বব্যাপী ও সর্বগ্রাসী আধিপত্যেরই প্রকাশ? আমরা অতঃপর সেই আলোচনায় ঢুকবো।

নেটওয়ার্কড পৃথিবী ও বিরুদ্ধতা

নেটওয়ার্ক বিষয়টি আসলে কি? যেহেতু শব্দের অর্থ তার ব্যবহারে, এবং এই শব্দটির নানাবিধ ব্যবহার আছে, এক কথায় এর উত্তর দেওয়া মুশকিল। বর্তমান আলোচনার প্রসঙ্গে, নেটওয়ার্ক বলতে অন্তর্জাল বা ইন্টারনেট নির্ভর যে সদা-সংযুক্ত পৃথিবীর মধ্যে আমরা থাকি, বা থাকতে বাধ্য হই, সেই নির্মাণটি। নির্মাণ (construct) বলছি এ কারণে যে পৃথিবী বলতে এখানে একমাত্রিক এক-পৃথিবীর কথা ভাবা হচ্ছে কি স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে ধরে নেওয়া হচ্ছে, যা ভৌগোলিক ও সামাজিক সীমাকে অতিক্রম করে সদা-সংযুক্ত থাকে। এই ভাবনাটি ঠিক, এমন বলা যাবে না। নেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে, বা নেটনির্ভর প্ৰযুক্তি ব্যবহার করছেন প্রতিদিন আরো বেশি সংখ্যক মানুষ। মহাশূন্যে বিভিন্ন রাষ্ট্র যে সব উপগ্রহ মোতায়েন করেছে, তার নজরে স্থান বা ভূগোল নির্বিশেষে পৃথিবীগ্রহের গোটাটাই দিবারাত্র বন্দী। এতদসত্ত্বেও, পৃথিবীর সর্বত্র সমস্ত মানুষ সারাক্ষণ নেট ব্যবহার করছেন, করলেও একই ভাবে করছেন, তা নয়। আর দশটা প্ৰযুক্তির মত নেটও বস্তুত প্রযুক্তিমাত্র, তার মালিক থাকে। উপগ্রহ স্থাপন বা ব্যবহারের খরচা থাকে, উপগ্রহ থেকে যে সাংখ্যসঙ্কেত দেওয়া-নেওয়া হয়, সেটাও বিনিখরচায় হয় না। এ ভিন্ন, পাহাড় ফুঁড়ে, সমুদ্রের তলা দিয়ে প্রবাহিত অথচ কার্যত অদৃশ্য যে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন আঁশতার বা হাই-অপটিক ফাইবার কেবল মারফত তথ্যের আদানপ্রদান ঘটে সচরাচর, সে প্ৰযুক্তি যথেষ্ট খরচসাপেক্ষ। নেটওয়ার্ক সাকার ও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে যে সেলফোন বা কম্পিউটার মারফত, তা বানায় বড় কর্পোরেশনকুল, ব্যক্তি ব্যবহারকারীর সেলফোনে নেট পৌঁছে দেবার প্ৰযুক্তিও বড় কর্পোরেট সংস্থার আয়ত্বে থাকে। অর্থাৎ সদা-সংযুক্ত নেটওয়ার্কড পৃথিবীটিকে তৈরি করতে ও বাঁচিয়ে রাখতে আগাগোড়া বিপুল পরিমাণ পুঁজি লগ্নি করতে হয়। সাংখ্যপ্রযুক্তির প্রত্যেক খন্ডে, অধ্যায়ে, উপাদানে পুঁজি যুক্ত থাকে, যার অর্থ, সে পুঁজি লগ্নি হয়, খাটে, মুনাফা হয়ে পুঁজিমালিকের ঘরে ফেরত আসে, অথবা আসে না, পুঁজিবাজারের নিয়মমাফিক। অন্যদিকে, পৃথিবীজোড়া ও সদা-সংযুক্ত যে ব্যবহারকারী বাহিনী এই নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে, তা কদাচ স্ব-সম্পূর্ণ ও সামাজিক-অর্থনৈতিক ভাবে সুষম একটি গোষ্ঠী নয়, সাংখ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার সব ব্যবহারকারীর সাধ্য ও সামর্থ্যের মধ্যে সবসময় থাকে না। গত দু দশক ধরে সাংখ্যপ্ৰযুক্তির বাহক যন্ত্রের(ফোন, কম্পিউটার, মোডেম) দাম কমেছে, একথা ঠিক। নেট পরিষেবা যথা ব্রডব্যান্ড কি ডেটা সংযোগের দাম অন্তত ভারতবর্ষে ধারাবাহিকভাবে কমছে। কিন্তু এত কমেনি যে যে কেউ স্মার্টফোন বা কম্পিউটার কিনে যখনতখন নেটওয়ার্কে ঢুকে পড়বেন। দাম ছাড়াও, প্ৰযুক্তি-পরিচিতির অভাবও প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারে।

অর্থাৎ, নেটওয়ার্ক ব্যাপারটি আপাদমস্তক এক নির্মাণ, যার ভিতরে রাষ্ট্র, পুঁজি, পুঁজিমালিক, দোকানদার, শ্রম, শ্রমিক সব মিশে আছে। সাংখ্যপ্রযুক্তির শরীর/অবয়ব(হার্ডওঅ্যার) তৈরি হয় যে প্ৰযুক্তি/প্ৰযুক্তিগুচ্ছে, তার সবটাই আসলে বিভিন্ন বাজারে বিভিন্ন পণ্য হিসেবে বিক্রি হয়। সংযুক্ত হতে, অর্থাৎ নেটওয়ার্কে ঢুকতে গেলে আপনাকে আগে ক্রেতা হতে হবে, দোকানবাজার ঘুরতেই হবে। এই কেনাকাটা/বাজারের অংশটা চট করে বোঝা যায়, কেননা এর একটি আপাত শারীরিকতা আছে। দৃশ্যমান না হলেও উপগ্রহ কি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন আঁশতার যে কোথাও না কোথাও আছে, এটা জানা কঠিন নয়, কেননা ডেটা দেওয়া-নেওয়া করার কোনও না কোনও মাধ্যম ও আধার চাই। ফোন, কম্পিউটার ইত্যাদি প্রবলভাবে দৃশ্যমান, ফলত সে নিয়েও কোনো অস্বচ্ছতা নেই। এই বাজারটি জানা বাজার, যে পুঁজি এ বাজারকে সম্ভব করে তোলে, তার চলনবলনও জানা। আর দশটা পরিচিত বাজারের মত, এখানেও পণ্য তৈরি হয় শ্রম এবং কাঁচামালের সঙ্গে পুঁজি মিশিয়ে। যেহেতু পণ্য, তা বিক্রি হয়, বিক্রির জন্য প্রয়োজনীয় ইনফ্রাস্ট্রাকচার বা কাঠামো তৈরি করতেও হয়।

যেটা গোলমেলে ও অধুনা আলোচ্য, তা হচ্ছে সাংখ্যপ্রযুক্তির নিরাবয়ব ও রহস্যময় অন্তর্দেশ, যেখানে যন্ত্রের শারীরিক প্রত্যক্ষতার জায়গা নেয় যন্ত্রভাষার দুর্জ্ঞেয় সাংকেতিকতা। অর্থাৎ সফটওঅ্যার বা প্রোগ্রাম। নিছক উপগ্রহ বা আঁশতার, চেনা যন্ত্রের চেনা বাজার দিয়ে সাংখ্যপ্ৰযুক্তিকে, সমাজজীবনের স্তরে স্তরে তার সদা-উপস্থিত, সম্মোহক ও নেশাধরানো প্রভাবকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। সফটওঅ্যার বা প্রোগ্রাম মানে যন্ত্রভাষা, যা যন্ত্রকে জীবন দেয়, অন্য যন্ত্রের সঙ্গে কথা বলে, প্রয়োজনমতো নিজেই ভাষা তৈরি করে। নেটওয়ার্কের শরীর যদি হার্ডওঅ্যার বা যন্ত্র হয়, যন্ত্রভাষা তার আত্মা। নেটওয়ার্ক তৈরির গোড়ার দিকে যে সব যন্ত্রভাষাবিৎ প্রোগ্রামার ভাষা তৈরিতে ব্যাপৃত ছিলেন, তারা যে এর প্রায়োগিক সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ বিষয়ে খুব ভাবিত বা ওয়াকিফহাল ছিলেন এমন নয়। অন্তর্জাল তৈরি হয়ে ওঠার পিছনে সম্ভবত মার্কিনী সামরিক গবেষণার ভূমিকা ছিলো, কিন্তু যে প্রোগ্রামাররা প্রাথমিক কাজটা করছিলেন তাঁরা বিষয়টির প্রায়োগিক উপযোগিতার কথা মনে রেখে কাজ করছিলেন না। বরং, সমকালীন যন্ত্রভাষার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে সর্বযন্ত্রগ্রাহ্য কোন একভাষায় পৌঁছনো যায় কিনা, সেই যূথবদ্ধ অনুসন্ধিৎসা তাঁদের প্রাণিত করেছিল। প্রথম প্রোগ্রামারকুলের অন্যতম, রিচার্ড স্টলম্যান(স্টলম্যান আশির দশকের গোড়ায় বিখ্যাত এম আই টি বা ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনলজির এ আই ল্যাব বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরির গবেষণাগারে কর্মরত ছিলেন) বলছেন, তাঁরা ভাবেনই নি যে এই ভাষা ভবিষ্যতে ব্যবসায়িক কারণে ব্যবহৃত হতে পারে, সফটওঅ্যার খোলাবাজারে বিক্রি হতে পারে, কোনো কর্পোরেট সংস্থার একচেটিয়া মালিকানা থাকতে পারে সে সফটওঅ্যারের ওপর। ভাষা মানেই তা সর্বজনীন, মুক্ত, এমন একটা ভাবনাই ছিল।

হালফিলের যে সব যন্ত্রভাষা নিয়ে আমরা কথা বলছি, সাংখ্যপ্রযুক্তির আমব্যবহারকারীদের কাছে তা এখনো মুখ্যত মুক্ত। সফটওঅ্যার বেচে মাইক্রোসফট বা অ্যাপল কোম্পানি অশ্লীল মুনাফা করেছে, কিন্তু তাতে প্ৰযুক্তির মুক্ত ব্যবহার ঠেকে যায়নি, নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হয়েছে প্রতিদিন। সফটওঅ্যার জাল করা হয়েছে যথেচ্ছ, অ্যাপল কোম্পানির দামী যন্ত্রের প্রায় যাবতীয় সুবিধা নিয়ে বাজারে এসেছে সস্তার চীনা মাল। যে সব প্রোগ্রাম/সফটওঅ্যারের ওপর নির্ভর করে আমাদের দৈনন্দিন নেটওয়ার্ক ব্যবহারের সিংহভাগ, তার প্রায় সবকটিই বিনামূল্যের, জাল করার দরকার নেই, বিশেষত সেলফোনে সর্বক্ষণ যে সফটওঅ্যার/অ্যাপ ব্যবহৃত হয়ে থাকে, যথা আমাজন, উবের, ফ্লিপকার্ট।

এহ বাহ্য। অ্যাপের যে সব প্ৰযুক্তি আপাতঅর্থে মুক্ত, তাদের প্রত্যেকটির ওপর কোনো না কোনো বড় বাণিজ্যিক সংস্থার মালিকানাদখল রয়েছে, ওই প্ৰযুক্তি মারফত সংস্থাগুলি প্রথমে বাজার তৈরি করে, পরে সে বাজারে মাল/পরিষেবা বিক্রি করে। এটিও পুঁজিবাজারের চেনা চলন, বোঝায় অসুবিধা নেই।

যা চট করে ঠাউরে ওঠা যায় না, তা হল নেটওয়ার্কড জ্ঞান, মানুষজন, সমাজ। যথা গুগল, ফেসবুক, ট্যুইটার কি রেডিট। গুগল মারফত আমরা নেটওয়ার্ক-এর ভিতরে ঢুকি, অন্তর্জালের গভীরে গিয়ে যে কোন বিষয়ে অবিরল জ্ঞান অর্জন করি, গুগলের তৈরি করা আন্ড্রয়েড প্ৰযুক্তি স্মার্টফোনে ব্যবহার করি দিনরাত, গুগলের মেইল সফটওঅ্যার কাজে লাগিয়ে প্রয়োজনীয় চিঠিপত্র লিখি। কিম্বা ফেসবুক, যেখানে নতুন করে যৌথ তৈরি হয়, পুরোনো বন্ধুদের খুঁজে পাওয়া যায়, নতুন বন্ধুও, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যেখানে নিজের জীবনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ ছবি ও শব্দ সুদ্ধ তুলে ধরা যায়, অন্যের জীবনেও উঁকি মারা যায় ইচ্ছামতো, কেননা ফেসবুক যে সংযোগ নির্মাণ করে, তদ্বারা আত্মপর ভেদাভেদ লুপ্ত হয়ে যায়। শুধু এইমাত্র নয়। যে কথা আগেই বলা হয়েছে, ফেসবুক এখন রাজনৈতিক বিরুদ্ধতার অনিবার্য হাতিয়ার, কিম্বা ট্যুইটার, যা ব্যবহার করে প্রকৃত সামাজিক বদল ঘটানো সম্ভব হয়ে উঠছে। এ সবই হয় নিখরচায়। ফেসবুক তার কোটি কোটি ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে পয়সা নেয় না, গুগল নেয় বটে, কিন্তু ব্যবহারের একটি পর্যায়ে পৌঁছে, তার আগে পর্যন্ত বিনামূল্যে পরিষেবা। ট্যুইটারও পয়সা নেয় না। অথচ কিমাশ্চর্যম, কি গুগল কি ফেসবুক কি ট্যুইটার, নেটওয়ার্কড পৃথিবীর উজ্জ্বলতম নক্ষত্রদের মধ্যে প্রমুখ, তাদের মুনাফার পরিমাণ প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।

যে সব বড় কর্পোরেট সংস্থা সাংখ্যপ্ৰযুক্তির প্রসার ও বিস্তৃতির দায়িত্বে, এই প্রযুক্তি সাধারণ্যে নিয়ে আসার কাজ যারা করে, তারা আমব্যবহারকারীর কাছ থেকে সচরাচর খাজনা নেয় না। তাহলে তাদের মুনাফার উৎস কি? গত সাত-আট বছরে এ নিয়ে বেশ কিছু লেখাপত্র হয়েছে, গুগল বা ফেসবুক জাতীয় সংস্থা কি করে মুনাফা করে, তা এখন আর অজানা নয়। অন্য আর দশটি কোম্পানির মতো গুগল বা ফেসবুকও পুঁজি লগ্নি করে, পুঁজি খাটায়, পুঁজি ফেরত আনে। সংযুক্ত বিশ্বসমাজ নির্মাণ, মানবপ্রেম ও জ্ঞানের গণতন্ত্রীকরণের বহুলপ্রচারিত ও এক অর্থে সমাজগ্রাহ্য ধারণার গভীরে গেলে মুনাফা তৈরির সেই পুরোনো গল্পই উঠে আসে। কিন্তু বদল ঘটেছে পদ্ধতিতে। নেটওয়ার্কড বিশ্ব মানে নেটওয়ার্কড বাজার, অনলাইন বাণিজ্য মারফত দ্রুত যে কোন পণ্য ক্রেতা বা ভোক্তার ঘরে পৌঁছে দেওয়া যায়। আমাজন, ফ্লিপকার্ট আদি সংস্থাগুলি এ কাজ করে, পুরোনো ব্যবসা নতুন কায়দায় হয়। গুগল বা ফেসবুকের ব্যবসা করার সমস্ত কায়দাটাই আলাদা — তাদের বাজারে যে ক্রেতা, সে একাধারে ক্রেতা/ভোক্তা ও বিনামজুরির শ্রমিক। একইসঙ্গে সে পণ্যও বটে। গোলমেলে ঠেকলেও ব্যাপারটা কিছু বিশদে বোঝা দরকার।

কিভাবে কাজ করে গুগল বা ফেসবুক? সাংখ্যপ্ৰযুক্তি ও অন্তর্জালের ব্যবহার যত সরল হয়, বাড়ে, ব্যবহারকারী গোষ্ঠী/ব্যক্তি/সমাজ যত বিচিত্র, বিবিধধর্মী হয়, তত বেশি জ্ঞান উৎপন্ন হয় প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে। প্রতি ব্যবহারকারীর ব্যবহারের ধরণ, পছন্দ অপছন্দ ও মাত্রা, এ সবই জ্ঞান হিসেবে পাইকারিচালান হতে থাকে নেটওয়ার্কে। গুগল বা ফেসবুকের বিশেষ যন্ত্রভাষা, যাকে অ্যালগরিদম বলা হয়ে থাকে, সেই জ্ঞানকে তথ্যে অনুবাদ করে মুহূর্তে। সেই তথ্য/জ্ঞান পণ্য হিসেবে পৌঁছে যায় সেই বাজারে, যাকে আমব্যবহারকারী জনতা দেখতে-বুঝতে পারে না। বিজ্ঞাপনদাতা ছোটবড় বাণিজ্যিক সংস্থা সে বাজারের ক্রেতা, নেটওয়ার্ক মারফত আসতে থাকা জ্ঞান গুগল বা ফেসবুকের কাছ থেকে কিনে তারা বিজ্ঞাপন দেয়, সেই বিজ্ঞাপনের শুল্কে ফেসবুক/গুগল আদি কর্পোরেট সংস্থার মুনাফা বাড়তে থাকে।

স্থান-কাল-সমাজ-অর্থনীতি-ধর্ম-জাতি নির্বিশেষে আমি-আপনি ও যাবতীয় নেটওয়ার্কড জনতা এই বাজারে গলামুখ অবধি ডুবে আছি। গুগলে ঢুকে আপনি জ্ঞান খুঁজলেন, কি খুঁজলেন, কতবার খুঁজলেন, তা জ্ঞান/তথ্য হয়ে বাজারে চলে গেলো। হয়তো আপনি ভ্রমণোৎসাহী, কোথায় বেড়াতে যাওয়া যায় সে বিষয়ে খবর নিচ্ছেন। একবার গুগল খুঁজলেন, দুবার খুঁজলেন, ট্রেনপ্লেনবাসের সময় দেখলেন। পরে আবার গুগলে ঢুকলেন, অন্য কিছু দেখলেন, আপনার ফোন কি কম্পিউটারের পর্দায় হোটেল আর পর্যটনসংস্থার অসংখ্য বিজ্ঞাপন আপনাকে তাড়া করতে থাকল। ফেসবুকে ঢুকলেন, সেই এক বিজ্ঞাপন মিছিল করে এল, তৎসহ আরো বহু নতুন, যা ফেসবুকে আপনার পোস্ট, খবর দেখা, লাইক মারা ইত্যাদির জ্ঞান থেকে সদ্য পুষ্ট। অন্য বিজ্ঞাপন থেকে নেটওয়ার্কড বিজ্ঞাপনের তফাৎ এই যে নেটওয়ার্ক বিজ্ঞাপন সর্বদা নির্দিষ্টলক্ষ্য বা টার্গেটেড। আপনার পছন্দ অপছন্দের এবং চাহিদার বিশেষ নির্দিষ্ট জ্ঞান মুহূর্তে বিশ্লেষণ করে গুগল কি ফেসবুকের অ্যালগরিদম আপনার ফোন/কম্পিউটারের পর্দায় তৎকাল লাগসই বিজ্ঞাপন ভাসিয়ে দেবে, যা আসতেই থাকবে, আসতেই থাকবে, গুগল খোঁজপর্দায় বা সার্চস্ক্রিনে, ফেসবুকের খবরদানী বা নিউজফিডে। এমন নয় নেটওয়ার্কপূর্ব সময়ে বিজ্ঞাপনদাতারা শূন্যে ঢিল ছুড়তেন। ক্রেতা/ভোক্তাদের মনস্তত্ত্ব, মানসিক অবস্থা, এ সব নিয়ে সমীক্ষা চালিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হতো, এখনো হয়। কিন্তু নেটওয়ার্ক যে নিরন্তরতায়, গতিতে, এবং নির্দিষ্টতায় তথ্য সংগ্রহ করে, তার প্রতিতুল কিছুর কথা আগে, অর্থাৎ নেটওয়ার্কপূর্ব সময়ে, ভাবা অসম্ভব ছিল। তার চাইতেও বড় কথা, এই তথ্য সরাসরি সংগৃহীত হচ্ছে ক্রেতা/ভোক্তার বিষয়ীচৈতন্য থেকে।

কি গুগল কি ফেসবুক কি ট্যুইটার, তাদের মুনাফার পরিমাণ প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। কীভাবে?

বিজ্ঞাপনদাতার কাছে যে ক্রেতা/ভোক্তা, সে-ই নেটওয়ার্কের কাঁচামাল, কেননা তার ব্যক্তি ও সমষ্টিজীবনের ভিতরকার সমস্ত তথ্য নেটওয়ার্ক আহরণ করে বাণিজ্যিকভাবে মূল্যবান জ্ঞান হিসেবে, যে জ্ঞান/তথ্য না থাকলে নেটওয়ার্ক থাকেই না। একইসঙ্গে সে বিনামজুরির শ্রমিক, ব্যবহারকারী ব্যক্তি/সমষ্টিঅংশ হিসেবে সে যে শ্রম দেয়, দিতে থাকে, তার সময় ও মন/মেধা দিয়ে, তা মুহূর্তমধ্যে জ্ঞান/তথ্যে রূপান্তরিত হয়, যে জ্ঞান বস্তুত পুঁজির প্রয়োজনে, পুঁজির মধ্যস্থতায় (agency), বাজারউপযোগী পণ্যমাত্র।

নেটওয়ার্কড বা সদা-সংযুক্ত পৃথিবী এ কারণে প্রথমাবধি এক বাজার, পৃথিবীর বৃহত্তম বাজার, যা এসময়ের পুঁজিতন্ত্রের অচ্ছেদ্য অংশ। এই বাজারকে বাজার হিসেবেই দেখা-বোঝা প্রয়োজন। নাহলে নেটওয়ার্ক যে নতুন বাস্তব নির্মাণ করে প্রতিনিয়ত, যাকে অন্যত্র আমরা পুঁজিবাস্তব বলেছি, তার স্বরূপ বোঝা যাবে না। পুঁজিবাস্তবতার অন্য নাম মায়াবাস্তব। জ্ঞান, তথ্য ও খবরের তথাকথিত নির্বাধ দেওয়া-নেওয়া, উন্মুক্ত সংযুক্ত নেটওয়ার্কড পৃথিবী, যেখানে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে কি দল বা গ্ৰুপ খুলে, ট্যুইটারে দুই দাঁড়ি টেনে হ্যাশট্যাগ লিখে রাজনৈতিক বিরুদ্ধতা ঘোষণা করা যায়, এ পৃথিবীটি আসলে মায়া, যা নেই।

ভেবে দেখা দরকার, নেটওয়ার্কড বিরুদ্ধতা আসলে কার জন্য? বেড়াতে যাওয়া, চলচ্চিত্রতারকাদের কি রাজনেতাদের ব্যজস্তুতি করা বা ক্রীড়াচর্চার জন্য যে সব গোষ্ঠী ফেসবুকে তৈরি হয় প্রতিনিয়ত, তাদের সঙ্গে ‘বিরুদ্ধ’, স্থিতাবস্থা বিরোধী গোষ্ঠীসমূহের তফাৎ কি? নেটওয়ার্ক পরিসরের উন্মুক্ত বাজারি সাম্যের পরিসরে, যাবতীয় ব্যবহারকারী মূলে এক, ভোক্তা, ক্রেতা, কাঁচামাল, পণ্য ও শ্রমিক, নিরন্তর ব্যবহৃত। নেটওয়ার্ক ব্যবহারের আপাত স্বাধীনতাও মায়া।

গুগল খুলে আপনি মার্ক্সপন্থা চর্চা করুন কি অর্শের টোটকা খুঁজুন, সেই খোঁজ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে গুগলের পাতাসংখ্যা (page rank) অ্যালগরিদমে, যন্ত্র যেভাবে চাইবে, আপনি দেখবেন সেইভাবে, কোন সাইটনাম বা ইউ আর এল আপনার কাছে পৌঁছবে, তা আপনি ঠিক করে দেবেন না। ফেসবুকে আপনি পোস্ট দিচ্ছেন, আপনার বন্ধুরাও দিচ্ছে, সে পোস্ট আপনার খবরদানীতে পৌঁছবে কিনা ঠিক করে দেবে ফেসবুকের অ্যালগরিদম। শুধু এইমাত্র নয়। আপনি বামপন্থী, ফেসবুক কি ট্যুইটার আপনার কাছে বিরুদ্ধতা নির্মাণের পরিসর, একা কি দলবদ্ধভাবে আপনি সংগঠিত পোস্ট দিতে থাকলেন। আপনার রাজনৈতিক বিরোধীরাও ফেসবুক/ট্যুইটার ব্যবহারকারী, কিন্তু সংখ্যায়/ব্যবহারসামর্থ্যে অধিকতর ও ক্ষিপ্রতর, তারা আরো বেশি পোস্ট দিল কি আপনাকে গালাগাল দিয়ে ট্রোল করলো, দরকার ও মওকামত আপনার পোস্ট ফেসবুক-অনুপযোগী বলে রিপোর্ট করেও দিলো। বিরুদ্ধতা ও প্রতিবিরুদ্ধতার এই চক্রাকার প্রক্রিয়া থেকে নেটওয়ার্ক ব্যবহার আরো বাড়লো, জ্ঞান উৎপন্ন হলো, নিরবচ্ছিন্নভাবে অ্যালগরিদম সে জ্ঞান জমা করতে বা বিশ্লেষণপূর্বক বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে পাঠাতে থাকলো। দেখা গেছে ফেসবুকের অ্যালগরিদম নিরপেক্ষ নয়, পোস্ট বেছে বেছে খবরদানীতে পাঠানো, কি অনুপযোগী বলে দাগানো পোস্ট বাতিল করার সময়, যে যে মাপকাঠি থাকে, তাতে রাষ্ট্রবিরোধী/পুঁজিবিরোধী শক্তির দিকে পাল্লা হেলে থাকে না। অ্যালগরিদমকে শাসন করার কি ফাঁকি দেবার উপায় বের করা হয়তো যেতে পারে, যেহেতু যন্ত্রভাষাকে অন্য দক্ষতর যন্ত্রভাষা দিয়ে নতুন করে লেখা যায়। বিশ্বজোড়া হ্যাকারদের যে সব বিচিত্র ক্রিয়াকলাপ আছে, তা মূলত বিরুদ্ধ যন্ত্রভাষা তৈরির। এ ভিন্ন, প্রয়োজনমতো, রাজনৈতিক বিরুদ্ধতা সংগঠিত করার কাজেও নতুন যন্ত্রভাষা তৈরি করা যেতে পারে। কিন্তু নেটওয়ার্কড মায়াবাস্তবের কুহেলিকা ছিন্ন করে অন্য বিরুদ্ধ বাস্তব তৈরি করা তদ্বারা সম্ভব নয়। এর তিনটি প্রধান কারণ।

এক, যে কথা এতক্ষণ বলা হচ্ছিলো, নেটওয়ার্ক ও সাংখ্যপ্ৰযুক্তির সমগ্র বিষয়টি আশরীরআত্মা(কি হার্ডওঅ্যার কি সফটওঅ্যার) বড়ো কর্পোরেশনের খাসদখলে, বিরুদ্ধ চিন্তা এখানে নেহাৎই পুঁজি তৈরির উপযোগী পণ্যবস্তু এবং কাঁচামাল।

দুই, প্রয়োজনমতো, নেটওয়ার্ক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা যায়, কি রাষ্ট্র কি পুঁজিমালিক কর্পোরেশন, কি অ্যালগরিদম, যে কেউ এই নিয়ন্ত্রণের কাজ করতে পারে। কর্পোরেশনগুলিকে ব্যবসা করে খেতে হয়, রাষ্ট্রের সঙ্গে স্থায়ী সঙ্ঘাতে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। রাষ্ট্র নেটওয়ার্ক সংস্থাদের বাধ্য করতে পারে, বিশেষ বিরুদ্ধ পোস্ট কি দলিল তুলে নিতে, বিরুদ্ধ ব্যবহারকারীদের নেটওয়ার্ক থেকে বের করে দিতে। আরব বসন্তের সময়পর্বে এ ধরণের ঘটনা আকছার ঘটেছে, বিশেষত ইজিপ্টে কি তিউনিসিয়ায়। এতদ্ব্যতীত, রাষ্ট্র দরকারমত সাংখ্যমাধ্যম ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে, ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে দমনমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে, এমনকি বিশেষ অঞ্চলে কি গোটা দেশে অন্তর্জাল পরিষেবা বন্ধ করেও দিতে পারে। উল্টোদিকে, নেটওয়ার্ক-এর তথ্যভাণ্ডারে জমতে থাকা জ্ঞান কর্পোরেশনগুলির কাছ থেকে রাষ্ট্রের কাছে পৌঁছতে পারে, সে তথ্য হয় রাষ্ট্রীয় নজরদারির কাজে লাগে, নয় নির্বাচনে তা ব্যবহার করা যায়, যথা কুখ্যাত ফেসবুক-কেমব্রিজ অ্যানালেটিকা কান্ড, যেখানে অসংখ্য ফেসবুক ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য কেমব্রিজ অ্যানালেটিকা নামের সংস্থার হাত ঘুরে মার্কিনদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ব্যবহৃত হয়।

তিন, নেটওয়ার্কড বাস্তব থেকে বিরুদ্ধ জ্ঞানে পৌঁছনো সম্ভব তো নয়ই, উপরন্তু নেটনির্ভর বিরুদ্ধতার চালু প্রক্রিয়াটি কার্যত পুঁজিতন্ত্র/রাষ্ট্র বিরোধী সামাজিক আন্দোলনের পক্ষে বিভিন্নভাবে ক্ষতিকারক। নেটওয়ার্ক-এর বহু তাৎক্ষণিক ব্যবহারিক উপযোগিতা আছে, যা বিরুদ্ধ আন্দোলনের কাজে লাগতে পারে, লাগে। তুলনায় ক্ষতি যা হয়, এবং হচ্ছে, তা দীর্ঘমেয়াদি। সামাজিক আন্দোলনের স্থিতাবস্থা বিরোধী চরিত্র ও সমাজৰদলের বৈপ্লবিক সম্ভাবনার কথা ভাবলে, রাজনৈতিক ক্ষতি, সম্ভবত অপূরণীয়। সে প্রসঙ্গে আসছি।

নেটওয়ার্কড দুনিয়া: বিরুদ্ধতার রাজনীতি থেকে রাজনীতির বিরুদ্ধতা

আমরা বলেছি, যে কোন জ্ঞানের মত, বিরুদ্ধ জ্ঞানও সমাজসঞ্জাত। পুঁজিতন্ত্রের সময়, বিশেষত হালের নিওলিবরল পুঁজিতন্ত্রের সময়, সে জ্ঞান পুঁজিতন্ত্রের সামাজিক বিরুদ্ধতায় প্রোথিত থাকবে, এটি অভিপ্রেত। পুঁজিতন্ত্রের বিরুদ্ধতা অর্থে পুঁজিবাস্তবের বিরোধিতা, পুঁজি ও রাষ্ট্রের আপাতঅভিন্ন দুই দ্বারা বিরুদ্ধ চৈতন্য দখলের বিরোধিতা। যে ব্যক্তি/সমষ্টি এই বিরুদ্ধতাকে ধারণ করতে চায়, তাকে ব্যক্তিজীবনের আটপৌরে প্রাত্যহিকতা থেকে শুরু করে আন্দোলনযৌথের সমষ্টিচৈতন্যে বিরুদ্ধ জ্ঞানকে চারিয়ে দিতে হবে অহর্নিশ। বিরুদ্ধ জ্ঞানের এই প্রক্রিয়া স্বভাবত উভয়মুখী ও দ্বান্দ্বিক, তা অতীতের সমস্ত বিরুদ্ধ সামাজিক প্রক্রিয়া থেকে উদ্ভূত ও সঞ্চিত বিরুদ্ধ জ্ঞানের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে, কিন্তু প্রশ্নহীন আনুগত্যে নয়। বিরুদ্ধতার সামাজিক প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক হয়ে উঠতে গেলে সঞ্চিত জ্ঞানের উত্তরাধিকার বহন করতে হয়, একইসঙ্গে আন্দোলনের পরিবর্তনশীল বর্তমান থেকেও শিখতে হয়। এবং সে শেখা সম্পূর্ণ হয় না যদি পুঁজিতন্ত্র-উত্তর ও না-পুঁজি সামাজিক পরিসরের বিবিধ বিচিত্র সম্ভাবনা সম্পর্কে সচেতন থাকা যায়। অর্থাৎ অধীত বিদ্যা বা জ্ঞানের সঙ্গে প্রয়োগের বর্তমান মিশে থাকে, এবং সে মিশেল ভবিষ্যতের সম্ভাবনায় ও স্বপ্নে নিরন্তর জারিত হয়। তত্ব ও প্রয়োগের মধ্যে কোন বিরোধ নেই, তত্ব ভিন্ন প্রয়োগ হয় না, প্রয়োগ ভিন্ন তত্বও। বিরুদ্ধ জ্ঞানের রাজনৈতিক প্ৰতর্ক এবং প্রকল্পটি একারণে প্রত্যক্ষতাবাদ ও নির্ধারণবাদের সার্বিক বিরোধিতা ভিন্ন সিদ্ধ হয় না।

অর্থাৎ, বিরুদ্ধ জ্ঞানের যেমন স্থানকালপাত্র নিরপেক্ষ কোন নির্বিশেষ সাধারণ হয় না, প্রত্যক্ষ ও আপাত বাস্তবের সীমায়ও তা বদ্ধ থাকে না। আজকের বিরুদ্ধ সামাজিক আন্দোলন সেকারণেই যেমন অতীত আন্দোলনগুলি থেকে গঠন ও ধরণে ভিন্ন হতে বাধ্য, পুঁজিবাস্তবের গণ্ডীর মধ্যে আটকা থাকারও তার দায় নেই। শ্রেণী-রাজনীতি বলতে আমরা যা বুঝি তা আসলে শ্রেণীর বিরুদ্ধতার, শ্রেণীব্যবস্থা বিলোপের রাজনীতি। পুঁজিতন্ত্রের আধিপত্যের বিরুদ্ধে নিরন্তর না লড়তে পারলে সেই শ্রেণী-রাজনীতি নির্মিত হয় না। আজকের সময়ে পুঁজিতন্ত্রের বিরুদ্ধে ঘটে চলা বিভিন্ন লড়াই নানা কারণে বড় খণ্ডিত, টুকরো, হয় তা অতীত জ্ঞানের প্রতি নতশির অনুগত, নচেৎ তা প্রত্যক্ষ বাস্তবের মধ্যে আটকা। কি ভারতবর্ষে কি অন্যত্র, ইদানীংকালের পুঁজিতন্ত্র বিরোধী যে সব সামাজিক আন্দোলন সম্পর্কে খবর পাওয়া যায়, বিরুদ্ধ জ্ঞান তৈরির দীর্ঘ দার্শনিক প্রক্রিয়া সে সব আন্দোলনে পুষ্ট তো হয়ই না, আন্দোলনগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখে। তত্ব ও প্রয়োগ, ব্যবহারিক (practical) ও বিমূর্ত, আশু ও দীর্ঘকালীন ইত্যাদি দ্বিত্ব তৈরি করে(বা না করেও), আন্দোলনের অংশগ্রহণকারী কর্মী ও নেতৃত্ব তথাকথিত প্রায়োগিক বাস্তবে মগ্ন থাকেন, ফলে আন্দোলন যে বিরুদ্ধতার প্রকাশ, তা তার রাজনৈতিক নির্যাস হারাতে থাকে ক্রমাগত। অন্যত্র এই আলোচনা করেছি, আপাতত বিশদ বলার সুযোগ নেই। তৎসত্বেও, পরবর্তী চর্চা থেকে রাজনীতিহীনতার বিষয়টি খানিক প্রাঞ্জল হবে, ধরে নেওয়া যায়।

সমকালীন যে সব আন্দোলন খবর হয়ে উঠেছে, তাদের অধিকাংশই সাংখ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ, সাংখ্যমাধ্যম যথা ফেসবুক বা ট্যুইটার মারফত তারা বিরুদ্ধ জ্ঞান আহরণ করে, এবং ওই সাংখ্য অনলাইন পরিসরে প্রচার চালিয়ে, বা রাস্তার আন্দোলন/জমায়েত(যাকে বলা হচ্ছে অফলাইন অ্যাকশান) সংগঠিত করে, সেই বিরুদ্ধতার প্রকাশ ঘটায়। যেহেতু এই অফলাইন আন্দোলন গড়ে ওঠে প্রধানত অনলাইন যোগাযোগের মাধ্যমে, বহুক্ষেত্রেই আন্দোলনকারীরা একে অন্যের অপরিচিত, আন্দোলনযৌথগুলি প্রথমাবধি ভঙ্গুর থাকে। দীর্ঘসময় ধরে চলতে থাকা শারীরিক যোগাযোগের সামাজিক রসায়ন, যা এতকাল ধরে যাবতীয় বিরুদ্ধ সঙ্ঘায়ন সম্ভব করেছে, সাংখ্যমাধ্যমে যোগাযোগ রেখে তৈরি হওয়া আন্দোলন, তা অফলাইন কি অনলাইন হোক, সেখানে সে রসায়ন অনুপস্থিত থাকে। আন্দোলন গড়ে ওঠে, ময়দান/চক দখল হয়, রাস্তাও কাঁপে, জমায়েত বড় হলে কি আন্দোলনে হিংসার ঘটনা ঘটলে তা প্রচলিত সংবাদমাধ্যমে খবরও হয়। বিরুদ্ধতা অনলাইন পরিসর, যথা ফেসবুক, ছাড়িয়ে রাস্তায় নামে, শাসককে চিন্তায় ফেলে। তা সত্বেও, এ সময়ের বিভিন্ন খবর হওয়া আন্দোলন থেকে একটিই সাধারণ শিক্ষা সম্ভব, প্রত্যক্ষ বাস্তবের তাৎক্ষণিক গণ্ডী ভেঙে এ জাতীয় আন্দোলন বেরুতে পারছে না, বা চাইছে না। বিরুদ্ধ জ্ঞানের যে রাজনৈতিক নির্মাণ ভিন্ন আন্দোলন ভবিষ্যত সমাজমুক্তির সম্ভাবনাকে ধারণ করতে পারে না, সেই কাজ এ কারণে হয় অসমাপ্ত থাকে, নয় শুরুই হয় না। এরকম কেন ঘটে? কেন আন্দোলনকারী বিরুদ্ধ জনসমষ্টি, স্থায়ী যৌথে রূপান্তরিত হতে পারে না, পুঁজিতন্ত্রের বিরুদ্ধে লম্বা লড়াই গড়ে তোলা যায় না? এ প্রসঙ্গেও অন্যত্র আলোচনা করা হয়েছে, বিশদে যাচ্ছি না। যেটা বলার তা হচ্ছে, সমস্যাটা এখানে এক বা একাধিক আন্দোলন সংগঠিত হবার পদ্ধতির নয়, কি অনলাইন বা অফলাইন কাজের সমন্বয়েরও নয়, বরং জ্ঞানতত্বের বা epistemological। পুঁজিতন্ত্র বিরোধী বিরুদ্ধ জ্ঞান নির্মাণের সমগ্র ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার সংঙ্গে যেভাবে পার্টিরাষ্ট্র, পার্টিশাসন ও গণতন্ত্রহীনতার বিষয়গুলি জড়িয়ে গেছে গত একশো বছর ধরে, অথবা যেভাবে বিরুদ্ধ শ্রেণী-আন্দোলন স্থানকাল নির্বিশেষে পুঁজিতান্ত্রিক স্থিতাবস্থার অংশ হয়ে উঠেছে, তা থেকে নিরন্তর জড়পূজন বা ফেটিশের উদ্ভব ঘটেছে। বিরুদ্ধ জ্ঞান যখন পুঁজিতান্ত্রিক ফেটিশের নামান্তরমাত্র, তা স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধতা করতে অক্ষম। এ সময়ে, সাংখ্যপ্রযুক্তি ও যন্ত্রভাষানির্ভর যে জনসমষ্টি আন্দোলনের ঘটক ও উপাদান, তাদের অনেকের কাছেই এই ফেটিশ পরিত্যাজ্য। অতি-সংগঠন বা পার্টিশাসনের আপাত ব্যক্তিবিরোধী চরিত্র প্রত্যাখ্যান করে আজকের ব্যক্তি আন্দোলনকারী সঙ্ঘায়নের (organising, basic organising) বুনিয়াদি ও প্রয়োজনীয় সামাজিক কাজ থেকেও দূরে সরছেন। এর ফলে শুধু যে বিরুদ্ধ জ্ঞানের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার ও অর্জন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে আজকের সামাজিক আন্দোলন, তাই-ই নয়, আন্দোলন কোন নতুন বাস্তবতা তৈরি (posit) করতেও পারছে না। ফলে, যত তাড়াতাড়ি রাস্তায় ভিড় জমছে তা পাতলাও হয়ে যাচ্ছে দ্রুত, রাষ্ট্রের দমন-নিপীড়ন বা সংগঠনহীনতার অন্তর্লীন বিপদ-এ দুইয়ের কোনটারই মোকাবিলা করা যাচ্ছে না।

আসলে, সাংখ্যমাধ্যমের ওপর নির্ভরতা এবং অনলাইন সঙ্ঘায়ননির্ভর জমায়েত তৈরির অফলাইন অ্যাকশান, এ সবই সূচিত করে রাজনীতির বিরুদ্ধতা। আগাপাছতলা পুঁজিশাসিত, পুঁজিসৃষ্ট অথচ আপাত-নিরপেক্ষ নেটওয়ার্ক পরিসরে বিরুদ্ধ জ্ঞান নির্মিত হয় না, বিরুদ্ধ রাজনীতিও নয়। স্থিতাবস্থার, শাসকের আধিপত্যের, পুঁজিতন্ত্রের বিরুদ্ধে জমতে থাকা রাগ সাংখ্যমাধ্যমে উগরে দেওয়া যায়, অন্য অন্য রাগী মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ করাও যায় হয়তো। যে খবর বড় সংবাদমাধ্যম মারফত পাওয়া সম্ভব নয়, তা-ও খানিক পাওয়া যায়। কিন্তু এতদসত্বেও, সাংখ্যমাধ্যম নিরন্তর রাজনীতিহীনতা প্রসব করে। জ্ঞান, বিশেষত বিরুদ্ধ জ্ঞান, দীর্ঘ সময় ধরে সামাজিক, সমাজবদ্ধ চর্চার, অনুশীলনের, অনুভবের বিষয়। তা পণ্য হিসেবে উৎপন্ন হয় না, সাংখ্যমাধ্যমের পুরোদস্তুর বাজারি পরিসরে সে জ্ঞান প্রাপ্তব্য নয়।

আসলে যে ভাবে, যে পদ্ধতিতে সাংখ্যমাধ্যমে জ্ঞান উৎপন্ন হয়, তা দীর্ঘকালীন চর্চা ও অনুশীলনের বিপরীত। বিভিন্ন ঘটনা, যা ব্যক্তিজীবনের এবং সমষ্টির, প্রতিষ্ঠানের এবং প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার, একই যন্ত্রভাষায় অনুদিত হয়ে আপনার খবরদানীতে আসে, একইসঙ্গে বা পরপর। খবরের পর খবর আসতে থাকে, আপনি সেগুলোয় চোখ বোলান, পড়েন বা পড়েন না। পড়ার চাইতে দেখেন, শোনেন বেশি, খবরের সারি লম্বা হয়ে ওপরে উঠতেই থাকে, বড় পোস্ট পড়ার সময় থাকে না, মনোযোগও নয়। সময়ের চেয়েও বেশি মনোযোগের অভাব ঘটে। গভীর, মনোযোগী পাঠ, যা ছাড়া মানবমস্তিষ্কে জ্ঞাননির্মাণের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় না, ফেসবুক, ট্যুইটার বা অন্যান্য সাংখ্যমাধ্যমের মঞ্চে তার অবকাশ থাকে না। ফলত, ব্যবহারের পুরো বিষয়টিই অ্যালগরিদম নিয়ন্ত্রিত দ্রুতগতিতে ঘটে। আপনি ঘটনা দেখেন, শোনেন বা পড়েন, কিন্তু তা নিয়ে তলিয়ে ভাবার সময় থাকে না। প্রায় যন্ত্রের অনুকৃতিতেই অতিদ্রুত আপনি দেখা, শোনা বা পড়া ঘটনা সম্পর্কে সিদ্ধান্তে পৌঁছন, লাইক দেন, মন্তব্য করেন বা নিজে পোস্ট দেন। যা দেখা, শোনা, পড়া হলো, তা ঠিক অর্থাৎ সত্য কিনা, তা যাচাই করার আপনার অবকাশ নেই, হয়তো সুযোগও নেই। অর্থাৎ জ্ঞাননির্মাণের সমস্ত প্রক্রিয়াটি যান্ত্রিক দ্রুততায় নিষ্পন্ন হয়, জ্ঞান উৎপন্ন ও পুনরুৎপাদিত হতে থাকে, হতেই থাকে। কালক্রমে সেই জ্ঞান আপনাকে/আপনার সমষ্টিকে অফলাইন রাস্তার জমায়েত অনলাইনে খুলে ফেলতে প্রাণিত করে, আপনি ঘটনা বা ইভেন্ট ঠিক করে অন্যদের সেখানে জড়ো হতে বলেন। রাস্তায় জমায়েত, সভা, মিছিল হয়, তার ছবি ও বর্ণনা নেটওয়ার্কে জমা হয়, শেয়ার হয়। সমগ্র প্রক্রিয়ায় আসলে যা তৈরি হয় তা পুঁজি, কেননা আপনার পবিত্র বিরুদ্ধতা নেটওয়ার্কড পৃথিবীর মায়াবাস্তবে নেহাৎই পণ্য।

ইত্যবসরে, বিরুদ্ধ রাজনীতি থেকে রাজনীতির বিরুদ্ধতা অভিমুখে, জ্ঞান ও বিরুদ্ধ জ্ঞান থেকে সার্বিক নির্জ্ঞানের দিকে যাত্রা জারি থাকে। সঙ্ঘায়নের অনিবার্য সামাজিক প্রক্রিয়ার জায়গা নেয় সাংখ্যমাধ্যমের দক্ষতর ব্যবহার, যার ফলে পাঠ ও চিন্তার, সন্দেহ ও বিশ্লেষণের যে সংশ্লেষ ভিন্ন জ্ঞাননির্মাণ অসম্পূর্ণ থাকে, তা আন্দোলনকারী ব্যক্তি/সমষ্টির কাছে অপ্রয়োজনীয় ঠেকে। অপ্রয়োজনীয় কেননা তা তাৎক্ষণিক নয়, দীর্ঘমেয়াদী, সেকারণে অব্যবহারিক। ফেসবুক/ট্যুইটারে চটজলদি প্রতিক্রিয়া/পোস্ট কি দ্রুত অফলাইন ইভেন্ট খোলা, এর কোনটিতেই ধীর পাঠের, চিন্তার, সামাজিক জ্ঞাননির্মাণের কোন প্রয়োজন নেই। উপরন্তু দ্বিতীয় বা তুলনায় পুরোনো প্রক্রিয়াটি আন্দোলনকে দ্রুত দৃশ্যমান হতে, রাস্তায় নামতে বাধা দেয়, এমন ভাবা যেতেই পারে।

ফলত নেটওয়ার্কড দুনিয়ায় সামাজিক আন্দোলনের সমগ্র প্রক্রিয়া সাংখ্যমাধ্যমের অ্যালগরিদম অনুসরণ করে দ্রুত ঘটতে থাকে। এক ঘটনার জায়গা নেয় পরবর্তী ঘটনা/ঘটনাগুচ্ছ, তার জায়গায় আসে তৎপরবর্তী কিছু। বাকি প্রক্রিয়া গোটাগুটি একই থাকে। এমন তো নয় যে নেটওয়ার্ক ব্যবহারের ফলশ্রুতিতে ব্যবহারকারীদের মস্তিষ্কের গঠনের বা রসায়নের পরিবর্তন ঘটছে, চিন্তা করার বা জ্ঞাননির্মাণের ক্ষমতাই লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ? এমন তো নয় যে বিরুদ্ধতা প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে টিঁকে থাকবে যন্ত্রভাষা, বাকি সামাজিক কথোপকথন আমরা ভুলে যাবো? এমন আশঙ্কা অনেকেই করছেন আজকাল, যাকে অমূলক বলার বা উড়িয়ে দেবার সাধ্য বর্তমান লেখকের নেই।

ভাষার প্রশ্নটি ঘুরেফিরে আসে। সাংখ্যমাধ্যম/সাংখ্যপ্ৰযুক্তি শেষপর্যন্ত কোথায় গিয়ে থমকাবে, আদৌ থমকাবে কিনা, হাতেগোনা গুটিকয় গবেষণাপত্র লেখা পন্ডিতগোষ্ঠীর বাইরে কোন ধীর জ্ঞান আর জীবিত থাকবে কিনা, তা অজানা। অথচ জোর দিয়ে বলা যায়, বলা দরকার, নেটওয়ার্ক-এর মাকড়শাজাল কেটে বিরুদ্ধ জ্ঞানকে বাইরে আনতেই হবে। এ কাজ করতে গেলে সাংখ্যমাধ্যমের একচ্ছত্র চিহ্নভাষাকে সামাজিক ভাষা ও সামাজিক জ্ঞান দিয়ে প্রতিস্থাপিত করতে হবে, ফিরিয়ে আনতে হবে ধীর পাঠ, গভীর পাঠ। বছর কয় আগে বামপন্থী লেখক, গবেষক ও সমাজকর্মী জোডি ডিন বলেছিলেন, যোগাযোগপ্ৰযুক্তিতে যে পুঁজি উৎপন্ন হয়, তা নতুন জাতের পুঁজি, যাকে বলা যায় যোগাযোগপুঁজি বা কমিউনিকেটিভ ক্যাপিটাল। এখন বোঝা যাচ্ছে, যোগাযোগপুঁজিও পুঁজি, পুরোনো গোত্রেরই পুঁজি। কিন্তু যে ভাষায় যে পদ্ধতিতে নিজেকে তা পুনরুৎপাদিত করতেই থাকে, তা ক্রমাগত, অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে নিজের চরিত্র চেহারা বদলাচ্ছে। স্মার্টফোন যে অ্যান্ড্রয়েড ভাষায় কথা বলে, বোঝে, বা যাবতীয় অ্যালগরিদম যে ভাষার প্রকাশ, তাতে অ-মানুষী যন্ত্রবুদ্ধির বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর পুরোনো দুঃস্বপ্ন ছায়া ফেলছে। যন্ত্রবুদ্ধি যত খরতর হবে, তা কালক্রমে মানবচৈতন্যকে গিলে ফেলবে না তো? পুঁজির সবচাইতে বড় বাজার, অর্থাৎ অর্থপুঁজির বাজার অনেকদিন থেকেই যন্ত্রবুদ্ধির আওতায় চলে এসেছে, যথা শেয়ারবাজারের আপাত দুর্বোধ্য হাই-ফ্রিকোয়েন্সি ট্রেডিং, যে ব্যবসায় উচ্চকোটির মেইনফ্রেম কম্পিউটারযন্ত্র অ্যালগরিদম এবং ক্ষমতাবান আঁশতার ব্যবহার করে প্রায় আলোর গতিতে শেয়ার কেনাবেচা করে। গুগল এবং অ্যাপল সংস্থাদুটি পাল্লা দিয়ে যন্ত্রবুদ্ধি বা এ আই বানানোর কাজে লেগে পড়েছে। একটা সময় হয়তো স্মার্টফোন বা কম্পিউটারের দরকার হবে না, নেটওয়ার্ক ও অ্যালগরিদম-এর নির্দেশ সোজা আপনার মস্তিষ্কে পৌঁছবে। সাংখ্যপ্ৰযুক্তিনির্ভর ই-বাণিজ্যের যে মানুষকর্মীরা আছেন, তাদের দিবারাত্র যন্ত্র ও অ্যালগরিদম শাসনের মধ্যে থাকতে হয়, যথা আমাজন কিংবা উবের-এ কর্মরত শ্রমিক। কি করতে হবে, কোন যাত্রীকে কোথায় নিয়ে যেতে হবে, কোন মাল কোন গুদামের কোথায় আছে, কোথায় পৌঁছতে হবে, সবটাই ঠিক করে দিচ্ছে অ্যালগরিদম, শ্রমিকের বিশেষ দক্ষতা বা জ্ঞান, যা দীর্ঘ সামাজিক অভ্যাসের মধ্য দিয়ে অর্জিত হতো, তা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, কেননা ওই জ্ঞান সাংখ্যপ্ৰযুক্তিতে অচল। অর্থাৎ যন্ত্র যত মানুষের মত হয়ে উঠবে, মানুষ তত যন্ত্রের মত হবে, তবে কিনা পুরোনো বুদ্ধিহীন যন্ত্র, যাকে চালানোর জন্য মানুষী বুদ্ধি বা দক্ষতার প্রয়োজন হতো একসময়।

যন্ত্র ও ভাষানির্ভর এই নতুন পুঁজিশাসনে পুরোনো, ধীর, মানুষী ও সামাজিক জ্ঞান ক্রমশ লুপ্ত হয়, সে জায়গায় দ্রুত, দক্ষতর ও অ-মানুষী জ্ঞান আসে। আসে শাসকের ইচ্ছায়, প্রয়োজনে। সংগঠন নির্মাণের বাস্তব শরীরী প্রক্রিয়া ছেড়ে, বিরুদ্ধ জ্ঞান নির্মাণের সামাজিক প্রক্রিয়া ত্যাগ করে, তাৎক্ষণিক জ্ঞান অনুসারী সাংগঠনিক কাজ করে যে সামাজিক আন্দোলন নির্মিত হয়, তা এই যন্ত্রবুদ্ধি ও যন্ত্রশাসনের জ্ঞানের ঘেরাটোপ (epistemic enclosure) থেকে বেরুতে পারে না। সাংখ্যমাধ্যমে যে খবর আসে, খবরের সত্যিমিথ্যে যাচাই না করে তাকে বিশ্বাস করা হয়। মানে ফেক নিউজ, ফেক ছবি, চিহ্নভাষার, উল্টোনো সেমানটিক দুনিয়ায় ঢুকে পড়া। সেকারণে, প্রতিক্রিয়া অর্থে চটজলদি মন্তব্য, বিশ্লেষণহীন গালাগালি, এমনকি সাংগঠনিক কাজ, মিছিল সমাবেশ। জ্ঞাননির্মাণের মানুষী ও সামাজিক ক্ষমতা ক্রমশ নেটওয়ার্ক-এ থাকা মানুষজন হারিয়ে ফেলছেন। বোধহয় বুদ্ধিও।

সামাজিক বিরুদ্ধ জ্ঞানের পরিবর্তে যন্ত্রভাষা বা শাসকের জ্ঞানের ওপর ভরসা করা মানে ভাষার সামাজিক ব্যবহার ও উৎস থেকে জ্ঞানকে চুড়ান্তভাবেই বিচ্ছিন্ন করা। হ্বিটগেনস্টাইনের ভাষা-খেলার পরিপ্রেক্ষিতে, ননসেন্স থেকে সেন্স/অর্থকে পৃথক করতে না পারা। পার্থক্য এই যে অ্যালগরিদমের খেলা ও শাসন বিষয়টা নিছক ভাষাখেলার নয়। যা যন্ত্রশাসন, তা-ই পুঁজিশাসন, বাজারশাসন। বিরুদ্ধতার নামে সামাজিক যৌথের জায়গায় কৃত্রিম মিডিয়াযৌথ তৈরি, যা একইসঙ্গে ভোক্তা/কাঁচামাল/ক্রেতা ও বিনিমাইনের তথ্যশ্রমিকদের জটলা। মায়াবাস্তব।

এদেশের, সম্ভবত বিশ্বের বামপন্থীদের গরিষ্ঠ অংশই দীর্ঘকাল যাবৎ ভাষা ও চিহ্ননির্ভর জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত। পুরোনো বিপ্লবপ্রচেষ্টা/বিপ্লবের সঙ্গে যুক্ত কিছু মানুষের মূর্তি, ছবি, মৃতদেহ ইত্যাদি ঘিরে ব্যক্তিপূজার যে প্রচলন পার্টিরাষ্ট্রের রমরমার সময়ে শুরু হয়েছিলো, তা বন্ধ তো হয়ইনি, উল্টে বহুক্ষেত্রেই তা অমোঘ ফেটিশে রূপান্তরিত হয়েছে। কিছু চিহ্ন, যথা লাল পতাকা বা মুষ্টিবদ্ধ হাত থেকেও একইরকম ফেটিশ জন্মেছে। যে বাস্তব বিপ্লবী প্রক্রিয়া অর্থাৎ সামাজিক বিরুদ্ধতা ও বিরুদ্ধ জ্ঞানের প্রক্রিয়া এই চিহ্নগুলিকে তাৎপর্যমন্ডিত করতে পারতো, তার অবর্তমানে চিহ্নই জ্ঞান হয়ে উঠেছে, যেন পতাকার লাল রঙ, মুঠো করা হাত বা অনর্গল বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক কি লাল সেলাম স্লোগানে মরে যাওয়া, না থাকা বিপ্লব ফিরে আসবে পৃথিবীতে, আবার দশ দিনে কেঁপে উঠবে দুনিয়া।

যেন লাল সেলাম স্লোগানে মরে যাওয়া বিপ্লব ফিরে আসবে পৃথিবীতে

এইরকম ভাবনার মধ্যে যে ফাঁকিবাজি ও চিন্তাহীনতা ওতপ্রোত থাকে, তা অন্তত ভারতীয় বামপন্থীদের বেশির ভাগের সম্বৎসরের কাজ দেখলে দিব্য বোঝা যায়। সমাজের সঙ্গে যুক্ত থেকে সামাজিক দ্বন্দ্বগুলিকে বোঝা এবং তদনুযায়ী সামাজিক আন্দোলনের জন্য প্রয়োজনীয় দীর্ঘকালীন সঙ্ঘায়নের কাজ করে যাওয়া, তার জায়গা নিয়েছে রাষ্ট্র্ববাদী নির্বাচনী রাজনীতি, অথবা প্রথানুগ মিছিল সভা ধর্মঘট, যার কোনটাই বিরুদ্ধ জ্ঞাননির্মাণের প্রক্রিয়ায় যুক্ত নয়। যে স্লোগান মিছিলে দেওয়া হয়, পোস্টারে লেখা হয়, বা যে ছবি সভামঞ্চে কি পার্টিঅফিসে টাঙানো থাকে সচরাচর, তা থেকে ভাষা এবং ভাষার বাইরে কিছুই তৈরি হয়ে ওঠে না, জ্ঞান তো দূরস্থান।

ভাষানির্ভর এমনকি ভাষাআসক্ত এই বামপন্থীরা যখন সাংখ্যমাধ্যমের খোলা দুনিয়ায় গিয়ে পড়েন, পুরোনো ফেটিশ নতুন ফেটিশের সঙ্গে মিশে যায়, বিরুদ্ধ জ্ঞাননির্মাণ অসম্ভব হয়ে পড়ে। বিরুদ্ধতা, যেমন আমরা আগেই বলেছি, পুঁজিসৃষ্টির উপায়মাত্র হয়ে ওঠে। নেটওয়ার্কের, নেটওয়ার্কের যন্ত্রবুদ্ধির/জ্ঞানের ঘেরাটোপের বাইরে আসা যায় না।

লেখাটা শেষ করা দরকার। আরো দরকার জ্ঞাননির্মাণের সামাজিক প্রক্রিয়াকে বাঁচিয়ে তোলা, দীর্ঘমেয়াদি বিরুদ্ধ জ্ঞান নির্মাণ। সঙ্ঘায়ন। বিরুদ্ধ ভাষা নির্মাণ, যা সেই জ্ঞান ধারণ করতে সক্ষম। এই আপাত-অসম্ভব কাজ কিভাবে সম্ভব হয়ে উঠবে, জানা নেই। কিন্তু কাজটা না করলেও নয়।

পাদপূরণ

ছোট্ট একটি টেইলপিস আছে। তরুণ কিছু বন্ধুদের তাড়নায় আমি গত চার বছর ধরে সাংখ্যমাধ্যম মানে ফেসবুক ব্যবহার করছি। বন্ধুরা আমাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে ফেসবুকে না ঢুকলে এই প্রজন্মের বিরুদ্ধতার হালহকিকত বোঝা সম্ভব নয়। নিশ্ছিদ্র আনুগত্য নিয়ে পুরো চার বছর ফেসবুক করার পর আমার জানা হয়েছে যে এই প্রজন্ম কেন কোন প্রজন্মের পক্ষেই আর বোধহয় কিছু জানা সম্ভব নয়, বিশেষ যাঁরা রাজনৈতিক বিরুদ্ধতার চর্চা করেন। যে বন্ধু যে দলে/গোষ্ঠীতে আছেন, সেই দল বা গোষ্ঠীর পোস্ট তাঁরা নিয়ম করে পড়েন বা ‘লাইকান’, দরকার মতো এবং প্রায়ই অন্য গোষ্ঠীর ব্যবহারকারীদের গাল দেন বা ‘খিল্লি’ করেন। সব বন্ধুরাই(ফেসবুকে আমার প্রায় পাঁচহাজার বন্ধু, যাদের দুই শতাংশকেও আমি চিনি না, কিন্তু কি আশ্চর্য, প্রায় সবাই বামপন্থী, কেননা সবাই পোস্টে পোস্টে অবিরল লাল সেলাম দেন, নভেম্বর বিপ্লব উদযাপন করেন এবং নিজের গোষ্ঠীভুক্ত নন এমন কারুর পোস্টে সচরাচর লাইক দেন না)। সব বামপন্থী বন্ধুরাই দলগোষ্ঠী নির্বিশেষে ইভেন্ট খোলেন, ইভেন্টে যান এবং সেসবের ছবি পোস্ট করেন, লাইক চলতে থাকে।

চার বছর ফেসবুক জীবনযাপনের মধ্যে, বিস্তর ফেসবুকীয় আন্দোলনও দেখা হয়েছে। এই লেখার কথাটা যখন মনে এসেছিলো, ভেবেছিলাম, সে সব আন্দোলনের দু চারটির কথা বিস্তারিতভাবে বলবো। তারপরে দেখলাম, আলাদা করে তেমন কিছু বলার নেই, এইরকমই হয়। ওপরে সেসব আলোচিত হয়েছে।

বিস্তারিত নয়, সংক্ষেপে দু চারটির উল্লেখ করি। এক, ইসলামপুর দাড়িভিট স্কুলে গুলিকান্ড। যদিও অদ্যাবধি ওই স্কুলে ঠিক কি ঘটেছিল তা স্পষ্ট নয়, যতটুকু বোঝা যাচ্ছে বিষয়টিতে আগাগোড়াই আরএসএস ও ভারতীয় জনতা পার্টির প্রধান ভূমিকা ছিল। ফেসবুকে যা হয়, গুলি/হিংসা দ্রুত ছবি হয়ে আসে। সে ছবি দেখে সব বামপন্থীরা প্রচারে নেমে পড়লেন। বিরুদ্ধ প্রচার, কিন্তু বিরুদ্ধ পক্ষ যে কে বোঝা গেল না, সম্ভবত রাষ্ট্র, কারণ পুলিশ গুলি চালিয়েছে এমন শোনা যাচ্ছিলো। যারা ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছিলেন এবং ইভেন্ট খুলছিলেন তাঁদের কেউ ইসলামপুর পৌঁছে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করেছিলেন কিনা জানা নেই। কিন্তু তাতে প্রচার থেমে থাকেনি, বিরুদ্ধতাও।

দুই, বিখ্যাত মিটু আন্দোলন। ট্যুইটারে শুরু হলেও, ২০১৭-র মাঝামাঝি ফেসবুক তোলপাড় হয়ে গেলো। প্রায় শতখানেক বামপন্থী বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদদের একটি তালিকা বাজারে ছেড়ে দেওয়া হলো। অভিযোগ, এঁরা সবাই বিভিন্ন সময়ে যৌন হেনস্থার ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আমেরিকাপ্রবাসী যে মহিলা তালিকাটি পোস্ট করেছিলেন, তাঁর দাবী ছিলো, হেনস্থার শিকার মহিলারা ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে এই হেনস্থার বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন। বামপন্থীদের একটা সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তালিকাটি শেয়ার করা শুরু করলেন। অদ্যাবধি এ বিষয়ে আর কিছু জানা যায়নি। কারা হেনস্থা হলেন, কবে, কিভাবে, কিছুই জানা গেল না। অনেক নামসুদ্ধ একটি এখনো পর্যন্ত বেবুনিয়াদ তালিকা হাতে হাতে ঘুরতে থাকলো, বিরুদ্ধতার চিহ্ন হিসেবে। বিষয়টি সাংখ্যমাধ্যম থেকে বড় সংবাদমাধ্যম অবধি গড়ালো, কিন্তু আর কোনো তথ্য এল না।

তিন, সাম্প্রতিকতম, অভনি বাঘ। মানুষখেকো এই বাঘটা দু বছর ধরে মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ এলাকার জঙ্গল লাগোয়া গ্রামে হানা দিয়ে মানুষ মারছিল। ইয়াভতমল জেলার কোথাও বাঘটাকে গুলি করে মারা হয়। এর পর দেশজুড়ে ফেসবুক/ট্যুইটারে প্রতিবাদ শুরু হয়, রাস্তায় নেমে মিছিল করতে থাকেন সংরক্ষণবাদীরা। মোদ্দা, সাংখ্যমাধ্যমে ব্যাপারটা খুব ‘খাচ্ছিলো’। যে তরুণ বন্ধুদের দলটির সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ, তাঁরা হঠাৎ এব্যাপারে তৎপর হয়ে উঠলেন। তাঁদের পোস্ট মারফত জানা গেলো, বাঘ মারাটা আসলে আম্বানি মানে রিয়ালেন্স কোম্পানির ষড়যন্ত্র। যে বনে বাঘটাকে গুলি করা হয়, সেটা নাকি রিলায়েন্সকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে, সুতরাং তারা মহারাষ্ট্র সরকারকে চাপ দিয়ে এই কান্ড ঘটিয়েছে। বনজঙ্গল নিয়ে দীর্ঘদিন কাজের সুবাদে বিদর্ভ অঞ্চল পরিচিত, বাঘ বাঁচানোর নাম করে সেখানে বহুকাল ধরে আদিবাসী বনবাসীদের ওপর যে রাষ্ট্রীয় জুলুম চলছে সে সম্পর্কে কিছু জানাশোনা ছিল। কর্পোরেটরা বাঘ মারে নাকি? তারা তো বন ও আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে, সরকারকে বনের দাম ধরে দিয়ে। সেই টাকায় বাঘ বাঁচানোর জন্য আবার আদিবাসীদের বন থেকে বার করে দেওয়া হয়। বাঘ দেখতে পর্যটকদের ঢল নামে, পর্যটন ব্যবসার রমরমা হয়। বাঘ বাঁচানোর নামে সরকারি ও বিদেশি টাকাপয়সা আসতে থাকে। যে বন্ধুরা বাঘ মারা নিয়ে কর্পোরেটবিরোধী পোস্ট দিচ্ছিলেন তাঁদের এসব অনেকবার বলবার চেষ্টা করেছি। যাইহোক, খোঁজ নিয়ে দেখলাম বাঘ মারার সঙ্গে রিলায়েন্স কোম্পানির কোন যোগাযোগ নেই, প্রায় নষ্ট হয়ে যাওয়া যে বনের টুকরোটা রিলায়েন্সকে দেবার কথা, সেটা বাঘ যেখানে মরেছে তা থেকে ষাট কিলোমিটার দূরে, বাঘটা সেখানে কোনদিন গিয়েছিল বলে খবর নেই। বন্ধুদের এসব বললাম। তাতে কিছু লাভ হল না। বিরুদ্ধতা তীব্রতর করতে তাঁরা ইভেন্ট খুলে ফেললেন, কলকাতার রাজপথে মিছিল করলেন, সেই মিছিলের ছবি পোস্ট করলেন। জ্ঞান কি-ই বা, সত্যই বা কি? সাংখ্যমাধ্যমে যা আসে, তা-ই জ্ঞান, বিশেষত যা ভাইরাল হয়। এছাড়া, এই মাধ্যমে যে ইস্যু যখন ‘খায়’ তখনই ধরতে হয়, দেরি করলেই মুশকিল।

2 thoughts on “বিরুদ্ধ জ্ঞানের খোঁজে: সাংখ্যপ্রযুক্তির যুগে সামাজিক আন্দোলন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.