ধীমান বসাক
নেশা ভ্রমণ, পাহাড় চড়া, ছবি তোলা। একসময়ে সক্রিয় ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত ধীমান এখন আইনের পেশায় রয়েছেন। নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে ভালবাসেন।
কথায় আছে কোথাও তেরাত্তির না কাটালে নাকি পুণ্যি হয় না। সে না হোক জায়গা চিনতেও তো সময় লাগে। ছুটিতে ঘুরতে যাওয়া, সময় কই! হয়তো আর আসা হবে না; যা পার, যতটা পার দেখে নাও। তবুও ইচ্ছে ছিল যেখানেই যাব অন্তত দু’রাত থাকব। ২০১৪তে তুঙ্গনাথে দু’রাত কাটানোয় আমার দেওরিয়া তাল যাওয়া হল না। ঠিক সেভাবেই যেদিন দুপুরে মদমহেশ্বর কিংবা মধ্যমহেশ্বর পৌঁছলাম, সেদিন বিকেলেই চড়াই চড়ে বুড়া (বৃদ্ধ) মদমহেশ্বর, রাত্রে মন্দির আরতি, সকালে আবার বুড়া মদমহেশ্বর ঘুরে আসায় সেইভাবে দেখার আর কিছু ছিল না। কিন্তু ঠিক করলাম এখানেই সে রাতটাও কাটাব। দু’জন সঙ্গী বলল তারা এই ফাঁকে কেদারনাথ ঘুরে আসবে, একজন আমার সাথেই থাকবে।
সারাটা দিন প্রায় কিছু করার নেই। রোদে পিঠ দিয়ে শুয়ে বা বসে থাকা, রাস্তার থেকে একটু উঁচুতে ঢিবিটায় দুজন স্থানীয় মানুষ রোদ পোহাচ্ছিলেন। কথা শুরু হল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম মন্দিরের প্রবেশদ্বারের ঠিক উপরে ওটা কার মুখ লাগানো আছে? উত্তর এল – বহুর্বাণ (যদি অবশ্য উচ্চারণ ঠিকঠাক শুনে থাকি)। সে কে? শুরু হল গল্প।
মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ আরম্ভ হতে চলেছে। সবাই যে যার মত পক্ষ বেছে নিচ্ছে। বহুর্বাণ একজন দক্ষ তীরন্দাজ। (স্থানীয়ই হবেন।) ঠিক করলেন যুদ্ধে যোগ দেবেন। বীরের মত সিদ্ধান্ত নিলেন যে পক্ষ দুর্বল, হারবে সেই পক্ষেই যোগ দেবেন! রওনা দিলেন কুরুক্ষেত্রের দিকে।
কৃষ্ণ সে খবর টের পেলেন। বহুর্বাণের মত শ্রেষ্ঠ তীরন্দাজ যদি কৌরবদের পক্ষে যায় তাহলে মহাবিপদ! কৃষ্ণ অর্জুনকে নিয়ে বেরোলেন বহুর্বাণকে আটকাতে। মদমহেশ্বরে তাঁদের সাক্ষাত হল।
কৃষ্ণ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কোথায় যাচ্ছ?’ উত্তর এল, ‘আমি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যোগ দেব।’ ‘কার পক্ষে?’ ‘যে পক্ষ হারবে, দুর্বল, তার পক্ষে।’ ‘তুমি কত বড় বীর?’ ‘পরীক্ষা নিন।’ কৃষ্ণ বললেন, ‘ঐ যে গাছটা আছে তার সব কটা পাতাকে একটা তীর চালিয়ে পেড়ে নিয়ে এসে আমার পায়ের কাছে জড়ো কর!’ বহুর্বাণ তীর যোজনা করে ছুঁড়লেন। একের পর এক পাতা তীরবিদ্ধ হয়ে খসে যখন কৃষ্ণের পায়ের কাছে জমা হচ্ছে, কৃষ্ণ কয়েকটি পাতাকে নিজের পা দিয়ে চাপা দিয়ে লুকিয়ে ফেললেন। গাছ থেকে সবকটি পাতা খসে যাবার পর, তীর তখন ঐ পাতাগুলোর সন্ধানে কৃষ্ণের পায়ে এসে বিদ্ধ হয় আরকি! কৃষ্ণ পা সরিয়ে নিলেন, বুঝলেন বহুর্বাণ অর্জুনের চেয়েও শ্রেষ্ঠতর তীরন্দাজ, একে কৌরবপক্ষে যোগ দেওয়া থেকে বিরত করতে হবে। বললেন, ‘বহুর্বাণ, তুমি অথবা অর্জুন, যুদ্ধে একজনই যোগ দিতে পারবে, অন্যজনকে মৃত্যুবরণ করতে হবে, তুমি ঠিক কর কে সে জন।’ ‘প্রভু, তা কি করে হয়, অর্জুন না থাকলে তো যুদ্ধই হবে না, আপনি আমাকেই মারুন, তবে একটা শর্ত আছে।’ ‘কী?’ ‘আমাকে হত্যা করুন, কিন্তু আমি যাতে যুদ্ধ দেখতে পাই তার ব্যবস্থা করতে হবে।’ ‘তথাস্তু!’ কৃষ্ণ বহুর্বাণের শিরশ্ছেদ করে, একটি ত্রিশূলের মাথায় অনেক উঁচুতে বহুর্বাণের শিরস্থাপন করে ফিরে গেলেন।
যুদ্ধ এগোচ্ছে, একে একে কৌরবরা হারছে। অশ্বত্থামা হত ইতি গজ, শিখণ্ডীর আড়ালে যুদ্ধ, রথের চাকা বসে যাওয়া অবস্থায় কর্ণহত্যা, দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ, এসব দেখে বহুর্বাণ বুঝতে পারলেন তঞ্চকতা করে কৌরবদের পক্ষে যোগদান থেকে তাকে আটকানো হয়েছে। ক্রোধে রাগে তিনি কাঁপতে থাকলেন। মহাপ্রলয়; গোটা মদমহেশ্বর থরথর করে কাঁপছে! যুদ্ধশেষে কৃষ্ণ ও পাণ্ডবরা তাঁকে এসে শান্ত করে বললেন, ‘এখানে পাণ্ডবরা শিবের যে মন্দিরস্থাপন করবেন, তার দরজায় তোমার শির থাকবে, আর তোমার পূজা না করে শিবের পুজো হবে না।’
তখন থেকে তাই হয়ে আসছে।
ঠাণ্ডা হাওয়া, পিঠে অলস রোদ, এগারো হাজার পাঁচশো ফুট উচ্চতায় হিমালয়ের দুর্গম প্রান্ত, একপাশে খাদ অন্যদিকে প্রাচীন মন্দির, দূরে মাঠের মধ্যে একলা এক গাছ। মনে হল যেন ঐ সেই গাছ, যেন আমার সামনেই ঘটল এতকিছু।
মদমহেশ্বর আমার হৃদয়ে জড়িয়ে গেল।
মনে পড়ল দামোদর ধর্মানন্দ কোশাম্বি-র ‘মিথ এ্যান্ড রিয়ালিটি’, ‘অ্যান ইনট্রোডাকশন টু ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি’র কথা। কৌতূহলী হয়ে মন্দিরের পূজারীকে জিজ্ঞাসা করলাম। দক্ষিণ ভারতের ব্রাহ্মণ। বললেন, ওটা শিবগণ, শিবগণের মস্তক, শিবের অংশ।
এটাই হয়ত ভারতের ইতিহাস। একটা গোষ্ঠীকে আত্মস্থ করে নেওয়া, গাঁওদেবতা বা বহুর্বাণের পুজো না দিয়ে শিবের উপাসনা হবে না, দুর্গার আগে কলাবউ-এর পুজো, পেঁয়াজের খোসার মত পরতের পর পরত গল্প, খোসা ছাড়ালে আরেকটা খোসা, ছাড়াতে ছাড়াতে ভেতরে গিয়ে কিছু নেই, ঐ খোসা, স্তর, পরতেই তুমি যা খুঁজছ তা হয়ত আছে। এভাবেই প্রস্তরযুগের শিলনোড়া এখনও মাইক্রোওয়েভ ওভেনের পাশে স্থান পায়, লিখিত-প্রচারিত ইতিহাসের পাশেই বয়ে চলে লোককথা, গাথা।
যারা আজ থেকে বছর দশেক আগেও হরিদ্বার গেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন জায়গাটার নাম লেখা থাকত হরদ্বার, লোকে বলতোও হরদোয়ার। ১৯৭৪ সালে প্রথমবার গিয়ে বাবাকে এই তফাতের কারণ জিজ্ঞাসা করাতে বাবা বলেছিলেন এটা হরদ্বারই, হর অর্থাৎ শিব; পঞ্চকেদারে যাওয়ার রাস্তা এখান থেকেই শুরু, তাই হর-দ্বার, আমরা বাঙালিরা ভুল করে হরিদ্বার বলি। ২০১৫-তে দেখলাম সব হরিদ্বার (হরি=বিষ্ণু) হয়ে গেছে। স্টেশনের নাম, সাইনবোর্ড, লোকের কথা সব। তাহলে কি শৈবপ্রধান সংস্কৃতি বিষ্ণুপ্রধান সংস্কৃতির রূপ নিচ্ছে? হরি বা বিষ্ণুর ধাম বদ্রিনাথ। বিষ্ণুর উপাসক, পৃষ্ঠপোষক বানিয়া গোষ্ঠীর প্রভাবেই কি এই পরিবর্তন। খুঁজতে খুঁজতে পেঁয়াজের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে জানলাম দুটো নামই চালু ছিল – বিষ্ণুর উপাসকরা হরিদ্বার, শৈবরা হরদ্বার, স্থানীয়দের মধ্যে হরদ্বারই চালু ছিল। হর কি পৌড়ী, মূল গঙ্গার ওপারে কনখল, যেখানে দক্ষের মহাযজ্ঞ, সতীর দেহত্যাগ, শিবের তাণ্ডবনৃত্যের শুরু, পঞ্চকেদার সব মিলিয়ে শিবই প্রধান ছিলেন। খেয়াল করলাম গীতায় কৃষ্ণ (হরি বা বিষ্ণুর অবতার) এত করে বোঝালেন অর্জুনকে, আত্মীয়হত্যায় পাপ নেই, সবই পূর্বনির্দিষ্ট, মায়া, তুমি উপলক্ষ; যুদ্ধ হল। ছলনা, কপটতা, আত্মীয়হত্যায় বিষণ্ণ অবসন্ন পাণ্ডবরা কিন্তু ক্ষমাপ্রার্থনায় শিবের শরণ নিলেন। শিব ভীষণ ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ পাণ্ডবদের ওপর, কিছুতেই দেখা দেবেন না পাপীদেরকে, রূপ নিলেন নিজের বাহন ষণ্ডের, তারপর মাটিতে প্রবেশ, পাঁচ কি ছয় জায়গায় তার দেহের অংশবিশেষ-এর প্রকাশ, সেখানে পাণ্ডবদের মন্দিরস্থাপন আর তার সাথে বহুর্বাণদের জড়িয়ে নেওয়া। কৃষ্ণর (হরি) প্রভাবে নির্লিপ্ত আত্মীয়হত্যায় ‘কেন্দ্র’দখলের পর শিবের (হর) হাত ধরে স্থানীয় বিস্তার?
শক্তি ছাড়া শিব হয় না, অন্তত শৈবরা তাই বলেন। হরিদ্বারে তিনটি শক্তিমন্দির আছে, চণ্ডী, মনসা, মায়া। এই মায়া সতীর একটি পীঠ, এতটাই প্রসিদ্ধ ছিল যে, ‘মায়াপুরী’ ছিল প্রাচীন হরদ্বার বা হরিদ্বারের নাম। কই যাওয়া হয়নি তো সেখানে, যেতে হবে, আমার বা আপনার জন্য নতুন কিছু গল্প হয়তো সেখানে অপেক্ষা করে আছে!
2 thoughts on “হরদ্বার কিংবা/এবং হরিদ্বার ও মদমহেশ্বরের গল্প”